Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

লস্ট ভয়েস গাই: একজন বোবা কৌতুকাভিনেতার সাফল্যের গল্প!

একটা দৃশ্য কল্পনা করা যাক। কৌতুক শুনে মঞ্চে উপচে পড়া দর্শক অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। আর প্রতিটি কৌতুকের পর হল রুম জুড়ে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে অজস্র করতালি। কিন্তু যিনি কৌতুক করছেন তিনি নিজেই কথা বলতে পারেন না। অর্থাৎ একজন বাকপ্রতিবন্ধী মঞ্চের দখল নিয়ে, দারুণ সব কৌতুকের রসে বিমোহিত করে রেখেছে গ্যালারি ভর্তি দর্শকদের।

Lost-Voice-Guy-BGT
গ্যালারি ভর্তি দর্শক এবং বিচারকদের সামনে ব্রিটেন গট ট্যালেন্টস এর মঞ্চে বাকপ্রতিবন্ধী কৌতুকাভিনেতা লী রাইডলি; Source: Inspiremore.com

প্রিয় পাঠক, দৃশ্যটি কল্পনা করতে কষ্ট হতে পারে। আর যদি বলি, কল্পনায় নয়, সত্যি সত্যিই এই কাজটি কেউ করে যাচ্ছেন, তাহলে হয়ত বিশ্বাস করতেও কষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু অবিশ্বাস্য হলেও সত্য; কল্পনাকেও হার মানিয়েছেন ‘লস্ট ভয়েস গাই’ নামক একজন বাকপ্রতিবন্ধী কৌতুকাভিনেতা। এটি মূলত তার ছদ্মনাম, যে নামে নিজেকে একজন কৌতুকাভিনেতা হিসেবে বিশ্বব্যাপী পরিচিত হয়েছেন। গ্রেট ব্রিটেনের বাসিন্দা এই কৌতুকাভিনেতার আসল নাম লী রাইডলি। জন্মের ৬ মাস পর থেকে বাকপ্রতিবন্ধী হয়েও শুধুমাত্র নিজস্ব একাগ্রতা এবং বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়ে আইপ্যাডের একটি টেক্সট টু ভয়েস কম্পোজার অ্যাপের সাহায্য নিয়েই জিতেছেন যুক্তরাজ্যের সবচাইতে জনপ্রিয় ট্যালেন্ট হান্ট রিয়েলিটি শো ব্রিটেইন গট ট্যালেন্টস এর শিরোপা। এর পাশাপাশি প্রতিনিয়ত কমেডি শো করছেন। আমন্ত্রণ পাচ্ছেন নানা লাইভ শো থেকে। এমনকি রেডিওর সিটকমও করছেন এই কৌতুকাভিনেতা।

lost voice guy childhood
সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত শিশু লী রাইডলি; Source: Instragram

রাইডলি মাত্র ছয় মাস বয়সে সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হয়েছিলেন। এর ফলে কথা বলার ক্ষমতা হারান তিনি। এবং তার দেহের ডান অংশ বাম অংশ থেকে দুর্বল। এই প্রতিবন্ধকতার সাথে কৈশোরে যোগ হয় মৃগীরোগ। মস্তিষ্কে ইনফেকশন নিয়ে দুই সপ্তাহের কোমায় চলে যাওয়া লীর পরিবারও কখনো কল্পনা করতে পারেনি তার পক্ষে বেঁচে থাকা সম্ভব। তার ৯১ বছর বয়সী দাদী এথেল ফস্টার ব্রিটিশ পত্রিকা দ্য সানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন,

“ডাক্তাররা তো ওর বাঁচার সম্ভাবনা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তারপরও সে বেঁচে গিয়েছে এবং ওর বাবা-মাকে দিন-রাত ওর পাশে থাকতে হতো দেখাশোনা করার জন্য। সেই সময়টা খুবই খারাপ ছিল”

lee's grandmother
লী রাইডলির অন্যতম ভক্ত তার ৯১ বছর বয়সী দাদী এথেল ফস্টার; Source: Dailymail

বাকহীন থাকার কারণে ছোটবেলায় লীর তেমন কোনো বন্ধু ছিল না। স্বাভাবিক আর দশটা শিশুর মতো স্বাভাবিক স্কুলে যেতে পারেননি। তিনি পড়াশোনা করেছিলেন প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ স্কুলে। আর একে তিনি হতাশার মতো না দেখে আশীর্বাদ হিসেবে দেখেছেন। সানকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন,

“আমি প্রতিবন্ধীদের স্কুলে পড়াশোনা করেছি। সেখানে আমি শিক্ষকদের কাছ থেকে যথেষ্ট সহায়তা পেয়েছি। কিন্তু স্বাভাবিক বাচ্চারা তাদের স্কুলে বর্তমান সময়ে শিক্ষকদের কাছ থেকে যথেষ্ট সহযোগিতা পাচ্ছে না। এটি বরং তাদের জন্যই খারাপ একটি লক্ষণ।”

স্বাভাবিক আট-দশটা শিশুদের মতো অগণিত বন্ধু না থাকলেও লীর দুই-একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। কৌতুকাভিনেতা হবার পেছনে এবং এক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনের জন্য সেসব বন্ধুর অবদান আছে বলেও তিনি স্বীকার করেন। তাঁর ভাষ্যমতে,

আমার জীবনের সাফল্যে আমার বন্ধুদের অবদান অপরিসীম, তাদের সহযোগিতা ছাড়া আমি এত দূর আসতেই পারতাম না। কখনো কৌতুকাভিনেতা হিসেবে নাম কুড়াবো এই কথা কল্পনাও করিনি। যদিও আমার কৌতুক শুনতে ভালো লাগতো এবং ভাবতাম, যদি কথা বলতে পারতাম, তাহলে আমিও হয়ত দু-চারটা কৌতুক বলে মানুষকে আনন্দ দিতে পারতাম। আমার বন্ধুদের উৎসাহেই আমি প্রথম কৌতুকবাজি করার পদক্ষেপ নিয়েছিলাম।

lost voice guy's friend_Hayley_Fishe
ইউনিভার্সিটিতে বন্ধুর সাথে লী রাইডলি; Source: Dailymail UK

তবে তাঁর কৌতুকাভিনেতা হয়ে ওঠার প্রধান অস্ত্র হচ্ছে দুটি আইওএস অ্যাপ। প্রলকটুগো (Proloquo2Go) এবং প্রলকফর টেক্সট (Proloquo4Text) নামক অ্যাপ দুটির সন্ধান পান তিনি। এই অ্যাপ বিভিন্ন সংকেত এবং প্রতীক ও লেখাকে শব্দে রূপান্তর করতে পারে। যারা কথা বলতে পারেন না বা বাকপ্রতিবন্ধী, তাদের সাহায্যার্থেই এই অ্যাপ তৈরি করা হয়েছিল। এই অ্যাপকে বলা হয় এএসি (AAC) অ্যাপ বা অগমেন্টিভ অ্যান্ড অলটারনেটিভ কমিউনিকেশন অ্যাপ। এই অ্যাপ তৈরি হবার পূর্বে বাকপ্রতিবন্ধীদেরকে সাইন ল্যাংগুয়েজ ব্যবহার করে যোগাযোগ রক্ষা করতো। এছাড়া লেখা বা প্রতীককে শব্দে রূপ দেয়ার জন্য যেসব ডিভাইস বা অ্যাপ ছিল সেগুলোর দামও ছিল অনেক বেশি, প্রায় ৩০০০ ডলার। অন্যদিকে প্রলকটুগো এবং প্রলকফরটেক্সট অ্যাপ দুটির দাম যথাক্রমে ২৫০ এবং ১২০ ডলার। বর্তমানে প্রায় ১ লক্ষ ৭০ হাজার বাকপ্রতিবন্ধী এই অ্যাপ ব্যবহার করে কথা বলা এবং যোগাযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।

লী তাঁর হাস্যরসাত্মক কৌতুক এই অ্যাপের মাধ্যমে রেকর্ড করে রাখেন এবং একটি ভয়েস সিন্থেসাইজারের মাধ্যমের সেই রেকর্ড করা কৌতুক জনসম্মুখে উপস্থাপন করেন। কৌতুকাভিনয়ের পাশাপাশি দৈনন্দিন জীবনযাপনে যোগাযোগের জন্যও তিনি এই অ্যাপ দুটি ব্যবহার করে থাকেন।

proloquo iso app
প্রলকটুগো অ্যাপের ইন্টারফেস। Source: The Sun

তাঁর সাফল্যের পেছনে যেমন পরিবার, বন্ধু এবং শিক্ষকদের সহযোগিতা ছিল, তেমনি তাঁকে অনেক বাঁধা-বিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে এত দূর আসতে হয়েছে। ব্রিটেন গট ট্যালেন্ট নামক রিয়েলিটি শো’র ইতিহাসে এই প্রথম কোনো বাকপ্রতিবন্ধী শিরোপা জিতলো। আর এই রিয়েলিটি শোর প্রাইজ মানি হিসেবে তিনি পেয়েছেন ২ লক্ষ ৫০ হাজার ডলার বা প্রায় দুই কোটি টাকা। এই টাকা দিয়ে তিনি কী করবেন জিজ্ঞেস করা হলে লী কৌতুক করেই জবাব দেন,

সবার প্রথমে আমি আমার এই ভয়েস সিন্থেসাইজারের এক্সেন্ট চেঞ্জ করে জর্ডি এক্সেন্ট কিনে ফেলবো। বর্তমান ভয়েসটা একটা ফিটফাট রোবোকপের মতো শোনায়! রোবোকপের ভয়েস একজন কমেডিয়ানের সাথে ঠিক যায় না!

ব্রিটেন গট ট্যালেন্টের শিরোপা জয়ের মধ্যে থেমে থাকেননি লী। বিবিসির নিয়মিত সিটকমেও তিনি কৌতুক উপস্থাপন করেন। বিবিসি রেডিও টাইমসের সবচাইতে সম্মানজনক ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান রেডিও ফর কমেডি অ্যাবিলিটিতে তিনি টানা দুই সপ্তাহের একটি কমেডি শো করার সুযোগ পান। তারপর থেকে তিনি নিয়মিত সেখানে পারফর্ম করেন। এই শোতে তিনি এমন একটি চরিত্রে অভিনয় করেন, যার কি না সেরেব্রাল পালসিতে আক্রান্ত হয়ে বাকশক্তি হারিয়ে গেছে।

ability_marketing lost voice guy poster
বিবিসি রেডিও ৪ এর অ্যাবিলিটি শোর মার্কেটিং কন্টেন্টে লী রাইডলি ওরফে লস্ট ভয়েস গাই; Source: comedy.co.uk

তাঁর শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে পুঁজি করে তিনি নতুন নতুন কৌতুকের জন্ম দিয়ে থাকে। প্রচণ্ড ইচ্ছাশক্তি ও অদম্য আত্মবিশ্বাস তাকে আজ এই অবস্থায় নিয়ে এসেছে। এমনকি ব্রিটেন গট ট্যালেন্ট শোর সেমিফাইনালে জয়লাভের পর তিনি একটি পানশালায় পড়ে গিয়ে ফাইনালের আগের দিন আহত হয়েছিলেন। নাক ফেটে গিয়েছিল তার। তবুও ফাইনালে অংশ নিয়ে তিনি জয়লাভ করেছিলেন। এটি নিয়েও কৌতুক করতে ছাড়েননি তিনি। নিজের অক্ষমতা নিয়ে প্রতিনিয়ত হাসিয়ে যাচ্ছেন তিনি। কৌতুক করেই বলেছিলেন,

সেমিফাইনালের আগে আমি ছিলাম শুধুমাত্র লস্ট ভয়েস গাই, সেমিফাইনাল জয়ের আনন্দ উদযাপন করে মাতাল হয়ে পড়ে গিয়ে আমি হয়ে গেলাম লস্ট ব্যালেন্স গাই।

লস্ট ভয়েস গাইয়ের কিছু কৌতুক

নিজের অক্ষমতা নিয়ে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন কৌতুকের জন্ম দেন লী রাইডলি। তার কথা বলার অক্ষমতা ও জনপ্রিয়তা প্রসঙ্গে তিনি কৌতুক করে বলেন,

আমার অক্ষমতা আমার জনপ্রিয়তার চাইতেও পুরোনো।

ব্রিটেন গট ট্যালেন্টে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, আপনি কতদিন যাবত কথা বলতে পারেন না?

তিনি সেখানেও কৌতুক করে বলেন,

আমি ৩৭ বছর ধরে কথা বলতে পারি না। আমি যখন প্রথম জানলাম, আমি আর কখনোই কথা বলতে পারবো না, আমি আসলেই সেদিন নির্বাক ছিলাম!

প্রতিবন্ধীদের নিয়ে তিনি কৌতুকের মাধ্যমে জানান তাদের সক্ষমতা।

প্রতিবন্ধীদের জন্য সব সময় আলাদা ব্যবস্থা। যেমন- স্পেশাল স্কুল, স্পেশাল বাস, স্পেশাল হাসপাতাল। আমি ঠিক বুঝতে পারি না, আমার মতো প্রতিবন্ধীদের মধ্যে এমন স্পেশাল কী আছে! তাই যখন বলা হয়, একদল স্পেশাল ফোর্স যুদ্ধে যাচ্ছে, আমি তখন তাদের যুদ্ধ নিয়ে একটু দ্বিধায় পড়ে যাই!

ব্রিটেনস গট ট্যালেন্ট রিয়েলিটি শোর অডিশনে লস্ট ভয়েস গাই

ব্রিটেনস গট ট্যালেন্ট রিয়েলিটি শোর সেমিফাইনালে লস্ট ভয়েস গাইয়ের পারফর্মেন্স

ব্রিটেনস গট ট্যালেন্ট রিয়েলিটি শোর ফাইনালে লস্ট ভয়েস গাইয়ের পারফর্মেন্স

Related Articles