Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

সুখেন্দু চাকমা: রংতুলিতে সুখ-দুঃখের গল্প আঁকা ছেলেটি

পৃথিবীতে বিভিন্ন মানুষ বিভিন্নভাবে সৃষ্টিশীল। কেউ লেখালেখি করে, কেউ গান-বাজনা করে আবার কেউ করে আঁকাআঁকি। সৃষ্টিশীলতা মননের একটি অংশ, এর জন্য হয়তো কোনো প্রতিষ্ঠানের তেমন প্রয়োজন নেই। আজ তেমনই একজনের কথা বলবো, যার তেমন কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও পুরোদস্তুর একজন চিত্রশিল্পী হতে পেরেছে।

পরিবারের সবার সাথে বাবা-মায়ের মাঝে সুখেন্দু চাকমা © সুখেন্দু চাকমা

হ্রদ, ঝর্ণা, উঁচু-নিচু সবুজ পাহাড়, গভীর বনাঞ্চল, আঁকাবাঁকা পাহাড়ী পথ, ছড়াসহ নানাবিধ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা। এই জেলার ঘাগড়া ইউনিয়ন পরিষদের ছোট্ট একটি গ্রাম জুনুমা ছড়া। সেই পাহাড়বেষ্টিত গ্রামের একটি আদিবাসী পরিবারে ১৯৯১ সালের ১০ মার্চ বিমল কান্তি চাকমা ও বিদ্যা রানী চাকমার কোল আলোকিত করে জন্মগ্রহণ করে তাদের প্রথম সন্তান। পরিবার থেকে নাম রাখা হয় সুখেন্দু চাকমা।

চাকমা গ্রাম © সুখেন্দু চাকমা

পাহাড়ি পরিবেশে বেড়ে ওঠা সুখেন্দুকে বাবা-মা গ্রামের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল। অত্যন্ত মেধাবী ছেলেটি যে পরিবেশে বেড়ে ওঠে সেখানে তখনও আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া ছিল না। টেলিভিশনের পর্দায় বাংলাদেশ টেলিভিশনই ছিল একমাত্র ভরসা। প্রতি শুক্রবার টেলিভিশনে বাংলা সিনেমা দেখার আলাদা একটা নেশা কাজ করতো তার মাথায়। আর সবার মতোই ছোটবেলায় সিনেমার কাহিনী যেমনই হোক মারামারির দৃশ্যগুলো ভাল লাগত সুখেন্দুর। সিনেমায় মারামারির দৃশ্যের প্রিয় চরিত্রের জয় হওয়ার ঘটনাটি তার মনকে আন্দেলিত করে তুলতো। আর তাই হয়তো পড়াশোনার ফাঁকে ফাঁকে সেসব দৃশ্য সাদা কাগজের উপর কলম আর পেন্সিলের দ্বারা আঁকিবুঁকি করতো ছেলেটি। ছবি আঁকার সূচনা হয়েছিল এভাবেই।

কার প্রিয়মুখ? © সুখেন্দু চাকমা

যখন সুখেন্দু চতুর্থ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছিল তখন বাবা বিমল কান্তি চাকমা একদিন ছেলের ছবি আঁকার আগ্রহ ও অংকন কৌশল দেখে মুগ্ধ হন। তিনি সন্তানকে চিত্রাঙ্কন বিদ্যায় পারদর্শী করতে উদয়ন চাকমা নামের এক শিক্ষকের কাছে পাঠান। সেখানে মাত্র এক থেকে দেড় বছর ছবি আঁকা শেখার সুযোগ হয়েছিল। চিত্রাঙ্কনের ক্ষেত্রে উদয়ন চাকমাই ছিলেন প্রথম শিক্ষক। তিনি সুখেন্দুর ছবি আঁকায় মুগ্ধ হয়ে ভবিষ্যতে সে বড় কিছু করবে এই স্বপ্ন দেখতেন। গ্রামের স্কুলে সপ্তম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করার পর অষ্টম শ্রেণী থেকে ঢাকার বনফুল আদিবাসী গ্রিনহার্ট কলেজে পড়াশোনার জন্য ভর্তি হয়েছিল সুখেন্দু। সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত আহসান হাবীব নামক এক শিক্ষকের সান্নিধ্যে আবারও চিত্রাঙ্কন শেখার সুযোগ হয়েছিল। অপরদিকে স্কুল জীবনে শেখা অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে নিজস্ব চিন্তা-ভাবনাকে ব্যবহার করে অসম্ভব সুন্দর সুন্দর সব ছবি এঁকে সবাইকে মুগ্ধ করছে তরুণ বয়সে পা রাখা সুখেন্দু।

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য © সুখেন্দু চাকমা

অত্যন্ত মেধাবী সুখেন্দু স্কুল-কলেজের গণ্ডী পেরিয়ে ফুড সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি বিষয়ে তার স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের জন্য চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সায়েন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়। সেখানে পরিচয় ঘটেছিল ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা উপাচার্য প্রফেসর ড. নীতিশ চন্দ্র দেবনাথের সাথে। উপাচার্য পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিলেও বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সভা-সেমিনারে অংশ নিতে আসেন। তাকে একটি অসাধারণ ছবি এঁকে উপহার দেন সুখেন্দু চাকমা। সুখেন্দুর অঙ্কিত সেই ছবি হয়তো এখনও সযত্নে সাবেক উপাচার্যের বাসার দেয়ালে কিংবা ফটো অ্যালবামে শোভা পাচ্ছে।

কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন শাইখ সিরাজ © সুখেন্দু চাকমা

চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষের নবীন বরণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জনপ্রিয় সাংবাদিক, কৃষি উন্নয়ন ও গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব শাইখ সিরাজ। গ্রামীণ জীবনের কৃষি নিয়ে গণজাগরণ ‍সৃষ্টির লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছেন যিনি, তাকে কাছ থেকে দেখতে পেয়ে একটি ছবি অংকন করে উপহার দেয়ার বাসনা জাগ্রত হয় সুখেন্দুর মনে। অবশেষে মনের আল্পনা ও রং তুলির আঁচড়ে শাইখ সিরাজের চিরাচরিত রূপটি অংকন করে ফেলেছিল সেদিন। ছবিতেও দেখা যায় শাইখ সিরাজ গ্রামীণ কয়েকজন কৃষকের সাথে আলাপচারিতায় ব্যস্ত রয়েছেন। এই ছবিটি ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য গৌতম বুদ্ধ দাশের দ্বারা শাইখ সিরাজের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল। ছবিটি দেখার পর তিনি মুগ্ধ হয়ে ভূয়সী প্রশংসা করেছিলেন সুখেন্দুর।

ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালে গেলে এই ছবি দেখে মনে পড়বে সুখেন্দুর কথা © সুখেন্দু চাকমা

অসাধারণ চিত্রাঙ্কনে পারদর্শী সুখেন্দুর কাছে অনেকেই প্রিয়জন, বাবা-মা, দূর-দূরান্তে ফেলে আসা কোনো প্রিয় মুখের ছবি অংকন করে নিয়ে থাকেন। সুখেন্দু হাসিমুখেই সকলের আবদার পূরণ করে থাকে। এভাবেই এক শিক্ষকের পৃষ্ঠপোষকতায় পোষা কুকুর কোলে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এক প্রাণী চিকিৎসকের ছবি এঁকে দেয় সে। বর্তমানে ছবিটি ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী হাসপাতালে প্রবেশ করামাত্রই চোখে পড়ে।

মনে হচ্ছে যেন ক্যামেরায় তোলা ছবি © সুখেন্দু চাকমা

সুখেন্দুর ছবি শুধু দেশেরই বিভিন্ন স্থানে শোভা পাচ্ছে এমন নয়। ২০১৩ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার নামকরা প্রাণী চিকিৎসক গংহিউং কিম চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয় সফরে আসলে তাকেও তারই অবিকল একটি ছবি উপহার দেয়ার সুযোগ হয়েছিল সুখেন্দুর।

সুখেন্দু চাকমা শুধু তার ক্যাম্পাস জীবনেরই ছবি অঙ্কন করেনি। আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা, পারিবারিক ও সমাজ জীবনের সুখ-দুঃখ, পাওয়া না পাওয়ার চিরাচরিত নিয়মগুলোকেও তার হাতের ছোঁয়ায় সুন্দর করে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে।

মায়ের ভালবাসা © সুখেন্দু চাকমা

মায়ের ভালবাসার তুলনা নেই। মানব সমাজের মা আর প্রাণীজগতের মা- দুয়ের মাঝে পার্থক্য করা কিন্তু খুবই মুশকিল। সুখেন্দু সেই দৃশ্যও তার ছবিতে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে তুলতে সক্ষম হয়েছে। ছবিতে মানবসন্তানকে যেমন মা বুকে আগলে রাখে, তেমনই মা পাখিকেও তার বাচ্চার জন্য খাবার সংগ্রহ করে খাওয়াতে দেখা যায়।

বাবার কাছে পরম নির্ভরতায় ঘুমাচ্ছে সন্তান © সুখেন্দু চাকমা

বাবা-মা সন্তানকে অনেক আদর-যত্নে বড় করে তোলেন। একটি সন্তানকে বড় করে তুলতে যেমন মায়ের ভূমিকা রয়েছে তেমনই রয়েছে বাবারও ভূমিকা। তাই বাবা কিভাবে সন্তানকে ঘুম পাড়ান তেমনই একটি ছবি অঙ্কনের প্রয়াস পেয়েছে সে।

দারিদ্র্যের কারণে সন্তানরা যখন বাবাকে ছেড়ে যায়, সেই নির্বাক বাবার চাহনী © সুখেন্দু চাকমা

বাবা-মায়ের আদরে গড়া সন্তানটি হয়তো নানা কারণে, বিশেষত দারিদ্র্যের কারণে, একদিন বৃদ্ধ বাবা-মাকে ফেলে চলে যায়। সেই সময় বৃদ্ধ বাবার কঙ্কালসার অবয়ব ও দৃষ্টি কাকে যেন খুঁজে ফেরে! এমনই একটি ছবি অঙ্কন করেছিল ২০১৩ সালে।

ছোট পরিবার, সুখী পরিবার প্রত্যাশা করতেই পারেন যে কেউই © সুখেন্দু চাকমা

ছোট পরিবার, সুখী পরিবার। হয়তো এমন পরিবারে বাবা-মা আজীবন সুখী হবে। বর্তমানে একটি বা দুটি পর্যন্ত সন্তানের ছোট পরিবার প্রায় সকলেরই কাম্য। তেমনই একটি সুখী পরিবারকে তুলে ধরেছে সুখের প্রত্যাশায়।

বামে চারকোল দিয়ে আঁকা অধরা সুখের প্রত্যাশায় ভাবনাচ্ছন্ন বালক ও ডানে সুখ প্রত্যাশায় সুখ পাখিকে উড়িয়ে দেয়া এক চাকমা নারী © সুখেন্দু চাকমা

সুখ ও ভবিষ্যত- এ দুয়ের প্রত্যাশায় আমাদের প্রায় সমগ্র জীবনই কেটে যায়। এক চাকমা বালক কোনো কিছুর প্রত্যাশায় আনমনে, চিন্তাশীল বদনে বসে প্রতিনিয়ত দিনাতিপাত করছে। হয়তো তার প্রত্যাশা সর্বদা অধরাই থেকে যাচ্ছে। অনিশ্চিত ভবিষ্যত, জানা যায় না নিয়তি কী লিখে রেখেছে কপালে। তবুও মানুষের মুখ্য চাওয়া সুখের জন্য সুখ পাখিকে নীল আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে কোনো এক রমণী। আচ্ছা, সুখ পাখি ওড়ালেই কি সুখ আসে জীবনে? এমন বাস্তব গল্প প্রতিনিয়ত সুখেন্দু তার তুলির আঁচড়ে রচনা করে যাচ্ছে।

স্বার্থপর © সুখেন্দু চাকমা

স্বার্থপর মানুষ সর্বদা পথিমধ্যে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। তারা অপরের উন্নতি ও সুখ সহ্য করতে পারে না। এমন সব স্বার্থপর মানুষদের পরিচয় করে দিতে ‘স্বার্থপর’ নামের একটি ছবি অংকন করে ২০১৪ সালে। ছবিতে স্বার্থপর বলতে মূলত পথের মধ্যে বাধা হয়ে দাঁড়ানো লাল-গাঢ় নীল রঙের ত্রিভুজটিকে বুঝানো হয়েছে। এটি নিজেও পার হচ্ছে না, আবার বাকিদেরও যেতে দিচ্ছে না। এখানে এই ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত ও রেখা দ্বারা বিভিন্ন মানুষের বিভিন্ন বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশ পেয়েছে। বৃত্ত বলতে বোকা মানুষদের, ত্রিভুজ দ্বারা তিনমুখো মানুষ, রেখা দ্বারা সহজ-সরল মানুষদের ইঙ্গিত করা হয়েছে। আর চতুর্ভুজ দ্বারা চতুর্মুখী তথা চতুর লোকদের বুঝানো হয়েছে। আর তাই তো এরা বাকিদের মতো এক জায়গায় ভিড় না করে অন্য আরেক দিকে পথ বের করার চেষ্টা করছে।

চাকমা আদিবাসীদের জীবিকার সন্ধান ও তা শেষ করে বাড়ি ফেরা (মাঝের ছবিটি চিত্রশিল্পী তিতাস চাকমার আঁকার পুনঃসংস্করণ) © সুখেন্দু চাকমা

বাঁধাবিঘ্ন যতই আসুক, সুখ পাখিরাও সুখগুলো নিজেদের মাঝেই রাখুক। তথাপিও ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য, জীবিকার জন্য পাহাড়ি আদিবাসীরা নানারকম কাজকর্ম করে থাকেন। সারাদিন জুম চাষ করে স্বামী-স্ত্রীর বাড়ি ফেরা, নদীতে মাছ ধরার দৃশ্য, পৃথিবী থেকে হানাহানি দূর হোক সেই স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা কিছু উল্লেখযোগ্য ছবিরও দেখা মেলে সুখেন্দুর কাছে।

রংতুলির নেশায় পেয়ে বসলেও সুখেন্দুরা হয়তো একদিন হারিয়ে যাবে এই স্বার্থপর পৃথিবী থেকে। বাস্তব জগত যে বড়ই কঠিন তা ইতিমধ্যেই বুঝতে শিখেছে তরুণ এই চিত্রশিল্পী। পরিবারের বড় সন্তান হিসেবে সংসারের অনেক দায়িত্ববোধ তার কাঁধে এসে ভিড় করছে। তাই আজকাল হয়তো নিজেকে আড়াল করে রাখতেই ভালবাসে ছেলেটি। বর্তমানে ঢাকার মিরপুরে একটি ড্রয়িং স্কুলে শিক্ষকতা করছে সুখেন্দু, কাজ করছে ফ্রিল্যান্স আর্টিস্ট হিসেবেও।

তবে সে স্বপ্ন দেখে, একদিন তার নিজস্ব একটি আর্ট স্কুল হবে। স্বপ্ন দেখে একদিন বিখ্যাত সব চিত্রশিল্পীর নামের সাথে তার নামও থাকবে। সেদিন বাংলাদেশ গর্বের সাথে বলবে, “সুখেন্দু আমারই সন্তান“।

ফিচার ইমেজ – শাইখ সিরাজ © সুখেন্দু চাকমা

Related Articles