Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ধর্ষণ নিয়ে মোদীর বিরুদ্ধে লন্ডনে প্রতিবাদ; কিন্তু পশ্চিমা দুনিয়া কি আসলেই চিন্তিত?

চার বছর আগে তিনি যখন দিল্লির মসনদে আসীন হয়ে বিশ্বের নানা দেশে পা রাখতেন, প্রবাসী ভারতীয় এবং তার সমর্থক-অনুরাগীদের মধ্যে উদ্দীপনা থাকত চোখে পড়ার মতো। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার প্রত্যেকটি বিদেশ সফরে একজন প্রকৃত রাষ্ট্রনায়কের মতো দেশের প্রতিনিধিত্ব করতেন। রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিসরে এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলা হচ্ছিল যে, বহুদিন পরে ভারত একজন যোগ্য নেতা পেয়েছে; এবার আন্তর্জাতিক  মহলে ভারতের গুরুত্ব-প্রভাববৃদ্ধি আটকায় কে?

সম্প্রতি মোদী যখন লন্ডনে পা রাখলেন যুক্তরাজ্যের রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠক করা ছাড়াও কমনওয়েলথ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে, তখন সেই চিরাচরিত চিত্রটি কিন্তু দেখা গেল না। উল্টো দেখা গেল, মোদীর বিরুদ্ধে পথে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ; ‘মোদী গো ব্যাক’ ধ্বনি।

কারণ? সম্প্রতি ভারতের মাটিতে ঘটে যাওয়া দুটি ভয়ঙ্কর ধর্ষণের ঘটনা, যা নাড়িয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে। এর মধ্যে একটিতে বর্বর ধর্ষণ ও খুনের শিকার হয় জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশের কাঠুয়া এলাকার আসিফা নামের একটি আট বছরের শিশুকন্যা।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর লন্ডন সফরের সময়ে সেখানকার রাস্তায় বিক্ষোভকারীদের প্রদর্শন; Source: Twitter @iScrew

অন্যটি ঘটে উত্তরপ্রদেশের উন্নাও এলাকায়, যেখানে এক ভারতীয় জনতা পার্টির বিধায়কের বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে এক ষোড়শী কন্যাকে ধর্ষণ করার এবং এক্ষেত্রে মেয়েটি বেঁচে গেলেও নিস্তার পায় না তার পিতা। ধর্ষণের অভিযোগকে কেন্দ্র করে ওই বিধায়কের সমর্থকদের সঙ্গে মেয়েটির বাবার হাতাহাতির পরে তাকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু মারামারির ফলে তিনি আহত থাকার কারণে তাকে জেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে, সেখানেই তার রহস্যজনকভাবে মৃত্যু ঘটে।

এই দুটি ন্যাক্কারজনক ঘটনার পাশাপাশি ভারতে সাধারণভাবে নারীবিদ্বেষ বাড়ার প্রবণতা এবং এ ব্যাপারে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ কঠোর পদক্ষেপ না নেওয়ার ফলেই লন্ডনে তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ আরও জোরদার হয়। লন্ডনের পার্লামেন্ট স্কয়ারে ভারতের তেরঙ্গা জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে দেওয়ারও ঘটনা ঘটে, যার জন্য ব্রিটেনের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে দুঃখপ্রকাশও করা হয়।

নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে ব্রিটেনে বসবাসকারী তামিল সম্প্রদায়ের বিক্ষোভ প্রদর্শন; Source: Twitter @imanojprabhakar

সোচ্চার হয় ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যমও

ব্রিটেনের সংবাদমাধ্যমও মোদীর বিরুদ্ধে এই প্রতিবাদ হালকাভাবে নেয়নি। দ্য গার্ডিয়ান পত্রিকা তো ভারতে ঘটে চলা নানাবিধ নির্যাতনের ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতকে ‘ভয়ের প্রজাতন্ত্র’ আখ্যাও দেয়; বলা হয়, ব্রিটেনের উচিত ভারতের উপরে এই বিষয়ে চাপ সৃষ্টি করা।

এখন প্রশ্নটা এখানেই। নীতিগতভাবে ভারতে ক্রমাগতভাবে ঘটে চলা পীড়ন-দমনের ঘটনাবলীর প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক মহলের একটি কঠোর অবস্থান নেওয়া জরুরি। মানবাধিকারের প্রশ্নে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ঘটনার উপরেও বহির্বিশ্বের মতামত থাকা দরকার, যাতে সেই দেশের শাসকশ্রেণী রাজধর্ম পালনে আরও মনোযোগী হয়।

কিন্তু, ভারতে মুসলমান-দলিত-নারী ইত্যাদি সংখ্যালঘিষ্ঠদের উপরে আক্রমণ হয়ে চললেও, ব্রিটেন সহ পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ শক্তিগুলো যে খুব একটা বিচলিত হবে না, তাতে সন্দেহ নেই। ভারত যতই ‘ভয়ের প্রজাতন্ত্র’ হয়ে থাকুক, তার অন্দরের সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাতে বিশেষ কাউকে দেখা যাবে বলে মনে হয় না।

পশ্চিমা দুনিয়া এখন মোদী সরকারকে চটাবে না

এর প্রধান কারণ হচ্ছে ভূ-অর্থনীতি। ব্রেক্সিট-এর মতো একটি সংবেদনশীল এবং অনিশ্চয়তা সৃষ্টিকারী রাজনৈতিক ঘটনার প্রাক্কালে ব্রিটেনের নিজের অবস্থাই বেশ গোলমেলে। ব্রিটেনের ‘বাঘের পিঠে সওয়ারি’ করতে থাকা রাজনৈতিক নেতৃত্ব খুব জাতীয়তাবাদী গর্ব দেখিয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) সংসারে ভাঙন ধরিয়ে বেরনোর পথ তৈরি করলেও, তারা জানে যে অদূর ভবিষ্যতে ব্রিটেনের অর্থনৈতিক স্বাস্থ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আর তখন যদি ব্রিটেনের কান্ডারীরা ইইউ-র বিকল্প হিসেবে কিছু খাড়া না করতে পারেন, তবে তাদের জাতীয়তাবাদ তেড়ে আসবে তাদেরই পানে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: Author: Balatokyo; Wikimedia Commons

ব্রিটেনের থেরেসা মের সরকার তাই এখন হন্যে হয়ে খুঁজছে নতুন বাণিজ্য সঙ্গী। আর সেখানেই কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর দিকে ব্রিটেনের বিশেষ নজর পড়েছে। এক্ষেত্রে ভারতের অর্থনীতি যেহেতু বিরাট সম্ভবনাময়, তাই মোদী সরকারের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে জোট বাঁধতে মরিয়া লন্ডন। মোদীকে যে এবার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ জামাই আদর দিয়ে বরণ করলেন লন্ডনে, তা কি আর এমনি এমনি?

একই কথা ইইউর ক্ষেত্রেও। ভারতের সঙ্গে ব্রিটেন যেমন দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যকে আরও মজবুত করে তোলার জন্যে আগ্রহী, তেমনই ইইউও আশাবাদী যে তাদের সংগঠন থেকে ব্রিটেনের বিদায়ের পর ভারতের সঙ্গে তারা মুক্ত বাণিজ্যিক সম্পর্ককে জোরদার করতে পারবে।

ভারতের মতো দ্রুত উন্নয়নশীল অর্থনীতির সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে লক্ষ্মীর কৃপা থেকে বঞ্চিত হতে চায় না কেউই। আর এই বাতাবরণে ইউরোপের কোনো পক্ষই নারীবিদ্বেষ বা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো বিষয়ে যে মোদী সরকারকে চটাবে না, তা বলাই বাহুল্য।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সঙ্গে লন্ডনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: Twitter handle of British Prime Minister Theresa May @theresa_may

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা যদিও ২০১৫ সালে তার ভারত সফরের সময়ে মোদী সরকারকে ধর্মীয় বিভাজন নিয়ে কিছু সাবধানবাণী শুনিয়েছিলেন, কিন্তু তার উত্তরপুরুষ ডোনাল্ড ট্রাম্প সেই পথের ধারও ধারেননি।

উল্টো আফগানিস্তান এবং চীন প্রশ্নে ওয়াশিংটনের কাছে ভারতের ভূ-কৌশলগত বিপুল গুরুত্বের কাহিনী শুনিয়েছেন ট্রাম্প বারংবার; এশিয়া-প্যাসিফিকের নাম বদলে করেছেন ইন্দো-প্যাসিফিক; পাকিস্তানকে চাপে রাখতে কাবুলে চেয়েছেন নয়াদিল্লির বৃহত্তর ভূমিকা। ট্রাম্প ভারতের বিরুদ্ধে যে কথা বলেননি তা নয়, কিন্তু তা ভিসা, বাণিজ্য এবং পরিবেশ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে, তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতির সঙ্গে সাযুজ্য রেখে।

চীনের তিয়েনআনমেন স্কয়ারের পর কতটা কী করেছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র?

আসলে, বর্তমান বিশ্ব রাজনীতিতে আদর্শের ভূমিকা অনেকটাই স্তিমিত। ঠাণ্ডা যুদ্ধের শেষের দিকে চীনের কুখ্যাত তিয়েনআনমেন স্কয়ার কাণ্ড ঘটার পরেও বেইজিংয়ের দমননীতির বিরুদ্ধে মার্কিন প্রক্রিয়া নিয়ে অসন্তোষ দেখা গিয়েছিল অনেক মহলেই। তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রপতি জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের ‘কিছু না করার নীতি’ নিন্দিত হয়েছিল খোদ মার্কিন কংগ্রেসেই। কারণ সেই একই। চীনের মতো উদীয়মান অর্থনৈতিক শক্তিকে বয়কট করা মানে নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থকে আঘাত করা।

১৯৮০’র দশকে যদি অর্থনৈতিক গুরুত্ব ততটা হতে পারে, তবে আজকের দুনিয়ায় তো কথাই নেই। ভূ-রাজনীতি বা ভূ-কৌশলনীতির থেকেও ভূ-অর্থনীতির গুরুত্ব আজ আরও বেশি। পশ্চিমের অর্থনীতিগুলি আজও দুনিয়াজুড়ে কর্তৃত্ব বজায় রাখলেও, ভারত এবং চীনের অর্থনৈতিক গুরুত্ব আজ বেড়েছে অনেকটাই। আর তাই তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে বেশি মাথা ঘামিয়ে নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেওয়া মানে যে মূর্খামি, সেটা তারা ভালোই বোঝে। অতএব, ‘থাকুক কাঠুয়া, উন্নাও। আগে নিজের স্বার্থ দ্যাখো।’

মোদীকে পশ্চিমের বয়কট করার নীতিও টেকেনি বেশিদিন

মোদীকে পশ্চিমা দুনিয়া ২০০২ সালের গুজরাট দাঙ্গার পরেও বয়কট করেছিল। কিন্তু যখন মোদীর উত্থানের চিত্র ক্রমেই পরিস্কার হচ্ছিল ভারতীয় রাজনীতিতে, তখন সেই পশ্চিমী রাষ্ট্রগুলোই মোদীকে গ্রহণ করতে শুরু করে। কারণ আর কিছুই না। এক তো তিনি বিশ্বের এক বড় অর্থনীতির প্রধান কাণ্ডারি হতে চলেছেন; আর দ্বিতীয়ত, গুজরাটের মতো উন্নত প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী থাকার দরুন মোদীর একটি সুখ্যাতি ছিল দক্ষ এবং উন্নয়ন-বান্ধব প্রশাসক হিসেবে। তাকে নৈতিক কারণে বেশিদিন দূরে সরিয়ে রাখা মানে ভারত এবং গুজরাটের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে হাতছাড়া করা। বিশ্ব অর্থনীতির ব্যাকরণ যখন ক্রমেই কঠিন হয়ে যাচ্ছে, তখন ভারত বা চীনের মতো সস্তা শ্রমের দেশগুলোকে কোনোমতেই দূরে সরিয়ে রাখতে পারে না আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের হোতারা।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প; Source: Author: Gage Skidmore; Wikimedia Commons

একটি বিষয় লক্ষ্যণীয়, মোদীর বিদেশ সফরে তার সরকারের ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ নিয়ে যতটা না কথা হয়, তার সিকিভাগও হয় না ভারতে সংখ্যাগরিষ্ঠদের দমন নিয়ে। মোদী বাইরে গিয়ে ভারতের দ্রুত উন্নয়নের কথা গর্বভরে বললেও তাকে অস্বস্তিকর কোনো প্রশ্নের সম্মুখীন সেভাবে হতে হয় না। কোনো ভারতীয় শীর্ষ নেতাকেই হতে হয় না কারণ, এদেশের বিপুল অর্থনৈতিক সম্ভাবনা। এই রক্ষাকবচ তাদের দিকে ধেয়ে আসা যাবতীয় আক্রমণকে ঠেকিয়ে দিচ্ছে আপাতত। ভারতের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কতদিন এই অর্থনীতির ঢালের পিছনে নিজেদের ব্যর্থতাকে লুকিয়ে রাখতে পারেন, এখন সেটাই দেখার বিষয়।

Featured Image Source: The Real News Network

Related Articles