Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মালদ্বীপ সঙ্কট: আবারও স্পষ্ট হলো ভারতের বিদেশনীতির দুর্বলতা

সম্প্রতি ভারত মহাসাগরে অবস্থিত ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ খবরের শিরোনামে উঠে এসেছে এর অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ডামাডোলের কারণে। সে দেশের রাষ্ট্রপতি ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুম তার বিরোধীপক্ষ এবং বিচারব্যবস্থার উপরে খড়গহস্ত হয়ে জরুরি অবস্থা জারি করে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকেই খারিজ করে দিয়েছেন। নিজেদের পদক্ষেপের সমর্থনে গাইয়ুম সরকার ভারতসহ পশ্চিমের দেশগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চীন, সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের মতো দেশে বিশেষ প্রতিনিধিও পাঠিয়েছে। তাদের তরফ থেকে বলে দেওয়া হয়েছে যে, আইনের শাসন এবং দেশের সুরক্ষা বজায় রাখতে এই সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।

মালদ্বীপকে ঘিরে স্বভাবতই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে দক্ষিণ এশিয়ার কূটনৈতিক আবহ। মাত্র ২৯৮ বর্গ কিলোমিটারের আয়তনের এই মুসলিম প্রধান দেশটিকে আপাতদৃষ্টিতে উল্লেখযোগ্য মনে না হলেও, আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তার ভূকৌশলগত এবং ভূ-অৰ্থনৈতিক গুরুত্ব যথেষ্ট। এবং সেই কারণেই সেখানে গাইয়ুমের কর্মকাণ্ড এবং তার চীন-প্রীতি ভাবিয়ে তুলেছে ভারতের নেতৃবৃন্দকে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি আব্দুল্লাহ ইয়ামিন আব্দুল গাইয়ুম নয়াদিল্লিতে একটি যৌথ সংবাদ সম্মেলনে। ছবিটি ২০১৬ সালের ১১ এপ্রিলের; Source: pmindia.gov.in

ভারতের রাজনৈতিক এবং মিডিয়া মহল আজ দ্বিধাগ্রস্থ কীভাবে মালদ্বীপ সমস্যার মোকাবেলা করা হবে, তা ভেবে। একটি মত হচ্ছে, নয়াদিল্লির পক্ষে এ ব্যাপারে চুপ থাকা ঠিক হবে না এবং দরকার হলে সামরিক বাহিনীকে পাঠানো উচিত। ঠিক যেমন ১৯৮৮ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী পাঠিয়েছিলেন মামুন আব্দুল গাইয়ুম (সম্পর্কে বর্তমান রাষ্ট্রপতির সৎভাই) সরকারকে অভুত্থান থেকে রক্ষা করতে। অপারেশন ক্যাকটাস-এর সফলতা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের গুরুত্ব বাড়িয়েছিল অনেকখানিই, সমৃদ্ধ করেছিল নয়াদিল্লি-মালে সম্পর্ককে।

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের কর্তৃত্ব খর্ব করছে চীন

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। এবারে মালদ্বীপের সরকার নিজেই আগ্রাসী এবং ভারত-বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে হাত মেলাতে তৎপর। আর সেকারণেই পরিবেশ সামরিক পদক্ষেপের প্রতিকূল বলে নয়াদিল্লির আরেকটি মহলের অভিমত। যদি তিন দশক আগেকার মতো বর্তমান নরেন্দ্র মোদী সরকার সেনা পাঠায় মালেতে গাইয়ুম সরকারকে নিজের অবস্থান বদলাতে, তবে এই মুহূর্তে তা চীনসহ অন্যান্য দেশকে চটাবে এবং পরিস্থিতি হয়ে উঠবে আরও উদ্বেগজনক।

চিনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং এর সাথে করমর্দনরত ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: Narendra Modi’s Twitter handle @narendramodi

১৯৮৮ সালের সামরিক হস্তক্ষেপ করার সময়ে ভারত দক্ষিণ এশিয়ার একচ্ছত্র অধিপতি থাকা সত্ত্বেও নানা মহলে তা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ পায়। আর আজকে যেখানে চীন এই অঞ্চলে ক্রমশই নিজের প্রভাব বাড়িয়ে চলছে নিরন্তর, তখন তো সামরিক কোনো সিদ্ধান্ত যথেষ্ঠ বিপজ্জনক।

দক্ষিণ এশিয়া প্রশ্নে মোদী শুরুটা করেছিলেন ভালো, কিন্তু তারপর?

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ভারতের তাহলে কী করণীয়? আর এখানেই নয়াদিল্লির বিদেশনীতি চলে আসে এক বড়সড় প্রশ্নের মুখোমুখি। আজকে মালদ্বীপের সমস্যা নিয়ে ভারতকে বেগ পেতে হচ্ছে তার প্রতিবেশী নীতির ব্যর্থতার কারণে। চার বছর আগে মোদী যখন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নিয়ে তার শপথ অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানান পাকিস্তানসহ দক্ষিণ এশিয়ার সব প্রতিবেশী দেশগুলোকে, ভাবা হচ্ছিল যে, তিনি আগেকার সরকারগুলোর ব্যর্থতা ঢেকে দক্ষিণ এশিয়ার আহত আঞ্চলিকতাবাদকে এক সুতোয় গাঁথতে পারবেন। এই সমস্যাদীর্ণ অঞ্চলে ভারতের একটি ইতিবাচক নেতৃত্ব সবসময়ই কাম্য। মোদী ভুটান এবং নেপাল ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে শুরু করেন তার বিদেশনীতির যাত্রা এবং উদ্যোগ নেন পাকিস্তানকে একঘরে করে যেন দক্ষিণ এশিয়ার সংহতি বাড়ানো যায়।

দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিত সার্ক গোষ্ঠী জন্ম থেকেই পঙ্গু ভারত-পাক সংঘাতের কারণে এবং সেকারণে ভুটান, বাংলাদেশ, ভারত এবং নেপালকে (বিবিআইএন) নিয়ে একটি খণ্ড আঞ্চলিকতাবাদকেও গুরুত্ব দেন মোদী। ভাবা হয় বিবিআইএন-এর অন্তর্ভুক্ত একটি অবাধ ভূতল পরিবহন চুক্তির কথাও।

ভারতের প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী যশোবন্ত সিংহ। তাঁর মতে নয়াদিল্লির কোনোভাবেই মালদ্বীপের এই সঙ্কটে মুখে কুলুপ এঁটে থাকা উচিত নয়; Source: imf.org

কিন্তু এর পরেই যেন থমকে যায় ভারতের প্রতিবেশী নীতি। আর ঠিক এসময়েই চীনের বিরাট কর্মকাণ্ড বেল্ট এবং রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) আলোড়ন ফেলে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি এবং কূটনীতিতে। পাকিস্তান তো বটেই, ভারতের অন্যান্য প্রতিবেশী (ভুটান ছাড়া) দেশগুলোও অনুধাবন করতে পারে চীনের এই বিপুল পরিকল্পনার গুরুত্ব। তারা ঝুঁকতে শুরু করে চীনের দিকে, আর এতেই অনাবৃত হয়ে পড়ে ভারতের দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশী নীতি।

ভারতের পড়শিরা ক্রমাগত ঝুঁকছে চীনের দিকে

আজকে মালদ্বীপ যে পুরনো বন্ধু ভারতকে এড়িয়ে যাওয়ার সাহস দেখতে পারছে, তার কারণ, সে জানে নয়াদিল্লি না থাকলেও অর্থনৈতিকভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী চীনের সাহায্য সে পাবে। নেপালও এই এক পথের পথিক। শ্রীলঙ্কা সম্প্রতি মুখে চীনের থেকে দূরত্ব তৈরি করার কথা বললেও, রাজাপক্ষে-পরবর্তী কলম্বোকে দেখা গিয়েছে চীনের অর্থনৈতিক প্রসাদ পেতে সে খুব অনিচ্ছুক নয়।

ভুটান যদিও চীনের কর্তৃত্ব মেনে নিতে এখনও রাজি নয় এবং ভারতকেই সে বেশি কাছের বলে মনে করছে, কিন্তু গত বছরের ডোকলাম সঙ্কটের সময়ে থিম্পুর একাংশ ভারতের ভূমিকায় খুব একটা সন্তোষ প্রকাশ করেনি। বাংলাদেশে যদিও এই মুহূর্তে ভারত-বান্ধব সরকার রয়েছে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেশটির ভারত নীতি কী হতে চলেছে, তা কেউই জানে না। এমনকি, এই সময়েও তিস্তা জলবণ্টন ইস্যুতে ঢাকা যে নয়াদিল্লি এবং কলকাতার মধ্যে চলতে থাকা টানাপোড়েন নিয়ে খুশি নয়, তা বোঝা গেছে ইতোমধ্যেই।

চীন এবং ভারতের বিদেশনীতির তফাৎ

এই সমস্ত ঘটনা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, ভারতের বিদেশনীতির প্রণেতারা দক্ষিণ এশিয়ায় বাড়তে থাকা বিপদকে এখনও বুঝে উঠতে পারেননি। ভারত এবং চীনের বিদেশনীতির মধ্যে সবচেয়ে বড় ফারাক হচ্ছে বাস্তববাদিতা এবং ধারাবাহিকতা। ভারতের কোলাহলপূর্ণ গণতন্ত্রের নেতৃত্ব চেষ্টা করেন নৈতিক দিকটি বাঁচিয়ে নীতি প্রণয়ন করার। অর্থাৎ যে সমস্ত দেশ গণতান্ত্রিক রীতিনীতির তোয়াক্কা করে না, তাদেরকে দূরে সরিয়ে রেখে নিজের নৈতিক উচ্চতা ধরে রাখা। এর একটি কারণ হচ্ছে, নেহরুবাদী আদর্শের প্রভাব এবং দ্বিতীয়ত, ঘরোয়া রাজনীতিতে বিরোধীপক্ষের নিদারুণ আক্রমণের ভয়।

মার্কিন সিনেটর জন ম্যাককেইন এর সাথে মালদ্বীপের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি মোহাম্মদ নাশিদ। নাশিদ বর্তমান সঙ্কটে ভারতের সামরিক হস্তক্ষেপের পক্ষে; Source: Nasheed Twitter handle @MohamedNasheed

কিন্তু চীনের সেসবের বালাই নেই। চীনের একমুখী রাজনৈতিক ব্যবস্থায় জাতীয় স্বার্থ সবচেয়ে বড় বিষয়। একদিকে বিরোধীদের জবাবদিহি করার দায় নেই, অন্যদিকে আছে অর্থনৈতিক জোর, যা দিয়ে ছোট দেশগুলোকে সহজেই প্রভাবিত করা যায়।

এদিকে ভারতের আদর্শবাদী বিদেশনীতিতে ধারাবাহিকতার অভাব লক্ষ্য করা গিয়েছে সেই চীনের কারণেই। মিয়ানমারে সাম্প্রতিককালে রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে সেদেশের রাষ্ট্রশক্তির নিধনযজ্ঞের পরেও ভারত কোনো আদর্শবাদী অবস্থান নিয়ে এর নিন্দা জানায়নি, পাছে চীন তার সুবিধা নেয়।

অতীতে নেপালের রাজাকেও গণতান্ত্রিক ভারত সমর্থন করে এসেছে সময়ে সময়ে, যাতে মাওবাদীরা এবং তার সঙ্গে সঙ্গে চীন সেখানে সুবিধা নিতে না পারে। কিন্তু উভয় ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, ভারতের এই অবস্থানও বিশেষ কার্যকর হয়নি। বর্তমানে মায়ানমার ও নেপাল- এই দুই দেশের শাসককুলের কাছেই চীন নিজের গুরুত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে যথেষ্ঠভাবে, কারণ আর কিছুই নয়, বেইজিং এর বাস্তববাদী বিদেশনীতি।

চীনের বেইজিংয়ে চীনা প্রধানমন্ত্রী লি কেছিয়াং এর সাথে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি; Source: REUTERS/Jason Lee

চীনের বিদেশনীতিতে অস্ত্রের চেয়ে অর্থের ভূমিকা বড়, যার দরুন বেইজিং অর্থনৈতিকভাবে অনেক দুর্বল রাষ্ট্রের বন্ধু হয়ে উঠতে পারে সহজেই; সেখানকার পরিকাঠামো, পরিষেবা ইত্যাদি নির্মাণের উপর জোর দিয়ে। আর প্রত্যক্ষ অর্থনৈতিক প্রভাবের হাত ধরে আসে পরোক্ষ রাজনৈতিক প্রভাব। এই দুইয়ের মেলবন্ধন চীনকে বিশ্ব রাজনীতিতে করে তুলছে ক্রমশই এই পরাক্রমী শক্তি, যাকে ঠেকাতে অদূর ভবিষ্যতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো মহাশক্তিধর রাষ্ট্রকেও প্রবল হিমশিম খেতে হবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। ভারত তো সেখানে এখনও বেশ কিছুটা পিছিয়ে।

ভারতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা কোথায়?

গত কয়েক দশকে চীন দ্রুতগতিতে নিজেকে ‘সফট পাওয়ার’ থেকে ‘হার্ড পাওয়ার’-এ রূপান্তরিত করেছে এবং এখনও করছে। গোঁড়া কমিউনিস্ট শাসনের যাঁতাকল থেকে বেরিয়ে আজ তারা তামাম দুনিয়ার অর্থনৈতিক ব্যবস্থার উপর কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে উদ্যোগী। ভারতের ছোট প্রতিবেশীরা তাদের নিজেদের জাতীয় স্বার্থের কথা ভেবেই চীনের দেখানো পথে এগোতে উৎসাহী। আর তাতে স্বাভাবিকভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ভারতের নিজের স্বার্থ। এই অবস্থা থেকে বেরোতে নয়াদিল্লির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার দিন তৎকালীন পাকিস্তানী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের সঙ্গে বার্তা বিনিময়ে মোদী। নয়াদিল্লি, ২৬ মে ২০১৪; Source: Narendra Modi Flickr account

চীনের সঙ্গে টক্কর দিয়ে স্বল্পমেয়াদি হাততালি কুড়িয়ে কাজের কাজ কিছুই হবে না। অথচ বিভাজিত গণতন্ত্রে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করাটাও সহজ কাজ নয়। দলীয় রাজনীতির উর্ধ্বে উঠে সর্বসম্মতিতে জাতীয় স্বার্থের জন্যে কাজ করার ইস্পাতকঠিন দৃঢ়তা এখনও ভারতীয় রাজনীতিবিদদের করায়ত্ব হয়নি। আর তার ফলেই বেরিয়ে পড়ছে দুর্বলতা।

সামনের পথ বন্ধুর। ভারতীয় নেতৃত্ব আগামী দিনে কীভাবে এই পথ পেরোন, এখন সেটাই দেখার।

ফিচার ইমেজ: REUTERS/Adnan Abidi

Related Articles