Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কর্ণাটক নির্বাচন: সিদ্দারামাইয়ার দুর্গে কি আঘাত হানতে পারবে মোদীর বিজেপি?

২০১৯ সালের ভারতের সংসদীয় নির্বাচনের আগে দেশটির বেশ কিছু রাজ্যে নির্বাচন হতে চলেছে  এবং তার প্রত্যেকটিই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তার ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) জন্য  গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন, যা অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা আর কয়েক মাসের মধ্যেই, বিজেপি এবং ভারতের জাতীয় কংগ্রেস উভয়পক্ষের কাছেই রীতিমতো সম্মানের লড়াই। আর এই কর্ণাটককে কেন্দ্র করেই ভোটযুদ্ধের পাড়া ক্রমশই চড়ছে।

কর্ণাটকের নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ, কারণ ভারতীয় রাজনীতিতে ক্রমশই ফিকে হয়ে আসা কংগ্রেস দলের হাতে একমাত্র বড় রাজ্য এখন এই একটিই। অন্যদিকে, বিজেপি এই রাজ্যটি ছিনিয়ে নিতে আরও মরিয়া, কারণ ২০০৮ সালে তারা সেখানে প্রথমবার ক্ষমতায় এলেও পাঁচ বছরের মেয়াদকালে কর্ণাটকে তাদের রীতিমতো নাজেহাল হতে হয়। তিন-তিনজন মুখ্যমন্ত্রী ক্ষমতায় আসেন, স্থানীয় বড় নেতা বি এস ইয়েদুরাপ্পা দুর্নীতির অভিযোগে ক্ষমতা হারান এবং দল ছেড়ে নিজের নতুন দল তৈরি করে ২০১৩ সালের রাজ্য নির্বাচনে বিজেপিকে বড় ধাক্কা দেন।

ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুতে একটি জনসভায় বক্তব্য রাখছেন সে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া; Source: Siddaramaiah Twitter handle @siddaramaiah

বিজেপির এই ডামাডোলের সুযোগ নিয়ে কংগ্রেস সিদ্দারামাইয়ার নেতৃত্বে সরকার গড়ে রাজ্যে এবং গত পাঁচ বছরে সিদ্দারামাইয়া সরকারের বিরুদ্ধে নানা অসন্তোষ দেখা দিলেও বিজেপি সেভাবে তার সুযোগ নিতে পারেনি, এমনকি লিঙ্গায়েত মুখ ইয়েদুরাপ্পাকে দলে ফিরিয়ে এনেও। গত বছর কর্ণাটকের নঞ্জনগুড় এবং গুন্ডলুপেট বিধানসভা কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত হওয়া হাই-প্রোফাইল দুটি উপনির্বাচনে কংগ্রেস নানা চ্যালেঞ্জ পেরিয়ে জয়ী হয় সিদ্দারামাইয়ার নেতৃত্বে এবং সেটাই শাসকদলকে চাঙ্গা করে বড়রকমভাবে।

এই দুটি নির্বাচনের আগে সিদ্দারামাইয়ার ‘ব্যক্তিকেন্দ্রিক’ শাসনের বিরুদ্ধে অসন্তোষ দেখা দেয় কংগ্রেস দলে; দল ছাড়েন বেশ কিছু নেতা। এমনকি কর্ণাটক রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং বর্ষীয়ান নেতা এসএম কৃষ্ণও বিজেপিতে যোগ দেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ মত দেন যে, সিদ্দারামাইয়া এই অসন্তোষ সামলাতে সফল হবেন না; পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের আগে তার নেতৃত্ব দুর্বল হবে। কিন্তু সিদ্দারামাইয়া সবাইকে ভুল প্রমাণিত করেন এবং দলকে দুটি উপনির্বাচনেই জিতিয়ে নিয়ে আসেন। অন্যদিকে, বিজেপির ইয়েদুরাপ্পা নিজেকে প্রমাণ করতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হন।

সাংবাদিক রাজদীপ সারদেশাইয়ের সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে ভারতের কর্ণাটক রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া; Source: Siddaramaiah Twitter handle @siddaramaiah

বর্তমান কংগ্রেসের আর পাঁচজন নেতার থেকে সিদ্দারামাইয়ার বড় তফাৎ আছে। প্রথমত, তিনি মোসাহেবি করা নেতা নন। সিদ্দারামাইয়া তার পুরোনো দল জনতা দল (সেকুলার) ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দেন ২০০৬ সালে। আর যদি বর্তমান দলেও তার বিরুদ্ধে অতিরিক্ত ওজর-আপত্তি ওঠে তাহলে তিনি তা ছেড়ে দিয়ে নিজের আলাদা দল তৈরি করতেও পিছপা হবেন না।

অন্যদিকে, কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব চাইবেন না প্রতিষ্ঠিত একজন নেতা চটে গিয়ে দল ছাড়ুন আর তারা আরও একটি নির্বাচনে হড়কে যান, বিশেষ করে সেটা যখন কর্ণাটকের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের নির্বাচন। কংগ্রেসের নতুন সভাপতি রাহুল গান্ধী তাই সিদ্দারামাইয়াকেই কর্ণাটক নির্বাচনে দলের সেনাপতি বানিয়েছেন, কারণ এই মুহূর্তে মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে বেশি ভালো করে আর কেউ হাল ধরতে পারবেন না।

সিদ্দারামাইয়া সরাসরি টক্কর দিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে

আর এখানেই দলের সঙ্গে সম্পর্কের সমীকরণে সিদ্দারামাইয়ার অবস্থান আরও শক্তিশালী হয়েছে এবং তিনি বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী ইয়েদুরাপ্পা নন, সোজাসুজি টক্কর নিচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে। অনেকেই এই নির্বাচনের মধ্যে ২০১৫ সালের দিল্লি এবং বিহার নির্বাচনের ছায়া দেখছেন। ওই দুটি নির্বাচনেও স্থানীয় মুখ যথাক্রমে অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং নীতিশকুমারের সঙ্গে সরাসরি লড়াই হয়েছিল প্রধানমন্ত্রী মোদীর এবং দুই ক্ষেত্রেই প্রবল ভরাডুবি ঘটে বিজেপির। অনেকের মতে, সেরকম কিছু ঘটতে পারে এবারের কর্ণাটক নির্বাচনেও।

ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ সিদ্দারামাইয়া যে শুধুমাত্র পপুলিজম বা জনপ্রিয়তাবাদ (জনমুখী প্রকল্প, সস্তায় খাবার), প্রশাসনিক সাফল্য বা উন্নয়নের নিরিখে মোদীর সঙ্গে লড়ছেন, তা কিন্তু নয়। উনি কন্নড় জাতিবোধের সলতেও পাকিয়েছেন, যাতে বিজেপির উত্তর ভারতীয়-কেন্দ্রিক হিন্দিবাদী রাজনীতিকে স্থানীয় ভোটারদের সামনে প্রকট করে দেওয়া যায়। সিদ্দারামাইয়া সাধারণ মানুষকে এই বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছেন যে, বিজেপি নির্বাচনে জিতলে তাদের হিন্দিবাদী এজেন্ডা কর্ণাটকের নিজস্ব জাতিগর্বকে ম্লান করে দেবে।

ভারতের কর্ণাটকের মহিশূরে একটি প্রকল্পের উদ্বোধনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী; Source: Author: Narendra Modi; flickr.com

সাম্প্রতিককালে বেঙ্গালুরু মেট্রোতে হিন্দি সাইনবোর্ড তুলে দেওয়ার পক্ষে যে জরুরি প্রশ্ন তুলেছেন সিদ্দারামাইয়া, তা এই ‘আইডেন্টিটি পলিটিক্সের’ই এক অন্যতম বড় উদাহরণ। প্রাতিষ্ঠানিক অর্থে কর্ণাটকের আলাদা লাল-হলুদ পতাকা চালু করার পরিকল্পনাও এই খণ্ড জাতীয়তাবাদী রাজনীতির নিদর্শন।

সিদ্দারামাইয়ার রাজনৈতিক কৌশলের কোনো উত্তর বিজেপির কাছে নেই এখনও

বিজেপি কিন্তু সিদ্দারামাইয়ার এই রাজনৈতিক কৌশলের কোনো সদুত্তর খুঁজে পায়নি এখনও। গেরুয়াবাদী দলের রাজনৈতিক এজেন্ডা একমুখী হওয়াতে সেটি তাদের শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষে সহজে সম্ভবও হবে না। সার্বিক দুর্নীতির প্রশ্নে সিদ্দারামাইয়া সরকারকে মোদী এবং বিজেপির জাতীয় সভাপতি অমিত শাহ বিঁধেছেন ঠিকই, কিন্তু তা যথেষ্ট নয়। আর শুধু উন্নয়নের বুলি দিয়ে কর্ণাটককে পকেটস্থ করাও সহজ নয়, কারণ এই রাজ্যটি ভারতের উন্নত প্রদেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। সম্প্রতি বিজেপি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে কর্ণাটকে নিয়ে এলে সিদ্দারামাইয়া সরাসরি প্রশ্ন করেন উত্তর প্রদেশের সরকারের প্রশাসনিক রেকর্ড নিয়ে।

কর্ণাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী বি এস ইয়েদুরাপ্পা (মাঝখানে); Source: BS Yueddyurappa Twitter handle @BSYBJP

দক্ষিণ ভারতের রাজ্যগুলো প্রশাসনিক নিরিখে উত্তরের রাজ্যগুলোর চেয়ে এগিয়ে অনেকটাই। তাই বিজেপির এই আত্মঘাতী কৌশল কর্ণাটকের মানুষের চোখে সিদ্দারামাইয়ার প্রতি শ্রদ্ধা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকখানিই। স্তিমিত হয়ে গিয়েছে তার সরকারের বিরুদ্ধে গত পাঁচ বছরের প্রতিষ্ঠান-বিরোধী হাওয়া।

কর্ণাটকের জাতপাতের সংঘাতের সুযোগ নিয়েও সিদ্দারামাইয়া সরকার চেষ্টা করেছে বিজেপিকে কোণঠাসা করার। বীরশৈবদের সঙ্গে সংঘাতের পরে এই রাজ্যের বৃহত্তম গোষ্ঠী লিঙ্গায়েতরা রাজ্য সরকারের কাছে আবেদন করেছে তাদের স্বতন্ত্র একটি ধর্মের অন্তর্ভুক্ত করার জন্যে এবং চতুর সিদ্দারামাইয়া এর মধ্যে খুঁজে পেয়েছেন ইয়েদুরাপ্পাকে পর্যুদস্ত করার রাস্তা। যদি লিঙ্গায়েতদের দাবি মেনে নেন তিনি, তাহলে লিঙ্গায়েত ভোটের কিছুটা পেয়েও তাদের বড় নেতা ইয়েদুরাপ্পার জয়ের পথটি আটকে দেওয়া সহজ হবে।

কাবেরী জলবণ্টন সমস্যাকে সিদ্দারামাইয়া ব্যবহার করেছেন কৌশলে

আরও একটি ক্ষেত্রে সিদ্দারামাইয়া বিজেপিকে প্যাঁচে ফেলেছেন। আর তা হলো প্রতিবেশী রাজ্য তামিলনাড়ুর সঙ্গে কাবেরী নদীর জলবণ্টন নিয়ে কলহ। কেন্দ্রের শাসকদল হওয়াতে বিজেপির পক্ষে এ ব্যাপারে শুধুমাত্র কর্ণাটকের পক্ষপাতিত্ব করা সম্ভব নয়, কারণ তাকে তামিলনাড়ুতে নিজের স্বার্থকেও দেখতে হবে সমানভাবে। কিন্তু সিদ্দারামাইয়ার সেই বাধ্যবাধকতা নেই; তিনি শুধু নিজের রাজ্য নিয়েই ভাববেন সেটাই স্বাভাবিক। আর এখানেই তিনি বিজেপিকে চাপে ফেলছেন রাজ্য নির্বাচনের প্রাক্কালে। সিদ্দারামাইয়া কাবেরী ইস্যু নিয়ে যতটা সরব কর্ণাটকের পক্ষে, বিজেপির পক্ষে তা সম্ভব নয় সবদিকে বাঁচিয়ে চলতে গিয়ে। আর এতে ক্ষতিগ্রস্তই বেশি হচ্ছে কর্ণাটকের ভোটারদের কাছে মোদীর দলের ভাবমূর্তি।

ভারতের প্রাক্তন উপ-প্রধানমন্ত্রী এবং বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি; Source: Author: US State Department; Source: flickr.com

সব মিলিয়ে, এবারের কর্ণাটক নির্বাচন জমে গেলেও বিজেপির পক্ষে সিদ্দারামাইয়াকে সিংহাসনচ্যুত করা কতটা সম্ভব হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। ব্যক্তিগতভাবেও সিদ্দারামাইয়ার ভাবমূর্তি প্রচ্ছন্ন; অন্যদিকে ইয়েদুরাপ্পার অতীত যথেষ্ঠ কলঙ্কময়। বর্ষীয়ান বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদভানি অতীতে ইয়েদুরাপ্পাকে দলে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে যথেষ্ঠ আপত্তি করেছিলেন। কারণ, তার মতে, এমন কালিমালিপ্ত নেতাকে দলে নিলে তা জনমানসে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

কিন্তু, বিজেপিতে তার জমানা শেষ হওয়াতে আদভানির সাবধানবাণী শোনেনি কেউই, বিজেপিতে দর্পের সঙ্গে ঘটে ইয়েদুরাপ্পার প্রত্যাবর্তন। কারণ, বর্তমান নেতৃত্ব মনে করে যে কর্ণাটকে ভোট জিততে ওই নেতার কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু পোড়খাওয়া নেতা আদভানি যে ভুল বলেননি, তা হয়তো কর্ণাটকের আমজনতা প্রমাণ করবেন আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনেই।

ফিচার ইমেজ: Twitter(@PIB_India)

Related Articles