ভিনগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব নিয়ে আমাদের কৌতুহলের শেষ নেই। বিশ্বজুড়ে ভিনগ্রহবাসীদের নিয়ে লেখা হয়েছে অসংখ্য কল্পকাহিনী, তৈরি হয়েছে অনেক চলচ্চিত্র। বিজ্ঞানীরাও অনেকদিন থেকেই পৃথিবীর বাইরে প্রাণের অস্তিত্ব রয়েছে কিনা তা খুঁজে বের করার চেষ্টা চালাচ্ছেন। সম্প্রতি তাদের এই অনুসদ্ধানে আশার আলো দেখিয়েছে নাসার রোবটযান কিউরিওসিটি। মঙ্গলগ্রহে জৈবিক পদার্থের সন্ধান পেয়েছে এই যানটি। তবে সত্যিই কি ওই লাল গ্রহে প্রাণের সঞ্চার ঘটেছিল কোনো এককালে?
নতুন আবিষ্কারগুলোর কথা দুটি গবেষণাপত্রে গত ৭ জুন বৃহস্পতিবার সাইন্স জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর একটি মঙ্গলগ্রহের বায়ুমণ্ডলে মিথেন গ্যাসের উপস্থিতি এবং অপরটি সেখানে প্রাপ্ত প্রাচীন জৈবযৌগ সংক্রান্ত। সবমিলিয়ে এই দুটি আবিষ্কারকে বিজ্ঞানীরা অ্যাস্ট্রোবায়োলজির দারুণ সাফল্য হিসেবে দেখছেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক কিউরিওসিটি কী তথ্য এনেছে পৃথিবীর মানুষের জন্য।
মঙ্গলে কিউরিওসিটির জৈবযৌগ আবিষ্কার
মঙ্গলগ্রহের ‘গেইল’ নামের একটি জ্বালামুখের মাটি থেকে প্রায় ৩০০ কোটি বছর আগের একটি পললের নমুনায় জৈবযৌগের সন্ধান পেয়েছে কিউরিসিটি। গত বৃহস্পতিবার এ আবিষ্কারের কথা ঘোষণা করে নাসা।
কীভাবে এই জৈব পদার্থ সেখানে এসেছে, সে সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা এখনও নিশ্চিত না। সে কারণে এই জৈবযৌগ সংক্রান্ত কিছু প্রয়োজনীয় প্রশ্নও উঠে এসেছে। এগুলো কি পূর্বের জীবিত কোনো অস্তিত্বের অবশিষ্টাংশ, নাকি পাথরের সাথে রাসায়নিক দ্রব্যের বিক্রিয়ায় গঠিত? নাকি এগুলো কোনো ধূমকেতু বা উল্কাপিণ্ডের মাধ্যমে মঙ্গলগ্রহে পৌঁছেছে?
পৃথিবীর বাইরে জীবনের জন্য অনুসন্ধান করার ক্ষেত্রে প্রথমেই দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে হয় জীবনের বিল্ডিং ব্লকের উপর। এর মাঝে রয়েছে জৈব যৌগ এবং জৈব অণু। তবে জীবিত কোনোকিছুর উপস্থিতি ছাড়াও এগুলোর অস্তিত্ব থাকতে পারে। জৈবপদার্থ নানাভাবে উপস্থিত থাকতে পারে, যেমন- প্রাচীন প্রাণের অস্তিত্বের প্রমাণ নিয়ে বিদ্যমান থাকতে পারে, আবার কোনো জীবিত অস্তিত্বের খাদ্যের উৎস হিসেবে বা জীবিত অস্তিত্বের কাছাকাছি অবস্থান করতে পারে।
তাই এখনই এটি বলা সম্ভব না যে আসলেই মঙ্গলগ্রহে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল কিনা। মেরিল্যান্ডে নাসার গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের জীববিজ্ঞানী জেনিফার এইজেনব্রড বলেন, “পদার্থটির উৎস সম্পর্কে না জানলেও ফলাফলের আশ্চর্যজনক ধারাবাহিকতা মনে করিয়ে দেয়, আমরা মঙ্গলগ্রহে প্রাণের অস্তিত্বের একটি জোরদার সংকেত পেয়েছি।” তিনি আরও বলেন, “এটি বলছে না যে সেখানে প্রাণের অস্তিত্ব ছিল; এটি বলছে যে সেই ধরনের পরিবেশে বাস করতে প্রাণীর যা প্রয়োজন তার সবই সেখানে ছিল।“
কিউরিওসিটি প্রায় ৬ বছর আগে মঙ্গলগ্রহে পৌঁছায়। ছোট গাড়ির আকৃতির এই রোবটযানটি এপর্যন্ত সেখানে প্রায় ১২ মাইল পথ পাড়ি দিয়েছে। এটি গেইল জ্বালামুখের প্রাচীন হ্রদের তলানি ছিদ্র করে সেখান থেকে এই জৈব অণুগুলো সংগ্রহ করেছে এবং তা উচ্চতাপমাত্রায় গরম করেছে। প্রায় যখন নমুনার যৌগ ৫০০ থেকে ৮২০ সেলসিয়াস তাপমাত্রা পর্যন্ত পৌঁছায়, তখন এক ধরনের তথাকথিত সুগন্ধযুক্ত বাষ্পের সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানী দলের বিশ্বাস, এটি কয়লায় পাওয়া যায় এমন জৈবযৌগের চেয়েও বৃহত্তর জৈব অণুর ভাঙনের ফলে সৃষ্ট, যা অনেক বছর আগেই মঙ্গলগ্রহের শিলায় রয়ে গিয়েছিল।
ক্রিস্টেন সিব্যাক নামে একজন গ্রহ সংক্রান্ত ভূ-তত্ববিদ জানান, “এই অণু জীবনের অংশ হয়ে থাকতে পারে, আবার এগুলো কোনো জীবিত অস্তিত্বের জন্য খাদ্যও হতে পারে।“
মঙ্গলের বায়ুতে মিথেনের উপস্থিতি!
মঙ্গলে কিউরিওসিটি পৌঁছানোর আগেই সেখানকার বায়ুমণ্ডলে মিথেনের উপস্থিতি দেখতে পান বিজ্ঞানীরা। তবে কিউরিওসিটি মিথেনের উপস্থিতি নীরিক্ষা করেছে। গত পাঁচ বছর ধরে গেইল জ্বালামুখের আশেপাশের বায়ুমণ্ডলে এটি লেজার স্পেক্টোমিটার দিয়ে মিথেনের তারতম্য মেপেছে। এর আগে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পারেননি কেন মিথেনের পরিমাণ কম-বেশি হয়।
মিথেনের তারতম্য মৌসুমের উপর নির্ভর হয়ে থাকে। এর অর্থ, মিথেন মঙ্গলের পৃষ্ঠদেশ থেকে অথবা মাটির নিচের কোনো আধার থেকে বেরিয়ে বায়ুমণ্ডলে আসে। এমনকি পৃষ্ঠের নিচে জলের স্ফটিকের মাঝেও মিথেন আটকা পড়তে পারে। নাসার জেট প্রপালশন পরীক্ষাগারের বিজ্ঞানী ওয়েবস্টারের মতে, মঙ্গলের মাটির গভীরে আধারে থাকা মিথেন ক্রমাগত বেরিয়ে আসতে থাকে। গ্রহটিতে উত্তর গোলার্ধে শীতকাল থেকে গ্রীষ্মকালে মিথেনের পরিমাণ বেড়ে প্রায় তিনগুণ হয়ে যায়।
মিথেন একটি শক্তিশালী গ্রিনহাউজ গ্যাস। মঙ্গলে হ্রদের জন্য দরকারি জলবায়ু উপস্থিত থাকার জন্য এটি সাহায্য করে থাকতে পারে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এমনকি এই অবস্থা পৃষ্ঠদেশের নিচে এখনও বিরাজ করতে পারে। মাটিতে জৈব যৌগের উপস্থিতি ও বায়ুতে মিথেনের মতো জৈব গ্যাসের আবিষ্কার মঙ্গলে প্রাচীনকালে প্রাণের উপস্থিতি সম্পর্কে শক্তিশালী ইঙ্গিত দেয়।
কিউরিওসিটির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ধারণা করা হয়, প্রায় ৩৫০ কোটি বছর আগে গেইল জ্বালামুখটি হয়তো বাসযোগ্য ছিল। এটি সত্যি হয়ে থাকলে এ অবস্থার সাথে আমাদের পৃথিবীর তুলনা করা যাবে। কেননা ঐ সময় আমাদের পৃথিবীতেও প্রাণের বিকাশ ঘটছিল।
তবে মঙ্গলে মিথেনের পরিমাণের তারতম্য পরিমাপ করা সহজ ছিল না। মঙ্গলগ্রহের এক বছর পৃথিবীতে দু’বছরের সমতুল্য। তাই পরীক্ষা ও বিশ্লেষণের পূর্ণ ফলাফল পেতে পরপর দুই মৌসুমের মিথেনের তারতম্য লিপিবদ্ধ করতে হয়েছে, যা পৃথিবীতে ৪ বছরের সমান।
আরও পরীক্ষা-নীরিক্ষার জন্য নাসার ইনসাইড ল্যান্ডার গত ৫ মে মঙ্গলের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেছে। এটি এ বছর নভেম্বরের ২৬ তারিখে মঙ্গলে পৌঁছানোর কথা। মঙ্গলগ্রহ ভূ-তাত্ত্বিকভাবে সক্রিয় কিনা সেটি দেখাই এর দুই বছর মেয়াদের মিশন। এদিকে ২০২০ সালে মার্স ২০২০ নামে অপর একটি যান মঙ্গলে পাঠানোর কথা। এটি গ্রহটির মাটির নমুনা পরীক্ষায় সাহায্য করতে পারে।
মঙ্গলে পুরোপুরি প্রাণের সন্ধান পাওয়া না গেলেও সাম্প্রতিক এই আবিষ্কার যথেষ্ট আশাব্যঞ্জক বলেই মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে, তারা সঠিক পথে এগোচ্ছেন। হয়তো ভবিষ্যতে প্রাণের সন্ধান মিলেও যেতে পারে এই লালগ্রহে!
Featured Image Source: NASA/JPL-Caltech