Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ড্যাডি কি রসুই: ৫ রূপীতে একবেলার ভরপেট খাবার

প্রতিদিন দু’মুঠো খাবার জোগাড়ের জন্য আমাদের ছুটে চলা। কারো ভাতে ভীষণ অরুচি, আবার কারো জন্য একমুঠো ভাত দিনশেষে মুখে হাসি ফোটায়। সৃষ্টিকর্তার বিধানই বলুন আর কর্মফলই বলুন, কারও খাবার টেবিলে প্রতিদিন প্রতিবেলা হাজারো খাবারের উপস্থিতি থাকে, কিন্তু কারো জন্য ডাল, ভাতের জোগাড় করাটাও অনেক সময় অসম্ভব হয়ে পড়ে। বিশ্বে অন্নকে সবার মৌলিক অধিকার হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু এমনও অনেকে আছে যারা ক্ষুধার্ত অবস্থায় অনাহারে থেকে দিনের পর দিন কাটিয়ে দেয়।

বিশাল অট্টালিকার পাশে কিছু মানুষকে খোলা আকাশের নীচে ঘুমাতে দেখা যায়, আর যাদের ভাগ্য কিছুটা সহায়ক তারা হয়ত গাদাগাদি করে বস্তিতে বসবাস করার সুযোগ পায়। এই বিশাল অট্টালিকার সবগুলো ঘর হয়ত কখনো ব্যবহারই হয় না, নেহায়েত কোনো ধনকুবের ইচ্ছে হেতু এমন প্রাসাদ বানানো হয়েছে যাতে মানুষের বসবাস হাতে গোনা। এই মানুষগুলো হয়ত পারে খোলা আকশের নীচে থাকা ওই ছিন্নমূল মানুষগুলোর জন্য কিছু একটা করতে, কিঞ্চিৎ মাথাগোজার ঠাই হিসেবে একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করে দিতে। সৃষ্টিকর্তা তো তাদের অনেক দিয়েছেন, সামান্য ইচ্ছেটুকু হয়ত অনেকের ভাগ্যটাই বদলে দিতে পারে।

ভাবছেন, এসব আবার কী শুরু করলাম? যাদের সৃষ্টিকর্তা অনেক দিয়েছেন তাদের একটু সদিচ্ছা আর একটু চেষ্টা হয়ত একইভাবে অনেকের মুখে অন্ন তুলে দিতে পারে। আমাদের সমাজে ধনবান লোকের যেমন অভাব নেই, ঠিক তেমনই অভাব নেই অনাহারে থাকা মানুষের। এমন লোকেরা যখন নির্বিকার থাকেন, তখন বিবেকবোধ সম্পন্ন কিছু সাধারণ মানুষ সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তাদের হয়ত অঢেল ধনসম্পদ নেই, তথাপি মানুষের পাশে দাঁড়ানোর জন্য দৃঢ় মনোবল রয়েছে। আজকে এমনই এক সাধারণ মানুষের কথা আপনাদের বলব, যিনি তার ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০০ জনের মুখে একবেলা আহার তুলে দেন।

খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত অনুপ খান্না; Source: dnaindia.com

নাকের নীচে মাঝারি সাইজের গোঁফ আর মাথায় সাদা চুলের এক প্রবীণ ব্যক্তি বিরক্তিহীনভাবে একের পর এক পাতে খাবার বেড়ে চলেছেন। আর মানুষও লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে সেই খাবার গ্রহণ করছেন। বলছি ভারতের শ্রী অনুপ খান্নার কথা, যিনি প্রতিদিন একবেলা করে ৫ রূপীর বিনিময়ে খাবার প্রদান করে থাকেন। তার খাবারের তালিকায় রয়েছে ভাত-ডাল ও রুটি-সবজি। কখনো তিনি ভাত-ডাল, আবার কখনো রুটি-সবজি পরিবেশন করে থাকেন। নয়ডার ১৭ নং সেক্টরে সকাল দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত এবং ২৯ নং সেক্টরে দুপুর বারোটা থেকে দুইটা পর্যন্ত তিনি খাবার বিক্রি করে থাকেন। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য মূলত এই ব্যবস্থাটি করা হয়ে থাকলেও ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে চাকরিজীবীরা পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে খাবার সংগ্রহ করে থাকেন। তার এখানে অগ্রীম বুকিং এর কোনো ব্যবস্থা নেই।

Source: thebetterindia.com

সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও অর্থায়নে আজ থেকে দুই বছর আগে তিনি এই সমাজসেবামূলক কাজটি শুরু করেছিলেন, যা আজ অবধি তিনি নিরলসভাবে করে চলেছেন। প্রতিদিনের রান্নার জন্য তিনি প্রায় ৩০,০০০ হাজার রূপী খরচ করে একটি রান্নাঘর নির্মাণ করেছেন এবং নাম দিয়েছেন ‘ড্যাডি কি রসুই’। ড্যাডি কি রসুই রান্নাঘরের নামটি দিয়েছেন অনুপ খান্নার মেয়ে সাক্সী খান্না। এমন একটি মানব হিতৈষী উদ্যোগের জন্য তিনি তার পরিবার অর্থাৎ স্ত্রী, কন্যার কাছ থেকে মানসিকভাবে পূর্ণ সমর্থন পেয়েছেন।

Source: dnaindia.com

অনেকেই হয়ত বলে থাকবেন, যিনি এত মানবদরদী, তিনি তো চাইলে বিনামূল্যেও খাবার বিতরণ করতে পারেন। এতে হতদরিদ্র মানুষের কি আরো একটু বেশী উপকার হত না? তাহলে তিনি কেন ৫ রূপী করে খাবার বিতরণ করছেন? তাঁকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে, তিনি যে উত্তরটা দিয়েছিলেন তা হয়ত সমাজের বিত্তবানদের বিবেকবোধে কিছুটা হলেও নাড়া দিবে। তিনি বলেন,

“কারো কাছে আমাদের হাত পাতা উচিত নয়। যারা আর্থিকভাবে সচ্ছল নয় তাদেরকে আমি ভিক্ষুকদের দলে ফেলতে চাই না।”

কারো কাছ থেকে হাত পেতে কোনো কিছু নেওয়াটা অসম্মানের। মানুষ হিসেবে প্রত্যেকেরই আত্মসম্মান রয়েছে, এর সাথে ধনী গরীবের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। এমনও অনেক মানুষ আছে যারা সম্মানের ভয়ে কারো কাছে কিছু চাইতে পারে না, আবার এমনও অনেকে আছে যারা শুধুমাত্র দামের কারণে ফুটপাতের দোকান থেকেও কিনে খেতে পারে না। তাদের জন্য কি এটাই ভালো নয় যে, ৫ রূপী দিয়ে তারা একবেলা ভরপেট খাবার কিনে খেতে পারছে? এতে যেমন তারা আত্মতৃপ্তির সাথে খেতেও পারল, অপরদিকে গরীব মানুষগুলোর মুখে হাসিও ফুটল। দামের কথা চিন্তা না করেই যে কেউ খেতে পারে এখানে।

Source: indiatimes.com

এবার আসা যাক খাবারের মান প্রসঙ্গে। অনুপ খান্না খাবারের মান ধরে রাখার ব্যাপারে সদা সচেতন। তার রান্না করা খাবারগুলো খেলে বাড়ির রান্না খাওয়ার মতো একটা সুখানুভূতি হয়। রান্নার সময় সবসময় তিনি রান্নাঘরে সশরীরে থেকে তদারকি করে থাকেন।

এমন একটি মহৎ উদ্যোগের ব্যাপারে তার অনুপ্রেরণা কী ছিল, জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,

“ছোটবেলা থেকেই আমি বিভিন্ন সমাজসেবামূলক কাজের সাথে জড়িত। আমার বাবা ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের একজন ছিলেন। তিনি মহাত্মা গান্ধী এবং মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে কাজ করার সুযোগ পেয়েছিলেন। আমিও আমার বাবার মতো জনহিতৈষীমূলক কাজে নিজেকে নিয়োজিত রাখতে চাই।”

এই কাজটি শুরুর কয়েক মাসের মধ্যেই ড্যাডি কি রসুই সকলের কাছে সুপরিচিত হয়ে উঠে। ৫০০ লোকের এই খাবার রান্না করতে তার সব মিলিয়ে প্রতিদিন খরচ পড়ে ২,৫০০ রূপী। অনেকেই স্বেচ্ছায় এই কাজের জন্য দান করতে আগ্রহ প্রকাশ করে থাকে। অনেকে তাদের বিবাহ, জন্মদিন বা বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে এখানে বিভিন্ন রকম খাবার প্রদান করে থাকেন যা অভাবী মানুষগুলোর মাঝে বিলিয়ে দেয়া হয়। নিজস্ব তহবিল ও সকলের সহায়তায় অনুপ খান্না তার এই কাজটি ক্রমাগত করে চলেছেন। শুধু তা-ই নয়, অনুপ খান্না কৃতজ্ঞতার সাথে বলেন,

“দোকানদাররাও আমাকে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে দ্রব্যাদি কেনার সুযোগ দিয়ে থাকেন।” 

Source: thelogicalindian.com

অনুপ খান্নার সমাজসেবা শুধু এতেই সীমাবদ্ধ নেই, তিনি একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোরও শুরু করেছেন, যেখানে স্বল্পমূল্যে গরীবদের জন্য কাপড়-চোপড়, জুতা-স্যান্ডেল ও বই-পুস্তক কেনার সুযোগ রয়েছে।

এবার আসুন ব্যক্তি অনুপ খান্না সম্পর্কে কিছু তথ্য জেনে নেয়া যাক। ৫৭ বছর বয়সী এই প্রবীণের জন্ম ভারতের উত্তর প্রদেশের ছোট শহর মুরাদাবাদে। তিনি মাধ্যমিক দিয়েছেন ডাকপাঠারের একটি স্কুল থেকে। গ্রাজুয়েশনের জন্য ভর্তি হন রোহেলখন্ড ইউনিভার্সিটিতে এবং ১৯৭৮ সালে তিনি গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করেন।

পেশাগত জীবনে তিনি একজন ফার্মেসি রিটেইলার। বর্তমানে নয়ডাতে তার ৪টি ঔষধের দোকান রয়েছে। নয়ডার মানুষ তাঁকে যতটা না ঔষধের দোকানদার হিসেবে চেনে, তার চেয়েও বেশী চেনে একজন বিপদের বন্ধু হিসেবে। কারো বিপদের কথা শুনলে তিনি তার সাধ্যমতো সাহায্য নিয়ে মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়ান।

মানুষের ছোট ছোট পদক্ষেপ সমাজে অনেক বড় পরিবর্তন আনতে পারে। আর এজন্য খুব বেশী কিছুর প্রয়োজন হয় না। ইচ্ছাশক্তি আর চেষ্টা থাকলে কার্য সমাধার রাস্তা আপনাআপনি তৈরি হয়ে যায়। সমাজে অনুপ খান্নার মতো এমন অনেকে আছেন যারা সমাজের সুবিধাবঞ্চিতদের ভাগ্য পরিবর্তনে দিন-রাত কাজ করে যাচ্ছেন। আসুন আমরা তাদের পাশে দাঁড়াই অথবা নিজেরাই একেকজন অনুপ খান্না হয়ে উঠি।

ফিচার ইমেজ: patrika.com

Related Articles