Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আলোচিত-সমালোচিত: বাংলাদেশ ক্রিকেটের ২০১৭

বিখ্যাত কেউ একবার বলেছিলেন, সামনে এগোতে হলে পুরনোকে ঝেড়ে ফেলতে হয়। কিন্তু সেই পুরনোকে আমলে না নিলে আবার হিতে বিপরীতও হতে পারে। সেই পুরনো অতীতেও মিশে থাকতে পারে সোনালী সময়। যেটাকে কেন্দ্র করে সামনের পথ হয় আরও প্রশস্ত, আরও সাবলীল।  ২০১৭ বছরটির পাতা এই মুড়োলো বলে। কিন্তু  নতুন খাতা খোলার আগে পুরনোর হিসাবগুলো না দেখে নিলেই নয়।  ক্রিকেটের বেলাতেও তাই। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মতন বাংলাদেশ জাতীয় দলও বছর জুড়ে ছিল আলোচিত-সমালোচিত, ছিল প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি। বছর শেষ করার আগে তাই মোটাদাগে একটু চোখ বুলানো যাক মাশরাফি-সাকিব-মুশফিকদের পারফরম্যান্স, ক্রিকেট মাঠের বাইরের ক্রিকেটীয় আলোচনা ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) রঙ্গমঞ্চ থেকে।

প্রথম ভারত সফর

ভারতীয় ব্যাটসম্যানকে আউট করার পর উদযাপনে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল; Source: AP

অনেকটা অনুরোধের ঢেঁকি গিলতেই বাংলাদেশকে টেস্ট খেলতে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ভারত। তারপরও সেটা দেশের ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখার মতই ঘটনা। ২০০০ সালে প্রথম টেস্ট এই ভারতের বিপক্ষেই খেলেছিল বাংলাদেশ। কিন্তু কখনও তাদের দেশে বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ জানায়নি। সেটা হল এই ২০১৭ সালে, একটিমাত্র টেস্ট দিয়ে।

হায়দ্রাবাদের সেই টেস্ট জিততে পারেনি বাংলাদেশ। বছরের শুরুতে নিউজিল্যান্ডের ঘরের মাটিতে পাওয়া ব্যর্থতার গ্লানি এখানেও ছিল। দল হেরেছিল ২০৮ রানের বিশাল ব্যবধানে। তারপরও অধিনায়ক মুশফিকুর রহিমের ১২৭ রানের ইনিংস, সাকিব আল হাসানের ৮২ রানের ইনিংস, মিরাজ- মাহমুদউল্লাহর হাফ সেঞ্চুরি প্রাপ্তির খাতায় কিছুটা হলেও ঘষামাজা করতে পেরেছিল

মুশফিকদের শততম টেস্ট জয়

নিজেদের শততম টেস্ট জয়ের পর উদযাপনে মুশফিকুর রহিম ও সৌম্য সরকার; Source: AFP

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সাদা পোশাকে দুই টেস্টের মিশন। প্রথম টেস্টে হারল বাংলাদেশ ২৫৯ রানের ব্যবধানে।কিন্তু দ্বিতীয় টেস্টে মানসিকভাবেই আমূল বদলে গেল পুরো দল। কারণ এটি দেশের ১০০তম টেস্ট ম্যাচ। জয়টা যে খুবই জরুরী! কিন্তু শ্রীলঙ্কার মতন শক্তিশালী দলের বিপক্ষে তাদেরই ঘরের মাঠে ব্যাপারটা সহজ ছিল না। তারপরও অনেকটা  অসম্ভবকে সম্ভব করে ছেড়েছিল মুশফিকবাহিনী। তামিম-মোসাদ্দেকের হাফ সেঞ্চুরি, সাকিব আল হাসানের সেঞ্চুরির পাশাপাশি দুই ইনিংসে ছয় উইকেট, মিরাজ-মুস্তাফিজদের তোপ; সব মিলিয়ে কলম্বোয় দিশেহারা লঙ্কান ক্রিকেট দল। ফলাফল? শুধুমাত্র শততম টেস্টেই জয় পায়নি বাংলাদেশ, প্রথমবারের মতন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও টেস্ট জিতেছে। সেটাও লঙ্কানদের মাটিতেই। ইতিহাসের সাক্ষী হয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের প্রত্যেক সদস্য, এমনকি সমর্থকরাও।

কিন্তু এই টেস্ট জয়ের আগে বিসিবির খানিক আক্ষেপ ছিল দলকে সংবর্ধনা দেওয়া নিয়ে। উহু, আগের ম্যাচে হারের কারণে নয়। দেশের হয়ে ১০০তম টেস্ট খেলতে যাচ্ছে ক্রিকেটাররা, তাই ছোটখাট একটু আয়োজন না করলেই যেন নয়। কিন্তু বিদেশ বিভূঁইয়ে সেটা কিভাবে সম্ভব? বিসিবিকে অবাক করে দিয়ে ক্রিকেটীয় ‘স্পিরিট’ হয়ে এগিয়ে এল শ্রীলঙ্কা ক্রিকেট (এসএলসি)। ম্যাচ শুরুর আগে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে উপহার দিল বিশেষ স্যুট, মেডেল আর ক্রেস্ট। বিসিবির কর্মকর্তাদেরও দাওয়াত দেওয়া হয়েছিল। সবকিছু মিলিয়েই মনে রাখার মতো হল বাংলাদেশের শততম টেস্ট ম্যাচটি।

শোকেস বন্দী মাশরাফির টি-টোয়েন্টি জার্সি

ক্যারিয়ারের শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ম্যাচের পর মাশরাফি বিন মুর্তজা; Source: AP

টসে নেমে মাইক্রোফোনে বলে দিলেন, এটাই টি-টোয়েন্টিতে তার শেষ ম্যাচ। বাংলাদেশের জার্সিতে আর এই ফরম্যাটে খেলবেন না তিনি। মাশরাফি বিন মুর্তজার কন্ঠে সেদিন অভিমান ছিল। নাটকীয় এই বিদায়ের পিছনে সবচেয়ে প্রভাব ছিল সদ্য সাবেক কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের। তরুণ নির্ভর দল গড়তে গিয়ে আকার ইঙ্গিতে মাশরাফির গলায় করাত ধরলেন। বোর্ডকে জানালেন, তরুণ ক্রিকেটারেই আগ্রহ বেশি তার। এ নিয়ে শ্রীলঙ্কায় বসেও বোর্ড-কোচ-মাশরাফির বৈঠক হল।  সেখানেও যেন মাশরাফিকে সরেই যেতে বলা হল। এরপর আর ভাবতে সময় নেননি বাংলাদেশের কিংবদন্তী এই ক্রিকেটার। বিদায় বলে দিয়েছেন বাংলাদেশের হয়ে ২০ ওভারের ম্যাচকে।

কিন্তু তার অবসরে যে চাপে পড়েছিল বিসিবি সেটাও মনে রাখার মতন। মাশরাফির শেষ ম্যাচে জয় এনেছিল সাকিব-মুশফিকরা। সব মিলিয়ে বিমানবন্দরে হাজির বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন। সংবাদ সম্মেলনে তার দাবী, মাশরাফি টি-টোয়েন্টির অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন, ফরম্যাট নয়। কিন্তু যত যা-ই বলুন তিনি, মাশরাফি নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে দাঁড়াননি।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বাজিমাত

কার্ডিফে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর; Source: AFP

ওয়ানডে র‍্যাংকিংয়ের সেরা আট দলে থেকে প্রথমবারের মতন চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে জায়গা করেছিল বাংলাদেশ এই ২০১৭ সালেই। সে এক অন্যরকম রোমাঞ্চ। সেই ‘প্রথম’টাও হয়েছে মনে রাখার মতো। আয়ারল্যান্ড-নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলা। সেখানে সাফল্য হিসেবে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে জয় পাওয়া। সেই ধারাবাহিকতা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির মাঠেও। আবারও বাংলাদেশের বিপক্ষে হারে নিউজিল্যান্ড। এরপর অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে বৃষ্টিবিঘ্নিত ম্যাচ ড্র করে সেমিফাইনালে জায়গা করে নেয় লাল-সবুজ জার্সিধারীরা। এই গর্বের সঙ্গে অন্য কিছুর তুলনা হয় না।

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ব্যর্থতার স্বাদও নিতে হয়েছে মাশরাফি বিন মুর্তজার দলকে। ফাইনালে ওঠার লড়াইয়ে ভারতের বিপক্ষে হেরে দেশে ফিরতে হয়েছে।

একটি উত্তপ্ত সংবাদ সম্মেলন ও মুমিনুলের ফেরা

মুমিনুল হক; Source: AFP

ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়া টেস্ট খেলতে আসবে। তাই দল ঘোষণা করতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচকসহ নির্বাচক প্যানেলের সদস্যরা। যেখানে কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহেও রয়েছেন। তিনিও আসলেন। কিন্তু বিপত্তি হল, যখন দলে মুমিনুল হকের নাম পাওয়া গেল না। অর্থাৎ, দেশের অন্যতম সেরা টেস্ট ব্যাটসম্যান হয়েও সুযোগ পাননি তিনি! সেবার মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট দলের সংবাদ সম্মেলন কক্ষ যেন প্রশ্নবানের রণক্ষেত্র হয়ে উঠেছিল। সাংবাদিকদের প্রশ্নের তোপে পেরে উঠছিলেন না প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু। খানিকটা চটে গিয়ে বলেই দিলেন, মুমিনুলকে সরানোর সিদ্ধান্ত তাদের নয়, বরং কোচের!

সব মিলিয়ে ২৫-২৭টি প্রশ্ন করা হয়েছিল নির্বাচক প্যানেলকে, যার মধ্যে দুই-তিনটি ছাড়া সবগুলোই মুমিনুল কেন্দ্রিক। এটাও কম রেকর্ড নয়! আশার খবর হল, পরবর্তীতে মোসাদ্দেক হোসেন সৈকতকে সরিয়ে মুমিনুল হককে জায়গা দেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়া সিরিজের জন্য।

ইতিহাসের পাতায় অস্ট্রেলিয়া বধ

অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ঐতিহাসিক টেস্ট জয়; Source: Getty Images

১১ বছর পর ২০১৭ সালে টেস্ট খেলতে বাংলাদেশে সফর করেছিল অস্ট্রেলিয়া। স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নারদের মতো শক্তিশালী ক্রিকেটারদের নিয়ে তৈরি অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে এমনিতেও কাগজে-কলমে পিছিয়ে ছিল বাংলাদেশ। সঙ্গে অতীতের দুঃস্মৃতি তো একরকম বিভীষিকা। কিন্তু এসব ‘বাণী’ একপাশে রেখে অজিদের মুদ্রার ওপিঠ চিনিয়েছিলেন মুশফিকুর রহিম ও তার দল। প্রথমবারের মতো টেস্ট জিতেছিলেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। সাকিব আল হাসানের ১০ উইকেটের সঙ্গে হাফ সেঞ্চুরি আর তামিম ইকবালের জোড় হাফ সেঞ্চুরি (৭১ ও ৭৮) অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে জয় এনে দেয় বাংলাদেশকে। মিরপুর শেরে বাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামের সেই ম্যাচে টেস্ট ক্রিকেটের নতুন ইতিহাস রচনা করে বাংলাদেশ।

একটি কথা মনে করিয়ে দেওয়া উচিত। এই সফরটি ২০১৫ সালেই হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেবার নিরাপত্তাজনিত কারণে শেষ মুহূর্তে বাংলাদেশ সফর থেকে সরে দাঁড়ায় ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া (সিএ)।

হেড কোচের পদত্যাগ

সাব্বির রহমানের সঙ্গে চান্দিকা হাতুরুসিংহে; Source: Getty Image

বছরের শেষ সফরে দক্ষিণ আফ্রিকায় ভরাডুবি। আর সেখানেই দলের কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহের পদত্যাগ। সেটা নিয়েও কম নাটক হয়নি হাতুরুসিংহে-বিসিবির মধ্যে। দক্ষিণ আফ্রিকা থেকেই পদত্যাগপত্র বিসিবির কাছে পাঠিয়েছিলেন লঙ্কান কোচ। কিন্তু হুট করে দায়িত্ব ছাড়ায় সহজভাবে মেনে নিতে পারেনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সংস্থা। তাই বাংলাদেশে এসে আলোচনায় বসতে অনুরোধ করা হল তাকে। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ততক্ষণে নিজের দেশ শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের কোচ হিসেবে নিয়োগ নিতে যাচ্ছেন। আলোচনাও প্রায় শেষ, শুধু দায়িত্ব নেওয়া বাকি। এদিক তো বিসিবি চেঁচিয়ে সাড়া করেছে।

অনেকটা যেন ইচ্ছের বিরুদ্ধেই শেষপর্যন্ত ঢাকায় এসেছিলেন হাতুরুসিংহে। বোর্ড কর্তাদের সঙ্গে বৈঠকের পর সংবাদ সম্মেলনে দায় দিয়ে গিয়েছিলেন দলের জ্যৈষ্ঠ ক্রিকেটারদের উপর। সাকিবের বিশ্রাম নেওয়া, ড্রেসিংরুমে তার কথা শুনতে না চাওয়ার মতন ‘আজগুবি’ সব অভিযোগ দিয়ে বাংলাদেশ ছাড়েন শ্রীলঙ্কা জাতীয় দলের সাবেক এই ওপেনার।

ও হ্যাঁ, এখন তিনি শ্রীলঙ্কা জাতীয় ক্রিকেট দলের কোচ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।

মাশরাফি শিরোপার রেকর্ড

দলের সঙ্গে উদযাপনে মাশরাফি বিন মুর্তজা; Source: Daily Star

মাসখানেকের ব্যবধানে দুইবার আলোচনায় মাশরাফি। কোচের চক্ষুশূল হয়ে বাংলাদেশের জার্সিতে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে অবসর নিলেন। এরপর বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) রংপুর রাইডার্সের হয়ে টুর্নামেন্ট জিতলেন, যেন জবাব দিলেন। সঙ্গে আগের বছর কুমিল্লা ভিক্টোরিয়ান্সের হয়ে খেলতে গিয়ে যে ব্যর্থতার ঘোরটোপে পড়েছিলেন, সেখান থেকেও বের হয়ে এলেন, গড়লেন রেকর্ড। অধিনায়ক হিসেবে টুর্নামেন্টের পাঁচ আসরের চারটি শিরোপাই বগলদাবা করলেন মাশরাফি।

অবশ্য তার সঙ্গে যুদ্ধক্ষেত্রে যোগ দিয়েছিলেন ব্রেন্ডন ম্যাককালাম, ক্রিস গেইল, রুবেল হোসেন, নাজমুল হাসান অপু আর মোহাম্মদ মিঠুনের মতো দেশি-বিদেশি তারকারা। বাংলাদেশের হয়ে শেষ টি-টোয়েন্টিতে জয়ের পর যেভাবে দুহাত আকাশে তুলে দিয়েছিলেন, বিপিএলেও সেই পুনরাবৃত্তি করলেন। যেন নিজের ‘টেম্পারমেন্ট’ বুঝিয়ে দিলেন বাংলাদেশের সফলতম এই অধিনায়ক, রাঙিয়ে দিলেন বছরের শেষটা।

ফিচার ইমেজ- AFP

Related Articles