Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কলকাতা মেট্রোতে যুগলকে আলিঙ্গন করার ‘অপরাধে’ পেটানো: এই কি পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি?

গত ৩০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতার মেট্রোতে এক যুগলকে প্রকাশ্যে আলিঙ্গন করার ‘অপরাধে’ গণপিটুনি দেন বেশ কিছু অভিভাবক-স্থানীয় মানুষ, যাদেরকে কোনোভাবেই ‘অশিক্ষিত’ বলা চলে না। নবীন পুরুষ সঙ্গীটি তো বটেই, ভারতের সাংস্কৃতিক পীঠস্থানের এই ‘নৈতিক আইনরক্ষকদের’ রোষ থেকে পার পাননি তার সঙ্গী নারীও। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ধিক্কার ওঠে শহর-রাজ্য এমনকি দেশেরও নানা প্রান্তে। ওই যুগলের উপরে চড়াও হওয়া প্রৌঢ়দের প্রবল সমালোচনা করে বলা হয় যে তারা বিকৃতমনষ্ক, যৌন ঈর্ষায় ভোগেন, সাংস্কৃতিক অর্থে দ্বিচারিতা করেন, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে পারেন না ইত্যাদি।

কলকাতা মেট্রোতে সম্প্রতি এক যুগলের উপরে চড়াও হন বেশ কিছু বয়স্ক মানুষ; কারণ? তারা নাকি প্রকাশ্যে সৌজন্যতার সীমা লঙ্ঘন করছিল; Source: Times of India

এই প্রসঙ্গে বলি, গত বছরের মাঝামাঝি যখন আমি ইউরোপের অন্যতম বড় সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগে একটি সাংবাদিক সম্মেলনে যোগ দিতে যাই, সেখানে এই প্রকাশ্য আলিঙ্গনের দৃষ্টান্ত আমার চোখ এড়ায়নি। এক যুগলকে তো দেখেছিলাম এয়ারপোর্টের বাইরে অনেকক্ষণ ধরে চুম্বন করতে- হয়তো তারা একে অপরকে ছেড়ে অনির্দিষ্টকালের জন্যে থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কিন্তু সেই দৃশ্য দেখে কাউকে খড়গহস্ত হতে দেখিনি। দুজন মানুষের চূড়ান্ত ঘনিষ্ঠ মুহূর্তকে বিঘ্নিত করার কুমতলব কারও মাথায় আসেনি, আর তার কারণটা লুকিয়ে রয়েছে তাদের ব্যাক্তিস্বাধীনতার সংস্কৃতির ভিতরে।

ব্যক্তি স্বাধীনতার মর্মার্থ এখনও আমাদের কাছে অধরা; আমরা বুঝি দল

উদারবাদী সমাজের এই গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিটি আমাদের এদিককার দুনিয়ায় এখনও পোক্ত নয়। মুখে বলি অনেক কিছুই, কিন্তু করে দেখাই তার সিকিভাগ বা তারও কম। কলকাতার মেট্রোর ঘটনাটিও তার অন্যথা নয়।

আজকের পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে হয়তো এর মধ্যে পুরুষতান্ত্রিক হিন্দুবাদীদের দৌরাত্ম্য ইত্যাদির প্রসঙ্গও উঠবে, কিন্তু এই সমস্যার মূলে রাজনীতির চেয়ে অনেক বেশি দায়ী সমাজজীবনের ব্যর্থতা- চিন্তাভাবনার ব্যর্থতা, সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারার ব্যর্থতা, দিগভ্রষ্ঠ অভিভাবকত্বের ব্যর্থতা।

চেক প্রজাতন্ত্রের রাজধানী প্রাগের ঠাকুরোভাতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বক্ষাবয়ব মূর্তি; বিশ্ববন্দিত এই কবি এবং মানবতাবাদী মহর্ষির পরিচয় ছিল তার উদারবাদী মননের জন্যে; পশ্চিমবঙ্গের আজকের বাঙালিরা তাকে বাহ্যিক সম্মান দেখালেও তারা সত্যি কতটা নিতে পেরেছে তার দীক্ষা? © Shubham Ghosh

সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ মানে শুধু ভালো গাইয়ে, আঁকিয়ে, কবি বা সংগীতশিল্পী হওয়া নয়। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের মধ্যে সমাজের সামগ্রিক উন্নয়নার্থে নতুন দিশা দেখানোর কাজটিও পড়ে। সেখানে স্থবিরতা মানে সোজাসুজি পরাজয় আর বঙ্গসমাজের হোতারা ব্যর্থ এখানেই। আর এই ব্যর্থতা স্রেফ আজকের নয়, চিরকালীন। যদি সত্যিই বাঙালি জাতি সাংস্কৃতিকভাবে সচেতন হতো, সার্বজনীন রেঁনেসার পূজারী হতো, তবে রামমোহন বা বিদ্যাসাগর মহাশয়কে অত লড়াই লড়তে হতো না- তারা পায়ের উপরে পা তুলে দিব্যি রাজস্ব বা মাসমাইনেতে দিন গুজরান করে দিতে পারতেন। কিন্তু সেই মহাপুরুষরা বুঝেছিলেন যে, এই জাতির দুর্দশা কাটাতে হলে সমাজ সংস্কার করা আশু প্রয়োজন। আর তাই নানা বাধা-প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা নিজেদের লক্ষ্য থেকে সরে আসেননি। একই কথা খাটে রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রেও। এখন আমরা তাকে দেবতার আসনে ঠাঁই দিয়েছি বটে, কিন্তু একথা ভোলার নয় যে জীবনের নানা উদ্যোগের পথে তিনি কম আঘাত পাননি। আর এই আঘাত এসেছে তার নিজের সমাজের পক্ষ থেকেই।

পশ্চিমবঙ্গের স্থবির রাজনীতি, সমাজনীতি

অতএব বাঙালির ‘এগিয়ে থাকার’ সুনামকে সরিয়ে রেখেই কলকাতা মেট্রোর ঘটনাটির বিশ্লেষণ করার প্রয়োজন। বলা হয় বাঙালি অন্যান্য অনেক জাতির চেয়েই অগ্রসর বেশি- পড়াশোনায়, চিন্তাভাবনায়। একথা আংশিক সত্য। আসলে বাঙালির এই বাইরের খোলসটি তৈরি করেছে বিগত দিনের একটি রাজনীতি-কেন্দ্রিক সমাজনৈতিক পরিচয়।

ভদ্রলোক শ্রেণী দ্বারা লালিত বাঙালির রাজনীতি-সমাজনীতিতে একধরনের সবজান্তা-নৈতিকতাবাদী ‘এলিটিজম’ অনেক দিন ধরেই তৈরি হয়েছে। সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত পরিণত বয়স্ক শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বা উচ্চ-মধ্যবিত্ত এই শ্রেণী স্বাধীনতার পর থেকে পশ্চিমবঙ্গে তৈরি করেছে এই এলিটিজম, যা সময়ের সাথে সাথে এক অন্তঃসারশূন্য গর্বে পর্যবসিত হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে সমাজনীতি-অর্থনীতি-ব্যক্তিগত জীবনদর্শনে যে স্থবিরতা প্রত্যক্ষ করা যায়, তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক; রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বংশধর বলে যে গর্ব পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি করে তার সঙ্গে এই এই স্থবিরতা সর্বরূপেই বেমানান; Source: News18.com

প্রথমে কংগ্রেস এবং পরে বামপন্থীদের রাজত্বকালে বাঙালির রাজনৈতিক দর্শনের ক্রমেই অবক্ষয় হয়েছে, তার আর্থ-সামাজিক জীবনে এক ভয়ঙ্কর স্থবিরতা এসেছে এবং সর্বোপরি এর ফলাফল হয়েছে এক চূড়ান্ত হীনমন্যতার উন্মেষ। কলকাতার মেট্রোতে যে প্রৌঢ়রা ওই কমবয়সী যুগলকে মারলেন, তারা এই হতাশাপূর্ণ অতীতেরই প্রতীক। এরা কোনোদিনই পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারেননি, এদিনও পারলেন না।

প্রজন্মগত ব্যবধান ঘুচে যাবার নয়

বিশ্বময় উদারবাদের আগমনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবনযাত্রার অনেক মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। পঞ্চাশ বা ষাটের দশকে যেভাবে সমাজজীবনকে দেখা হতো, আজ আর তা সম্ভব নয়। অর্থনীতি মানুষের জীবনের মূল চালিকাশক্তি আর এখানেই এই বিগতযৌবনের প্রৌঢ়-বৃদ্ধদের জীবনের সঙ্গে আজকের নবীন প্রজন্মের জীবনের গুণগত ফারাক। বলা চলে অনন্ত ফারাক।

কিন্তু এর জন্যে তো কোনো ব্যক্তিবিশেষকে অধম আখ্যা দেওয়া চলে না, বা তার উপর চড়াও হয়েও চলে না। মূল্যবোধের তফাৎ যদি সত্যি বড় হয়ে থাকে তবে সেখানে নবীন এবং প্রবীণের মধ্যে এক বোঝাপড়া প্রয়োজন। অভিভাবকত্বের দোহাই দিয়ে দলগত অভব্যতা কোনো সভ্য সমাজে মেনে নেওয়া চলে না। তবে আমরা এখনও কতটা সভ্য, তা ঠিক করতে হবে আমাদেরকেই।

কিন্তু বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বের কথাও তো হতাশাজনক

একথা অস্বীকার করার জো নেই যে, আজকের পশ্চিমবঙ্গে এই অন্তঃসারশূন্য ভদ্রলোক-কেন্দ্রিক সংস্কৃতি অনেকটাই স্তিমিত। কংগ্রেস এবং পরে বামপন্থীদের দীর্ঘ ক্ষমতার অবসানের সঙ্গে সঙ্গে এই সাদা বস্ত্রাদি পরিহিত বাঙালিরা আজকে প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, তাদের প্রস্থানের পরে যারা এসেছে তারা আরও ভয়ানক। তাদের রাজনীতির প্রাথমিক পাঠ সেই ভদ্রলোক শ্রেণীর শেষ বংশধরদের কাছেই; কিন্তু তাদের চিন্তাভাবনা আরও সংকীর্ণ, আতঙ্ক সৃষ্টিকারী। বছর পাঁচেক আগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়- যিনি নিঃসন্দেহে বর্তমান যুগে ভারতে বাঙালির প্রধান রাজনৈতিক মুখ- মন্তব্য করেছিলেন যে, আজকাল ধর্ষণের কাণ্ড বেশি ঘটছে কারণ এখনকার ছেলেমেয়েরা অবাধ মেলামেশা করে!

পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়; Source: Author: Biswarup Ganguly; Wikimedia Commons

আবার তার সাত-বছর ব্যাপী সরকারের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্প্রতি বলেন যে, সমকামিতা বঙ্গীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী এবং সরকার তা রাজ্যের বিদ্যালয়গুলিতে কখনোই অনুমোদন করবে না।

অর্থাৎ, আমাদের বর্তমান রাজনৈতিক নেতৃত্বই যখন “এটা আমাদের সংস্কৃতি নয়” বলে নিদান দেন তখনই বোঝা যায়, তাদের নিজেদের মানসিকতাই কতটা সংকীর্ণ এবং ভ্রান্ত। আর বৃহত্তর সমাজ তো এই নেতৃত্বেরই প্রতিফলন ঘটায়। সেখানে দুজন ব্যক্তির স্বাধীনতাকে যে একদল সংকীর্ণ মানসিকতার মানুষ একসঙ্গে আক্রমণ করে তার টুঁটি চেপে ধরবে, তাতে আর সন্দেহ কী- বিশেষ করে এই বঙ্গসমাজে।

পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়; Source: Author: WBsea; Wikimedia Commons

পাশের বাড়িতে একা থাকা মেয়েটির বাড়িতে কে এসেছে, কাদের বাড়িতে ক’জন পাত পেড়ে খায় একসঙ্গে, এইসব নিয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির কৌতূহল নতুন কিছু নয়। বা বলা চলে, প্রাচীনপন্থী যারা ভারতে যারা আজও বেঁচেবর্তে রয়েছেন, তাদের মধ্যে এমনতরো চিন্তাভাবনা নতুন নয়। কিন্তু সমস্যা তখনই বড় হয়, যখন এই হস্তক্ষেপ ভদ্রতা-সৌজন্যতার সীমা ছাড়িয়ে  সোজা মানুষের সম্মানকে বিদীর্ণ করে। তা ঘটতে দেওয়া মোটেই কাঙ্ক্ষিত নয়। কলকাতা মেট্রোর ঘটনাটি লজ্জাজনক, কলঙ্কময় তো বটেই, সঙ্গে সঙ্গে এক বিপদের বার্তাও বহন করে আনে। ভয়টা সেখানেই।

Featured Image Source: DNA India

Related Articles