Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জর্ডান সংকট: কী ঘটছে, কেন ঘটছে?

গত বুধবার থেকে জর্ডানে হাজার হাজার মানুষ রাজপথে নেমে এসেছে। দীর্ঘ কয়েক দশকের মধ্যে এটি জর্ডানের সবচেয়ে বড় আন্দোলন। আন্দোলন যদিও শান্তিপূর্ণ ছিল, কিন্তু দাবির মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন জর্ডানের প্রধানমন্ত্রী হানি আল-মুলকি। কিন্তু কেন এ আন্দোলন? কী দাবি আন্দোলনকারীদের? কোন দিকে যাচ্ছে জর্ডানের ভবিষ্যৎ? এসব নিয়েই আমাদের আজকের বিশ্লেষণ।

কেন এ আন্দোলন?

জর্ডান মধ্যপ্রাচ্যের অপেক্ষাকৃত দরিদ্র রাষ্ট্রগুলোর একটি। দেশটির প্রাকৃতিক সম্পদ অত্যন্ত সীমিত। এর অর্থনীতি মূলত বিদেশী ঋণ এবং সাহায্যের উপর নির্ভরশীল। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ঋণ এবং সহায়তা আসে সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংগঠন থেকে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব জর্ডানকে সাহায্য দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের UNRWA তহবিলে বরাদ্দকৃত অর্থের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়ায় তার প্রভাবও এসে পড়েছে জর্ডানে, যেহেতু ফিলিস্তিনি শরনার্থীদের একটি বড় অংশের বাস জর্ডান সীমান্তের অভ্যন্তরে।

ইরাক এবং সিরিয়ার দীর্ঘমেয়াদী গৃহযুদ্ধও জর্ডানের অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। জর্ডানের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্কের সুবাদে ইরাক, তুরস্কসহ আশেপাশের দেশগুলোর সাথে ইসরায়েলের বাণিজ্যের অধিকাংশই সম্পন্ন হতো জর্ডানের উপর দিয়ে। গৃহযুদ্ধের ফলে এসব ব্যবসা-বাণিজ্যের অধিকাংশই হুমকির মুখে পড়েছে। এছাড়াও সিরিয়া থেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে আসা শরণার্থীর চাপও সামলাতে হচ্ছে জর্ডানকে। ফলে জর্ডানের অর্থনৈতিক অবস্থা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ক্রমেই খারাপ হচ্ছিল।

সরকারি হিসেবেই জর্ডানে বেকারত্বের হার ১৮ শতাংশ এবং ধারণা করা হয় যুবকদের মধ্যে বেকারত্বের প্রকৃত হার এর দ্বিগুণ। শুধুমাত্র ২০১৮ সালেই জ্বালানী তেলের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে পাঁচবার, বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে ৫৫ শতাংশ। দ্য ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জর্ডানের রাজধানী আম্মান আরব বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরগুলোর মধ্যে একটি। প্রধানমন্ত্রী হানি আল-মুলকি ২০১৬ সালে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকেই দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। কিন্তু তার পদক্ষেপগুলো দেশের সাধারণ মধ্যবিত্ত জনগণের উপরই বোঝা হয়ে উঠেছে

এরকম পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী মুলকির সর্বশেষ পদক্ষেপ আয়কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের পরেই মূলত জর্ডানের জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। গতমাসে জর্ডানের সরকার নতুন একটি আয়কর আইনের প্রস্তাব করে। এটি ছিল ২০১৬ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, IMF থেকে জর্ডানের ৭২৩ মিলিয়ন ডলার ক্রেডিট লাইন গ্রহণের প্রেক্ষিতে তাদের সুপারিশে গৃহীত অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচির একটি অংশ। নতুন এই আইনের আওতায় করদাতা নাগরিকের সংখ্যা ৪.৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ১০ শতাংশ হওয়ার কথা আছে এবং পূর্বের তুলনায় অনেক কম আয়ের জন্যই আয়কর প্রদানের প্রস্তাব করা হয়েছে।

কারা আন্দোলন করছে?

জর্ডানের এ আন্দোলনে সর্বস্তরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। তবে আন্দোলনের ডাক দিয়েছে ‘হারাক শাবাবি’ তথা যুব আন্দোলন নামের একটি সংগঠন। তাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছে দেশটির ৩৩টি পেশাজীবী এবং নাগরিক সংগঠন। এদের মধ্যে আছে জর্ডান’স ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশন এবং জর্ডানিয়ান টিচার্স সিন্ডিকেটের মতো দেশব্যাপী বিস্তৃত সংগঠনগুলো, যাদের সদস্য সংখ্যা তিন লক্ষাধিক বলে ধারণা করা হয়। দেশজুড়ে মোট আন্দোলনকারীর সংখ্যা প্রায় দুই লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে বলে অনুমান করা হয়।

সরকার কী পদক্ষেপ নিয়েছে?

জর্ডানে যদিও আইন প্রণয়নের জন্য দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট সংসদ এবং দেশ পরিচালনার জন্য সরকার দায়ী থাকে, কিন্তু যেকোনো বিষয়ে চূড়ান্ত ক্ষমতা নেওয়ার অধিকার রাখেন দেশটির রাজা। তবে জর্ডানের রাজ পরিবার অতীতেও গণআন্দোলনের মুখে সহিংস প্রতিক্রিয়ার পরিবর্তে জনগণের দাবি আংশিক মেনে নেওয়ার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ১৯৮৯ সালে জনগণ যখন এরকম রাজপথে নেমে এসেছিল এবং প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ, জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সূচনা প্রভৃতির দাবি তুলেছেল, তখন তৎকালীন বাদশাহ হুসেইন তাদের প্রায় সব দাবিই মেনে নিয়েছিলেন।

এবারও শুরু থেকেই আন্দোলনও মোটামুটি শান্তিপূর্ণ ছিল, এবং পুলিশের আচরণও অসহিংস ছিল। গত সোমবার যুবরাজ আব্দুল্লাহ বিন হুসেইন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সামনের প্রতিবাদস্থলে গিয়ে নিরাপত্তাকর্মীদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি জনগণকে মতপ্রকাশের সুযোগ দেওয়ার জন্য এবং তাদেরকে রক্ষা করার জন্য নিরাপত্তাকর্মীদেরকে নির্দেশ দেন। এই আন্দোলনে এখন পর্যন্ত কোনো মৃত্যুর সংবাদ আসেনি। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, তারা ৬০ জন আন্দোলনকারীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং এখন পর্যন্ত ৪২ জন নিরাপত্তাকার্মী আহত হয়েছে।

জনগণের আন্দোলনের মুখে জর্ডানের বাদশাহ আব্দুল্লাহ বিন হুসেইন তার পরিকল্পিত বিদেশ সফর বাতিল করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রী হানি আল-মুলকিকে গত সোমবার তার হুসেইনি রাজপ্রাসাদে ডেকে পাঠান। সেখানেই প্রধানমন্ত্রী বাদশাহর কাছে তার পদত্যাগপত্র জমা দেন। এর পূর্বে জর্ডানের পার্লামেন্টের ৫৭ জন সদস্য বাদশাহর কাছে লেখা একটি চিঠিতে প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করার আহ্বান জানান। সোমবার বিকেলে বাদশাহর কার্যালয়ের পক্ষ থেকে হানি আল-মুলকির পদত্যাগপত্র গ্রহণ করার তথ্য নিশ্চিত করা হয় এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শিক্ষামন্ত্রী ওমর রাজ্জাজকে দায়িত্ব দেওয়া হয়।

কী ঘটতে পারে ভবিষ্যতে?

প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলেও আন্দোলনকারীরা এখনও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তাদের মতে, তারা শুধু চেহারার পরিবর্তন না, বরং নীতির পরিবর্তন চায়। ইনকাম ট্যাক্স আইন বাতিল না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছে। একইসাথে তারা রুটি এবং জ্বালানী তেলের উপর ভর্তুকি পুনর্বহালের দাবি জানিয়েছে। অনেকে সংসদ ভেঙে দিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনেরও দাবি জানিয়েছে।

তবে জর্ডানের এই আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য হলো, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীসভা, সরকার কিংবা শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হলেও এখন পর্যন্ত প্রতিবাদকারীরা বাদশাহর পতন কিংবা রাজতন্ত্রের অবসান চায়নি। বরং আন্দোলনকারীদের অনেকেই এখনও বাদশাহকে দেশের ঐক্যের প্রতীক হিসেবেই দেখছে। ফলে জর্ডানের পরিস্থিতি আরব বসন্তের গণআন্দোলনের মুখে পড়া অন্যান্য দেশের পরিস্থিতির সাথে তুলনীয় না। কিন্তু জর্ডানের অর্থনৈতিক বাস্তবতায় বাদশাহ তার জনগণকে কতদিন পর্যন্ত সন্তুষ্ট রাখতে পারবেন, সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

মানুষ নতুন প্রধানমন্ত্রী ডঃ ওমর রাজ্জাজকে কতটুকু গ্রহণ করবে, সেটিও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। ওমর রাজ্জাজ একজন সাবেক বিশ্বব্যাংকের অর্থনীতিবিদ। দেশে সর্বশ্রেণীর জনগণের মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতাও আছে। কিন্তু তিনি নিজেই মুলকির সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন। ফলে তার গ্রহণযোগ্যতা কিছুটা হলেও প্রশ্নবিদ্ধ হতে পারে। তবে শেষপর্যন্ত সবকিছু হয়তো নির্ভর করবে নতুন সরকারের, বাদশাহর এবং সর্বোপরি প্রতিবেশী আরব রাষ্ট্রগুলোর এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ জর্ডানের পশ্চিমা মিত্রদের সিদ্ধান্তের উপর।

জন্মলগ্ন থেকেই জর্ডান ব্রিটেন এবং আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র। যদিও তারা বিভিন্ন সময় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, কিন্তু তারপরেও তাদের সাথে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সুসম্পর্ক আছে। অন্যদিকে জর্ডানে বিপুল সংখ্যক ফিলিস্তিনি শরণার্থীর বসবাস। ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংক্রান্ত অনেক সমস্যাতেই জর্ডানকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে ভূমিকা নিতে দেখা যায়। জর্ডানের স্থিতিশীলতা তাই সবার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। জর্ডানের এই আন্দোলনের ভবিষ্যতের চাবি তাই অনেকটাই তার পশ্চিমা এবং সৌদি আরবসহ স্থানীয় আরব মিত্রদের হাতে। তারা চাইলেই নিজেদের এবং আরব বিশ্বের স্থিতিশীলতার স্বার্থে অর্থনৈতিক সাহায্যের মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধান করতে পারে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে জর্ডান জেরুজালেম প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অনড় অবস্থান নেওয়ার পরেও কি তারা জর্ডানকে পূর্বের মতো সহযোগিতা করবে? এ প্রশ্নের উত্তরের উপরই নির্ভর করবে জর্ডানের ভবিষ্যৎ।

Featured Image Source: المثنى الغزاوي

Related Articles