Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফ্রান্স ও জার্মানির সরকারপ্রধানের যুক্তরাষ্ট্র সফর: ইরান পরমাণু চুক্তির ভবিষ্যৎ কী?

২০১৫ সালে সাত দেশের (ইরান, নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য এবং জার্মানি) মধ্যে স্বাক্ষরিত হয়েছিল সম্মিলিত সর্বাঙ্গীন কর্ম পরিকল্পনা (Joint Comprehensive Plan of Action, JCPOA) চুক্তি, সাধারণভাবে যা ইরান নিউক্লিয়ার ডিল নামে পরিচিত। ঐ চুক্তির উপর বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছিল আমাদের পূর্ববর্তী একটি লেখায়। চুক্তিটির ফলে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের প্রচেষ্টা বন্ধ করে দেয় এবং বিনিময়ে ইরানের উপর থেকে বিভিন্ন ধরনের অবরোধ উঠিয়ে নেওয়া হয়।

চুক্তিটিকে বিশ্ব শান্তির পথে এক বড় ধরনের অগ্রযাত্রা হিসেবে দেখা হলেও, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এর চরম বিরোধী। তিনি চুক্তিটিকে সর্বকালের সেরা বাজে চুক্তি হিসেবে অভিহিত করেছেন। সম্প্রতি তিনি হুমকি দিয়েছেন, আগামী মে মাসের ১২ তারিখের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর এই চুক্তি মেনে চলবে না। ফলে বিশ্ব কি আবারও নতুন এক পারমাণবিক সংকটের দ্বারপ্রান্তে উপস্থিত হতে যাচ্ছে কিনা, সেটাই এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সম্প্রতি ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাঁক্রো যে তিন দিনের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফর সম্পন্ন করেছেন, তার পেছনেও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে পারমাণবিক চুক্তিটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার ব্যাপারে প্ররোচিত করার চেষ্টা করা। কিন্তু কেন ট্রাম্প চুক্তিটি বাতিল করতে চাচ্ছেন? তার পক্ষে-বিপক্ষে কারা আছে? কী হতে পারে এই চুক্তির ভবিষ্যৎ? এ নিয়েই আমাদের আজকের বিশ্লেষণ।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের অভিযোগ, ইরান নিউক্লিয়ার ডিলের মাধ্যমে ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র নির্মাণের উপর শুধুমাত্র ১০ থেকে ১৫ বছরের নিষাধাজ্ঞা আরোপ করা সম্ভব হয়েছে, কিন্তু ব্যালিস্টিক মিসাইলসহ অন্যান্য অস্ত্র নির্মাণের বিরুদ্ধে এতে কোনো শর্ত ছিল না। তাছাড়া এ চুক্তির ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আটক ইরানের ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ইরানকে ফেরত দেওয়া হয়েছিল,  ট্রাম্পের অভিযোগ অনুযায়ী যা ইরান ব্যবহার করছে সন্ত্রাসবাদ কায়েমের উদ্দেশ্যে।

তবে ইরান চুক্তি বাতিলের পক্ষে ট্রাম্প এসব অভিযোগ করলেও বিশেষজ্ঞদের ধারণা, বাস্তবে ট্রাম্পের উদ্দেশ্য ভিন্ন। ইরান চুক্তি থেকে সরে আসার পেছনে ট্রাম্পের অনেক কারণ থাকতে পারে। তার মধ্যে একটি হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। ইরান চুক্তিটি ছিল ওবামা প্রশাসনের সবচেয়ে বড় সাফল্যগুলোর মধ্যে একটি। আর ট্রাম্প ক্ষমতায় এসেছেনই মূলত ওবামা প্রশাসনের পররাষ্ট্রনীতির বিরোধিতা করার মধ্য দিয়ে। নির্বাচনী প্রচারণার সময়ই তিনি ঘোষণা দিয়েছিলেন, ক্ষমতায় আসলে চুক্তিটি তিনি বাতিল করবেন।

ক্ষমতায় আসার পরেও ট্রাম্প ওবামা প্রশাসনের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছেন, আন্তর্জাতিক অনেক চুক্তি এবং সমঝোতা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিয়েছেন। ইরান পারমাণবিক চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার প্রচেষ্টাও হতে পারে তারই একটি ধারাবাহিকতা। ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েলও ম্যাঁক্রোও অনেকটা সেরকমই ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তার ধারণা, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হয়তো ‘অভ্যন্তরীণ কারণে‘ চুক্তিটি বাতিল করবেন।

তবে এটিই একমাত্র কারণ না-ও হতে পারে। ইরান মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। সিরিয়াতে ইরানের অবস্থান ক্রমশ আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে এবং ইতোমধ্যেই ইসরায়েলের সাথে ইরানের ছোটখাট কয়েকটি সংঘর্ষও হয়েছে। সৌদি আরব, আরব আমিরাতসহ কয়েকটি আরব রাষ্ট্রও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের ক্রমবর্ধমান হস্তক্ষেপকে নিজেদের জন্য হুমকি হিসেবে দেখে। তাই ইরানের উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য এসব রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর চাপ থাকতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নবনিযুক্ত জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টনের ভূমিকাও এক্ষেত্রে একটি বড় কারণ হতে পারে। জন বোল্টন ছিলেন ইরান পারমাণবিক চুক্তির সবচেয়ে বড় বিরোধিতাকারীদের মধ্যে একজন। সে সময় নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে তিনি প্রস্তাব করেছিলেন, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচী ধ্বংস করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অথবা ইসরায়েলের উচিত ইরানের পারমাণবিক কেন্দ্রগুলোতে বিমান হামলা করা।

তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পারমাণবিক চুক্তিটি বাতিলের কোনো একক ক্ষমতা নেই। কারণ, এতে মোট সাতটি দেশ স্বাক্ষর করেছিল, যাদের কেউই এখন পর্যন্ত এ ব্যাপারে ট্রাম্পের নীতির সাথে পুরোপুরি একমত না। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাঁক্রোর যুক্তরাষ্ট্র সফরের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ট্রাম্পকে চুক্তিটি বাতিল করার সিদ্ধান্ত থেকে নিবৃত্ত করা। তবে ম্যাঁক্রো এটিও মন্তব্য করেছেন যে, চুক্তির শর্তগুলো যথেষ্ট নয়, এবং তিনি নতুন একটি চুক্তি করতে অথবা আগের চুক্তিটি সংশোধন করতে আগ্রহী।

ম্যাঁক্রোর পরপরই যুক্তরাষ্ট্র সফরে গিয়েছেন জার্মান চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেল। তার সফরেও সবচেয়ে গুরুত্ব পেয়েছে ইরান ডিল। এবং তিনিও চুক্তিটি বহাল রাখার ব্যাপারে তার সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। চীন এবং রাশিয়া সব সময়ই চুক্তিটির পক্ষে তাদের দৃঢ় অবস্থান ব্যক্ত করে এসেছে। তবে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে ফ্রান্সের পক্ষে অবস্থান নিয়ে জানিয়েছেন, তারা নতুন একটি চুক্তির ব্যাপারে কাজ করে যাচ্ছেন।

যুক্তরাষ্ট্রের একার পক্ষে সম্পূর্ণ চুক্তিটি বাতিল করা সম্ভব না হলেও, তারা চুক্তির শর্ত অমান্য করে ইরানের উপর থেকে প্রত্যাহার করা অবরোধগুলো পুনর্বহাল করা, নতুন অবরোধ আরোপ করা, ইরানের অর্থ জব্দ করাসহ বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা নিতে পারবে। ইরান এমনিতে চুক্তিটির পক্ষে, কিন্তু তাদের উপর অবরোধ আরোপ করা হলে তারাও হয়তো চুক্তিটি থেকে সরে গিয়ে নতুন করে অস্ত্র নির্মাণ প্রক্রিয়া আবারও আরম্ভ করতে পারে। ইরান ইতোমধ্যেই সে হুমকি দিয়েছে

তবে এটাই ইরানের একমাত্র করণীয় না-ও হতে পারে। চুক্তির ধারা অনুযায়ী কোনো পক্ষ যদি চুক্তির কোনো শর্ত অমান্য করে, তাহলে তা নিষ্পত্তির সুযোগ রাখা হয়েছে। সেক্ষেত্রে ইরান হয়তো ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রীনীতি বিষয়ক প্রধান ফেডেরিকা মোগেরিনির নেতৃত্বে গঠিত বিশেষ কমিশনের কাছে বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য উত্থাপন করতে পারে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র যদি একবার চুক্তিটি থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে কমিশনের দেওয়া সিদ্ধান্তও তারা মানবে কিনা, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

ইম্যানুয়েল ম্যাঁক্রো এবং অ্যাঙ্গেলা মার্কেল ডোনাল্ড ট্রাম্পকে তার সংকল্প থেকে সরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছেন কিনা, তা হয়তো ১২ মে’র আগে বোঝা যাবে না। ম্যাঁক্রো আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, ট্রাম্প হয়তো শেষপর্যন্ত চুক্তিটি বাতিলই করবেন। নবনিযুক্ত মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও সর্বশেষ এ ইঙ্গিত দিয়েছেন। কিন্তু সেক্ষেত্রে মধ্যপ্রাচ্য এবং সর্বোপরি সমগ্র পৃথিবী আবারও নতুন একটি সংকটে জড়িয়ে পড়বে, যার দায় বর্তাবে যুক্তরাষ্ট্রের উপরই, যারা নিজেদের উদ্যোগে করা চুক্তি ভঙ্গ করার মধ্যে দিয়ে নতুন করে একটি অপ্রয়োজনীয় সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করে যাচ্ছে।

Featured Image Source: AFP

Related Articles