Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্যারিসিয়ান স্পাইডারম্যানের দুঃসাহসী উদ্ধারাভিযান: ফ্রান্সের ভণ্ডামিপূর্ণ অভিবাসন নীতি আর কতদিন?

বিশ্বের সর্বপ্রথম কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরো চলচ্চিত্র নিয়ে এ বছর বেশ ভালোই মাতামাতি হয়েছে। ব্ল্যাক প্যান্থার (Black Panther) নামক এই চলচ্চিত্রটি এ পর্যন্ত আয় করেছে ১.৩৪৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ভেঙেছে একের পর এক অনেকগুলো বিশ্ব রেকর্ড। এমনকি দীর্ঘদিনের নিষেধাজ্ঞা ভেঙ্গে সৌদি আরব প্রথমবারের মতো যে চলচ্চিত্রটির মাধ্যমে সিনেমা হল উদ্বোধন করেছে, সেটিও ছিল এই ব্ল্যাক প্যান্থার। কিন্তু এবার আর চলচ্চিত্রের রূপালী জগত না, বাস্তবেই মানুষ দেখা পেল এক কৃষ্ণাঙ্গ সুপার হিরোর। ‘প্যারিসিয়ান স্পাইডারম্যান’ (Parisian Spiderman) নামে পরিচিত হওয়া মাহমুদু গাস্‌সামা (Mamoudou Gassama) শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরো না, তিনি একইসাথে একজন অবৈধ অভিবাসীও।

এককালে ফ্রান্সকে অত্যন্ত উদারপন্থী, শিল্প-সাহিত্যের সুতিকাগার হিসেবে বিবেচনা করা হলেও বর্তমান ফ্রান্সের চরিত্র অনেকটাই ভিন্ন। আধুনিক ফ্রান্সের কিছু রাজনৈতিক দল, প্রতিষ্ঠান এবং একটি বড় অংশের জনগণের মধ্যে একইসাথে মুসলমানদের বিরুদ্ধে এবং কৃষ্ণাঙ্গ অবৈধ অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তীব্র বিদ্বেষ লক্ষ্য করা যায়। গত সপ্তাহেই শুধুমাত্র হিজাব পরিধানের অভিযোগে ফরাসী ব্যাঙ্গাত্মক ম্যাগাজিন শার্লি হেবদো এক মুসলিম নারীকে আপত্তিজনক ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করেছে। ফ্রান্সের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও তার হিজাব পরার সমালোচনা করেছেন। বিভিন্ন সময় ফ্রান্স অভিবাসীদেরকে উচ্ছেদের দাবিতে মিছিলও হয়েছে। পরিস্কারভাবেই কৃষ্ণাঙ্গ মুসলমান অভিবাসীদের জন্য ফ্রান্সের জীবন মোটেই সুখকর কিছু না। কিন্তু তারপরেও মাহমুদু গাস্‌সামা যখন এক ফরাসী শিশুকে বিপদে পড়তে দেখেছেন, তখন নিজের জীবনকে তুচ্ছ করে তিনি ছুটে গেছেন তাকে বাঁচানোর জন্য।

২২ বছর বয়সী মাহমুদু গাস্‌সামা আফ্রিকার অন্যতম দরিদ্র দেশ মালির নাগরিক। গত সেপ্টেম্বর মাসে নতুন জীবনের খোঁজে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে তিনি ফ্রান্সে এসে পৌঁছান। তার কোনো বৈধ কাগজপত্র নেই, কোনো চাকরি নেই, থাকার জন্য পৃথক কোনো বাসাও নেই। অন্য অনেকের সাথে তিনি একটি হোস্টেলে থাকেন। গত শনিবার এই মাহমুদু যখন প্যারিসের ডিস্ট্রিক্ট এইটিন্থ ধরে হেঁটে যাচ্ছিলেন, তখনই তার চোখে পড়ে, পাশের একটি ভবনের চার তলার বারান্দা ধরে বিপজ্জনকভাবে ঝুলে আছে চার বছর বয়সী একটি শিশু। আশেপাশে অনেক মানুষের ভীড়, সবাই চেঁচামেঁচি করছে, কিন্তু কেউ বাচ্চাটিকে উদ্ধারের জন্য এগিয়ে যাচ্ছিল না।

ফ্রান্সের রাস্তাঘাটে মাহমুদুদের চলাফেরার প্রথম নিয়ম হচ্ছে, পুলিশ থাকতে পারে এমন স্থান এড়িয়ে চলা। কারণ, অভিবাসীদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত কঠোর আইনের রাষ্ট্র ফ্রান্সে অবৈধ অভিবাসীদেরকে গ্রেপ্তার করে ডিটেনশন সেন্টারে নিয়ে যাওয়া এবং এরপর জোরপূর্বক তার নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া খুবই নিয়মিত ঘটনা। কিন্তু মানবতার ডাক উপেক্ষা করা মাহমুদুর পক্ষে সম্ভব ছিল না। গ্রেপ্তার অথবা পা পিছলে পড়ে মৃত্যুবরণ করার ঝুঁকি নিয়ে তিনি বিল্ডিংটির বারান্দা বেয়েই উপরের দিকে উঠতে শুরু করেন। এ যেন কমিক্স বইয়ের পাতা থেকে উঠে আসা স্পাইডারম্যান। মাত্র আধ মিনিটেই তিনি পৌঁছে যান শিশুটির কাছে। আলগোছে তাকে তুলে রক্ষা করেন নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে।

মাহমুদু গাস্‌সামার এই বীরত্বপূর্ণ কাজটি ইন্টারনেটে বেশ সাড়া ফেলে। তার উদ্ধারকর্মের ভিডিওটি সামাজিক গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে শেয়ার হয় এবং লক্ষ লক্ষ ভিউ অর্জন করে। অনেকেই তাকে বাস্তবের স্পাইডারম্যান হিসেবে উল্লেখ করে। তাকে নাগরিত্ব প্রদানের জন্য পিটিশনে স্বাক্ষর করতে শুরু করে তার অনেক ভক্ত। প্যারিসের মেয়র অ্যানা হিদালগো মাহমুদুকে ধন্যবাদ জানিয়ে টুইট করেন। তিনি তার বীরত্বপূর্ণ কর্মকে সকল নাগরিকের জন্য উদাহরণস্বরূপ বলে উল্লেখ করেন। মাহমুদুকে ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করার জন্য তার অঙ্গীকারের কথাও উল্লেখ করেন মেয়র।

পরবর্তীতে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ইম্যানুয়েল ম্যাঁক্রো মাহমুদু গাস্‌সামাকে তার সাথে সাক্ষাৎ করার আমন্ত্রণ জানান। গতকাল সোমবার মাহমুদু প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁর সাথে বৈঠক করেন। এসময় প্রেসিডেন্ট তাকে ফ্রান্সের নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করার আহ্বান জানান এবং তাকে সম্মানসূচক নাগরিত্ব প্রদান করা হবে বলে আশ্বাস দেন। প্রেসিডেন্ট তাকে ফ্রান্সের ফায়ার সার্ভিসে চাকরি করার জন্য আহ্বান জানিয়ে বলেন, তাকে পেলে ফ্রান্সের অগ্নিনির্বাপক বাহিনী উপকৃত হবে। তবে মাহমুদুর সাথে বৈঠকের পরে প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে একথা আবারও স্মরণ করিয়ে দেন, অভিবাসীদের প্রতি ফ্রান্সের নীতি আগের মতোই থাকবে। মাহমুদুর ঘটনাটি কেবলই একটি ব্যতিক্রম

ফ্রান্স অভিবাসীদের প্রতি সবচেয়ে কঠোর দেশগুলোর মধ্যে একটি। দেশটির চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল ফ্রন্ট এর প্রধান ম্যারি লা পেন এবং তার বিপুল সমর্থকরা দেশটি থেকে সকল অভিবাসীকে জোরপূর্বক ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার পক্ষে অত্যন্ত সোচ্চার। ইম্যানুয়েল ম্যাঁক্রো যদিও লা পেনকে পরাজিত করেই ক্ষমতায় এসেছেন, কিন্তু দেশের একটি বড় অংশের জনগণের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে তিনিও অভিবাসীদেরকে সাহায্য করার কোনো উদ্যোগ নেননি। যেখানে জার্মানি, কানাডাসহ অনেক দূরবর্তী দেশ নিয়মিত অভিবাসীদেরকে নাগরিকত্ব দেয়, সেখানে ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ হয়েও ফ্রান্স ২০১৬ এবং ২০১৭ সালে সর্বমোট মাত্র ১১জন অভিবাসীকে নাগিরকত্ব দিয়েছিল। অথচ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যে এই আফ্রিকানরা ইউরোপের উদ্দেশ্যে ছুটে যাচ্ছে, এর পেছনে ফ্রান্সের দায় মোটেও কম না।

মাহমুদু গাস্‌সামার জন্মস্থান মালি এক সময় ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। দেশটির বর্তমান দারিদ্র্য এবং অস্থিতিশীলতার পেছনে সরাসরি ফ্রান্সের ভূমিকা আছে। মাহমুদু মালি থেকে ফ্রান্সে পৌঁছেছেন প্রথমে বুরকিনা ফাসো, নাইজার এবং পরবর্তীতে লিবিয়া হয়ে। আফ্রিকা হয়ে ইউরোপে যাওয়ার অন্যতম প্রধান রুট হচ্ছে লিবিয়া, যে বিপজ্জনক পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রতি বছর হাজার হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। সাবেক লিবীয় নেতা মোয়াম্মার আল-গাদ্দাফির সময়েও সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মানুষ ইউরোপে যেত। কিন্তু গাদ্দাফির পতনের পর সে সংখ্যাটা অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। আর গাদ্দাফিকে ক্ষমতাচ্যুত করে এই সংকট বৃদ্ধি করার পেছনে সরাসরি দায়ী ফ্রান্সের পররাষ্ট্রনীতি

কাজেই প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো যখন মাহমুদুর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং তাকে সার্টিফিকেট ও মেডেল প্রদান করেন, তখন তা দেখতে খুবই ভালো লাগে। কিন্তু পরমুহূর্তেই তিনি যখন আরো হাজার হাজার অবৈধ অভিবাসীর প্রতি তার অনমনীয় মনোভাব বজায় রাখেন, তখন ব্যাপারটিকে এক প্রকার শঠতা বলেই মনে হয়। ফ্রান্সের বাম ঘরানার একটি সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক রাফায়েল গ্লুক্সম্যান তার ফেসবুক পোস্টে তাই বলেছেন,

আমি এমন একটি দেশের স্বপ্ন দেখি, যেখানে কোনো অভিবাসীকে মানুষ হিসেবে তার অধিকার অর্জনের জন্য নিজের জীবনের ঝুঁকি নিতে হবে না অথবা দেয়াল বেয়ে উঠে কোনো শিশুকে রক্ষা করতে হবে না।

Featured Image Source: Social Media

Related Articles