Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ইসরায়েলের রাষ্ট্র গঠনের অধিকার আছে: সৌদি যুবরাজের এ বক্তব্যের তাৎপর্য কী?

সৌদি আরবের যুবরাজ মুহাম্মদ বিন গত সপ্তাহে হঠাৎ করেই জানান, ইসরায়েলের নিজস্ব ভূমির অধিকার আছে। স্বাভাবিকভাবেই তার বক্তব্যটি মুসলিম বিশ্বে প্রচণ্ড সমালোচনার মুখে পড়ে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে যায় যে, তার বাবা সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজকে পাল্টা নিশ্চিত করতে হয় যে, সৌদি আরব ফিলিস্তিনের পাশেই আছে এবং জেরুজালেমকে তারা ফিলিস্তিনের রাজধানী হিসেবেই দেখতে চায়। কিন্তু তাহলে প্রিন্স মুহাম্মদ কেন ইসরায়েলের অধিকার বিষয়ক বক্তব্যটি দিয়েছিলেন? কী বোঝাতে চেয়েছিলেন তিনি? আর কতটুকুই বা তাৎপর্যপূর্ণ তার এ বক্তব্য?

সৌদি যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের এই আচমকা বক্তব্যটি আসে গত ২ এপ্রিল সোমবার, দ্য আটলান্টিকের সাথে দেওয়া তার একটি সাক্ষাৎকারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকালে প্রিন্স মুহাম্মদ বিভিন্ন মার্কিন পত্রিকা এবং টিভি চ্যানেলের সাথে সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় তিনি মার্কিন সাময়িকী দ্য আটলান্টিকের সাথেও একটি সাক্ষাৎকার দেন। সে সাক্ষাৎকারেই তিনি ম্যাগাজিনটির সম্পাদক জেফরি গোল্ডবার্গের এর এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমি বিশ্বাস করি, যেকোনো স্থানের প্রতিটি মানুষের তাদের নিজেদের জাতির মধ্যে বসবাস করার অধিকার আছে।

প্রিন্স মুহাম্মদ আরও বলেন, ইসরায়েল তার আকারের তুলনায় একটি বৃহৎ অর্থনৈতিক শক্তি এবং সৌদি আরবের সাথে ইসরায়েলের বিভিন্ন বিষয়ে অভিন্ন স্বার্থ আছে। যদি শান্তি স্থাপিত হয়, তাহলে উপসাগরীয় সহযোগিতা কাউন্সিলের অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের সাথেও ইসরায়েলের বিভিন্ন বিষয়ে স্বার্থ তৈরি হবে। তার ভাষায়, “আমি বিশ্বাস করি, নিজেদের ভূমির ওপর ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলিদের অধিকার আছে। কিন্তু আমাদের একটি শান্তিচুক্তি থাকতে হবে, যেন সব পক্ষই স্থিতিশীল ও স্বাভাবিক একটি সম্পর্ক বজায় রাখতে পারে।

যুবরাজ মুহাম্মদ বিন সালমানের এ বক্তব্যের পরপরই মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর গণমাধ্যমে প্রচণ্ড সমালোচনার ঝড় ওঠে। অনেকে তার এ বক্তব্যকে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার সাথেও তুলনা করেন। কারণ, এর আগে কোনো সৌদি শাসকই ফিলিস্তিনি ভূমির উপর ইসরায়েলের অধিকার প্রসঙ্গে এরকম সরাসরি বক্তব্য দেননি। মিসর বা সিরিয়ার মতো যদিও সৌদি আরব কখনোই সরাসরি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযানে অংশ নেয়নি, কিন্তু ইসরায়েল প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা সব সময়ই ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনের পক্ষেই তাদের সমর্থন ব্যক্ত করে এসেছে।

তবে সৌদি আরবের গত কয়েক বছরের পররাষ্ট্রনীতির আলোকে বিবেচনা করলে প্রিন্স মুহাম্মদের এ বক্তব্যটি খুব একটা অনাকাঙ্ক্ষিত নয়। গত কয়েক বছর ধরে, বিশেষ করে বাদশাহ সালমান ক্ষমতায় আসার পর থেকে যখন প্রিন্স মুহাম্মদকে প্রথমে ডেপুটি ক্রাউন প্রিন্স এবং পরবর্তীতে ক্রাউন প্রিন্স হিসেবে নিয়োগ দেন, তখন থেকেই সৌদি আরবের সাথে ইসরায়েলের সম্পর্কের মধ্যে কিছুটা উন্নতির ব্যাপারে গণমাধ্যমে বিভিন্ন সংবাদ উঠে আসতে থাকে।

সৌদি আরব অবশ্য এখনো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেয়নি, বা আনুষ্ঠানিকভাবে দেশ দুটির মধ্যে কোনো সম্পর্কও স্থাপিত হয়নি। কিন্তু উভয় দেশের ক্ষমতাসীন বিভিন্ন নেতার বক্তব্য থেকেই তাদের সম্পর্কের স্বাভাবিকীকরণের চলমান প্রক্রিয়াটি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সর্বশেষ ৭০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ইসরায়েলগামী ভারতীয় এয়ারলাইন্সকে সৌদি আরবের আকাশসীমা ব্যবহার করার অনুমতি দিয়ে সৌদি আরব এই সম্পর্ক স্বাভাবিকীরণের প্রক্রিয়াটিকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। অনেকেই আশা করছেন, শীঘ্রই হয়তো অন্যান্য দেশের এয়ারলাইন্সকে এবং তার ধারাবাহিকতায় শেষপর্যন্ত ইসরায়েলি এয়ারলাইন্সকেও এ অনুমতি দেওয়া হতে পারে।

তবে সৌদি আরবের সাথে ইসরায়েলের অভিন্ন স্বার্থ শুধুমাত্র অর্থনৈতিক না। তাদের উভয়ের সবচেয়ে বড় অভিন্ন স্বার্থ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের অগ্রযাত্রাকে রুখে দেওয়া। পরমাণু শক্তিধর ইরানকে ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরেই এ অঞ্চলে তাদের প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। আরব বসন্তের পর সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ইরানের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং লেবানন, ইয়েমেন, ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে ইরানের ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে সৌদি আরবও তাদের অস্তিত্বের জন্য প্রধান হুমকি হিসেবে বিবেচনা করছে। আর তাই ইরানের বিরোধিতা করতে গিয়েই ইসরায়েলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিক করে তুলতে আগ্রহী হয়ে উঠছে সৌদি আরব। বিভিন্ন সময় ছোট ছোট পদক্ষেপ এবং বক্তব্য প্রদানের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সে পথেই হাঁটছে তারা। প্রিন্স মুহাম্মদের সাম্প্রতিক বক্তব্যটিও হয়তো সে পথেই একটি পদক্ষেপ।

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, প্রিন্স মুহাম্মদের বক্তব্যটি কতটুকু যৌক্তিক? ইসরায়েলের কি আসলেই রাষ্ট্র গঠনের অধিকার আছে? অন্যান্য মুসলমান রাষ্ট্রের এ ব্যাপারে অবস্থান কী? উত্তরটি হচ্ছে, ইসরায়েল যদিও দাবি করে, ঐতিহাসিকভাবে ফিলিস্তিনি ভূমির উপর তাদের অধিকার আছে, কিন্তু তাদের সে দাবির তেমন কোনো ভিত্তি নেই। তবে জাতিসংঘ ইসরায়েল রাষ্ট্রটিকে স্বীকৃতি দেওয়ায় এবং দীর্ঘদিন ধরে ইহুদীরা এই এলাকায় বসবাস করতে থাকায় ইসরায়েল রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এখন বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে, যাকে কেউ চাইলেই এখন আর অস্বীকার করতে পারবে না।

সেজন্যই অনেকগুলো মুসলিম রাষ্ট্রই এখন ইসরায়েলের অস্তিত্বকে বাস্তবতা হিসেবে মেনে নেওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করে, যদি ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের যুদ্ধের সময় দখল করা ভূমিগুলো এবং পবিত্র জেরুজালেমের দখল ছেড়ে দিতে রাজি থাকে। তারা বাস্তবতার কারণেই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দিয়ে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের দিকে এগিয়ে যেতে আগ্রহী, কিন্তু তাদের কেউই এটিকে ইসরায়েলের ‘অধিকার’ হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করে না।

প্রিন্স মুহাম্মদের ব্যবহৃত বাক্যের গঠন বিন্যাসও এখানে বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয়। পূর্ববর্তী অনেক সৌদি বাদশাহ যেমন বাদশাহ ফাহাদ এবং আব্দুল্লাহও দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিতে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার অঙ্গীকার করেছিলেন, কিন্তু তারা সব সময়ই তার পূর্বে শর্ত জুড়ে দিয়েছিলেন। অন্যান্য রাষ্ট্রও যখনই ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার কথা বলে, তখন প্রথমেই শর্ত উল্লেখ করে যে, ইসরায়েলকে জেরুজালেম ছেড়ে দিতে হবে এবং ‘৬৭ সালের পূর্বের সীমানায় ফিরে যেতে হবে।

কিন্তু প্রিন্স মুহাম্মদ তার বক্তব্যে এ ধরনের কোনো শর্তের কথা পরিষ্কার করেননি। তিনি ইসরায়েলের অধিকারের কথা উল্লেখ করেছেন এবং একটি শান্তিচুক্তির কথা বলেছেন, কিন্তু সে শান্তিচুক্তিতে কী কী শর্ত থাকবে, সে ব্যাপারে তিনি কোনো ইঙ্গিত দেননি। যে মুহূর্তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দূতাবাস সেখানে স্থানান্তর করার প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং যে মুহূর্তে গাজা-ইসরায়েল সীমান্তে শান্তিপূর্ণভাবে ‘গ্রেট মার্চ অফ রিটার্ন‘ আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ফিলিস্তিনিদের উপর ইসরায়েল নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করছে, সে মুহূর্তে ইসরায়েলের প্রতি এ ধরনের নমনীয় বক্তব্য সৌদি যুবরাজের মূল উদ্দেশ্য সম্পর্কে সন্দেহের জন্ম দেয়।

মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তবতায় হয়তো ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনি ভূমি থেকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করা সম্ভব হবে না। জাতিসংঘের অস্তিত্ব, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও আইনের কারণে তা যৌক্তিকও হবে না। শেষপর্যন্ত সবাইকে দ্বিরাষ্ট্র সমাধানের দিকেই এগিয়ে যেতে হবে এবং ঐতিহাসিক অধিকার না থাকলেও ১৯৬৭ এর পূর্বের সীমান্ত পর্যন্ত ইসরায়েলের যে এক বাস্তবতাপ্রসূত অধিকার সৃষ্টি হয়েছে, সেটিও হয়তো সবাইকে মেনে নিতে হবে। কিন্তু সৌদি আরব ইসরায়েলের চেয়ে ইরানকে বড় শত্রু গণ্য করতে গিয়ে যেভাবে ইসরায়েলের দখলদারিত্বকে একপ্রকার মেনে নিয়েই তাদের সাথে সম্পর্ক সৃষ্টিতে আগ্রহ প্রকাশ করছে, তাতে মধ্যপ্রাচ্যে অশান্তি ছাড়া শান্তি স্থাপিত হওয়ার তেমন কোনো সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।

Featured Image Source: Amir Levy/ Reuters

Related Articles