Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ট্রাম্প বনাম স্টর্মি ড্যানিয়েলস: ট্রাম্পের ব্যক্তিকেন্দ্রিকতাই বুমেরাংয়ের মতো ধেয়ে এল তার দিকে

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প ইদানিং বেশ আইনি ডামাডোলে পড়েছেন। একদিকে ২০১৬ সালের মার্কিন রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে রাশিয়ার সঙ্গে তার নির্বাচনী প্রচারের যোগসাজশ ছিল অভিযোগে চলছে বিশেষ আইনজীবী রবার্ট মুলারের তদন্ত। এই নিয়ে যখন চলছে জেরবার ট্রাম্পের বিরুদ্ধে, এবারে অভিযোগ এনেছেন এক পর্নতারকা স্টর্মি ড্যানিয়েলস; বলেছেন ট্রাম্পের সঙ্গে তার ২০০৬ সাল নাগাদ একটি যৌন সম্পর্ক তৈরি হয় এবং তার বছর দশেক পরে যখন ট্রাম্প রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রচার চালাচ্ছেন, তখন তাকে নাকি টাকার বিনিময়ে মুখ বন্ধ রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। এবং সে পরামর্শ যে আবেদনের সুরে দেওয়া হয়নি, ড্যানিয়েলসের অভিযোগে তাও খোলাসা করা হয়। অভিযোগ ছিল, ট্রাম্পের ব্যক্তিগত উকিল মাইকেল কোহেন নাকি তাকে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার মার্কিন ডলার ঘুষ দেন।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প; Source: Wikimedia Commons/Gage Skidmore

স্বভাবতই এই নিয়ে চারদিকে শোরগোল পড়লে ট্রাম্পকে সংবাদমাধ্যমের তরফে জিজ্ঞেস করা হয় এ ব্যাপারে। মার্কিন রাষ্ট্রপতি প্রথমবার সরাসরি নাকচ করেন এই অভিযোগ, বলেন তিনি এব্যাপারে কিছুই জানেন না। কিন্তু ট্রাম্পের এই জবাবের এক মাসের ভিতরে তারই এক সমর্থক রুডি জিউলিয়ানি বলেন, কোহেন ড্যানিয়েলসকে টাকা দেওয়ার পরে ট্রাম্প কোহেনের সেই পাওনা মিটিয়ে দেন। তবে জিউলিয়ানি এও বলেন যে, ট্রাম্পের এই টাকা দেওয়াতে কোনো অন্যায় কিছু ছিল না; নির্বাচনী বিধি তাতে ভঙ্গ হয়নি।

এই জিউলিয়ানিই সম্প্রতি ট্রাম্পের আইনজ্ঞদের দলে যোগ দেন রাশিয়ার সঙ্গে যোগসাজশের অভিযোগের মামলাটির দ্রুত নিস্পত্তি ঘটানোর জন্যে। আর এসেই তিনি স্বয়ং ট্রাম্পকেই ফেললেন বিড়ম্বনায়।

আর এরপর ৩ মে তারিখে স্বয়ং ট্রাম্পও স্বীকার করেন যে তিনি কোহেনকে ওই অর্থ শোধ হিসেবে দিয়েছিলেন। যদিও তিনি আত্মপক্ষসমর্থনে এও বলেন যে, ওই নারীকে অর্থ দেওয়ার সঙ্গে তার নির্বাচনী প্রচারের কোনোই সম্পর্ক ছিল না। মার্কিন রাজনীতিতে ট্রাম্পের এই ডিগবাজি যে ড্যানিয়েলস সহ তার বিরোধীদের হাতে বেশ বড়সর অস্ত্র তুলে দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

স্টর্মি ড্যানিয়েলস; Source: The New Yorker

আমেরিকাতে ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসার পরে সেদেশের রাজনীতিতে যে অনেক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটছে, তা নতুন করে বলার প্রয়োজন পড়ে না। ট্রাম্পের আমেরিকা-কেন্দ্রিক অতিজাতীয়তাবাদ তো রয়েছেই, পাশাপাশি মার্কিন দেশের ঘরোয়া রাজনীতিতেও ট্রাম্পের নানাবিধ কাণ্ডকারখানা দেখে বহির্বিশ্বের মানুষ প্রায়ই হকচকিয়ে যান; কেউ বা হেসে কুটোপাটিও হন। আবার রক্ষণশীল মানুষের কাছে মনে হয়, ট্রাম্পের মধ্যে কোনো নেতৃত্ব তো নেইই, উল্টো তিনি নিজের দেশের এতদিন ধরে লালিত গণতান্ত্রিক পরিসরটিকেই ধ্বংস করছেন; পৃথিবীর একমাত্র মহাশক্তিকে দুনিয়ার সামনে হাস্যস্পদ করছেন।

ট্রাম্প যে কারও ধার ধারেন না, বুঝিয়ে দিয়েছিলেন ক্ষমতায় আসার আগেই

অভিযোগটিকে মিথ্যে বলা যাবে না। ট্রাম্প তার রাষ্ট্রপতি হওয়ার আগে থেকেই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, গড়পড়তা রাজনীতিবিদদের মতো তিনি চলেন না; পলিটিক্যাল কারেক্টনেসের ধার ধারেন না। বরং নিজের মর্জির মালিক তিনি, যেটা মনে করবেন সেটাই করবেন; মন্ত্রীমণ্ডলী, পরামর্শদাতা, উপদেষ্টা তার নিষ্প্রয়োজন। কাল যদি রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করে ওয়াশিংটন; ট্রাম্প হয়তো তার মধ্যেই রুশ রাষ্ট্রপতি ভ্লাদিমির পুতিনকে ফোন করে তার কুশলসংবাদ নিতে পারেন। দুনিয়া অবাক হলেও ট্রাম্পের তাতে কিছু এসে যায় না। তিনি তার মতোই।

নিউ ইয়র্কের প্রাক্তন মেয়র রুডি জিউলিয়ানি; Source: Gage Skidmore/flickr

আমেরিকার সর্বোচ্চ নেতৃত্বের এই জমানায় এটিই বোধহয় মার্কিন রাজনীতি এবং রাষ্ট্রনীতির সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য। আর তা হচ্ছে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। ট্রাম্পের দেখানো পথেই কিন্তু হাঁটতে দেখা যাচ্ছে তার প্রশাসনের বিভিন্ন হোতাদেরকে। এতে সার্বিকভাবে সরকার বা রাষ্ট্রের সমন্বয় ক্ষুণ্ণ হচ্ছে কিন্তু ট্রাম্প এবং তার সমর্থক রাজনীতিবিদদের কিছু এসে যায় না। কারণ, তারা জানেন যে মার্কিন মুলুকে বারাক ওবামা জমানায় বিরক্ত প্রত্যেকটি সাদা মানুষ ট্রাম্পকে তাদের হর্তাকর্তা হিসেবে গ্রহণ করেছেন এক দীর্ঘ সময়ের জন্য। তার একগুঁয়েমি তাদের চোখে ধরা পড়বে এক নির্ভীক নেতৃত্ব হিসেবে; বিদেশনীতিতে তার হঠকারিতা তার সমর্থকরা দেখবে অভিনবত্ব হিসেবে- সব মিলিয়ে একজন পপুলিস্ট নেতার যেমন ভাবমূর্তি এবং সমর্থনভিত্তি থাকা প্রয়োজন, ট্রাম্পের তা রয়েছে। সেখানে ব্যক্তিগতভাবে কতজন নারীকে তিনি কতটা অসম্মান করেছেন, তাতে তার সমর্থকদের বিশেষ কিছু এসে যায় না। ট্রাম্পের মার্কিন মুলুককে ফের মহান করার যে মহাযজ্ঞ চলছে, তাতেই তারা খুশি।

ট্রাম্প ঘন ঘন তার আধিকারিকদের বদলান কারণ তিনি চান সবাই তার মনোভাব সমঝে চলুক

একটু খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, ট্রাম্পের প্রশাসনে একসূত্রে বাঁধা ব্যক্তিদের সংখ্যা কম। তাদের রক্ষণশীল দর্শন অনেক সময়ে এক হলেও ট্রাম্পের মুহূর্মুহূ আধিকারিক বদলানোর প্রবণতা দেখলে বোঝা যায় যে, তিনি অনেক ক্ষেত্রেই সমমনোভাবাপন্ন নেতাদের নিয়েও কাজ করতে ব্যর্থ। ট্রাম্পের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ইতিমধ্যেই তিনবার বদলেছে; সম্প্রতি তার জমানার দ্বিতীয় রাষ্ট্র সচিব হিসেবে শপথ নিলেন মাইক পম্পেও যাকে বলা হচ্ছে ট্রাম্পের মতোই কট্টর। আবার যিনি ট্রাম্পের তৃতীয় জাতীয় উপদেষ্টা হিসেবে দায়ভার নিলেন সম্প্রতি, সেই জন বোল্টন কুখ্যাত তার যুদ্ধবাজ মনোভাবের জন্য।

মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের শাসনকালের দেড় বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন কট্টরপন্থী জন বোল্টন; Source: Gage Skidmore/Flickr

ব্যাপারটা এই নয় যে, ট্রাম্পের প্রশাসনে এই প্রথম কট্টরপন্থী আধিকারিক এলেন। তিনি যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পঁয়তাল্লিশতম রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাজ্যপাটের দায়িত্ব নেওয়ার তোড়জোড় করছেন, তখনই বোঝা গিয়েছিল যে তার প্রশাসনে বেশিরভাগই আসবেন কট্টরপন্থী লোকজন, যারা তার রাজনৈতিক দর্শনেই বিশ্বাসী।

কিন্তু ক্রমেই প্রমাণিত হচ্ছে যে, ট্রাম্পের সঙ্গে ঘর করতে হলে একই দর্শন থাকলে হবে না; তার সঙ্গে থাকতে হবে ব্যক্তি ট্রাম্পকে ক্রমাগত তোয়াজ করে যাওয়া বা তার কথাকেই আপ্তবাক্য মনে করে চলতে পারার ক্ষমতা। অতি বড় মোসাহেবের পক্ষেও যা প্রায় অসম্ভব। আর এই সবের ফলে বর্তমান মার্কিন প্রশাসনে কার্যত যে মিউজিক্যাল চেয়ারের খেলা দেখা যাচ্ছে, তা কিন্তু আদতেই সরকারের কাজকর্মকে সাহায্য করছে না। স্রেফ একজন প্রশাসনিক কর্তার খামখেয়ালি মর্জিমেজাজকে বৈধতা দিচ্ছে।

তাই ট্রাম্পের সরকারে দেখা যাচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক কার্যকলাপ। যাকেই ট্রাম্পের অপছন্দ হচ্ছে, ট্রাম্প তাকে বিদায় করছেন নিমিষে। আবার যারা ট্রাম্পের পছন্দকে অপছন্দ করছেন, তাদের ট্রাম্প অহোরাত্র মুণ্ডুপাত করছেন যেন তার পছন্দের উপরে কথা বলার অধিকার আর কারও নেই। মার্কিন প্রশাসনকে কার্যত তার জমিদারিতে পর্যবসিত করেই চলছে ট্রাম্প জমানা।

কিন্তু ট্রাম্পের চ্যালাচামুন্ডারাও যদি পলিটিকাল কারেক্টনেসের ধার না ধারেন, তবে রাষ্ট্রপতিরই বিপদ

কিন্তু স্টর্মি ড্যানিয়েলসকে ঘুষ দেওয়ার অভিযোগকে কেন্দ্র করে তারই সমর্থক জিউলিয়ানিকে যা করতে দেখা গেল, তাতে এটাই পরিস্কার হলো যে, ট্রাম্পের প্রশাসনের এই অতি-ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, যেখানে সরকার বা দলের মধ্যে এক অবস্থান নেওয়ার নিয়মানুবর্তিতা মানার কোনো বালাই নেই, মাঝেমধ্যে দুমুখো তলোয়ারের মতো ধেয়ে আসতে পারে তার দিকেও।

ডোনাল্ড ট্রাম্পের উকিল মাইকেল কোহেন, যিনিও জড়িয়ে পড়েছেন ড্যানিয়েলস কাণ্ডে; Source: Flickr.com

জিউলিয়ানি যদি ট্রাম্প-কোহেন-ড্যানিয়েলস প্রসঙ্গে মুখে কুলুপ এঁটে থাকতেন তার সাম্প্রতিক সাক্ষাৎকারে, পলিটিক্যাল কারেক্টনেস পালনের বৈদিক নিয়মটি মেনে চলতেন, তাহলে তার রাজনৈতিক গুরু ট্রাম্পকে বাধ্য হতে হতো না টুইট করে স্বীকার করতে যে, তিনি আসলে তার উকিলকে ড্যানিয়েলস কাণ্ডে পয়সা পরিশোধ করেছিলেন। কী বিড়ম্বনা! অথচ এই প্রবণতা তৈরি হওয়ার পিছনে কিন্তু সবচেয়ে বেশি দায়ী মার্কিন রাষ্ট্রপতি নিজেই। তিনি নিজে যেমন কথা বলার সময়ে কোনো কিছুকেই ধর্তব্যের মধ্যে আনেন না, তেমনই তার দলীয় নেতারা সেই একই জিনিস করলে তিনি তা আটকাবেন কীভাবে?

ট্রাম্প একজন ব্যবসাদার। এবং একজন ব্যবসাদারের মতোই তার ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বে বিশ্বাস। সেখানে আর পাঁচজনকে নিয়ে দল হিসেবে দায়িত্ব ভাগ করে নেওয়ার অভ্যাস নেই। আর তার উপর মার্কিন রাষ্ট্রপতি হওয়ার ক্ষমতা এবং শ্বেতাঙ্গ জাতীয়তাবাদের গর্ব সেই ব্যাক্তিকেন্দ্রিকতাকে আরও ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তুলেছে। কিন্তু ট্রাম্প বুঝতে চান না যে, প্রশাসন মানে তিনি এক নন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কোনো একনায়কতন্ত্র নয় যে তিনি যা চাইবেন, বুঝবেন, তা-ই হবে। যদিও অনেকবারই দেখা গেছে যে ট্রাম্পকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো বিলে সই করতে হয়েছে বা উপদেষ্টাদের কথা না শুনে একার বুদ্ধিতে বিদেশনীতি নিয়ে মাতব্বরি করতে গিয়ে সমালোচিত হতে হয়েছে; অতিকট্টর অবস্থান নিতে গিয়ে বিচারব্যবস্থা বা আন্তর্জাতিক জোটসঙ্গীদের কাছে কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু এসব দৃষ্টান্ত থেকে তিনি কতটা শিক্ষা নিয়েছেন তা তিনিই জানেন। তবে শিক্ষা নিন বা না নিন, ট্রাম্পের অতি-ব্যক্তিকেন্দ্রিক প্রশাসনিক কারবার কিন্তু মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রকে অনেক ক্ষেত্রেই দুর্বল করে তুলেছে, পাশাপাশি তা তার বিশ্বাসযোগ্যতাও হারাচ্ছে।

ড্যানিয়েলস কাণ্ডে ব্যক্তি ট্রাম্পের অসৎ দিকটিও প্রত্যক্ষ করল মার্কিন জনগণ। এমন একজন ধনকুবের যিনি সারাজীবনে তার পয়সা এবং প্রভাবের দম্ভে যথেচ্ছাচার করে এসেছেন, তাকে দেশের রাষ্ট্রপতির মতো একটি দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসার মধ্যে একটি ঝুঁকি সবসময়েই ছিল। আর সেই ঝুঁকি আরও বেড়েছে ট্রাম্পের বেপরোয়া মনোভাবের জন্যে। ডেমোক্র্যাটদের এই দুর্দিনে ট্রাম্পকে আটকানোর মতো বল বিরোধীদের নেই ঠিকই কিন্তু গণতন্ত্রের নিজস্ব এক অদৃশ্য শক্তি রয়েছে, যা বড় বড় রাষ্ট্রনেতাদেরকেও মাথা ঝোঁকাতে বাধ্য করে, অন্তত ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত আছে প্রচুর। ড্যানিয়েলসকে টাকা দেওয়ার ব্যাপারে ট্রাম্পের বেপরোয়া মিথ্যাচারিতা কিন্তু মার্কিন গণতন্ত্রে একটি নেতিবাচক নজির রাখল।

ট্রাম্পের এই একরোখা এবং বেপরোয়া ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন খোদ মার্কিন রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে কতদিন খাপ খায়, সেটাই এখন দেখার বিষয়।

Featured Image Source: The Blast

Related Articles