Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাণ বাঁচাতে মৃত সহযাত্রীদের মাংস খেয়েছিল যারা

ক্ষুধা পেলে বাঘ নাকি ঘাসও খায়। কিন্তু কতটা ক্ষুধা পেলে নিজের স্বজাতির শরীরের মাংস খেতে পারে কেউ? কোনো মানুষ কি সেটা পারবে?

সৃষ্টির শুরু থেকেই টিকে থাকা ব্যাপারটাই খুব বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে মানুষের কাছে। কালের গর্ভে অনেক শক্তিশালী প্রাণী হারিয়ে গিয়েছে আর তাদের মধ্যে নিজের ক্ষমতাবলে টিকে গিয়েছে মানুষ। সবসময় তাই যুদ্ধ করতে হয়েছে তাকে। নিজের সাথে, সবার সাথে, পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে। ক্ষুধাবোধ এবং কোনোকিছু খাওয়া- এ দুটোই হলো মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। আর এই সহজাত প্রবৃত্তির কাছে হার মেনে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে মানুষের শরীরের মাংস কেটে খেতে বাধ্য হয়েছিলেন পেদ্রো আলগোরতা।

পেদ্রো আলগোরতো; Source: intothemountainsbook.com

“বেঁচে থাকা সবময়েই মানুষের প্রধান কাজ, আর বাঁচার জন্য প্রয়োজন খাবার, যেটা কেবল কোনো যৌক্তিক ব্যাপার নয়, বরং অনেকটাই সহজাত প্রবৃত্তি। আমি সবসময় খেতে ভালবাসতাম, আমার একটা হাত পকেটে থাকতো আর খানিক পরপর পকেট থেকে কিছু বের করে মুখে পুরতাম। মনে হত নিজেকে পুষ্টি যোগাচ্ছি”।

কথাগুলো পেদ্রো আলগারতোর। বিমান দুর্ঘটনার পর টানা ৭১ দিন আন্দিজ পর্বতমালার ভেতরে আটকে থাকা এক মানুষের কথা। কী করে বেঁচে  ছিলেন ভোজনপ্রিয় এই মানুষটি? এতগুলো দিন না খেয়ে কীভাবে পেরেছিলেন তিনি? না, একেবারে যে না খেয়েছিলেন পেদ্রো তা কিন্তু নয়। তবে খাবার ছিলো না সেখানে। তাই হাত, উরু এবং পুষ্টি জোগাতে পারে, শরীরের এমন সব অংশের মাংস খেয়েছিলেন তিনি!

উদ্ধারের পর ক্যানেসা; Source: Business Insider

৭১টি দীর্ঘ দিন! ১৯৭২ সালের ১৩ই অক্টোবরের কথা। সেবার মোট ৪০ জন যাত্রী ও ৫ জন ক্রু নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল বিমানটি। আর তাতে সবার সাথে ছিল আলগারতোও। উরুগুয়ে রাগবি দল ওল্ড ক্রিশ্চিয়ানসের সাথে ভ্রমণ করছিলেন তিনি। উরুগুয়ে থেকে চিলি যাচ্ছিলেন তারা। পেদ্রোর বয়স তখন ২০ বছর। এমন সুন্দর সময়ে, এত অল্প বয়সে, পায়ের নিচে থাকা দুধ সাদা বরফের কোলে এমন কোনো বীভৎস অভিজ্ঞতা অর্জন করতে হবে সেটা ভুলেও মাথায় আসেনি পেদ্রোর। বিমানের ৪৫ জনের মধ্যে মাত্র ১৬ জনই টিকে থাকতে পেরেছিলেন অতিরিক্ত ঠান্ডা, বিমান দুর্ঘটনা এবং হাইপোথার্মিয়ার পর। দুর্ঘটনার বীভৎস সেই দিনগুলো পার হয়েছে অনেক বছর আগে। তবে সেসব কখনোই মনে করতে চাননি তিনি। দুর্ঘটনার ৩৫ বছর পর হুট করেই ভাবেন পেদ্রো, নিজের অভিজ্ঞতাকে লিখে রাখবেন। আর তারপরেই ১৯৭২ সালের সেই গা শিউরে ওঠা অভিজ্ঞতাগুলোকে একটু একটু করে লিখতে থাকেন তিনি। লিখে ফেলেন বই- “ইনটু দ্য মাউন্টেইনস”। নিজের নির্মম আর অবিশ্বাস্য সেই ৭১ দিনের বেঁচে থাকার গল্প বলেন পুরো পৃথিবীকে।

গল্পটা কেবল পেদ্রো আলগারতোর একার নয়। এ গল্পে ছিলেন আরো ১৬ জন মানুষ, যারা শেষ পর্যন্ত ফিরে আসতে পেরেছিল মানবসভ্যতায়। এই ১৬ জনের একজন রবার্তো ক্যানেসা নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখেন- “আই হ্যাড টু সারভাইভ”। এছাড়া ১৯৯৩ সালে এই ঘটনাকে ভিত্তি করে নির্মিত হয় চলুচ্চিত্র “অ্যালাইভ”। স্বজাতি ভক্ষণ মানব সভ্যতায় কখনোই স্বীকৃতি পায়নি। মানুষ এমন বীভৎস ঘটনাকে স্থান দেয়নি নিজেদের মধ্যে। তবে বাধ্য হয়ে একটা সময় পেদ্রোকে সেটাই করতে হয়। তাকে সঙ্গ দেয় বাকীরাও।

ক্যানেসা ও তার বই আই হ্যাড টু সাউভাইভ; Source: Cole’s Books

“আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বেঁচে থাকা। কিন্তু আমাদের কোনো খাবার ছিল না। প্লেন থেকে জমানো খাবার কিছু পেয়েছিলাম, সেটাও অনেক আগেকার কথা। আর কিছুদিন পর যখন আমাদের শরীর অনেক বেশি দুর্বল হয়ে পড়তে লাগলো তখন আমরা বুঝলাম যে, আশেপাশে খাওয়ার মতো কোনো শাক কিংবা একটি পোকাও ছিল না।”

প্রাথমিকভাবে বিমান দুর্ঘটনার পর মোট ২৭ জন মানুষ বাঁচতে পেরেছিল। তবে এক রাতের ভেতরেই ভীষণ ঠান্ডায় তাদের ৮ জন মারা যায়। এমনকি একটু একটু করে ঠান্ডায় জমাট বাঁধা সঙ্গীদের শরীর খাওয়া শুরু করলে সেটাও দ্রুত শেষ হতে থাকে। নিজের দুঃস্বপ্নেও যেটা ভাবেননি সেটাই করতে শুরু করেন তখন পেদ্রোর দল। নিজের মৃত সঙ্গীদের পর নিজেদের মৃতপ্রায় সঙ্গীদের শরীরের দিকে ঝুঁকতে থাকেন। একমাত্র আশা ছিল, কেউ না কেউ, কোন না কোনদিন হয়তো তাদের খুঁজে বের করা হবে। মৃত্যুর আগে কিংবা পরে তারা ফিরে যাবেন মানুষের কাছে। ২৩শে ডিসেম্বর, বিমান দুর্ঘটনার ৭২ নম্বর দিনে অবশেষে সাহায্য আসে। মোট ১৬ জন মানুষকে বাঁচানো সম্ভব হয়।

তরুণ পেদ্রো; Source: Pinterest

কীভাবে পেরেছিলেন তারা? মানসিক দৃঢ়তা ও বেঁচে থাকার জন্য হন্য হয়ে স্বজাতি ভক্ষণকেই নিজেদের বেঁচে থাকার পেছনের কারণ বলে মনে করেন ক্যানেসা ও পেদ্রো। নিজেদের অতীত নিয়ে কি তারা ক্ষমাপ্রার্থী? কখনো কি মনে হয় যে এমনটা করে অপরাধ করে ফেলেছেন?

ক্যানেসা মন থেকে কখনোই সেই কালো অধ্যায়কে তাড়াতে পারেননি। সবাই অনেক সহজভাবে তাদেরকে আপন করে নিলেও যে সঙ্গীদের খেয়েছিলেন তারা, তাদের পরিবারের কাছে সবসময় নিরুত্তর থাকতে হবে বলে ভাবেন তিনি। তবে পেদ্রো আলগোরতার ভাবনাটা অন্যরকম। তার মতে, পুরো ব্যাপারটিই ক্ষমা চাওয়ার আর না চাওয়ার অনেক উর্ধ্বে। সেসময় নিজেদের ইচ্ছায় কিছু করেননি তারা। এটা অনেকটা যেন নিজ থেকেই চলে এসেছিল ব্যাপারটা। কেউ যেন বলে দিচ্ছিল যে, তোমাকে এটা করতে হবে।

৬৬ বছর বয়স্ক পেদ্রো তাই ব্যাপারটিকে আর দশটা সহজ-স্বাভাবিক ক্যানিবালিজম বা স্বজাতি ভক্ষণের মধ্যে ফেলেন না। শুধু তা-ই নয়, নিজের সেই সময়ের সেই অনুভূতিগুলোকেও খুব একটা মনে করতে চান না বলেই জানান পেদ্রো। আন্দিজ থেকে ফিরে আসার পর একটি প্রেস কনফারেন্সে ডাকা হয় উদ্ধারকৃত যাত্রীদের। এরপর অনেকদিন চলে গিয়েছে। নিজের মতো করে, নতুন করে বাঁচতে শুরু করেছেন পেদ্রো। বুয়েন্স আয়ার্সে গিয়ে অর্থনীতি পড়াশোনা শেষ করেন। পরবর্তীতে সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ করেন। পড়াশোনা শেষে চমৎকার এক ব্যবসায়িক জীবন শুরু করেন তিনি। ভুলেও নিজের অতীত নিয়ে কোনরকম চিন্তা কিংবা বাড়তি অনুভূতির বোঝা বহন করতে চাননি পেদ্রো আলগোরতা।

সেদিনের সেই পাহাড়ের কাছে ফিরে গিয়েছিলেন পেদ্রো; Source: Vice

“গত ৪০ বছর ধরেই আমি স্বাভাবিক জীবন যাপনের চেষ্টা করে আসছি”, এমনটাই জানান তিনি। তবে সহযাত্রীদের অভিজ্ঞতার কথা শুনে নিজের অনুভূতিগুলোকেও লিখে রাখার মতো বলে মনে হয় পেদ্রোর। বিমান দুর্ঘটনা থেকে শুরু করে মানুষের মাংস ভক্ষণ এবং ফিরে আসা- সবটুকুই ছিল দলগত কাজ। এক্ষেত্রে সবাই একই চিন্তা করছিল তখন, আর সেটা হলো- বাঁচতে হবে। তবে পরবর্তীতে এই ঘটনাটিকে একেকজন একেকভাবে ভেবেছেন। প্রত্যেকটি মানুষের অভিজ্ঞতা ভিন্ন হয়, আর তাই বলার ধরনও ভিন্ন হবে বলেই মনে করেন তিনি।

অনেকের পরিবার বিশ্বাস করতে চায়নি প্রথমে যে তাদের কেউ মানুষের মাংস খেয়েছে। তবে ধীরে ধীরে সবাই বুঝতে পেরেছে। পেদ্রো নিজেও মনে করেন যে, ব্যাপারটি খুব দ্রুত বুঝে ফেলার মতো বিষয়। ক্যানেসার জন্য ব্যাপারটি খুব দুর্ভাগ্যজনক, লজ্জার ও কষ্টের। তবে পেদ্রোর জন্য একেবারেই তা নয়। “সেদিন মানুষের মাংস না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে আজ আমি এখানে থাকতাম না”, এটা বলে নিজের কাজের প্রতি সম্মতি জানিয়ে কথা সমাপ্ত করেন পেদ্রো। সত্যিই কি ঠিক ছিলেন তিনি, নাকি নয়? বিচারটা না হয় আপনিই করুন!

ফিচাম ইমেজ: BBC

Related Articles