মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে নিয়ে দুনিয়া জুড়ে হৈ চৈ আর তামাশা কম হয়নি। বারাক ওবামার উত্তরসূরির হুটহাট সিদ্ধান্ত নেওয়া; নিজের সিদ্ধান্তকে নিজেই নাকচ করে দিয়ে ফের সিদ্ধান্ত পাল্টানো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার শত্রুদের তো বটেই, তার বনধু দেশগুলিকেও মহা ফাঁপরে ফেলেছে মাঝেমধ্যেই। দেড় বছরও হয়নি ট্রাম্প হোয়াইট হাউসে এসেছেন, এর মধ্যেই যেন অতিষ্ঠ মার্কিন প্রশাসন সহ সমস্ত আন্তর্জাতিক রাজনীতির কারবারিরা।
কিন্তু তারপরেই ঘটল উত্তর কোরিয়ার শান্তিপর্ব। যখন ভাবা হচ্ছিল উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের সংঘাত একটা কেলেঙ্কারি বাঁধিয়েই ছাড়বে, যখন উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা কিম জং-উন এর সঙ্গে ট্রাম্প নিত্যদিন জড়িয়ে পড়ছেন কথার তুমুল লড়াইতে; দু’পক্ষই যেসময় হুমকি দিচ্ছে একে অপরকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার- ঠিক সেই সময়ে হঠাৎই যেন উত্তর কোরিয়ার মাথায় লক্ষ্মী ভর করলেন। কিম ঘোষণা করলেন, তার দেশ আর কোনো পরমাণু পরীক্ষা-নিরীক্ষার পথে যাবে না।
২০১৮ সালের অগ্রভাগে শত্রু দক্ষিণ কোরিয়ার, যার সঙ্গে উত্তর কোরিয়া এখনও সত্যিই যুদ্ধে জড়িত, সঙ্গে উত্তর কোরিয়া এক অভূতপূর্ব সমঝোতার প্রদর্শন করে। ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়ার পিয়ংচ্যাং-এ শীতকালীন অলিম্পিকের উদ্বোধনী মঞ্চে একই পতাকার নিচে কুচকাওয়াজ করে দুই কোরীয় দল। এরপর অতি সম্প্রতি দক্ষিণ এবং উত্তর কোরিয়ার আধিকারিকদের মধ্যে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক শুরু হয়, যার শেষ হওয়ার কথা দুই কোরীয় শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে বৈঠকের মাধ্যমে।
আর এর আগে গত মার্চ মাসে দক্ষিণ কোরিয়ার এক উচ্চপদস্থ কূটনীতিক ট্রাম্পের কাছে উত্তর কোরিয়ার তার সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাব পেশ করলে ট্রাম্প তা নিমেষে লুফে নেন। আগামী মে মাসের শেষে বা জুন মাসের শুরুতে এই বৈঠক হওয়ার কথা, যদিও কোথায় হবে তা এখনও ঠিক হয়নি। আর দুই কোরিয়ার মধ্যে আলোচনার ঠিক আগে কিম স্বয়ং পুরোনো মিত্র চীনে গিয়ে সেখানকার রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং-এর সঙ্গে দেখা করে আসেন।
উত্তর কোরিয়ার পরমাণু সমস্যার সমাধান পেতে এই বিবিধ আলোচনাচক্রের প্রয়োজন ছিল নিদারুণ। যেকোনো সমস্যার সমাধান পেতে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে, ট্রাম্প এবং কিম যেভাবে একে অপরের প্রতি আক্রমণ শানাচ্ছিলেন, তাতে পরিস্থিতি আরও জোরালো হয়ে উঠছিল।
কিম হঠাৎ কেন পিছিয়ে এলেন?
কিন্তু কেন হঠাৎ কিম এর উত্তর কোরিয়া এই লড়াই থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিলেন? তিনি কি শেষমেশ ট্রাম্পের চোখ রাঙানিকে ভয় পেলেন? তার পিছিয়ে আসায় কি প্রমাণিত হলো যে, এযাবৎকাল ধরে পিয়ংইয়ংয়ের সমস্ত রকম হুমকি আসলে ছিল কাগুজে বাঘের গর্জন?
কিমের এই সিদ্ধান্তের আসল কারণ হচ্ছে উত্তর কোরিয়ার অর্থনৈতিক বিপর্যয়। বিগত দেড় দশক ধরে কিম এবং তার প্রয়াত পিতা কিম জং-ইল এর রাজত্বকালে পিয়ংইয়ং যতই নিজের পরমাণু পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে একগুঁয়েমি দেখিয়েছে, ততই আন্তর্জাতিক দুনিয়া তার উপরে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। এই নিষেধাজ্ঞার পাহাড় জমতে জমতে এখন উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতির রীতিমতো হাঁসফাঁস অবস্থা।
উত্তর কোরিয়ার অভ্যন্তরীণ রাজনীতির সঙ্গে যারা পরিচিত, তাদের মতে, আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার চাপে উত্তর কোরিয়ার অর্থনীতির এমন বেহাল অবস্থা যে আর এক বছরও কিমের সাম্রাজ্য টিকে থাকতে পারবে কিনা বলা শক্ত। গত বছর শেষের দিকে কিমের এক প্রাক্তন উপদেষ্টা রি জং-হো যিনি পরে সেদেশ ত্যাগ করেন, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন এই সমস্ত নিষেধাজ্ঞার ফলে যে অব্যবস্থা তৈরি হবে, তাতে প্রাণও হারাতে পারেন অসংখ্য মানুষ।
তিনি এও বলেন যে, মুখে ট্রাম্প এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ধ্বংস করে দেওয়ার হুমকি দিলেও আদতে উত্তর কোরিয়ার আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা জরুরি, নিজেরই অস্তিত্বের স্বার্থে।
আর এখানেই কিমের এমন সিদ্ধান্তের আসল কারণ লুকিয়ে রয়েছে। ট্রাম্পের কঠোর অবস্থান অবশ্যই কিমকে বাধ্য করেছে নরম হতে, কিন্তু তিনিও বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব বাড়িয়ে দিয়ে। পাশাপাশি চীন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গেও সম্পর্ক ভালো করার প্রচেষ্টা দেখিয়েছে যে, কিম এতদিন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেভাবে না মিশলেও কোরীয় উপদ্বীপ অঞ্চলে শান্তিপ্রক্রিয়াকে সফল করতে হলে সব দলকেই সঙ্গে নিয়ে এগোতে হবে, তা তিনি বোঝেন ভালোই। আর তাই একই সঙ্গে চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং আমেরিকার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্থাপনের মাস্টারস্ট্রোক তার।
‘মেইনস্ট্রিম’কে চ্যালেঞ্জ করে টিকে থাকা দুষ্কর
অনেকে, এমনকি রাষ্ট্রপতি ট্রাম্পও এখনও উত্তর কোরিয়া সমস্যা মিটে গেছে বলে মানতে রাজি নন। অতীতেও উত্তর কোরিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষপর্যন্ত তা রাখেনি- এমন কথা শোনা গেছে। কিন্তু একথা ভুলে গেলে চলবে না যে, দুনিয়ার কোনো প্রান্তেই ‘বিপ্লবী’দের কর্মকাণ্ড একটানা চলেনি। সে নেপালের মাওবাদী হোক বা শ্রীলঙ্কায় এলটিটিই- এরা কোনো না কোনো সময়ে ‘মেইনস্ট্রিম’কে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়েছে; নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয় তৈরি করার প্রতিজ্ঞা করেছে, কিন্তু বেশ কিছুদিন পরে হয় সেই ‘মেইনস্ট্রিম-এর সঙ্গেই মিশে গিয়েছে বা রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে সম্মুখ সংঘর্ষে বিলীন হয়ে গিয়েছে। অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক প্রতিকূলতাই এর কারণ।
উত্তর কোরিয়ার ক্ষেত্রেও একই কথা খাটে। কিম এতদিন একটি যুদ্ধবাজ অবস্থান নিয়ে আসছিলেন, কারণ, তিনি ক্রমশই একা হয়ে পড়ছিলেন। যে চীনের উপরে উত্তর কোরিয়া ভরসা করতো পশ্চিমের সঙ্গে সংঘাতের সময়ে, সেই চীনও একটি সময়ের পরে উত্তর কোরিয়ার উপরে চাপ সৃষ্টি করতে তৎপর হয় তার পরমাণু কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ করতে; উত্তর কোরিয়ার উপরে নিষেধাজ্ঞাকেও সমর্থন জানায় বেইজিং। চীনের আশঙ্কা ছিল যে, উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধংদেহি মনোভাবের ফলে তার নিজের দ্বারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র দেশ দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানও মারমুখী অবস্থান নিচ্ছে, যার ফলে পরিস্থিতি হয়ে উঠতে পারে আরও ঘোরালো।
আবার, যদি সত্যি সত্যি মার্কিন ক্ষেপণাস্ত্র কিমের সাম্রাজ্যকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়, তাহলে উত্তর কোরিয়া থেকে চীনে বিপুল সংখ্যক শরণার্থী ঢুকে পড়লে তা বেইজিং এর পক্ষে যথেষ্ঠ উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। চীন এবং রাশিয়া আদতে উত্তর কোরিয়াকে পশ্চিমের বিরুদ্ধে তাদের একটি ‘বাফার’ রাষ্ট্র হিসেবে দেখে, আর এই বাফারের অস্তিত্ব তাদের কাছে অপরিসীম।
কিন্তু কিম চীনের এই ‘বড়ভাইসুলভ’ আচরণে সন্তুষ্ট হয়নি। চীনের কাছে বরং সে আশা করেছিল নিঃশর্ত সমর্থন। দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ নেতৃত্ব বা ট্রাম্পের সঙ্গে দেখা করার আগে তিনি জিনপিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে চীনে গিয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তা ছিল কূটনৈতিক চাল। ওয়াশিংটন এবং সিউলকে দেখানো যে, চীন আমার সঙ্গেই যাচ্ছে। কূটনীতিটা খারাপ খেলেন না উত্তর কোরিয়ার এই অনূর্ধ-চল্লিশ রাষ্ট্রনেতা।
কিমের আসলে চাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন
কিন্তু আসলে কিমের চাই মার্কিন অর্থনৈতিক সহযোগিতা। অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়লে তার গদি যে এমনিই উল্টে যাবে, সে তিনি ভালোই জানেন। অতি বড় পরমাণু অস্ত্রও তখন বিশেষ উপকারে আসবে না। আর তাই সময় থাকতে থাকতেই তিনি চাইছেন সঠিক দিশায় যাত্রা শুরু করতে। উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে কারও ঠাণ্ডা যুদ্ধের সময়কার আদর্শগত লড়াই নেই। যা আছে তা হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংঘাত আর তা থেকে এখন বেরিয়ে আসতে চাইছেন স্বয়ং কিমই।
উত্তর কোরিয়ার সঙ্কট কমাতে কিমের বাস্তবিক চিন্তাভাবনা অবশ্যই ট্রাম্পের থেকে বড় ভূমিকা পালন করেছে, কিন্তু কিমের বৈঠকের প্রস্তাব গ্রহণ করে তিনিও বেশ বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। এযাবৎ ট্রাম্পকে যে সমস্ত পদক্ষেপ নিতে দেখা গেছে, এটি নিঃসন্দেহে সবচেয়ে ফলপ্রসূ।
কিম এবং ট্রাম্প- এই দুই বদরাগী নেতার কাছে এমন পরিণত পদক্ষেপ দেখে পৃথিবীর মানুষ আশান্বিত হতেই পারেন।
Featured Image Source: The Straits Times