২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল দিনটি এশিয়ার কূটনৈতিক ইতিহাসে বেশ উল্লেখযোগ্য দিন ছিল। একদিকে যেমন উত্তর এবং দক্ষিণ কোরিয়া সীমান্তে পানমুনজমে এক দশকেরও বেশি সময়ে পরে দেখা করেছেন দুই দেশের শীর্ষ নেতৃত্ব, তেমনই মধ্য-পূর্ব চীনের হুবেই প্রদেশের উহান শহরে পরস্পরের সঙ্গে বৈঠক করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং চীনের রাষ্ট্রপতি শি জিনপিং।
চীনা নেতৃত্বের সঙ্গে মোদীর এই বৈঠক যথেষ্ঠ তাৎপর্যপূর্ণ নানা কারণে। একদিকে যেমন এই বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হলো ডোকলাম নিয়ে দুই দেশের মধ্যে সামরিক সম্পর্কের অবনতির পরের বছর, তেমনই তা পরবর্তী লোকসভা নির্বাচনেরও আগের বছর। আর মোদীকে এই দুইয়ের মধ্যবর্তী সময়ে পা ফেলতে হচ্ছে যথেষ্ঠ সমঝে।
মোদী এই মুহূর্তে ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা, সে বিষয়ে কোনো দ্বিমত নেই। আগামী সাধারণ নির্বাচনেও যে তারই ফের জিতে ক্ষমতায় আসার পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে, তাও মোটামুটি বলে দেওয়া চলে। কিন্তু তবুও মোদীর কপালে কিছু বিষয়ে চিন্তার ভাঁজ রয়েছে আর সেই সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্যেই শি-এর সঙ্গে এই ‘ইনফর্মাল’ বৈঠকেরও দরকার ছিল।
সাম্প্রতিক সময়ে মোদী সরকারের সামনে ঘরে এবং বাইরে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ এসেছে। অভ্যন্তরীণ রাজনীতি-সমাজনীতিতে হিন্দুত্ববাদীদের বাড়াবাড়ি যেমন বেশ সমালোচনার সামনে ফেলেছে মোদী সরকারকে, তেমনই নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত ঘটতে থাকা ভয়ঙ্কর অপরাধও তাকে ফেলেছে যথেষ্ট অস্বস্তিতে।
সম্প্রতি কাঠুয়া এবং উন্নাওতে দুই শিশুকে ধর্ষণের ঘটনা এবং তার পাশাপাশি গতবছর বর্ষীয়ান সাংবাদিক গৌরী লঙ্কেশকে বেঙ্গুলুরুতে তার বাড়ির সামনে গুলি করে মারার ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোদীকে প্রবল বিক্ষোভ দেখতে হয় ব্রিটেন সফরেও। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গত চার বছরের রাজত্বকালে মোদী সরকার চাকরি তৈরির ক্ষেত্রে সেভাবে সাড়া জাগাতে পারেনি; উল্টো “পাকোড়া বিক্রি করাও কাজ” জাতীয় উক্তি করে বিরোধীদের প্রবল সমালোচনার মুখে পড়েছে।
ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভরসাযোগ্য নয়
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মোদী তার জমানার প্রথম দিকে সুসম্পর্ক স্থাপনের জন্যে সচেষ্ট হলেও বারাক ওবামার বিদায় এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের আগমনের পর আবহ বদলে গিয়েছে অনেকটাই। মুখে শুধু চীনের সঙ্গে বাণিজ্যের বিরোধিতা করলেও ট্রাম্প তার কাজে-কর্মে দেখিয়েছেন যে, তিনি মার্কিন স্বার্থ ছাড়া আর কিছু নিয়েই বেশি ভাবিত নন।
যুক্তরাষ্ট্রে সেখানকার স্থানীয়দের জন্যে কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে ভারতীয়দের ভিসা দেওয়া নিয়ে কড়াকড়ি তো রয়েছেই, পাশাপাশি পরিবেশ এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক বিষয়েও সময়ে সময়ে ভারতকে খোঁটা দিতে ছাড়েননি বর্তমান মার্কিন রাষ্ট্রপতি। আবার আফগানিস্তানে ভারতকে আরও বড় ভূমিকা নিতে হবে বলে বা এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলকে ইন্দো-প্যাসিফিক নাম দিয়ে পাকিস্তান বা চীনকে বিব্রত করতে ভারতের নাম ব্যবহার করতেও পিছপা হননি তিনি।
তাই এই স্বার্থপর রাষ্ট্রনায়ককে বেশি ভরসা করতে গিয়ে চীনের বিরোধিতা করার মধ্যে বিচক্ষণতা আদৌ কতটা রয়েছে, তা নিয়ে মোদী সরকার যে ভাবনাচিন্তা শুরু করেছে, তা উহান-এর বৈঠক ডাকার মধ্যেই পরিষ্কার হয়। তাছাড়া, ব্রেক্সিটের কারণে ইউরোপ এবং ব্রিটেনের সঙ্গেও ভারতকে আলাদাভাবে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এখন, যা সময়সাপেক্ষ। অতএব চীনের মতো একটি শক্তিশালী অর্থনীতির সঙ্গে সম্পর্ক মেরামতি করাই মোদী সরকারের পক্ষে সহজতর এবং বুদ্ধিমানের কাজ।
মোদীকে এখন দেখাতে হবে যে তিনি আবেগ দিয়ে পররাষ্ট্রনীতি সামলাননি
গত বছরের ডোকলাম সংঘাতের পরে মোদীকে দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীর কাছে এও দেখাতে হতো যে, তিনি পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে এখনও ততটাই যত্নবান, যতটা তিনি ছিলেন চার বছর আগে প্রধানমন্ত্রিত্বের দায়িত্ব নেওয়ার সময়ে। ভারত এখনও চীনের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার ক্ষমতায় পৌঁছায়নি। আর শুধু শুধু যুদ্ধবাজ আবেগে বশবর্তী হয়ে জনমানসে নির্বোধ প্রতিপন্ন হওয়ার মতো কাঁচা কাজ করার লোক নরেন্দ্র মোদী নন।
তার চেয়ে চীনের সঙ্গে সমঝোতা করে যদি তার সাহায্যে কিছু অর্থনৈতিক উপকার পাওয়া যায় এবং বর্তমান আন্তর্জাতিক ব্যবস্থায় ভারত ও চীনের মতো দুটি দ্রুত উন্নতিশীল অর্থনীতির মেলবন্ধনের ভিত্তিটি আরও জোরদার করা যেতে পারে, তবে আখেরে ভারতেরই লাভ।
মনে রাখতে হবে যে, বর্তমানে ব্রিকস নামক আন্তর্জাতিক মঞ্চটির দুই বড় শরিক হচ্ছে চীন এবং ভারত। আর এই মঞ্চটি বিশ্ব অর্থৈনৈতিক ব্যবস্থায় একটি বিকল্প দিশা দেখানোর কাজে ব্রতী। তাই ভারত এবং চীনের একসঙ্গে অনেক কিছু অর্জন করার রয়েছে। ঝগড়া বিবাদে জড়ালে সার্বিক ফল হবে উল্টো।
ভারতীয় রাজনীতিতে মোদী একজন শক্তিশালী নেতা হলেও, দিনের শেষে তিনি একটি গণতান্ত্রিক পরিমণ্ডলের নেতা। আর গণতন্ত্র মানেই মানুষের কাছে দায়বদ্ধতার হিসেবে দেওয়ার দায়িত্ব। চীনের সর্বোচ্চ নেতা জিনপিং-এর সে মাথাব্যথা নেই; সম্প্রতি জীবনভর রাষ্ট্রপতি হওয়ার পরে তো আরওই নেই। কিন্তু মোদীকে তার দ্বিতীয় দফার ক্ষমতা জিততে হলে স্বদেশের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, গণমাধ্যম এবং সমাজের সম্মুখীন হতে হবে। তিনি এতদিন নিজের একটি ‘অতিমানব’ ভাবমূর্তি গণপরিসরে লালিত করে এসেছেন; নির্বাচনের আগে সেটা কোনোভাবে আহত হোক তা তিনি চাইবেন না।
আর তাই দেশের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশীর সঙ্গে সম্পর্ক জোড়া লাগানোর তোড়জোড়; দেশের ব্যাঙ্ক ব্যবস্থাকে লুট করার নামে অভিযুক্ত নীরব মোদীকে হংকং থেকে দেশে ফিরিয়ে আনার কথাও চীনের সঙ্গে সুসম্পর্ক তোলার পরিকল্পনা। লক্ষ্য, জনসাধারণের মনে দাগ কাটা। সংখ্যালঘু নিপীড়ন এবং ধর্ষণের মতো ঘৃণ্য অপরাধ যখন তার সরকারকে বেকায়দায় ফেলছে, তখন এটাই মোক্ষম পথ।
তবে পথে কাঁটা কিছু থাকবেই
তবে মোদীর চীন প্রীতির এই নয়া উদ্যোগের সামনে কিছু প্রশ্ন থাকবে। সম্প্রতি চীন তার ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই) প্রকল্পটিকে নিয়ে বিশ্বজুড়ে একটি আলোড়ন ফেলেছে। দক্ষিণ এশিয়াতেও ভারতের অনেক ছোট প্রতিবেশী দেশ চীনের এই প্রকল্পে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, যাতে তারা চীনের এই বিপুল ভূ-অর্থনৈতিক প্রকল্প থেকে লাভবান হতে পারে।
সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসি করাচিতে চায়না-পাকিস্তান ইকনোমিক করিডোর এর শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানে বলেন, এই প্রকল্পটি পাকিস্তান এবং তার মিত্র চীনের মধ্যে এক বিশেষ সহযোগিতার পরিচায়ক। ভারত সে পথে হাঁটেনি। কারণ, এক তো দুই দেশের মধ্যে ইতিহাসগত রেষারেষি রয়েছেই; দ্বিতীয়ত, যেহেতু এই প্রকল্পের অন্তর্গত ‘চায়না-পাকিস্তান ইকোনোমিক করিডর’টি পাকিস্তান-অধ্যুষিত কাশ্মীর দিয়ে গিয়েছে, ভারত স্বভাবতই প্রতিবাদ জানিয়েছে; বলেছে তা তার সার্বভৌমত্বের পরিপন্থী।
মোদী-শি বৈঠকের দিন তিনেক আগেও ভারত একটি বৈঠকে চীনের এই প্রকল্পকে সমর্থন জানাতে অস্বীকার করেছে। অর্থাৎ, বন্ধুত্বের এই নয়া উদ্যোগের পরিবেশেও বিআরআই যেন গলার কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে। যদি চীন মোদীকে রাজি করাতে পারে এই প্রকল্পে যোগ দেওয়ার জন্য, তবে তা নিশ্চিতভাবেই এই দুই দেশের সম্পর্কের আবহে এক নতুন জোয়ার আনবে।
কিন্তু সেটা মোদীর পক্ষে খুব সহজ কাজ হবে না। কারণ, শি-এর সেই প্রস্তাব মেনে নিলে স্বদেশে তিনি আবারও বিরোধী এবং গণমাধ্যমের প্রবল রোষানলে পড়বেন এবং তাতে পণ্ড হতে পারে তার ফের ক্ষমতায় ফেরার প্রচেষ্টাও।
Featured Image Source: AFP