অবশেষে উত্তর কোরিয়া তার পরমাণু অস্ত্র পরীক্ষার কেন্দ্রটি বন্ধ করার সম্ভাব্য সময় জানিয়েছে। পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা বন্ধ করার কথা রাখতে তারা আগামী ২৩-২৫ মের মাঝে তাদের এই পরীক্ষা কেন্দ্রটি ভেঙে ফেলার পরিকল্পনা করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতের প্রায় তিন সপ্তাহ আগে এই উদ্যোগ নিচ্ছে উত্তর কোরিয়া। কিন্তু কীভাবে ভেঙে ফেলা হবে এই পরীক্ষা কেন্দ্রটি? আসলেই কি কোরিয়া পুরোপুরিভাবে পারমাণবিক তৎপরতা বন্ধ করবে? আসন্ন ট্রাম্প-কিম সাক্ষাতে কি পারমাণবিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করার শর্ত মেনে নেবে উত্তর কোরিয়া?
কোন পরমাণু কেন্দ্র ভেঙে ফেলা হবে?
পাঙ্গাই-রি পরমাণু কেন্দ্রটিকে উত্তর কোরিয়ার প্রধান পারমাণবিক পরীক্ষা কেন্দ্র বলে মনে করা হয়। উত্তর কোরিয়ার উত্তর-পূর্বের পাহাড়ি অঞ্চলে অবস্থিত এটি। এই কেন্দ্রটির কাছেই অবস্থিত মান্টাপ পর্বতের নিচে খনন করা সুড়ঙ্গে বিশেষ ব্যবস্থায় পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো হয়। ২০০৬ সাল থেকে সেখানে ৬টি পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো হয়।
২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষা চালানোর পরে পরমাণু কেন্দ্রটিতে বেশ কিছু ভূ-কম্পন আনুভূত হয়। ভূকম্পবিদদের মতে, পর্বতের ভেতরের অংশ ধসে যাওয়ার ফলে এই ভূ-কম্পনের সৃষ্টি হয়েছিল।
কীভাবে ভেঙে ফেলা হবে পরমাণু কেন্দ্রটি?
পাঙ্গাই-রি পরমাণু কেন্দ্রটি ভেঙে ফেলার নির্দিষ্ট তারিখ আবহাওয়ার উপর নির্ভর করবে। কেন্দ্রটির সবগুলো টানেল বিস্ফোরক দিয়ে ধসিয়ে দেওয়া হবে এবং প্রবেশ পথগুলো বন্ধ করে দেওয়া হবে। এছাড়াও সবগুলো নিরাপত্তা চৌকি, পরিদর্শন কেন্দ্র এবং গবেষণা ভবন বন্ধ করে দেওয়া হবে।
উত্তর কোরিয়া জানায়, এটি প্রত্যক্ষ করার জন্য শুধু স্থানীয় সাংবাদিকদের নয় বরং বিদেশি সাংবাদিকদেরও আমন্ত্রণ জানানো হবে। কেননা তাদের উদ্দেশ্য হলো তাৎক্ষণিকভাবে পুরো বিশ্বকে এটি জানানো। তারা পুরো প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ উপায়ে সম্পন্ন করতে চায়। সে উদ্দেশ্যে দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও রাশিয়া থেকে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হবে।
পরমাণু কেন্দ্রটি বসতিহীন পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত এবং জায়গার স্বল্পতার কারণে স্থান সংকুলান করতে না পারার জন্য স্বল্প সংখ্যক দেশ থেকে সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রটি কি বিশেষজ্ঞদের অনুপস্থিতিতেই ভেঙে ফেলা হবে?
গত এপ্রিলে দক্ষিণ কোরিয়ার কর্তৃপক্ষ জানায়, কেন্দ্রটি বন্ধ করার জন্য উত্তর কোরিয়া যুক্তরাষ্ট্র ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে বিশেষজ্ঞ আমন্ত্রণ জানানোর পরিকল্পনা করছে। তবে সম্প্রতি এটি ভেঙে ফেলার পরিকল্পনায় এধরনের বিশেষজ্ঞের উপস্থিতির কোনো উল্লেখ করেনি দেশটির রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম।
তবে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়-ইন এটি বন্ধ করার ব্যাপারটি যাচাই করার জন্য জাতিসংঘের সাহায্য চেয়েছিলেন।
উত্তর কোরিয়া কি আসলেই পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধ করবে?
উত্তর কোরিয়া পরমাণু কার্যক্রম বন্ধ করলেও তা পুরোপুরি যুক্তরাষ্ট্রের দাবি অনুযায়ী না হয়ে ভিন্নও হতে পারে। উত্তর কোরিয়ায় সাম্প্রতিক সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও জানান, পারমাণবিক তৎপরতা বন্ধের এরকম দাবি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশ কর্তৃক ভালোভাবে যাচাই করে নেওয়া উচিত।
এর আগে উত্তর কোরিয়ার পক্ষ থেকে চুক্তি ভঙ্গ করার অভিযোগ রয়েছে। ১৯৯৪ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন উত্তর কোরিয়ার কিছু কেন্দ্রে হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিলেন। গোয়েন্দাদের পক্ষ থেকে তার কাছে তথ্য ছিল যে, উত্তর কোরিয়া প্লুটোনিয়াম তৈরি করার মতো জ্বালানি আমদানি করছে।
তিনি হামলার হুমকি দিলেও উত্তর কোরিয়ার সাথে একটি চুক্তিতে আসতে সমর্থ হন। চুক্তির শর্ত ছিল যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়াকে জ্বালানি দেবে যার পরিবর্তে তারা এই প্রকল্প বন্ধ করবে। যুক্তরাষ্ট্র জ্বালানি সরবরাহ করলেও উত্তর কোরিয়া পরবর্তীতে এর শর্ত ভঙ্গ করলে ২০০২ সালে চুক্তিটি বাতিল হয়ে যায়।
২০০৭ সালে পিয়ংইয়ং জানায়, নিরস্ত্রকরণের পরিবর্তে সাহায্যের চুক্তি অনুযায়ী তারা ইয়ংবিয়ন রিয়্যাক্টরটি বন্ধ করে দিয়েছে। পরের বছর এর কুলিং টাওয়ারটি বন্ধের মাধ্যমে তারা পারমাণবিক কার্যক্রম বন্ধের প্রতিশ্রুতি সম্পন্ন করে। তবে ২০১৩ সালে আবারও ইয়ংবিয়ন রিয়্যাকটর চালু করার ঘোষণা দেওয়া হয়। পরবর্তীতে বিশেষজ্ঞরা তা প্রমাণিত করেন।
তাই পাঙ্গাই-রি পরমাণু কেন্দ্র ভেঙে ফেলার অর্থ এটা না যে, তারা পারমাণবিক তৎপরতা পুরোপুরি শেষ করতে যাচ্ছে।
পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষার জন্য উত্তর কোরিয়ার কতগুলো টানেল রয়েছে?
উত্তর কোরিয়ার মোট ৪টি টানেল রয়েছে। এর মাঝে পূর্ববর্তী পরীক্ষার কারণে দুটি টানেল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে এবং একটি টানেল এখনও ব্যবহারযোগ্য রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের একজন কর্তৃপক্ষ নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, অপর একটি টানেলে এখনও নির্মাণকাজ চলছে।
ট্রাম্পের নতুন পদক্ষেপ
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন আসন্ন জুনের ১২ তারিখ সিঙ্গাপুরে সাক্ষাৎ করতে যাচ্ছেন। গত মার্চে কিম জং উনের দেওয়া এই আমন্ত্রণে ট্রাম্প সম্মত হন। এই প্রথম উত্তর কোরিয়ার কোনো নেতার সাথে মার্কিন প্রেসিডেন্টের আলোচনার জন্য সাক্ষাৎ হতে চলেছে।
যুক্তরাষ্ট্র চায়, পিয়ংইয়ং তার পারমাণবিক তৎপরতা পুরোপুরি অপরিবর্তনীয়ভাবে বন্ধ করবে। উত্তর কোরিয়া থেকে ছাড়া পাওয়া তিনজন মার্কিন বন্দিকে স্বাগত জানানোর কয়েক ঘন্টা পরেই ট্রাম্প এই সাক্ষাতের সময় ও স্থান নিশ্চিত করেন।
তিনি বলেন, “আমরা একটি নতুন পদক্ষেপ শুরু করতে যাচ্ছি- আমি সত্যিই ধারণা করছি আমরা খুব অর্থপূর্ণ কিছু করতে যাচ্ছি।“ তিনি আরও বলেন, “আমরা উভয়েই এটিকে বিশ্ব-শান্তির জন্য স্মরণীয় মুহূর্তে পরিণত করার চেষ্টা করব।“
এছাড়াও আগামী ২২ মে হোয়াইট হাউজে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জায়-ইনের সাথে ট্রাম্পের সাক্ষাৎ করার কথা রয়েছে। তবে হোয়াইট হাউজের প্রেস সচিব সারাহ স্যান্ডার্স জানান, তিনি মনে করেন না মুন জায়-ইন ট্রাম্প ও কিম জং উনের এই ঐতিহাসিক সাক্ষাতের সময় উপস্থিত থাকবেন।
উত্তর কোরিয়া আসলেই পারমাণবিক কার্যক্রম পুরোপুরি বন্ধ করবে কিনা তা সময়ই বলে দেবে। তবে বিশ্ববাসীর কাছে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের যে ধরনের ভাবমূর্তি ছিল, তার অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে তার সাম্প্রতিক কিছু সিদ্ধান্তের কারণে। কোরিয়ার যুদ্ধের পরে উত্তর কোরিয়ার প্রথম নেতা হিসেবে তিনি গতমাসে সম্মেলনের উদ্দেশ্যে দক্ষিণ কোরিয়া গমন করেন। পারমাণু কেন্দ্রটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার মাঝেও তার বিচক্ষণতার ছাপ রয়েছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সাথে সাক্ষাতের বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এটি তাদের পরবর্তী কর্মসূচী ও পদক্ষেপ নির্ধারিত করবে। বিতর্কিত উভয় নেতাই বিশ্বশান্তির জন্য প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবেন এটিই কাম্য।
Featured I magev Source: Nord Eclair