Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আঁধার চিরে আলো জ্বালানো জোনাকিদের গল্প

গল্প শুনতে কে-না ভালোবাসে! আজ শুনবো প্রকৃতির এক অপার সৌন্দর্য, বিস্ময়কর জোনাকির গল্প। বিস্ময়কর কেন বলছি? এরা আসলে কীট বৈ অন্য কিছুই নয়। জোনাকির সাথে আমাদের শৈশবেই কম-বেশি সকলের পরিচয় ঘটে থাকে। আর তা ঘটে মূলত গ্রামের বাড়ি বেড়াতে গিয়ে। শৈশবের কোনো এক সন্ধ্যা বা রাতে গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে বাবার বা দাদা-নানার হাতটি ধরে চলতে চলতে, অবাক বিস্ময়ে আমাদের মনকে নাড়া দিয়ে যায় এক উড়ন্ত আলোর ঝলকানি। ঘুঁটঘুঁটে নিমেষ কালো অন্ধকারে যেন সাঁঝ দেবতা সেই উড়ন্ত আলোদের দায়িত্ব দিয়ে রেখেছিল পথিককে পথ দেখানোর। আর তারাও যেন ঠিক সে দায়িত্ব একেবারে অক্ষরে- অক্ষরে পালন করেই চলেছে।

রাতের গ্রামীন বনপথে শৈশবের কোন একদিন জোনাকির সাথে পরিচয়; Source: youtube.com

জোনাকি ল্যামপিরিড বিটলের বংশদ্ভূত

জোনাকি একধরনের কীটবিশেষ। এই ধরনের বহু কীট আছে পৃথিবীতে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, আজ পর্যন্ত প্রায় হাজারখানেক অনুরূপ কীটের সন্ধান পেয়েছেন তারা। তাদের মাঝে দক্ষিণ আমেরিকার দ্যুতিসম্পন্ন যে কীটদের দেখা মেলে, তারা আরো অদ্ভুত! জোনাকিদের ক্ষেত্রে কেবল পেটের তলায় দ্যুতি দেখা যায়। কিন্তু দক্ষিণ আমেরিকার ঐসব কীটদের দেহের দু’দিকে থাকে দু’সারি আলোর বিন্দু, সামনের দিকেও থাকে গাড়ির হেডলাইটের মতো লাল আভাযুক্ত আলো। এ কারণে তাদের বলা হয় ‘রেলওয়ে বিটল’।

আলোক জ্যোতি ছড়ানো জোনাকি পোকা; Source: youtube.com

এ সমস্ত কীটদেরকে বিজ্ঞানীরা ল্যামপিরিড পরিবারে অন্তর্ভুক্ত করেছেন। ‘ল্যামপিরিড’ অর্থ দ্যুতিসম্পন্ন। অর্থাৎ এই পরিবারে অন্তর্ভুক্ত আছে যারা, তাদের সবার বৈশিষ্ট্যই হলো অন্ধকারের মাঝে আলোর দ্যুতি ছড়ানো। জোনাকি সহ আরো প্রায় দুই হাজার প্রজাতির কীট রয়েছে এই পরিবারটিতে।

বিভিন্ন প্রজাতির কীটের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রয়োজন বিভিন্ন রকম আবহাওয়ার। এই যেমন জোনাকি প্রধানত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় বাস করে। স্যাঁতস্যাঁতে ভিজে জায়গা তাদের খুব পছন্দের জায়গা। জোনাকিরা সূর্যের আলো সহ্য করতে পারে না, তাই তারা দিনের বেলায় অন্ধকারে লুকিয়ে থাকতে পছন্দ করে। দিনে এরা লুকিয়ে থাকে গাছের বাকল বা কোনো ফাঁকফোকড়ের মধ্যে কিংবা কোনো অন্ধকারাচ্ছন্ন স্থানে।

জোনাকি পোকা দেখতে যেমন; Source: smithsonianmag.com

কীভাবে উৎপন্ন হয় এই আলো?

বিজ্ঞানীদের মতে, লুসিফেরিন নামক এক ধরনের রাসায়নিক পদার্থের কারণেই এরকম আলো নিঃসৃত হয়। জোনাকির দেহে উপস্থিত থাকে লুসিফেরাস নামক এনজাইম বা উৎসেচক।

যে প্রক্রিয়ায় জোনাকির দেহ হতে আলো নিঃসৃত হয়; Gold Biotechnology

এনজাইমটি অবশ্য তাদের দেহে আপনা হতেই তৈরি হয়ে থাকে। যখনই লুসিফেরিন বাইরের বাতাসে অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসে, তখনই তা লুসিফেরাস নামক এনজাইমের উপস্থিতিতে জারিত হয়। জারণ বিক্রিয়ার কারণেই নির্গত হয় শক্তি। আর সে শক্তির বহিঃপ্রকাশ ঘটে হালকা নীল আলোর মাধ্যমেই। লুসিফেরিন আবার ফসফরাসের একটি যৌগ। দিনের বেলাতেও ওদের দেহ থেকে শক্তি নির্গত হয়; কিন্তু সূর্যের তীব্র আলোতে তা আদৌ ধরা পড়ে না, এমনকি সন্ধ্যার আবছায়া আঁধারেও না।

গ্রামীন জনপথেই জোনাকির সবচেয়ে বেশি দেখা মেলে; Source: pinterest.com

সব জোনাকিই কি আলো জ্বালাতে সক্ষম?

না, দুনিয়ার সব জোনাকি কিন্তু আলো জ্বালাতে পারে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন কয়েক প্রকারের জোনাকি রয়েছে, যারা আলো জ্বালাতে সক্ষম নয়। উদাহরণস্বরূপ, উত্তর আমেরিকার পশ্চিমাঞ্চলে এক প্রকারের জোনাকি রয়েছে, যারা পরষ্পরের সাথে যোগাযোগের জন্যে আলো ব্যবহার করে না। আবার পূর্ণবয়স্ক জোনাকির ডিম থেকেও মাঝে মাঝে আলো নিঃসৃত হতে দেখা যায়। একধরনের জোনাকি রয়েছে, যারা ক্যামেরার ফ্ল্যাশের মতন আলোর ঝলকানি দিয়ে নিজেদেরকে শিকারীর হাত থেকে রক্ষা করে। 

নিজের আলোয় উদ্ভাসিত জোনাকি পোকা; Source: pinterest.com

এই নীলাভ আলোর বৈশিষ্ট্য কী?

জোনাকির সবুজাভ আলোর একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এতে তাপ নেই। তাদের দেহ নিঃসৃত আলো একেবারেই শীতল। এতটাই শীতল এ আলো যে, দিনের পর দিন যদি একটি থার্মোমিটারের পারদ অংশ এতে গুঁজে রাখা হয়, তবু একটু পারদও প্রসারিত হবে না। বিজ্ঞানীরা আজ পর্যন্ত যত রকম আলো আবিষ্কার করেছেন, তার মাঝে একমাত্র ফসফরাসের জারণ ব্যতীত অন্য কোনো উপায়ে সৃষ্ট আলো আদৌ শীতল নয়। সবক্ষেত্রেই সামান্য হলেও তাপ উৎপন্ন হতে দেখা যায়। তাপবিহীন আলো যেন কল্পনা করাটাই অলৌকিক। সেদিক থেকে জোনাকিদের বলা যেতেই পারে প্রকৃতির এক বিচিত্র সৃষ্টি। তাদের শীতল নীল আলোর যেন এক মোহময় যাদুকরী ক্ষমতা রয়েছে।

অন্ধকার রাতের জলাভূমিতে জোনাকির মুগ্ধতা ছড়ানো আলোর নৃত্য; Source: shivaii.org

আলো কি জোনাকিদের পরষ্পরের নিকট সঙ্কেত পাঠানোর মাধ্যম?

আলোর মাধ্যমে এক জোনাকি অপর জোনাকিকে সঙ্কেত পাঠানোর কাজ করে থাকে। শুধুমাত্র স্ত্রী জোনাকির সাথে মিলনের সময় তারা এই সঙ্কেত পাঠায় না। শত্রুদের বিভ্রান্ত করতে, নিজেদের এলাকাকে সুরক্ষিত রাখতে তারা আলো জ্বলা-নিভার কাজটি অত্যন্ত সুচতুরভাবে করে থাকে।

রাতের নৈসর্গিক প্রকৃতিতে জোনাকির বিচরণ; Source: media.mnn.com

জোনাকি দিয়ে কি ঘরকে আলোকিত করা সম্ভব?

জোনাকির দেহ থেকে লুসিফেরিন সংগ্রহ করে ঘরকে আলোকিত করা একেবারেই অসম্ভব! কারণ ঘরকে আলোকিত করতে যে পরিমাণ আলোর দরকার পড়ে তাতে লক্ষ-কোটি জোনাকিকে ধ্বংস করতে হবে। তবে লুসিফেরিন কৃত্রিমভাবে তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো, এমনভাবে আলো তৈরি করার কাজটি খরচে পোষাবে না।

বোতলবন্দী জোনাকী; Source: pinterest.com

বিত্তশালী সৌখিন কোনো ব্যক্তি যদি কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে অনুরূপ লুসিফেরিন তৈরি করে তার ঘরকে আলোকিত করতেও চান, তাতে লাভ কিচ্ছুটি হবে না। অধিকন্তু তিনিই বিভ্রান্ত হবেন। কারণ ঐ জাতীয় আলোতে কোনো রঙের বৈশিষ্ট্য ধরাই পড়বে না। সাদা, বেগুনী, লাল, হলদে, কালো সব মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে; সবই বেখাপ্পা ঠেকবে চোখের সামনে। বরঞ্চ আনন্দের পরিবর্তে বিরক্তিতে ভরে উঠবে মন। তখন মনে হতে থাকবে, এ যেন মনুষ্য সৃষ্ট কোনো অপার্থিব কিংবা কল্পনার অশরীরী পরিবেশ।

চিকিৎসা বিজ্ঞান এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণায় জোনাকি

জোনাকির শরীরে লুসিফেরাস ও লুসিফেরিন নামক দু’ধরনের রাসায়নিক পদার্থ পাওয়া গেছে, যা ATP নামক উচ্চশক্তির যৌগ উৎপাদন করে। প্রত্যেক প্রাণীর মধ্যে কম বেশি ATP উৎপন্ন হয়। কিন্ত প্রাণীর রোগাক্রান্ত কোষে এই ATP -র পরিমাণ অস্বাভাবিক হতে পারে। যদি জোনাকির শরীরের এই দুই রাসায়নিক পদার্থ কোনো প্রাণীর রোগাক্রান্ত কোষে প্রয়োগ করা হয় তবে তা কোষের পরিবর্তন সনাক্ত করতে সক্ষম হয়। ফলে ক্যান্সারের মতো অনেক মরণব্যাধি রোগের চিকিৎসা ও গবেষণায় জোনাকির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়াও খাদ্য নিরাপত্তা পরীক্ষা এবং ফরেনসিক পরীক্ষায় লুসিফেরাস নামক রাসায়নিক পদার্থের ব্যবহারে যথেষ্ট সাফল্য পাওয়া গেছে।

জোনাকিরা কি হারিয়ে যাচ্ছে?

ক্রমাগত পরিবেশ দূষণ, বিশেষ করে আলো দূষণ ও শব্দ দূষণ, পরিবেশের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়া, জোনাকির আবাসস্থল কমে যাওয়া ইত্যাদি কারণে বিজ্ঞানীরা পৃথিবীজুড়ে জোনাকির সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে বলে মনে করেন। রাতের ঝলমলে আলো জোনাকির মতো অনেক নিশাচর কীট-পতঙ্গের পক্ষে খুবই অসুবিধে। এছাড়া বিজ্ঞানীরা নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য জোনাকি পোকা ব্যবহার করছেন। এ কারণে জোনাকির সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। জোনাকিরা সাধারণত তাদের পছন্দের জায়গা থেকে নড়তে চায় না। এমন একটি জায়গা নষ্ট হয়ে গেলে তাদের বাঁচার এবং প্রজননের ক্ষমতাও হ্রাস পেতে থাকে।

ধানক্ষেতে জোনাকির নিরন্তর ছুটে বেড়নো; Source: Inhabitat

জোনাকির আলো দেখে মুগ্ধ হননি এমন মানুষ পৃথিবীতে খুবই বিরল। আমাদের বাংলা সাহিত্যও জোনাকির আলোক মুগ্ধতাকে অস্বীকার করতে পারেনি। আর তাই তো বাংলার লেখকদের অসংখ্য গল্প, কবিতা, উপন্যাসে স্থান পেয়েছে এই জোনাকি। মিটিমিটি আলো ছড়িয়ে আপন ঢঙে প্রকৃতির রং বদলানো এই জোনাকি প্রকৃতির এক অসমান্য সৃষ্টি। তাইতো জোনাকি নিয়ে রবি ঠাকুরের মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়ে এই গানের মধ্য দিয়ে-

ও জোনাকী, কী সুখে ওই ডানা দুটি মেলেছ।
আঁধার সাঁঝে বনের  মাঝে উল্লাসে প্রাণ ঢেলেছ।।
তুমি নও তো সূর্য, নও তো চন্দ্র,
তোমার তাই ব’লে কি কম আনন্দ।
তুমি আপন জীবন পূর্ণ ক’রে আপন আলো জ্বেলেছ।।

ফিচার ইমেজ- Pinterest.com

Related Articles