Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

জলাতঙ্ক মানেই কি নিশ্চিত মৃত্যু? জানুন ৩ জন সৌভাগ্যবানের গল্প

জলাতঙ্ক ভাইরাসজনিত মারাত্মক সংক্রামক রোগ। এই রোগকে হাইড্রোফোবিয়া, লাইসা বা পাগলা রোগও বলা হয়। শুধুমাত্র এন্টার্কটিকা মহাদেশ ব্যতীত সকল মহাদেশেই এই রোগটি বিস্তার লাভ করেছে। প্রতি বছর জলাতঙ্ক রোগে ৫৫ হাজার লোক মারা যায়। এর মধ্যে শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশের। এ রোগে আক্রান্ত হয়ে আমাদের পার্শ্ববতী দেশ ভারতে প্রতি বছর ২০ হাজার ও বাংলাদেশে প্রায় ২ হাজার মানুষ মারা যায়।

কুকুরের কামড়; Source: silverthorneattorneys.com

উষ্ণ রক্তবিশিষ্ট, জলাতঙ্ক বা র‌্যাবিস ভাইরাস বহনকারী প্রাণীর লালার মাধ্যমে এই রোগটি ছড়ায়। জলাতঙ্ক রোগ ছড়ানোর জন্য শতকরা ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রে কুকুরকে দায়ী করা হয়। তবে কুকুর ছাড়াও ভাইরাস আক্রান্ত গৃহপালিত ও পোষাপ্রাণীর মাঝে বিড়াল, গরু, ছাগল, ফেরেট বা নেউল জাতীয় প্রাণী, বেজী, ঘোড়া ইত্যাদির মাধ্যমে এ রোগ ছড়ায়। এছাড়া বন্য প্রাণীর মাঝে বাদুড়, শেয়াল, বানর, রেকুন ইত্যাদির মাধ্যমেও এই রোগটি বিস্তার লাভ করে।

১৮৮৫ সালের ৬ জুলাই ফরাসি রসায়নবিদ ও জীববিজ্ঞানী লুই পাস্তুর জলাতঙ্ক রোগের টিকা আবিষ্কার করেন। এই টিকা জলাতঙ্ক ভাইরাসের বাহক প্রাণী কামড়ানোর পূর্বে ও পরে উভয় সময়েই দেয়া যায়। যথাযথ নিয়মে টিকা গ্রহণ করলে শতভাগ রোগীর জীবন বেঁচে যায়। অন্যদিকে টিকা গ্রহণ না করলে এখনও শতভাগ রোগীর ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পর ভাগ্যে মরণই জোটে।

জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার এক সপ্তাহের মাঝেই রোগীর মৃত্যু ঘটে। এটিই ছিল এক সময়ের নির্মম সত্য কথা। তবে এ পর্যন্ত ছয় জন রোগীর কথা জানা যায়, যারা এই রোগের পুরো লক্ষণ প্রকাশ পাওয়ার পরও চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে উঠেছেন। এদের সবার বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া না গেলেও কয়েকজনের বিষয়ে তথ্য পাওয়া যায়। আজকের লেখায় জানানো হবে সেই সকল সৌভাগ্যবান মানুষের সম্পর্কে যারা মরণব্যাধি জলাতঙ্কে আক্রান্ত হয়েও সুস্থ হয়েছিলেন।

জিয়েনা গেইস

চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে যারা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন জিয়েনা গেইস। কারণ তিনিই প্রথম রোগী যিনি টিকা না নিয়ে জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হলেও বেঁচে যান এবং সুস্থভাবেই পরবর্তী জীবন কাটান। যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিনের অধিবাসী জিয়েনা ২০০৪ সালের ১২ সেপ্টেম্বর গির্জায় একটি বাদুড়কে বিপদ থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। সে সময় বাদুড়টি তার বাঁ হাতের তর্জনীতে কামড়ে দেয়।

মা অ্যানকে জড়িয়ে জিয়েনা; Source: jsonline.com

গেইসের মা অ্যান, বাদুড়ে কামড়ানো ক্ষতস্থানটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা’র নির্দেশিত পদ্ধতি অনুযায়ী ধুয়ে দেন। সাধারণত জলাতঙ্ক ভাইরাসের বাহক কর্তৃক আক্রান্ত হলে দ্রুত কাপড় কাঁচা সাবান (বল সাবান), পভিডন আয়োডিন ও ট্যাপের পানিতে কমপক্ষে ১৫ মিনিট ধৌত করতে হয়। অতঃপর টিকা গ্রহণ করাই হয় সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ।

টিকা না নিয়ে ঝাড়-ফুঁক, কবিরাজের গুঁড় পড়া, ইঁদুরের গর্তের মাটি পড়া, পিঠে কাসার থালা বাটি ইত্যাদি লাগিয়ে জলাতঙ্কের বিষ তথা ভাইরাস নামানোর চিন্তা করা নিতান্তই মূর্খতার পরিচায়ক ও কুসংস্কার ছাড়া কিছুই নয়। কারণ কবিরাজের কবিরাজী জলাতঙ্ক রোগ ভালো করতে পারে না।

যা-ই হোক, অ্যান তার বাচ্চা জিয়েনাকেও জলাতঙ্কের কোনো টিকা দেননি। ফলে কিছুদিন পর জিয়েনার মাঝে জলাতঙ্কের লক্ষণ দেখা দেয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায়, জিয়েনার ভাগ্যে নির্মম মৃত্যু লেখা হয়ে যায়।

জিয়েনার দুর্বলতা, জ্বর, মাথা ধরা, অস্বস্তি লাগা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। এছাড়াও তার ডাবল ভিশন বা দ্বিত্ব দৃষ্টির প্রকাশ ঘটে। সাধারণত মৃত্যুর পূর্বে জলাতঙ্কে আক্রান্ত রোগীর মাঝে অতিরিক্ত লালা ঝরা, হাইড্রোফোবিয়া (জলাতঙ্ক অর্থাৎ পানি দেখে ভয় পাওয়া, যা থেকে জলাতঙ্ক নামকরণ হয়েছে) হ্যালুসিনেশন তথা দৃষ্টিবিভ্রম, উৎকণ্ঠা ইত্যাদি লক্ষণ প্রকাশ পায়।

জিয়েনাকে দ্রুত উইসকনসিনের একটি শিশু হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ ড. রোডনি উইলোগবি প্রথম কোনো রোগীকে ‘মিলওয়াওকি প্রোটোকল’ এর প্রয়োগ করেন। এই পদ্ধতিতে আক্রান্ত রোগীকে প্রথমে বিভিন্ন প্রকার রাসায়নিক ও চেতনানাশক যেমন- কেটামিন, মিডাজোলাম ইত্যাদির মাধ্যমে কোমায় পাঠানো হয়। কোমায় পাঠানোর উদ্দেশ্য হল মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বন্ধ রাখা। ফলে জলাতঙ্ক ভাইরাস কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি করতে পারে না। অতঃপর ভাইরাসরোধী ঔষধ রিবাভিরিন ও অ্যামানটাডিন প্রয়োগ করেন। ৬ দিন পর জিয়েনার শরীরে জলাতঙ্ক রোগ প্রতিরোধের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ এন্টিবডি উৎপন্ন হয়।

লেকল্যাণ্ড কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রী লাভের পর; Source: media.jrn.com

জিয়েনা জলাতঙ্ক আক্রান্ত হলেও বেঁচে যান। তিনি হাঁটতে পারেন, হাত-পা চালাতে পারেন। তবে দৌঁড়াতে ও জোরে কথা বলতে পারেন না। তিনি ২০১১ সালে লেকল্যান্ড কলেজ থেকে জীববিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন ও ২০১৪ সালে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।

ম্যাথিউ ভিঙ্কলার

ঘটনাটি ১৯৭০ সালের ১০ অক্টোবরের কথা। যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইওর ছয় বছরের শিশু ম্যাথিউ তার শোয়ার কক্ষে ঘুমাচ্ছিল। রাতে চিলেকোঠা দিয়ে একটি বাদুড় প্রবেশ করে। বাদুড়টি ম্যাথিউয়ের বাঁ হাতের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে কামড় দেয়। ম্যাথিউ চিৎকার করে ওঠে। পরে তার বাবা-মা তাকে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে যান।

ম্যাথিউ ভিঙ্কলার; Source: noughtyscience

ডাক্তার ম্যাথিউকে জলাতঙ্ক রোগের টিকা দেন। টিকা নেওয়ার পরও কয়েকদিনের মধ্যে ম্যাথিউয়ের মাঝে জলাতঙ্ক রোগের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে। সাধারণত টিকা দেওয়ার পরও ভ্যাক্সিন ফেইলিউর বা টিকার কার্যক্ষমতা নষ্ট হলে রোগ হতে পারে। ম্যাথিউয়ের ক্ষেত্রে তা-ই হয়েছিল।

তার ঘাড় শক্ত হয়ে যায়, হাত প্যারালাইসিস হওয়া, মাথা ঘোরা, শ্বাসকষ্ট ও কথা বলায় সমস্যা হতে থাকে।

নভেম্বরের মাঝামাঝি রোগের মাত্রা আরো বেড়ে যায়। সে বারবার কোমায় যেতে থাকে। চিকিৎসক শ্বাসকষ্ট থেকে রক্ষা করতে ট্রাকিওটোমি করেন। কারণ জলাতঙ্ক রোগে কণ্ঠনালী, শ্বাসনালী সংকোচিত হয়। ট্রাকিওটোমি হচ্ছে শ্বাসনালীর কিছু অংশ কেটে শ্বাস-প্রশ্বাসের বিকল্প পথ বের করা। এছাড়াও শরীরের অতিরিক্ত কাঁপুনি ও সংকোচন প্রতিরোধের জন্য ওষুধ প্রয়োগ করেন। এসব করার উদ্দেশ্য ছিল ম্যাথিউয়ের মৃত্যুকে বিলম্বিত করা ও দেহকে জলাতঙ্ক রোগের ভাইরাসের বিরুদ্ধে এন্টিবডি উৎপাদনের জন্য যথেষ্ট সময় দেয়া।

চিকিৎসকদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছিল। ৩ মাস পর ম্যাথিউ সুস্থ হয়ে ওঠে। ফলে ম্যাথিউ হচ্ছে প্রথম সৌভাগ্যবান রোগী যে, জলাতঙ্ক রোগের টিকা নেয়ার পর, আক্রান্ত হলেও মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফিরে আসে। এখানে লক্ষ্য করুন, জিয়েনা হচ্ছেন প্রথম বেঁচে যাওয়া রোগী যিনি টিকা নেননি এবং ‘মিলওয়াওকি প্রোটোকল’ এর সফল পরীক্ষা তার উপরই প্রথম করা হয়েছিল।

প্রিসিয়াস রিনল্ডস

জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়ে বেঁচে যাওয়া রোগীর মধ্যে তৃতীয় জন হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের শিশু প্রিসিয়াস রিনল্ডস। প্রিসিয়াসের বয়স যখন মাত্র আট বছর তখন একটি বনবিড়াল তার হাতে কামড় দেয়। বিষয়টি পরিবারের লোকজন জানলেও চিকিৎসা বা টিকা দেওয়ার কোনো প্রয়োজন মনে করেননি।

প্রিসিয়াস ও তার চিকিৎসক; Source: Robert Durell/ucdavis.edu

টিকা না দেওয়ার ফলে মাত্র দুই সপ্তাহ পরই প্রিসিয়াসের মাঝে সর্দির মত উপর্সগ দেখা যায়। এরপর দ্রুত তার মাথা ও ঘাড় ব্যথা শুরু হয়। পাশাপাশি তার পা দুর্বল হয়। ক্যালিফোর্নিয়ার স্থানীয় হাসপাতালের নার্স তাকে পানি পান করাতে গেলে সে তা পান করতে ভয় পায়। অবস্থা খারাপ বুঝতে পেরে তাকে দ্রুত হেলিকপ্টার দিয়ে ইউসি ডেভিস হাসপাতালে পাঠানো হয়।

ইউসি ডেভিস হাসপাতালে পরীক্ষার পর জানা যায় পিসিয়াস জলাতঙ্ক রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এরপর পিসিয়াসকেও ‘মিলওয়াওকি প্রোটোকল’ অনুযায়ী চিকিৎসা করা হয়। চিকিৎসায় মৃত্যুর দ্বার থেকে ফিরে আসে প্রিসিয়াস রিনল্ডস।

‘মিলওয়াওকি প্রোটোকল’ এর মাধ্যমে জলাতঙ্ক রোগ থেকে রোগীকে সুস্থ করা গেলেও অনেকেই এই প্রোটোকলের সফলতাকে মেনে নিতে চান না। কারণ এ পর্যন্ত ৪১ জন রোগীর উপর এই পরীক্ষা চালানো হলেও বেঁচে ফিরেছেন মাত্র ৫ জন। সুতরাং জলাতঙ্ক ভাইরাসের বাহক প্রাণী কামড়ালে দ্রুত ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক টিকা গ্রহণ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাছাড়া কে চায় মৃত্যুর দ্বারে যেতে?

ফিচার ইমেজ-jsonline.com

Related Articles