Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্রাণীজগতে শিশু হত্যার রহস্য

সন্তানের জন্য মায়ের ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই। এটি শুধু মানুষের ক্ষেত্রেই না, সব ধরনের পশুপাখি এবং পোকামাকড়ের ক্ষেত্রেও সমানভাবে সত্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও জীবজগতে মাঝেমাঝেই দেখা যায় কোনো প্রাণীকে তার মা নিজ হাতে হত্যা করে ফেলছে। এমনকি হত্যা করার পর নিজের সন্তানকে খেয়ে ফেলার ঘটনাও মাঝে মাঝে ঘটতে দেখা যায়। তবে সবচেয়ে বেশি ঘটতে দেখা যায় যেটি, তা হলো নিজের সন্তান না, কিন্তু নিজ গোত্রের অন্য কারও সন্তানকে হত্যা করা।

বাঘ তার সন্তানকে বহন করে নিয়ে যাচ্ছে; Source: scienceabc.com

প্রাণীবিদ্যায় নিজ প্রজাতির সন্তান হত্যা করার ঘটনাকে ইনফ্যান্টিসাইড বা শিশুহত্যা নামে অভিহিত করা হয়। এছাড়াও প্রায় সমার্থক আরেকটি শব্দ হলো ওভিসাইড, যা দ্বারা কোনো প্রাণী জন্মগ্রহণ করার আগেই তার ডিম নষ্ট করে ফেলাকে বোঝানো হয়। ইনফ্যান্টিসাইডের একটি শাখা হলো ফিলিয়াল ইনফ্যান্টিসাইড, যার অর্থ নিজের সন্তানকে হত্যা করা। আর কোনো প্রাণী যখন নিজ সন্তানকে হত্যা করে তাকে খেয়ে ফেলে, সেটিকে বলা হয় ফিলিয়াল ক্যানিবালিজম। ইনফ্যান্টিসাইড বা শিশুহত্যা মাছ, পাখি, উভচর, পোকামাকড় সহ বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে দেখা যায়। তবে এটি সবচেয়ে বেশি ঘটে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের ক্ষেত্রে। এদের মধ্যে সিংহ, ডলফিন, বেবুন প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।

নিষ্ঠুর এবং আপাতদৃষ্টিতে প্রকৃতির নিয়ম বিরোধী হলেও বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞানীদের গবেষণা এবং পর্যবেক্ষণে প্রাণীদের নিজেদের সন্তানদের হত্যা করার পেছনে কিছু কারণ উঠে এসেছে।

খাদ্য এবং পরিচর্যার নিশ্চয়তা

চিতাবাঘ নিজের বাচ্চাকে খাওয়ার জন্য গাছে তুলেছে; Source: catersnews.com

সাধারণত কোনো প্রাণী যখন সন্তান জন্ম দেয়, তখন সে তার সবগুলো সন্তানকেই সমানভাবে পরিচর্যা করে। কিন্তু যদি এমন হয় যে, এক বা একাধিক সন্তান গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ে, অথবা দুর্বল বা বিকলাঙ্গ হিসেবে জন্ম নেয়, সেক্ষেত্রে একটি সম্ভাবনা থাকে যে, মা প্রাণীটি তার বাকি সন্তানদের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য এবং যত্ন নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে তুলনামূলকভাবে দুর্বল সন্তানদেরকে হত্যা করে ফেলবে। শুকর, খরগোশ, গুবরে পোকা সহ বেশ কিছু প্রাণীর মধ্যে এ ধরনের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা ইউনিভার্সিটির জীববিদ্যার অধ্যাপক ডাগ মক বলেন, প্রাণীদের খাবারের সংগ্রহের উৎস সীমিত। ফলে যদি কোনো সন্তান দুর্বল বা অসুস্থ হয়ে যায়, তখন তাদের বাবা-মা সীমিত খাবার তাদের পেছনে খরচ করাকে অযৌক্তিক মনে করে। সেক্ষেত্রে তারা অসুস্থ সন্তানকে হয় পরিত্যাগ করে অথবা হত্যা করে। আর মাংসাশী স্তন্যপায়ী মা প্রাণীরা সাধারণত হত্যার পর নিজের সন্তানকে খেয়ে ফেলে।

দুই বেবুনের মধ্যে লড়াই চলছে; Source: internapcdn.net

উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল জু-তে কালি নামে একটি ভালুক তিনটি সন্তান জন্ম দেওয়ার কিছুক্ষণ পরই একটিকে মেরে খেয়ে ফেলে। কিছুদিন পরে সে যখন দ্বিতীয় সন্তানটিকেও মেরে ফেলে, তখন চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ বাচ্চাটির লাশ উদ্ধার করে এবং তৃতীয় বাচ্চাটিকে সেখান থেকে সরিয়ে নেয়।

ডাক্তাররা পরীক্ষা করার পর দেখতে পান যে, মৃত বাচ্চাটি অসুস্থ ছিল। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবর্তনগত নৃতাত্ত্বিক লেসলি ডিগবির মতে, মায়েরা যখন বুঝতে পারে তার কোনো সন্তান গুরুতর অসুস্থ, তখন তার পরিচর্যার পেছনে শ্রম এবং খাবার নষ্ট করার করার চেয়ে তাকে হত্যা করে বাকি সন্তান এবং নিজের প্রতি মনোযোগ দেওয়াটাই প্রাণীদের কাছে বেশি গুরুত্ব পায়।

চিড়িয়াখানার তত্ত্বাবধায়ক টনি বার্থেল জানান, শুধু ভালুক না, সিংহ, শিকারী কুকুর সহ আরো অনেক প্রাণীই একইরকম আচরণ করে। তিনি আরও বলেন, এ ধরনের প্রাণীরা নিজের সন্তানকে হত্যা করার পরে অধিকাংশ সময়ই খেয়ে ফেলে। কারণ মৃতদেহটি মা প্রাণীর পুষ্টি এবং শক্তির যোগান দেয়। তাছাড়া না খেয়ে ফেলে রাখলে আবাসস্থলে দুর্গন্ধ সৃষ্টি হতে পারে এবং কীটপতঙ্গকে আকৃষ্ট করতে পারে।

একটি শ্বেত ভালুক বাচ্চাকে হত্যা করার পর খাচ্ছে; Source: nationalgeographic.com

স্বার্থপরতা

পুরুষ প্রাণীদের মধ্যে সিংহকে প্রায়ই নিজ গোত্রের সন্তানদেরকে হত্যা করতে দেখা যায়। সিংহের একটি দলে সাধারণত একটি বা দুইটি পুরুষ সিংহ থাকে। কোনোভাবে যদি অন্য কোনো পুরুষ সিংহ তাদের তাদেরকে সরিয়ে দলটির নেতৃত্ব দখল করতে পারে, তাহলে তারা প্রায় সাথে সাথেই সেই দলের সিংহ শাবকদেরকে মেরে ফেলে।

লস অ্যাঞ্জেলেসের ইউনিভার্সিটি অফ সাউদার্ন ক্যালিফোর্নিয়ার স্তন্যপায়ী বিশেষজ্ঞ ক্রেইগ স্ট্যানফোর্ড বলেন, নতুন আসা পুরুষ সিংহ পূর্বের সিংহগুলোর বাচ্চাদের খাবার এবং আশ্রয়ের পেছনে নিজের শক্তি এবং প্রচেষ্টা ব্যয় করাটাকে এক ধরনের অপচয় হিসেবে বিবেচনা করে। কিন্তু পরে যখন একই সিংহীর গর্ভে তার নিজের সন্তানের জন্ম হয়, তখন তাদেরকে সে বেশ যত্নের সাথে লালন-পালন করে।

একটি পেঁচা তার সন্তানকে খাচ্ছে; Source: Minden Pictures

বংশ বিস্তারের নিশ্চয়তা

অনেক ক্ষেত্রেই পুরুষ প্রাণীদের একই প্রজাতির অন্য কারো সন্তান হত্যার পেছনে প্রধান ভূমিকা পালন করে তাদের যৌনাকাঙ্ক্ষা। ১৯৭০ সালে সর্বপ্রথম এই বিষয়টি লক্ষ্য করেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞানী সারা হার্ডি

পরবর্তীতে ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার অধ্যাপক ডিটার লুকাস এবং তার সহকর্মী, ফ্রেঞ্চ ন্যাশনাল সেন্টার ফর সায়েন্টিফিক রিসার্চের আচরণগত বাস্তুবিদ্যার গবেষক এলিস হিউচার্ড ২৬০ প্রজাতির প্রাণীর উপর এক গবেষণা চালান, যাদের মধ্যে ১১৯ প্রজাতির মধ্যে শিশুহত্যার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। তারা লক্ষ্য করেন, যেসব প্রাণীর ক্ষেত্রে একাধিক পুরুষ এবং মহিলা প্রাণী একত্রে বসবাস করে এবং অল্প কিছু পুরুষ প্রাণী সেই দলের নেতৃত্বে থাকে, তাদের মধ্যে পুরুষ প্রাণীদের দ্বারা নিজের দলের অন্যের সন্তানদেরকে হত্যার প্রবণতা বেশি দেখা যায়।

একটি সিংহ তার বাচ্চাকে হত্যা করেছে; Source: Getty Images

তারা ব্যাপারটিকে ব্যাখ্যা করেন এভাবে, সন্তান জন্ম দেওয়ার পর তাদেরকে বড় করার পূর্ব পর্যন্ত মহিলা প্রাণীরা সাধারণত পুরুষ প্রাণীর সাথে মিলিত হয় না। কিন্তু পুরুষরা এত দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে রাজি হয় না। নিজ সন্তান জন্ম দিয়ে বংশ বিস্তার করার লক্ষ্যে তখন দলের অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী পুরুষ সদস্য মহিলা প্রাণীর পূর্বের সন্তানদেরকে হত্যা করে ফেলে, যেন সে তার সাথে মিলিত হয়ে তার নিজের সন্তান ধারণ করতে পারে। হিউচার্ড ব্যাপারটিকে স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যকার যৌনযুদ্ধের চরম প্রকাশ হিসেবে ব্যাখ্যা করেন।

এই দ্বন্দ্বের ফলে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় দলের মহিলা সদস্যরা, যারা তাদের সন্তানদেরকে জন্ম দেওয়ার পর একটা সময় পর্যন্ত লালন-পালন করার পর তাদেরকে হারাতে বাধ্য হয়। ন্যাশনাল একাডেমী অফ সায়েন্স থেকে প্রকাশিত একটি গবেষণায় দেখা গেছে, এরকম পরিস্থিতিতে মহিলা প্রাণীরা নিজেদের সন্তানদেরকে রক্ষা করার জন্য পাল্টা কৌশলের আশ্রয় নেয়। তারা একইসাথে একাধিক পুরুষ প্রাণীর সাথে মিলিত হতে শুরু করে, যেন তারা বুঝতে না পারে কোনটা কার সন্তান। এর ফলে পুরুষ প্রাণীর যদি সন্দেহ হয় যে, সন্তানগুলো তার নিজেরও হতে পারে, তখন সে আর তাদেরকে হত্যা করে না।

নিজের সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা

সন্তানকে হত্যার জন্য নিয়ে যাচ্ছে চিতাবাঘ; Source: catersnews.com

কিছু কিছু মহিলা প্রাণীকে একই গোত্রের অন্য সন্তানদেরকে হত্যা করতে দেখা যায়। সাধারণত এটি ঘটে থাকে যখন একই দলে অনেকগুলো সন্তান থাকে এবং মা প্রাণী তার নিজের সন্তানের খাবার এবং ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। অন্যের সন্তানকে হত্যার মাধ্যমে সে নিজের সন্তানের ভবিষ্যত নিশ্চিত করে।

তবে এরকম পরিস্থিতিতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল মায়েদেরকে নিজেদের সন্তানদেরকে রক্ষার জন্য পাল্টা কৌশলের আশ্রয় নিতেও দেখা যায়। যেমন দুর্বল বেজি মায়েরা প্রয়োজনে কিছুদিন অপেক্ষা করে অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী মায়েদের সাথে একই দিনে সন্তানের জন্ম দেয় এবং সব সন্তানকে একত্রে মিশিয়ে দেয়। ফলে বাকিরা বুঝতে পারে না কোনটা কার সন্তান, তাই কেউ হত্যা করতেও আগ্রহী হয় না।

ফিচার ইমেজ- cdn.com

Related Articles