Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্রিকেটের ‘ভূত’ এবং ‘ভবিষ্যৎ’

ব্লেজার গায়ে দু’দলের অধিনায়ককে টসে নামতে দেখার মধ্যে যে আভিজাত্য, তাঁর তুলনা আর পাওয়া যায় না। © গেটি ইমেজ

দারুণ রৌদ্রোজ্জ্বল সকালে ঘুম ভেঙে আপনি ঠিক কোনটা পেতে চাইবেন? ধোঁয়া ওঠা এক কাপ  কফি, নাকি একটা চকলেট বার? অনুমান করে নিতে পারছি, ভোটটা যাবে কফির দিকেই। কেননা ঘুম থেকে ওঠার পর আসলে কফিটাই টানে, চকলেট নয়।

ঠিক তেমনি একজন চিরাচরিত ক্রিকেটপ্রেমীর জন্য সকালের ‘ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ’ হলো টেস্ট ক্রিকেট। ঘুম থেকে উঠে স্পোর্টস চ্যানেল ধরিয়ে ব্লেজার গায়ে দু’দলের অধিনায়ককে টসে নামতে দেখার মধ্যে যে আভিজাত্য, যে তৃপ্তি, সেটা বুঝি আর কোনো খেলাতেই পাওয়া সম্ভব নয়। আর সেখানে ‘চকলেট বার’ হয়েই থাকার কথা ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটকে। অন্তত কয়েক বছর আগে অবধি এমন কিছু হওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক।

সময় পাল্টেছে, সাথে পাল্টেছে দুনিয়াজোড়া ক্রিকেট ফ্যানদের হালহকিকত। ‘বোরিং’ ক্রিকেটে আবেদনের ছোঁয়া আনতে আগমন ঘটেছে চিয়ারলিডারের, বোলাররাও হরহামেশাই ফিফটি-হান্ড্রেড হাঁকিয়ে দিচ্ছে, সাথে সাথে হয়তো কিছুটা বেড়েছে জনপ্রিয়তাও। কারণ হিসেবে বলেই দেওয়া চলে, ফ্রাঞ্চাইজি লিগ ক্রিকেটের দুনিয়াজোড়া দারুণ সাফল্য। ফলে ‘চকলেট বার’ ক্রিকেট খুব দ্রুতই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে গতিশীল এবং আকর্ষণীয় ফরম্যাট।

আধুনিক ক্রিকেটে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট © গেটি ইমেজ

আচ্ছা, বলে তো দিলাম জনপ্রিয়তা বেড়েছে। আসলে ঠিক কতটা বেড়েছে, বা আদৌ বেড়েছে কিনা, সেটা জানার উপায় কি? টিআরপি রেটিং? কিংবা দর্শকজরিপ? যেকোনো হিসেবেই প্রমাণিত, টি২০-ই এই মুহুর্তে সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিকেট ফরম্যাট।

আর সে প্রভাবটাই গত বেশ কয়েক বছর ধরে ভালোভাবেই পড়ছে বিশ্ব ক্রিকেটে। জনপ্রিয়তা, টাকার ঝনঝনানি কিংবা বাহ্যিক চাকচিক্য, সবদিক থেকেই গত কয়েক বছরে বিশ্ব ক্রিকেটকে খোলনলচে বদলে দিয়েছে এই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাট। কিন্তু তাতে কপাল চাপড়ানো বেড়ে গেছে আমাদের মতো ‘ব্যাকডেটেড’ সব ক্রিকেটভক্তদের। আধুনিক ক্রিকেটে পুরোনো সেই চিরাচরিত স্বাদটা যে আর পাওয়া যাচ্ছে না সেভাবে!

তাতে কি? সময়ের সাথে সাথে স্বাদ বদলালেও ক্রিকেট আগে থেকে আরো বেশি জমজমাট হতে শুরু করেছে, হতে শুরু করেছে আরো বেশি আবেদনময়। ‘ক্রিকেটের বিশ্বায়ন’ কথাটা সবসময়ই বেশ শোনা গেলেও সেটার বাস্তবতা বড্ড ম্যাড়ম্যাড়ে, সেখানে যেন কাকপক্ষী ছাড়া আর কারো বিশেষ যাতায়াত নেই। আর ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেট, তথা টি-টোয়েন্টির আগ্রাসনে যতই ‘জাত গেল, জাত গেল’ শোরগোল উঠুক না কেন, মানতেই হবে বিশ্বায়নের জন্য সবচেয়ে সেরা ফরম্যাট হতে পারে এই টি-টোয়েন্টিই, টেস্ট নয়।

বিশ্বায়নের জন্য সবচেয়ে সেরা ফরম্যাট হতে পারে এই টি-টোয়েন্টিই। © গেটি ইমেজ

ফলে টি২০ ক্রিকেটকে কিছুটা জায়গা ছেড়ে দিতেই হতো অন্য ফরম্যাটগুলোকে। সেটাতে কারো বিশেষ সমস্যা থাকারও কথা ছিলো না, হয়তো সেভাবে সমস্যা নেইও। এমনকি ক্রিকেটের কুলীনকুলের সদস্য ইংল্যান্ড এবং দক্ষিণ আফ্রিকাও শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত নিয়েছে চাকচিক্যপূর্ণ ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট শুরু করার। তাতে যেমন টাকার ঝনঝনানি থাকবে, খেলার বাইরে মিডিয়া এবং ক্রিকেটারদের মিলনমেলা থাকবে, আবার থাকবে আরো অনেক চমক।

ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট আরম্ভ করার জন্য শুধু বিশ্বায়ন এবং আর্থিক কারণই নয়, বরং বেশ কিছু কূটনীতিক কারণ রয়েছে। কিছুদিন আগেই দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় দলের তিনজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাইলি রশো, কাইল অ্যাবট এবং ডেভিড উইজ অসময়েই জাতীয় দল থেকে সরে গিয়েছেন কোলপাক চুক্তি করে। ইউরোপের বহিরাগত হওয়ায় দক্ষিণ আফ্রিকান ক্রিকেটাররা কোলপাক চুক্তির আওতায় আসতো না। তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সাথে কোনটুনু নামক চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরো বেশ কিছু দেশ কোলপাক চুক্তির জন্য বিবেচিত হতে পারছে।

রশো-অ্যাবটের মতো অনেক ক্রিকেটারই জাতীয় দল থেকে সরে যাচ্ছেন কোলপাক চুক্তিস্বাক্ষরের মাধ্যমে © গেটি ইমেজ

এখন প্রশ্ন হলো, এই কোলপাক চুক্তিটা আসলে কি? আর সেটার দিকে কেন ঝুঁকে গেলেন ক্রিকেটাররা? প্রশ্নটার উত্তর অনেকটাই বিশদ, আমি শুধু এখানে সংক্ষেপে দুটো কথা বলেই এড়িয়ে যাবো ব্যাপারটা।

কোলপাক হচ্ছে এমন এক চুক্তি, যাতে স্বাক্ষর করলে একজন খেলোয়াড় তার চুক্তিবদ্ধ ক্লাবকেই প্রাধান্য দিতে বাধ্য থাকেন। তবে নির্বাচকেরা চাইলে কাউন্টি মৌসুম ব্যতীত বাকি সময়টুকুর জন্য খেলোয়াড়দেরকে জাতীয় দলের জন্য বিবেচনা করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে নিজ নিজ ক্লাবের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তারা জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারবেন। জাতীয় দলের হয়ে খেলার সম্মানটা না পেলেও অর্থসঙ্গতির দিকটা কোলপাক চুক্তি বেশ ভালোভাবেই নজর রাখে। আর আধুনিক পেশাদার ক্রিকেটের সময়ে অর্থনৈতিক স্বার্থ দেখাটা সেভাবে অস্বাভাবিকও বলা চলে না। কে না চাইবে পরিবারকে আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখাতে?

শুধু এ ব্যাপারটাই নয়। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের প্রত্যাবর্তনের পর থেকে ক্রিকেটাররা জাতীয় দল থেকে এধরণের ক্রিকেটেই অর্থনৈতিকভাবে বেশি লাভবান হন। এ কারণে বেশ কিছু প্রতিভাবান খেলোয়াড় জাতীয় দল ছেড়ে ফ্রিল্যান্স ক্রিকেটার হয়ে সারা দুনিয়া দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন।

ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ব্যাটসম্যান ক্রিস গেইল একবার মন্তব্য করেছিলেন, “টেস্ট ক্রিকেট মরে গেলেও দুঃখ পাবো না।” সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ান অলরাউন্ডার শেন ওয়াটসন বলেছেন, ওয়ানডে ক্রিকেট নাকি ‘প্রাসঙ্গিকতা’ হারিয়ে ফেলছে। তিনি আরো দাবি করেছেন দ্বিপাক্ষিক ‘অর্থহীন’ সব সিরিজ খেলার নাকি কোনো মানেই হয় না! তাঁর মতে, “লোকে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্টগুলো ভালোবাসে কারণ এসবের একটা কাঠামো আছে, একটা ফলাফল পাওয়া যায়- এখানে সেমিফাইনাল আছে, ফাইনাল আছে।” তিনি আরো যোগ করেন, “বিগ ব্যাশ দেখতে যে বিপুল পরিমাণ লোক আসছে, সেটাই প্রমাণ করে লোকে আসলে কী দেখতে চায়। এসবই আসলে আসলে অর্থবহ খেলা।, অর্থবহ টুর্নামেন্ট। শুধু খেলার জন্য খেলতে হবে এমন একটা সিরিজ না।” তিনি জোরালো দাবি তুলেছেন দ্বিপাক্ষিক সিরিজ তুলে দিয়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের উপরই জোর দিতে।

দ্বিপাক্ষিক সিরিজের পরিবর্তে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার দাবি তুলেছেন শেন ওয়াটসন। © গেটি ইমেজ

ফলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তবে কি ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত? টি-টোয়েন্টির আগ্রাসন কি তবে ক্রিকেটকে ধ্বংসের দোরগোড়ায় নিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে? পেশাদারি মনোভাব কি শেষ পর্যন্ত সত্যিই দেশ থেকেও বড় ইস্যু হয়ে উঠেছে? সহজ কথায় এর উত্তর খোঁজাটা কিছুটা কঠিন। তাই একটু ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে ঘুরে আসা যেতে পারে, হয়তো আগের কিছু উদাহরণও ঘেঁটে দেখা যেতে পারে। তাতে যদি কোনো উত্তর মেলে! শুরুটা যখন করতেই হবে, একদম গোড়া থেকে শুরু করা যাক।

সাল ১৯৭৭ : কেরি প্যাকারের ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট’

তৎকালীন পত্রিকায় ‘ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ’ নিয়ে একটি ফিচার © গেটি ইমেজ

“এ যুগে আপনি ক্রিকেট দুনিয়ার যে দিকেই তাকাবেন – সেখানেই দেখবেন কেরি প্যাকারের সিরিজের প্রভাব। দিনরাতের ক্রিকেট ম্যাচ, সাদা বল, রঙিন পোশাক , হেলমেট, ফিল্ড রেস্ট্রিকশন, দলের মধ্যে ফাস্ট বোলারদের প্রাধান্য, আক্রমণাত্মক ব্যাটিং, উন্নত মানের ফিল্ডিং, ‘ড্রপ-ইন’ পিচ বা অন্য জায়গায় তৈরি করে মাঠে বসিয়ে দেয়া উইকেট – এগুলো সবই ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের আবিষ্কার, এবং সবই ওই দুই বছরের মধ্যে চালু করা হয়েছিল।” কেরি প্যাকারের সিরিজ নিয়ে লেখা বইতে লিখেছিলেন গিডিয়ন হেগ।

এখনকার মতো রঙচঙে দুনিয়ার আগে ক্রিকেট সাদাকালো একটা সময় পিছনে ফেলে এসেছে, সেও চল্লিশ বছর হয়ে গেলো। ক্রিকেটের এই আধুনিকায়নের প্রথম স্বপ্নদ্রষ্টার কৃতিত্ব দেওয়া হয় অস্ট্রেলিয়ান মিডিয়াব্যক্তিত্ব কেরি প্যাকারকে। তিনি কি করেছিলেন? তিনিই প্রথমবারের মতো সীমিত ওভারের প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেট শুরু করেন, নাম দেন ‘ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট’। আর ব্যক্তিগত মালিকানার ওই টুর্নামেন্টে নাম লিখিয়েছিলেন ভিভ রিচার্ডস, ইয়ান বোথাম, ডেনিস লিলিসহ খ্যাতনামা আরো অনেক ক্রিকেটাররা। সেই ক্রিকেট খেলতে প্রথম যারা নাম লিখিয়েছিলেন তাদের প্রায় সবাইকেই নিষিদ্ধ করেছিল তাদের দেশের ক্রিকেট বোর্ড।

ডেনিস লিলির মত বিখ্যাত ক্রিকেটাররাও যোগ দিয়েছিলেন ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটে। © গেটি ইমেজ

প্যাকার চেয়েছিলেন, ১৯৭৬ সালে অস্ট্রেলিয়ার খেলা সকল টেস্ট ম্যাচের সম্প্রচারস্বত্ত্ব পাবে তার মালিকানাধীন নাইন নেটওয়ার্ক। সেটার জন্য পানির মতো টাকা ঢালতেও রাজি ছিলেন তিনি, তবে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া তার প্রস্তাবে রাজি হয়নি। বরং তাঁকে টপকে সে স্বত্ত্ব কিনে নেয় অস্ট্রেলিয়ান ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন। দারুণ অপমানিত হয়ে প্যাকার শেষমেষ ঠিক করলেন, “স্বত্ত্ব যখন পেলামই না, তবে নিজের মতো করেই একটা সিরিজ চালু করবো এখন।”

ক্রিকেটে সেই প্রথম দেখা গেল দিনরাতের ক্রিকেট, রঙিন পোশাক, সাদা বল, কালো সাইটস্ক্রিন, ব্যাটসম্যানের হেলমেট, আর ১৩টি ক্যামেরা দিয়ে জমকালো টিভি সম্প্রচার । মাত্র দু’বছর চলেছিল ওই ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট, তবে তাতেই এমন দাগ রেখে গিয়েছিল সিরিজটি, যা পুরো ক্রিকেটকেই রাতারাতি আমূল বদলে দেয়। জন্ম নেয় ওয়ানডে ক্রিকেট, তার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হিসেবে জন্ম নেয় নতুন একটি আইডিওলজি- ক্রিকেট দিয়েও বাণিজ্য করা যায়, সম্ভব বিপণনও! কে জানতো পরে সেই আইডিওলজিই ক্রিকেটকে এতটা বদলে দেবে?

ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট জন্ম দিয়েছিল এমন এক আইডিওলজির, যা পরে বদলে দিয়েছে গোটা ক্রিকেটবিশ্বকে © গেটি ইমেজ

আধুনিক ক্রিকেটে পেশাদারিত্ব বা অর্থবিত্তের হাতছানির শুরুটাও হয়েছিল অনেকটা ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের মধ্য দিয়েই। আশির দশকে প্রতিটি টেস্ট ম্যাচ খেলার জন্য একজন ইংলিশ ক্রিকেটারকে দেওয়া হতো মাত্র ২১০ পাউন্ড।  টনি গ্রেগের ভাষায়, “আমি ভেবে পেতাম না, স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকের সামনে একটি টেস্ট খেলার পরও আমাদের কেন মাত্র ২১০ পাউন্ড দেওয়া হবে। অনেকেরই মানসিকতা ছিল দেশের হয়ে খেলাটাই অনেক সম্মানের ব্যাপার, অর্থটা নয়। আমি ভেবে পেতাম না সেই প্রচলিত মানসিকতা কীভাবে বদলাবে। একটা বিপ্লবের তাই দরকার ছিল, কেরি প্যাকার আয়োজিত ওয়ার্ল্ড ক্রিকেট সিরিজ ছিল ওই ধরনেরই একটা বিপ্লব।”

সাল ২০০৭ : আইসিএল বিপ্লব

হঠাৎই যেন ধূমকেতুর মত আবির্ভাব ঘটলো নতুন একটা ধারণার, ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ টি-টোয়েন্টি © আইসিএল

ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের ত্রিশ বছর পর আইসিএল জন্ম না নিলে এদেরকে যমজ ভাই বলে দাবি করলেও কিছু বলার থাকতো না। সত্যিই, এতগুলো কাকতাল একই সঙ্গে মিলে যাওয়াটা বেশ ইন্টারেস্টিং বটে!

২০০৩ সালে ইসিবি প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট উদ্ভাবন করার পর থেকে তখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি নেহায়েত পিকনিক ক্রিকেট হিসেবেই খেলা হয়ে আসছে। অজি ক্রিকেটাররা জার্সির পিছনে ডাকনাম লিখে মাঠে নামছে খেলতে, গল্পচ্ছলে হাসি-ঠাট্টা করতে করতে ম্যাচ খেলে চলেছে, আবার ম্যাচ হেরে গেলেও সেটাকে সেভাবে পাত্তা না দিয়ে মাঠ থেকে হাসতে হাসতেই বেরিয়ে আসছে। অদ্ভুতরকম অস্বাভাবিক একটা দৃশ্যই তখন বেশ দেখা যাচ্ছিলো টি-টোয়েন্টি নামের এই ‘পিকনিক ক্রিকেট’ ফরম্যাটের কল্যাণে।

হঠাৎই যেন ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব ঘটলো নতুন একটা ধারণার, ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগ টি-টোয়েন্টি। এবার স্বপ্নদ্রষ্টা জি এন্টারটেইনমেন্ট। কারণও অনেকটাই প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেটের মতোই, শুধু এবার ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার জায়গায় নাম এলো বিসিসিআইয়ের। দলে দলে সাবেক ও বর্তমান ক্রিকেটাররা নাম লেখাতে শুরু করলেন এই ফ্র্যাঞ্চাইজি লীগে, সাথে পাল্লা দিয়ে এলো টাকার ঝনঝনানি। বিসিসিআই নিজের প্রভাব খাটিয়ে বিভিন্ন ক্রিকেট বোর্ডকে দিয়ে আইসিএল নিষিদ্ধ করে দিলেও বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানসহ বিভিন্ন দেশ থেকে দল বানিয়ে আইসিএলে যোগ দিতে শুরু করেন খ্যাত-অখ্যাত অনেক ক্রিকেটার।

আইসিএলে বাংলাদেশী দল ‘ঢাকা ওয়ারিয়র্স’ © আইসিএল

কিন্তু আইসিএল কর্তৃপক্ষের নেহায়েত দুর্ভাগ্য, বিসিসিআইতে তখন দোর্দন্ড দাপটে রাজত্ব করছেন শ্রীনিবাসন। সাথে সারথি হিসেবে রয়েছেন ললিত মোদির মতো বিজনেস মাস্টারমাইন্ড। তাঁদের যৌথ প্রয়াসে হলো নতুন যুগের সূচনা – আইপিএল।

সাল ২০০৮ : আইপিএল যুগ এবং টি-টোয়েন্টি আগ্রাসন  

আইসিএলকে চাপা দিতে ললিত মোদি এবং শ্রীনিবাসনের ‘মাস্টারপ্ল্যান’ আইপিএল © গেটি ইমেজ

ললিত মোদি প্রথম যখন ‘আইপিএল’ নামের বিশেষ চিত্তাকর্ষক টুর্নামেন্টখানা বাজারজাত করলেন, তখন তিনি বেশ কিছু চাতুর্যপূর্ণ কাজ করেছিলেন; যার মধ্যে অন্যতম হলো ইউটিউবে ফ্রি লাইভ স্ট্রিমিং-এর ব্যবস্থা করা। এর ফলে যেটা হলো, ক্রিকেট হয়ে গেল সহজলভ্য এবং সেটা ছড়িয়ে গেল সারা বিশ্বে! সাথে চিয়ারলিডারের ব্যবস্থা এবং ক্রিকেটের সাথে শোবিজের অদ্ভুত সমন্বয় হাজার হাজার দর্শককে পঙ্গপালের মতো টেনে আনতে শুরু করলো মাঠে। বুঝিয়ে দিলেন ললিত মোদি, ক্রিকেট দিয়েও রমরমা ব্যবসা শুরু করে দেওয়া যায় অনায়াসেই!

এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি আইপিএলকে, একে এখন ‘বক্স-সেট ক্রিকেট’ বলা হয় এবং তাতে বরং আইপিএল ধারণাটার প্রশংসাই করা হয়। কেননা, আজকাল ‘ক্রিকেট’ শব্দটার সাথে ‘বাণিজ্য’ শব্দটা জুড়ে গিয়ে ‘ক্রিকেট-বাণিজ্য’ নামক এক অদ্ভুত শব্দের অবতারণা হয়েছে।

এই ক্রিকেট-বাণিজ্যের তোড়ে প্রথম দফায় শংকার মুখে পড়েছিল ওয়ানডে ক্রিকেট, যার ফলশ্রুতিতে শচীন টেন্ডুলকার পঞ্চাশ ওভারের ম্যাচ দুই ইনিংসের বদলে ওয়ানডেতে ২৫ ওভার করে চারটি ইনিংস করার অদ্ভুত প্রস্তাব দেন। সে দফায় টিকে গেছে ওয়ানডে ক্রিকেট, বরং হয়ে উঠেছে আরো গতিশীল। আজকাল ৫০ ওভারের ম্যাচে ৪০০ রান হরহামেশাই হচ্ছে, প্রতিনিয়ত ‘ব্যাটিং পিচ’ নামের ‘হাইওয়ে পিচ’ বানানো হচ্ছে, মাঠে দর্শক গিয়ে চার-ছক্কা বেশি দেখতে পাচ্ছে, বেশি আমোদিত হচ্ছে সমগ্র বিশ্ব, ছড়িয়ে যাচ্ছে ক্রিকেট বাণিজ্য! এই তো চাওয়া ছিল মোদির, এক আইপিএল ধারণার সূত্রপাত ঘটিয়ে সোজা ইতিহাসে ঢুকে গেলেন তিনি!

এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট যুগ

আইপিএল উন্মাদনা এবং প্রথম আসরের সফলতা দেখে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়াসহ আরো অনেক দেশই আয়োজন করে নতুন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ। © গেটি ইমেজ

আইপিএল উন্মাদনা এবং প্রথম আসরের সফলতা দেখে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া শুরু করে একই ধাঁচের টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট শুরু করে, যার নাম দেওয়া হয় ‘বিগ ব্যাশ ক্রিকেট’। এরপর সেই ধারাবাহিকতায়ই একে একে বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজসহ বিভিন্ন দেশে একইভাবে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ শুরু করা হয়। এর মধ্যে বাংলাদেশ পিসিএল এবং বিপিএল নামের দুটো ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ আয়োজন করে, দুটোই ব্যবসায়িকভাবে লাভের মুখ দেখে। শ্রীলংকান প্রিমিয়ার লিগ (এসএলপিএল) সে তুলনায় কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও লাভের অঙ্ক উঠে আসে সহজেই। ক্যারিবিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (সিপিএল)-ও যথেষ্ট লাভজনক টুর্নামেন্ট বলে প্রমাণিত হয়। বেশ কিছু নতুন ক্রিকেটারেরও উত্থান হয় এই টুর্নামেন্টগুলোর মাধ্যমে, ক্রিকেটাররাও অর্থনৈতিক দিক থেকে দারুণ লাভবান হন। এর ফলে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগের সমর্থনের পাল্লা ভারী হতেই থাকে, অন্যদিকে আয়োজকদের মুখেও হাসির অন্ত থাকে না। টি-টোয়েন্টিই ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে ক্রিকেট বিপণনের মূল অংশ।

একটা লম্বা সময় ধরেই টি-টোয়েন্টিকে ভাবা হতো ‘পিকনিক ক্রিকেট’, যা ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ ক্রিকেট যুগে এসে রাতারাতি বদলে যায়। © গেটি ইমেজ

কিন্তু মাথা চুলকিয়ে ভাবতে বসলেন অগ্রজ ক্রিকেটবোদ্ধারা, এতদিন ‘পিকনিক ক্রিকেট’ ভেবে আসা টি-টোয়েন্টির হঠাৎ আগ্রাসনে তাঁরা হারিয়ে যেতে দেখলেন টেস্ট ক্রিকেটকে। আইসিসি বললো, টি-টোয়েন্টির জন্য আলাদা উইন্ডো রাখা হবে, আর টেস্টের সাথে টি-টোয়েন্টির সংঘর্ষ হবে না। আমরা বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করলাম, আইসিসি আইপিএল নামের একটা ঘরোয়া টুর্নামেন্টের জন্য সত্যি সত্যিই আলাদা উইন্ডো রেখে দিয়েছে!

জানাই ছিলো, এই সিদ্ধান্তের ভয়াবহ দিকটার সম্মুখীন একদিন না একদিন আমাদেরকে হতেই হবে। সেটার জন্য খুব বেশিদিন দেরি করতে হয়নি আমাদের, খুব দ্রুতই ‘ফ্রিল্যান্সিং’ শব্দটির সাথে পরিচয় হয়ে যায় ক্রিকেটের। আমরা ভেবেছিলাম, এটাই হয়তো একমাত্র হুমকি হতে চলেছে।

সম্ভাবনাময় অস্ট্রেলিয়ান ফাস্ট বোলার শন টেইট পরবর্তীতে ফ্রিল্যান্সার ক্রিকেটার হয়ে যান। © গেটি ইমেজ

কিন্তু আমরা বড্ড ভুল ছিলাম! আর সেটা বুঝতে বুঝতে চলে গিয়েছে দশ বছরের কাছাকাছি সময়। এখন শেন ওয়াটসন দাবি করছেন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটকে প্রাধান্য দেওয়ার কথা, সেটাকে মহিমান্বিত করতে তিনি দ্বিপাক্ষিক সিরিজগুলোকে ‘অর্থহীন’ বলে দাবি করেছেন। দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার এই যে, সাম্প্রতিক কিছু জরিপে দেখা গেছে ওয়াটসন একাই এই ধারণা পোষণ করেন না। অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ আরো বেশ কিছু দেশের খেলোয়াড়দের উপর জরিপ চালিয়ে দেখা গেছে, দশজন ক্রিকেটারের মধ্যে প্রায় তিনজন ক্রিকেটারই ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের জন্য জাতীয় দলের ডাক উপেক্ষা করতে প্রস্তুত।

তাই এখন সেই অস্বাভাবিক প্রশ্নটাই মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে আরো একবার… ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কি তাহলে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের হাতেই চলে যাবে? আর এর সাথে পরিপূরকভাবেই একটা প্রশ্ন ওঠে, যদি যায় সেটা কি ক্রিকেটের জন্য হুমকির হবে আদৌ?

ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কি তাহলে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের হাতেই চলে যাবে? আর এর সাথে পরিপূরকভাবেই একটা প্রশ্ন ওঠে, যদি যায় সেটা কি ক্রিকেটের জন্য হুমকির হবে আদৌ? © গেটি ইমেজ

অতীত বলে, প্যাকারের ওয়ার্ল্ড সিরিজ ক্রিকেট টেস্টের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারেনি, বরং দুটি ফরম্যাটই পাশাপাশি হাত ধরাধরি করেই চলেছে। আইপিএল-বাণিজ্য ওয়ানডের সামনে হুমকি হয়ে আসলেও সেটা ধোপে টেকেনি, বরং ওয়ানডে হয়ে উঠেছে আরো উপভোগ্য। কিন্তু খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত নৈপূণ্যতে যে ভাটা পড়েছে, সে কথা অনস্বীকার্য। ব্যাটসম্যানদের টেকনিক এখন অতটা নিশ্ছিদ্র না হলেও চলে, স্পিনারদেরও গুগলি, ফ্লিপার কিংবা টপ স্পিন করতে সেভাবে দেখা যায় না। বরং তাঁরা এখন ব্যস্ত থাকেন, কীভাবে ব্যাটসম্যানদের রান আটকানো যায়। ব্যাটসম্যানেরা বল মারার পরিকল্পনাতেই মত্ত থাকেন। আর তাতে করে সাধারণ দর্শকেরা বেশ আমোদিত হলেও ওই যে চোখের শান্তি বলে একটা কথা আছে, সেটা আর আসে না। আর সেটাতেই আমাদের যত সমস্যা… চোখের শান্তিই যদি না পেলাম, তাহলে ক্রিকেটে আর সেই ‘ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ’ ফ্লেভারটা পাবো কোত্থেকে?

তাই ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ কী, সেটার থেকে বরং ভালো প্রশ্ন হতে পারে, চিরন্তন ক্রিকেটধারণার ভবিষ্যৎ কী? আর নিশ্চিতভাবেই সেটার প্রশ্ন এখন সময়ের হাতেই তোলা রইলো। ক্রিকেট সময়ের স্রোতের সাথে সমকালীনভাবে চলতে থাকবে, নাকি মানিয়ে নেবে অধুনা উদ্ভাবিত ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট লিগগুলোর সঙ্গে, প্রশ্ন এখন সেটাই।

তথ্যসূত্র

(১) standard.co.uk/sport/cricket/future-looks-bright-for-england-even-if-they-fail-at-world-t20-insists-jayawardene-a3209766.html

(২) thecricketer.com/the-future-of-domestic-t20.aspx

(৩) huffingtonpost.co.uk/jamie-beck/cricket-test-match-sport_b_11652434.html

(৪) espncricinfo.com/west-indies-v-england-2016-17/content/story/1084044.html

(৫) espncricinfo.com/magazine/content/story/1077082.html

(৬) theroar.com.au/2013/02/17/make-changes-or-risk-the-future-of-the-game/

(৭) timeslive.co.za/sundaytimes/sport/cricket/article1203306.ece

(৮) espncricinfo.com/southafrica/content/story/1080830.html

(৯) khela-dhula.com/ফিচার/featured/1155/কোলপাক:-ক্রিকেটের-দারুণ-হুমকি-

Related Articles