Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্রিকেট ইতিহাসে টেলএন্ডারদের করা প্রথম টেস্ট শতরানের গল্প

ক্রিকেটে টেলএন্ডারদের ভূমিকা কী? এর সোজা-সাপ্টা উত্তর হলো, অপর প্রান্তের সেট ব্যাটসম্যানকে যতটুকু সম্ভব ব্যাট করে যেতে সাহায্য করা, বিপক্ষ দলের ব্যাটিংয়ে নামাকে যতক্ষণ সম্ভব দীর্ঘায়িত করা যায় তার ব্যবস্থা করা। ক্রিকেটে একসময় এই ধারণাটাই ছিল টেলএন্ডার ক্রিকেটারদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। টেল এন্ডাররা মূলত বোলার, তাই তাদের লম্বা ইনিংস খেলার কথা কোনো দলেই ভাবা হতো না। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ক্রিকেটেও এই ধারণার পরিবর্তন ঘটেছে। ক্রিকেটের মতো এক অনিশ্চয়তাপূর্ণ খেলায় টেল এন্ডারদের ভূমিকা এখন অতীব গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। আজ এমন কয়েকজন বোলারের গল্প বলবো, যারা টেলএন্ডার হিসেবে ব্যাটিং করতে নেমে তাদের অসাধারণ ব্যাটিং স্কিলে দলের জয় নিশ্চিত করেছেন, আবার কখনো নিশ্চিত পরাজয়ের হাত থেকে দলকে রক্ষা করেছেন।

১) মোহাম্মদ রফিক- ১১১ রান (বিপক্ষ দল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে মোহাম্মদ রফিকের দৃষ্টিনন্দন সেঞ্চুরি; Source: sportskeeda.com

টেস্ট ক্রিকেটে মাত্র তিনজন খেলোয়াড় ৯ নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে শতরান করার গৌরব অর্জন করেছেন। তার মধ্যে এক উজ্জ্বল নাম বাংলাদেশের প্রাক্তন বাঁহাতি অফস্পিনার মোহাম্মদ রফিক। ২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেন্ট লুসিয়ায় অনুষ্ঠিত বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ভেবেছিল খুব সহজেই বাংলাদেশের ইনিংসটি গুটিয়ে দেওয়া যাবে। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টায় বাধা হয়ে দাঁড়ান মোহাম্মদ আশরাফুল ও মোহাম্মদ রফিক। রফিকের অসাধারণ সব শটে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বোলাররা নিজেদের রীতিমতো অসহায় বোধ করতে লাগলো। গেইলের করা দিনের শেষ ওভারের শেষ বলে কাট খেলে বলকে মাঠে বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে রফিক পূর্ণ করেন তার সেঞ্চুরি। বিশ্বের তৃতীয় ক্রিকেটার হিসেবে ৯ নম্বরে ব্যাট করতে নেমে এই অসাধারণ কৃতিত্ব অর্জন করেন তিনি। ১১টি চার ও ৩টি ছক্কার সাহায্যে ১১১ রানের এক অনবদ্য ইনিংস খেলেন তিনি। আর রফিক ও আশরাফুলের কল্যাণে বাংলাদেশ সেই টেস্ট ড্র করতে সক্ষম হয়।

২) অনিল কুম্বলে- অপরাজিত ১১০ রান (বিপক্ষ দল: ইংল্যান্ড)

ইংল্যান্ডের মাটিতে কুম্বলের অপরাজিত ১১০ রানের এক ঝকঝকে ইনিংস; Source: sportskeeda.com

২০০৭ সালে ইংল্যান্ডের মাটিতে অবিস্মরণীয় এক টেস্ট সিরিজ জয়ের দ্বারপ্রান্তে ভারত। প্রথম টেস্ট ড্র, দ্বিতীয় টেস্টে ৭ উইকেটে জয়লাভের পর তৃতীয় ও শেষ টেস্টে ড্র করলেই ভারতের বিদেশের মাটিতে টেস্ট জয়ের এক সুবর্ণ সুযোগ। শেষ টেস্টে তাই ভারত টস জিতে ব্যাট করতে নামে। দীনেশ কার্তিক, শচীন, ধোনি এবং টেলএন্ডার হিসেবে ব্যাট করতে নামা কুম্বলের দৃঢ়তায় ভাল অবস্থানে পৌঁছে যায় ভারত। এদের মধ্যে কুম্বলের ব্যাট থেকে আসে অপরাজিত ১১০ রানের ঝকঝকে এক ইনিংস। ১৯৩ বল খেলে ১৬টি চার ও ১টি ছক্কার সাহায্যে তিনি এ রান করেন। তার ইনিংসের কল্যাণে ভারত প্রথম ইনিংসে তোলে ৬৬৪ রানের বিশাল পাহাড়। এই রানের সুবাদে ভারত সেই টেস্ট ড্র করে এবং রাহুল দ্রাবিড়ের নেতৃত্বে বিদেশের মাঠে টেস্ট সিরিজ জয় করে।

৩) ওয়াসিম আকরাম- অপরাজিত ২৫৭ রান (বিপক্ষ দল: জিম্বাবুয়ে)

জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়াসিম আকরামের অপরাজিত ২৫৭ রানের এক অসাধারণ ইনিংস; Source: sportskeeda.com

ক্রিকেট বিশ্বের এক অসাধারণ সুইং বোলার ওয়াসিম আকরাম। তার বোলিং দাপটে বিপক্ষের ব্যাটসম্যানরা সর্বদাই তটস্থ থাকতো। কিন্তু তিনি ব্যাট হাতে দেখিয়েছেন তার অনন্য এক প্রতিভার স্বাক্ষর। ১৯৯৬ সালে পাকিস্তানের শেখপুরা স্টেডিয়ামে জিম্বাবুয়ে প্রথম ইনিংসে প্রথমে ব্যাট করে তোলে ৩৭৫ রান। তার জবাবে ১৮৩ রানে ছয় উইকেট পড়ে যায় পাকিস্তানের। এই অবস্থায় ব্যাট করতে নামেন পাকিস্তানের অধিনায়ক ও ফাস্ট বোলার ওয়াসিম আকরাম। সেই ম্যাচে ২২টি চার ও ১২টি ছক্কার সাহায্যে অপরাজিত ২৫৭ রানের এক অসাধারণ ইনিংস খেলেন তিনি।

৪) জেরোমি টেলর- ১০৬ রান (বিপক্ষ দল: নিউজিল্যান্ড)

নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে জেরোমি টেলরের ১০৬ রানের ঝড়ো ইনিংস; Source: sportskeeda.com

২০০৮ সালে নিউজিল্যান্ডের ডানেডিনে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচের সেই দিনটি ছিল মেঘাচ্ছন্ন। পিচের ওপর টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে পড়ছিল ব্যাটসম্যানদের পক্ষে। আউটসুইং, ইনসুইংয়ে রীতিমতো নাস্তানাবুদ হচ্ছিলেন ব্যাটসম্যানরা। প্রথম ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের ৩৬৫ রানের জবাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর তখন ১৭৩ রান ৬ উইকেটে। আট নম্বরে টেলএন্ডার হিসেবে ব্যাট করতে আসেন দ্রুতগতির বোলার জেরোমি টেলর। অন্য প্রান্তে ছিলেন তুখোড় ব্যাটসম্যান শিবনারায়ণ চন্দরপল। কিন্তু দিনটি ছিল টেলরের। শুরু হলো ব্যাটিংয়ে তার অনবদ্য কাব্য রচনা। ড্রাইভ, ফ্লিক, কাট ক্রিকেটের যাবতীয় শট খেলে ব্যতিব্যস্ত করে রাখলেন ভিটোরির মতো স্পিনার আর ফাস্ট বোলারদের। যখন টেলর আউট হন তখন তার নামের পাশে ১০৬ রান, আর নিউজিল্যান্ডের লিড মাত্র ৩৯।

৫) মিচেল জনসন- অপরাজিত ১২৩ রান (বিপক্ষ দল: দক্ষিণ আফ্রিকা)

দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে মিচেল জনসনের শতরানের এক বিধ্বংসী ইনিংস; Source: sportskeeda.com

মিচেল জনসন একজন স্লগার না অলরাউন্ডার এই বিতর্ক ক্রিকেট বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকদিন পর্যন্ত ছিল। ২০০৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে কেপ টাউনে ১২৩ রানের অপরাজিত ইনিংস খেলার মাধ্যমে এই বিতর্ককে চিরদিনের মতো আস্তাকুঁড়ে নিক্ষেপ করেন মিচেল। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলার স্টেইনের বোলিং তোপে অস্ট্রেলিয়া যখন ৬ উইকেটে ২১৮ রান, তখন আট নম্বরে ব্যাট করতে নামেন জনসন। সেদিন জনসনের বিধ্বংসী বোলিংয়ে খড়কুটোর মতো উবে যেতে থাকে দক্ষিণ আফ্রিকার বোলিংয়ের ঝাঁঝ। এন্ড্রু ম্যাকডোনাল্ডের সাথে জুটি বেঁধে সপ্তম উইকেটে ১৬৩ রানের এক পার্টনারশিপ গড়েন। জনসন যখন ৯৬ রানে অপরাজিত, ঠিক সে সময় দক্ষিণ আফ্রিকার পল হ্যারিসের পরপর দুই বলে ম্যাকডোনাল্ড ও পিটার সিডল আউট হয়ে গেলে সেঞ্চুরি না হওয়ার শঙ্কায় পড়েন জনসন, কিন্ত পরবর্তী ওভারে করা স্টেইনের একটি বলকে মাঠের বাইরে পাঠিয়ে জনসন তার প্রথম শতক করতে সক্ষম হন।

৬) হরভজন সিংহ- ১১৫ রান (বিপক্ষ দল: নিউজিল্যান্ড)

হরভজনের ১১৫ রানের ওপর ভর করে টেস্টে পরাজয়ের হাত থেকে দল রক্ষা পায়; Source: sportskeeda.com

২০১০ সালে আহমেদাবাদে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচটি চতুর্থ দিনের চা বিরতি পর্যন্ত নিষ্প্রাণ ড্রয়ের দিকে এগোচ্ছিল। চতুর্থ দিনের শেষ সেশনে নিউজিল্যান্ডের ফাস্ট বোলার ক্রিস মার্টিনের অসাধারণ এক স্পেলে প্রাণ ফিরে পায় ম্যাচটি। দ্বিতীয় ইনিংসে ভারত ১৫ রানের লিড নিয়ে ব্যাট করতে নামে। ক্রিস মার্টিনের ফাস্ট বোলিংয়ের তোপে ভারত ১৫ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ফেলে। চতুর্থ দিন শেষে ভারতের রান দাঁড়ায় ৬৫ রানে ৬ উইকেট। খেলার ভাগ্য তখন অনেকটাই নিউজিল্যান্ডের অনুকূলে। পঞ্চম দিনের সকালে ব্যাট করতে নামেন ভারতের নির্ভরযোগ্য স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান ভিভিএস লক্ষণ এবং টেলএন্ডার অফ স্পিনার হরভজন সিং। পঞ্চম দিনটি নিউজিল্যান্ডের না হয়ে  লক্ষণ আর হরভজনের অনন্য ব্যাটিং প্রদর্শনের দিন হিসেবে পরিণত হলো। হরভজনের অসাধারণ ব্যাটিং এবং লক্ষণের দৃঢ়তায় ভারত সেই ম্যাচটি ড্র করতে সক্ষম হয়। সেই ম্যাচটিতে হরভজন ১১৫ রানের দৃঢ়চেতা এক ইনিংস খেলেন। শুধু কি তা-ই! হরভজন তার এই ব্যাটিং পরের টেস্টেও অব্যাহত রাখেন। সেই টেস্টে আবার শতরান করে আট নম্বর বা তার পরে নামা ব্যাটসম্যান হিসেবে পরপর দু’ম্যাচে শতরান করার এক অন্য রকম কৃতিত্ব অর্জন করেন হরভজন।

৭) স্টুয়ার্ট ব্রড- ১৬৯ রান (বিপক্ষ দল: পাকিস্তান)

লর্ডসের মাটিতে স্টুয়ার্ট ব্রডের প্রথম সেঞ্চুরি; Source: sportskeeda.com

২০১০ সালে লর্ডসে অনুষ্ঠিত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচটিতে ১৬৯ রানের এক অসাধারণ ইনিংস খেলেন ইংল্যান্ডের এই পেসার। কিন্তু ম্যাচের শুরুটা ইংল্যান্ডের জন্য খুব একটা সুখকর ছিল না। মেঘলা আবহাওয়ার সুযোগ নিয়ে এবং পাকিস্তানী পেসার আমিরের দুর্দান্ত এক স্পেলে দিনের শুরুতেই ইংল্যান্ড ১০৭ রান করতেই ৭ উইকেট হারিয়ে ফেলে। নয় নম্বরে ব্যাট করতে নামেন ইংল্যান্ডের ফাস্ট বোলার স্টুয়ার্ট ব্রড। অষ্টম জুটিতে জোনাথন ট্রটের সঙ্গে জুটি বেঁধে ব্রড ৩৩২ রানের এক বিশাল পার্টনারশিপ গড়ে তোলেন, যা টেস্ট ক্রিকেটে এখনও পর্যন্ত সেরা পার্টনারশিপ হিসেবে স্বীকৃত। শুরুতে পাকিস্তানী উইকেটরক্ষক কামরান আকমলের হাতে জীবন পাওয়া ব্রড ২৯৭টি বল খেলে ১৮টি চার ও একটি ছক্কার সাহায্যে ১৬৯ রান করেন।

৮) রবিচন্দ্রন অশ্বিন- ১০৩ রান (বিপক্ষ দল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে রবিচন্দ্রন অশ্বিনের ১০৩ রানের ইনিংস; Source: sportskeeda.com

২০১১ সালের মুম্বাইয়ের ওয়াংখেড় স্টেডিয়ামে ভক্তরা টিকিটি কেটে গ্যালারিতে বসে ছিলেন একজন লিজেন্ড খেলোয়াড়ের শতক দেখার জন্য। তিনি আর কেউ নন, ভারতের কিংবদন্তী ব্যাটসম্যান শচীন রমেশ টেন্ডুলকার। চতুর্থ দিন ভক্তরা অপেক্ষায় ছিলেন শচীনের শততম শতক দেখার জন্য। কিন্তু তা যখন হলো না, ভক্তদের মন তখন হতাশায় ভরে উঠলো। তাদের সেই হতাশায় স্বস্তির প্রলেপ দেবার জন্য ক্রিকেট মঞ্চে আবির্ভূত হলেন ভারতীয় দলের অফস্পিনার রবিচন্দ্রন অশ্বিন। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে নিজের প্রথম টেস্ট শতরানের সাথে ৫ উইকেট শিকার করেন অশ্বিন। ১০৩ রান করেন এই ভারতীয় স্পিনার। টেস্ট ক্রিকেটে এই অফস্পিনারের এখন পর্যন্ত চারটি শতক রয়েছে।

৯) সোহাগ গাজী- অপরাজিত ১০১ রান (বিপক্ষ দল: নিউজিল্যান্ড)

সোহাগ গাজীর টেস্ট ক্রিকেটে প্রথম শতরান; Source: sportskeeda.com

২০১৩ সালে চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচটি ছিল বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্য এক অনন্য ঘটনা। আর বাংলাদেশি ক্রিকেটার সোহাগ গাজীর জন্য তা ছিল এক স্বপ্নের ম্যাচ। ২০১২ সালে টেস্ট অভিষেক হওয়ার পর খুব একটা সফলতা পাচ্ছিলেন না সোহাগ। তবে চট্টগ্রামে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে অনুষ্ঠিত টেস্ট ম্যাচটি তার ক্যারিয়ারের এক স্মরণীয় ম্যাচ হিসেবে লেখা থাকবে। ম্যাচটিতে ৬ উইকেট নেয়ার সাথে সাথে শতরান করেন সোহাগ। আট নম্বরে ব্যাট করতে নেমে ১০১ রানে অপরাজিত ছিলেন। তিনিই ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র ব্যক্তি, যিনি একই টেস্ট ম্যাচে শতকের সাথে হ্যাটট্রিক করার গৌরব অর্জন করেন।

ফিচার ইমেজ- Dhaka Tribune

Related Articles