Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভারত-পাকিস্তানের খেলোয়াড়: মাঠের বাইরের জানা-অজানা

সালটা তখন ১৯৯৯, রাজনৈতিক টানাপোড়েনে পাকিস্তানের ভারত সফর প্রায় অনিশ্চিত। ওদিকে ভারতের কিছু সংগঠন সিরিজের বিরোধিতা করে সহিংসতা শুরু করে দিয়েছে। ওয়াসিম আকরামকে পাকিস্তানের সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করলেন, তারা ভারতে খেলতে যাবেন কিনা। তার জবাব ছিল, “ক্রিকেট আর রাজনীতি আলাদা। আমরা যাব ও খেলব। হয়ত পরিবর্তন হতেও পারে।” জয়টা হয়েছিল ক্রিকেটেরই। ভারতে এসে এয়ারপোর্টে রাজসিক অভ্যর্থনা পেল পাক দল। ঝামেলার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে চেন্নাই স্টেডিয়ামে এলো ৪০,০০০ মানুষ আর দিল্লিতে দ্বিতীয় টেস্টে দর্শক সংখ্যা দাঁড়াল ৫০,০০০ এ। টানটান উত্তেজনার এই সফরে কলকাতায় তৃতীয় টেস্টের আগে সহিংসতা বা কোনো অঘটনের মেঘ পুরোই কেটে যায়। রাজনৈতিক বা সমর্থক পর্যায়ে যতই রেষারেষি থাক না কেন, পাক-ভারত খেলোয়াড়দের দারুণ সম্পর্কের অনেক কাহিনী রয়েছে।

টস করার সময় ওয়াসিম আকরাম ও আজহারউদ্দীন; Source: ESPN Cricinfo

ওয়াসিম আকরামের চেয়ে বেশি যন্ত্রণা ভারতীয় ব্যাটসম্যানদের কেউই দেননি ক্রিকেটের ইতিহাসে। অথচ ভারতে সবচেয়ে জনপ্রিয় পাকিস্তানি খেলোয়াড় কিন্তু তিনিই। তাকে ভারতীয়রা অনেকটা ঘরের ছেলেই ভাবে। আবার ওয়াসিম আকরামের মতে, পাকিস্তানে কোহলি-ধোনি গেলে নাকি ট্রাফিক জ্যাম লেগে যাবে! আকরাম তো না হয় ঘরের ছেলের মতোই, মাঠে প্রচণ্ড আক্রমণাত্মক শহীদ আফ্রিদিও ঢের জনপ্রিয় ভারতে। মাঠে ভারতীয় খেলোয়াড়দের সাথে আফ্রিদির প্রায়ই বচসা হলেও, সত্যটা হলো, তার সাথেই নাকি ভারতীয় খেলোয়াড়দের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো। তিনি নিজেই এক লেখায় স্বীকার করেছেন, এক গৌতম গম্ভীর ছাড়া আর বাকি সব ভারতীয় খেলোয়াড়দের সাথেই তার ভালো সম্পর্ক। তার সে লেখায় তিনি কিছু ঘটনাও শেয়ার করেছেন।

গম্ভীরের সাথে বচসারত আফ্রিদি; Source: Deccan Chronicle

একবার আফ্রিদি ভারতীয় ক্রিকেটারদের তার বাসায় নিমন্ত্রণ করেন। সবাই হাজির, খোশগল্প হলো। এবার খাওয়ার পালা। আফ্রিদি পাকিস্তানের ঐতিহ্যবাহী ভেড়ার মাংস ও খাসির মাংসের অনেক পদ করেছেন মেন্যুতে। ভাবলেন সবাই গোগ্রাসে গিলবে, কিন্তু এ কী! খাওয়ার টেবিলে অনেকেই মুখ চাওয়াচাওয়ি করছেন নিজেদের মাঝে। সমস্যা হলো, তরুণ আফ্রিদির মনেই ছিল না ভারতীয় দলের অনেকেই নিরামিষভোজী। ব্যস, তড়িৎবেগে শহরের সেরা আরেক রাঁধিয়েকে এনে ঝটপট তৈরি করে নিলেন নিরামিষ খাবার। পরে এক ভারতীয় খেলোয়াড় বলেন, “ভালোই হয়েছে তোমার মেন্যুতে প্রথমে সব মাংসের আইটেম থাকায়। দেড় ঘন্টা অতিরিক্ত আড্ডা দিতে পারলাম!” আফ্রিদির শেষ ভারত সফর জেনে কলকাতায় টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ম্যাচের আগে বিরাট কোহলি আফ্রিদিকে পুরো ভারতীয় দলের সাক্ষর করা একটি জার্সি দিয়ে যান তাকে সম্মান জানাতে। আফ্রিদি এটা নিয়ে লিখেছেন, “এটা আসলেই অন্যরকম অনুভূতি ছিল, আমি সম্মানিত। এটা আমার ক্যাবিনেটে আজীবন থাকবে।

শহীদ আফ্রিদির সবচেয়ে কাছের তিন ভারতীয় খেলোয়াড় হলেন জহির খান, হরভজন সিং আর যুবরাজ সিং। তার ভাষায়, “তরুণ বয়সে প্রচুর ঘুরতাম, খেতে যেতাম, আড্ডা দিতাম হোটেল লবিতে। তখন অবিবাহিত ছিলাম, সময়ও ছিলো। এখন সম্পর্ক আগের মতো থাকলেও আর এত ঘোরা হয় না। রাজনৈতিক কারণে সিরিজ কম হওয়ায় দেখাও হয় কম।” হরভজন সিংয়ের কাহিনী আরো অবাক করার মতো। ভারতীয় দলের যে কয়েকজন খেলোয়াড় পাকিস্তানের সাথে খেলার সময় সবচেয়ে আক্রমণাত্মক থাকেন, তাদের মাঝে তিনিও একজন। আফ্রিদি তো বটেই, শোয়েব আখতারের সাথেও তার দারুণ বন্ধুত্ব। শোয়েব তার দিকে মাঠে তেড়ে গেছেন, তিনিও স্লেজ করেছেন, তবে নেপথ্যটা মজারই। একবার ভাজ্জিকে স্লেজ করে শোয়েব বলছেন মাঠেই, “তোকে ব্যাট দিয়ে পেটাব আজকে খেলা শেষ হোক।” ভাজ্জিও উল্টো বললেন, “আসিস আজকে রাতে হোটেলে, আমিও দেখি কে কাকে দেয়।” ভাজ্জির ভাষায়, “খেলার পর হোটেলে গিয়ে আমি চিন্তায় আছি যদি সত্যিই ও ব্যাট নিয়ে পেটাতে আসে, তার তো ঠিক নেই! আর যা লম্বা আর শক্তিশালী ও!” তবে শোয়েব নাকি সত্যিই একবার হরভজন আর যুবরাজকে একসাথে রুমে পিটিয়ে এসেছিলেন, বন্ধুসুলভ মারামারি আর কী!

স্লেজিংরত ভাজ্জি ও শোয়েব; Source: Deccan Chronicle

আরো একটি ঘটনা বলেছেন ভাজ্জি।

একটা ম্যাচের আগের রাতেও ওর সাথে খেয়েছি। শোয়েব ম্যাচের সময় স্লেজিং শুরু করল। বলল, পারলে ছয় মারো। আমিও মেরে দিলাম। এরপর ও দুটো বাউন্স মারল। একশ মাইলের বাউন্স! আর সে কী স্লেজ আমাকে! সেই রাতেই আবার একসাথে খেলাম, যেন কিছুই হয়নি।

একটা রিয়েলিটি শোতে শোয়েব আখতার আর হরভজন দুজনেই এসেছিলেন। তাদের কথায় একটা দারুণ বিষয় উঠে এলো। শোয়েব বলছেন, “অনেকদিন বচসা হয় না মাঠে বা বাইরে কোথাও। আমি ভাজ্জিকে বললাম কিছু একটা ঝামেলা শুরু করতে। জনতা যে কোনো টপিক পাচ্ছে না।

এমন আরো অনেক বিখ্যাত সম্পর্কের কথা আছে। পাকিস্তানি সাবেক খেলোয়াড় ইকবাল কাশিম আর ভারতীয় বিষেণ সিং বেদীর মাঠের দ্বৈরথও সেই আমলে সবচেয়ে উপভোগ্য ছিল। অথচ ইকবাল কাশিমের কথায় তিনি ভারতে এলে হোটেলে না উঠে সোজা বেদীর বাসায় থাকেন, আর বেদীও পাকিস্তান গেলে তার লাহোরের বাসায় থাকেন।

হালের খেলোয়াড়দের মধ্যে ম্যাচ কম হলেও সম্পর্কের ঐতিহ্য রয়ে গেছে সেই আগের মতোই। মোহাম্মদ আমির যখন তার শাস্তি কাটিয়ে ফিরলেন, তখন তার এই দুঃসময়ের সাথে লড়ে জাতীয় দলে ফিরে আসাকে ‘অনবদ্য’ আখ্যা দেন কোহলি। পাশাপাশি প্র্যাকটিস চলার ফাঁকে একসময় কোহলি তার অটোগ্রাফসহ একটি ব্যাট আমিরকে গিয়ে দিয়ে আসেন। আমির সেটি টুইটারে পোস্ট করে জানান এবং ধন্যবাদ দেন এই আন্তরিকতার জন্য। এক ফ্যান টুইটারে তাকে জিজ্ঞাসা করেন, হালের সেরা ব্যাটসম্যান কে তার চোখে। আমির জবাব দেন- কোহলি।

আমিরকে ব্যাট দিচ্ছেন কোহলি; Source: Deccan Chronicle

চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচের আগের দিন মহেন্দ্র সিং ধোনি পাকিস্তান অধিনায়কের সাথে ছবি তুলতে এসে সেখানে দেখেন, সরফরাজের ছোট্ট সন্তানও সেখানে বাবার সাথে এসেছে। সাথে সাথে ধোনি তাকে কোলে নিয়ে ছবি তোলেন। সম্প্রতি আজহার আলিও তার টুইটারে ছবি দেন তার বাচ্চাদের সাথে যুবরাজদের। বাচ্চাদের ইচ্ছে ছিল যুবরাজের সাথে ছবি তোলার, সরফরাজের কাছে সে কথা শুনে যুবিরা নিজেরাই হোটেলে গিয়ে ভিনদেশি ‘ভাইপো’দের সাথে একপ্রস্থ ফটোসেশন করে নেন। এই ছবিগুলো দুই দেশেরই ক্রিকেট মহলে দারুণ খ্যাতি পায়।

সরফরাজের সন্তানকে কোলে নিয়ে ধোনি, যে ছবিটির মহিমা অনবদ্য; Source: Deccan Chronicle

রাজনীতিবিদরা তাদের নিজেদের স্বার্থে একে অপরের প্রতি তীর্যক বাক্য বা অগ্নিঝরা বক্তব্য দিয়ে থাকে, সমর্থকেরাও তাতে হয়ে ওঠে অসহিষ্ণু। কিন্তু বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের নিজেদের মাঝে এমন সুসম্পর্কের হাজারো উদাহরণ আছে। নারী ক্রিকেট প্রায়ই লাইমলাইটের বাইরে থাকে। এবার তাদের বিশ্বকাপের সময় ভারতীয় বোলার ঝুলন গোস্বামীর কাছে তার সাথে ছবি তুলতে চান পাকিস্তানের নবাগত এক বোলার, যার কাছে ঝুলন গোস্বামী লিজেন্ড। তিনি ছবি তো তোলেনই, সাথে কিছু টিপসও দেন। ওয়াসিম আকরামের কাছে সিরিজ চলাকালীনই টিপস চেয়েছেন ভারতের জহির খান, নেহরারা এবং পেয়েছেনও। অথচ অনেক সময়ই সমর্থকদের মানসিকতা একটা ক্ষুদ্র বৃত্তের বাইরে বের হতে পারে না। শেষ করা যাক একটা ছোট্ট ভিডিও দিয়ে।

বারুদে ঠাসা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ম্যাচের পর পাক-ভারত দুই দলের খেলোয়াড়রা নিজেদের মাঝে খুনসুঁটি করছেন। কোনো রাশভারিতা বা প্রতিদ্বন্দ্বিতার ছায়া নেই, অথচ এক দল সেখানে সদ্য পরাজিত। যে সময়ে তারা হাসছেন একে অন্যের সাথে, হয়ত সেই সময়টাতেই কোথাও দুই বন্ধু তাদের নিয়ে তর্ক লাগিয়েই ভেঙে দিচ্ছে নিজেদের তিলেতিলে গড়ে ওঠা সম্পর্ক!

ফিচার ইমেজ- The New York Times

Related Articles