Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ফুটবলে ব্যক্তিগত সেরা হবার ক্ষেত্রে দলীয় সফলতার ভূমিকা কতটুকু? (প্রথম পর্ব)

যেকোনো কাজেই পুরস্কার থাকে। পুরস্কার একজন মানুষের কাজের গতিকে তরান্বিত করে। তাকে আরেকটি কাজ ভালোভাবে করতে উদ্বুদ্ধ করে। অন্যান্য সকল জায়গার মতো ফুটবলেও পুরষ্কারের ব্যবস্থা আছে। সেটা একটি ম্যাচেও হতে পারে, একটা পুরো টুর্নামেন্টেও হতে পারে, আবার সম্পূর্ণ মৌসুমের ভিত্তিতেও হতে পারে। তবে ব্যক্তিগত আর দলীয় খেলায় পুরস্কারের মাঝে বিচার করার ক্ষেত্রে কিছুটা পার্থক্য থাকে।

দলীয় খেলায় ব্যক্তিগত সেরার পুরস্কার আসলে কীভাবে দেওয়া উচিত? খেলোয়াড়ের ব্যক্তিগত পারফর্মেন্সের উপর ভিত্তি করে, নাকি দলীয় সফলতার উপর নির্ভর করে? সাধারণভাবে মনে করা হয়, যেহেতু পুরস্কারটি ব্যক্তিগত, তাই আলোকপাতটা একজন ব্যক্তি কতটুকু ভালো কিংবা খারাপ করেছে সেটার উপরেই করা উচিত।

কথা হচ্ছে, ধারণাটি কতটুকু সঠিক কিংবা আগের পুরস্কারগুলো আসলে কোন সূত্র মেনে দেওয়া হয়েছে? আর এর চেয়েও বড় কথা হচ্ছে, পারফর্মেন্স বলতে আসলে কী বোঝানো হয়?

দলীয় খেলায় ব্যক্তিগত সেরার পুরস্কার আসলে কীভাবে দেওয়া উচিত? Source: pinterest.com

এই লেখায় প্রথমে ছোট দৈর্ঘ্যের টুর্নামেন্টের আলোকে বিষয়টি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হবে। কারণ, বড় টুর্নামেন্ট নিয়ে আলোচনা করতে গেলে অনেক সময়ের প্রয়োজন। সূত্র বের করতে পারলে ছোট বড় সব জায়গাতেই সেটার প্রয়োগ করা যাবে। লেখাটি শুরু করার আগে কয়েকটি কথা বলা জরুরি। প্রায় বছরেই পুরস্কার দেওয়ার পর এক শ্রেণীর মানুষ বিতর্কে নেমে যায়। প্রতিটি মানুষের নিজস্ব একটি বিচার পদ্ধতি আছে। আপনি বিচারের রায়ের পক্ষে থাকতে পারেন, বিপক্ষেও থাকতে পারেন।

তবে দিন শেষে একটি প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের বিচার আপনার মেনে নেওয়া উচিত। নিজের মতের সাথে না মিললেও মেনে নিতে হয়। কারণ, স্বাভাবিকভাবে যারা বিচারকের দায়িত্বে আছেন, তারা অবশ্যই সাধারণদের চেয়ে কিছুটা হলেও ভালো বোঝেন। তাই যখন নিজের মতের সাথে না মিলে, তখন বোঝার চেষ্টা করা উচিত যে কোন কারণে আপনার মতের সাথে তাদের মতটা মিললো না। সেখান থেকে নতুন কিছু শেখার চেষ্টা করাটাই বুদ্ধিমানের কাজ।

পুরস্কার দেওয়ার ক্ষেত্রে বিচারকদের মূল্যায়নকে সঠিক ধরে আজকের লেখাটি লেখা হয়েছে। কাজেই, যারা কিনা বিচারকদের চেয়ে নিজের মতের প্রতিই বেশি আত্মবিশ্বাসী, তাদের জন্য এই লেখাটি পড়া অর্থহীন। অনুরোধ করবো এই শ্রেণীর মানুষেরা লেখাটি এড়িয়ে যাবেন। তারা ভুল এমনটি বলাও উচিত না, তবে তারা সঠিক হলে বিচারকদের ভুল ধরে নিতে হয়। আপাতত বিচারকদেরই সঠিক মেনে লেখাটি লেখা হয়েছে। তাহলে শুরু করা যাক।

খেলাধুলায় পারফর্ম করার অনেক পন্থা আছে। একটি হচ্ছে, দলের চাহিদা না বুঝেই পারফর্ম করা, এরকম পরিস্থিতিতে খোলা চোখে নিজের পারফর্মেন্স ভালো হলেও অন্যান্য খেলোয়াড়দের সেরাটা না-ও পাওয়া যেতে পারে। আরেকটি হচ্ছে, দলের চাহিদা বুঝে পারফর্ম করা। আরেকটি হচ্ছে, নিজে একটু পেছনে থেকে পুরো পরিস্থিতিটাকে বোঝার চেষ্টা করা। তারপর পরিস্থিতি অনুযায়ী পারফর্ম করা।

ক্রিকেট দিয়ে ব্যাপারটি একটু বোঝানোর চেষ্টা করা যাক। দলের সেরা বোলাররা সাধারণত পাওয়ার প্লে কিংবা স্লগ ওভারে বোলিং করেন। পাওয়ার প্লেতে বল করে যদি সাকিব ১০ ওভারে ৪৫ রান দেন, তাহলে অন্য সময় বল করলে হয়তো ১০ ওভারে ৩৫ রান দিতে পারতেন। কিন্তু অন্য যে বোলার পাওয়ার প্লেতে বল করবেন, তিনি হয়তো সাধারণ সময়ে ১০ ওভারে ৫০ রান দিলেও পাওয়ার প্লেতে ৮০ রান দিয়ে ফেলবেন। কাজেই কে কখন বোলিং করেছেন, সেটাও বিচার করার সময় মাথায় রাখা উচিত। কার সামর্থ্যের কতটুকু নিতে হবে সেটা বের করার দায়িত্বও একজন গ্রেট খেলোয়াড়ের। পাওয়ার প্লেতে বল করে রান বেশি দিয়ে পরিসংখ্যানে পিছিয়ে গিয়েও, দলীয় অবদানের কারণে আপনি সফল হতে পারেন। এই কাজটা করতে গেলে অনেক সময়েই পরিসংখ্যানগতভাবে আপনি একটু পিছিয়ে পড়তে পারেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, যারা খেলাটা সত্যিকার অর্থে বোঝেন তারা আপনাকে মূল্যায়ন করবেন।

দলের সেরা বোলাররা সাধারণত পাওয়ার প্লে কিংবা স্লগ ওভারে বোলিং করেন; Source: zimbio.com

ফুটবলের মতো একটি দলগত টুর্নামেন্ট আপনি কখনো একা জেতাতে পারবেন না। এখন পর্যন্ত এরকম কোনো ঘটনা দলীয় খেলায় কখনো ঘটেনি। তবে খেলোয়াড় হিসেবে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা আপনি রাখতে পারবেন। এখন আপনার ভূমিকাটা দলের পরিকল্পনার উপর নির্ভর করবে। দলের চাহিদা অনুযায়ী আপনাকে খেলতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনি ভালো খেললেন কিংবা টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড় হলেন, সেটা কোনো দলের মূল লক্ষ্য নয়। দলকে কতগুলো শিরোপা জেতাতে পারছেন অথবা শিরোপা জেতাতে না পারলেও দলকে তার বর্তমান অবস্থান থেকে কতটা উপরে তুলে নিতে পারছেন, সেটাই একজন খেলোয়াড়ের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত।

যখন দেখবেন আপনার চেয়ে প্রতিপক্ষ সবল, তখন নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় মূল সময়ের জন্য। যাতে সতীর্থরা সাহস পায়, যেন ভাবতে পারে, আমার পরেও কেউ আছে। বিষয়টা এমন যে, আপনাকে ১০০ মিটার পথ যেতে হবে। আপনার সতীর্থরা যেতে পারলো ২০ মিটার, বাকি ৮০ মিটার আপনি হিসেব করে এগুবেন। আর আপনি যদি প্রথমে ৯০ মিটার গিয়েও শেষ করেন, তাহলেও আপনার সতীর্থরা হয়তো বাকি ১০ মিটার পার হতে পারবে না। কারণ তারা জানে যে, তার পরে আর কেউ নেই। বিষয়টা অনেকটা ৪ X ১০০ মিটার র‍্যালির মতো। নিজে ভালো খেললেই চলবে না, দলের অন্যান্যরা কেমন খেলছে সেটার উপর ভিত্তি করে নিজের পারফর্মেন্স ঠিক করতে হবে।

আরেকটু ভিন্নভাবে বোঝানোর চেষ্টা করি। ছোট বেলায় সাঁতার শিখেছেন? প্রাথমিক পর্যায়ে একজন কিন্তু সবসময় আপনার সাথে থাকে। তার সাহসেই আপনি ভরসা পান যে, আপনি ডুবে যাবেন না, ডুবতে গেলেও আরেকজন আপনাকে সাহায্য করবে। এই সাহসটাই আপনাকে শিখতে সাহায্য করে। ফুটবল কিংবা অন্যান্য খেলাতেও এই সাহসটা প্রয়োজন। অনেক সময় এই কাজটা করতে গিয়ে নিজের গোল কিংবা অ্যাসিস্ট হয়তো কমে যায়। সবচেয়ে জুতসই উদাহরণ দেওয়া যায় ১৯৯০ বিশ্বকাপের ম্যারাডোনা আর ২০০৬ বিশ্বকাপের জিদানকে দিয়ে। ১৯৯০ বিশ্বকাপে ম্যারাডোনার অ্যাসিস্ট মাত্র ১টি, কোনো গোল নেই।

এই লেখায় কোন ধরনের ভূমিকায় কে কতটা সফল হয়েছে, সেগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। আজকের আলোচনা ২০০৬ বিশ্বকাপের জিদানের ভূমিকা নিয়ে।

২০০৬ বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় কে? জিনেদিন জিদান।

তিনি কিন্তু সেই বিশ্বকাপে দলীয়ভাবে সফল নন, চ্যাম্পিয়ন হন নি, হয়েছেন রানার্স আপ। এমনকি চ্যাম্পিয়ন না হওয়ার জন্যও অনেকে তার ঢুস মারাটাকেই দায়ী করে থাকেন! ব্যক্তিগতভাবে কি তিনি সফল? ব্যর্থ বলা যাবে না, তবে পরিসংখ্যানের বিচারে তার চেয়েও সফল খেলোয়াড় কিন্তু সেই বিশ্বকাপেই ছিলেন।

এমনকি চ্যাম্পিয়ন না হওয়ার জন্যও অনেকে তার ঢুস মারাটাকেই দায়ী করে থাকেন! Source: punditarena.com

২০০৬ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন ক্লোসা। তার ৫টি গোলের পর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোল ৩টি। আর্জেন্টিনার ক্রেসপো ৩টি গোলের সাথে ১টি অ্যাসিস্টও করেছিলেন। তারা কেউই কিন্তু সেরার তালিকায় প্রথম তিনেও ছিলেন না।

বিশ্ব চ্যম্পিয়ন ইতালির নির্ভরতা আন্দ্রে পিরলোর পারফর্মেন্সও যথেষ্ট ভালো ছিল। পিরলো সেই টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৩টি ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচ হন। এর মাঝে ফাইনাল আর সেমি-ফাইনালের ম্যাচ দুটোও ছিল। টুর্নামেন্টে ৩টি অ্যাসিস্টও করেছেন। আবার শিরোপাও তিনি পেয়েছেন। তাহলে তার পারফর্মেন্সকে আপনি খারাপ কীভাবে বলবেন? পিরলো কেন পেলেন না? সমস্যাটা কোথায়?

যেহেতু আমরা ফিফার বিচারটিকে মেনে নেব, তাহলে বিশ্লেষণ করতে পারি, ঠিক কী কারণে এরকম পারফর্ম করার পরেও জিজুকে সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারটা দেওয়া হলো আর পিরলোকে বাদ দেওয়া হলো। সেটি দেখার আগে আগে বিশ্বকাপে জিদানের পারফর্মেন্সের দিকে আরেকটু ভালোভাবে দৃষ্টি দেওয়া যাক।

পিরলো কেন পেলেন না সেরার পুরস্কার? Source: lagazzettaitaliana.com

গ্রুপে ফ্রান্সের সাথে ছিল টোগো, সুইজারল্যান্ড আর সাউথ কোরিয়া। অতটা কঠিন কোনো দল না। কোনো অঘটন না ঘটলে গ্রুপ থেকে ফরাসি আর সুইসদেরই পরের পর্বে যাওয়ার কথা। ফ্রান্স আর সুইজারল্যান্ডের প্রথম ম্যাচটা গোলশূন্য ড্র হওয়ায় তাই অস্বাভাবিক মনে হয়নি ব্যাপারটি। এই ম্যাচে জিদানের পারফর্মেন্স ছিল আর দশটা গড়পড়তা ম্যাচের মতোই। ম্যান অব দ্য ম্যাচও হন ম্যাকলেলে।

পরের ম্যাচ দক্ষিণ কোরিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্র হলো। এখানেও জিজু সাদামাটা। ম্যান অব দ্য ম্যাচ পার্ক জি সুং। টোগোর সাথে শেষ ম্যাচটা হয়ে গেল তাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। টোগো প্রতিপক্ষ হিসেবে তেমন ভীতিজনক ছিল না। তবে আগের দুই ম্যাচেই দুটি হলুদ কার্ড খাওয়ায় জিজু ম্যাচটা মিস করলেন। ম্যাচটি বাঁচিয়ে নিয়ে গেলেন ভিয়েরা আর হেনরি। গ্রুপ পর্ব পর্যন্ত যদি হিসেব করা হয়, তাহলে জিজু সে পর্যন্ত একেবারেই সাদামাটা।

এরপরের দ্বিতীয় পর্বে জিজুকে একটু খুঁজে পাওয়া গেল। ২৮ তম মিনিটে ফ্রান্স গোল খাওয়ার পরেও ৩-১ গোলে জিতে গেল ম্যাচটি। জিদান ১টি গোল করেন, তবে সেটি একেবারে অন্তিম সময়ে, ৯২ মিনিটে। উল্লেখ্য, জিদান এই ম্যাচেও একটি হলুদ কার্ড পান। কিন্তু জিজু মূল খেলাটা দেখিয়ে দিলেন ব্রাজিলের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে।

সেই ম্যাচে কেউই ফ্রান্সকে ফেভারিট ধরেনি। ব্রাজিলের গ্রুপ পর্বের ৩ ম্যাচের ৩টিতেই জয় পাওয়া, সাথে ৭টি গোল। দ্বিতীয় পর্বে তারা ঘানাকে ৩-০ গোলে হারিয়েছে। এর বিপরীতে ফ্রান্সের ৩ ম্যাচে ১ জয় আর ২ ড্র, গোল করেছে মাত্র ৩টি। ব্রাজিল দলে কাফু, কার্লোস, কাকা, রোনালদো, রোনালদিনহো, আদ্রিয়ানোদের মতো খেলোয়াড়; রবিনহোর মতো খেলোয়াড়কে সাইড বেঞ্চে রাখতে হয়। এই দলের বিপক্ষে ফ্রান্সকে ডার্ক হর্স ধরাটা অবশ্যই যৌক্তিক।

বিশেষজ্ঞ বিচারকেরা মূল্য দেন অকল্পনীয় কোনো পারফর্মেন্সকে; Source: myfootballfacts.com

কিন্তু জিদানের সেই এক ম্যাচের পারফর্মেন্সই আবার তাকে রেসে ফিরিয়ে আনলো। পরিসংখ্যানে সেই ম্যাচের ১ অ্যাসিস্টই টুর্নামেন্টে তার একমাত্র অ্যাসিস্ট, সেই ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচও তিনি। সেমিতে পর্তুগালকে হারায় ফ্রান্স জিদানের ১ গোলেই, তবে গোলটা করেন তিনি পেনাল্টিতে। ম্যান অব দ্য ম্যাচও কিন্তু তিনি হননি, হয়েছেন থুরাম। ফাইনালেও জিজু ১ গোল করেন পেনাল্টি থেকে, ১টি হেড থেকে গোল করার চেষ্টা করেন যা কিনা অবিশ্বাস্যভাবে বুফন সেভ করেন।

তাহলে পরিসংখ্যানগতভাবে জিদানের পারফর্মেন্স আসলে কেমন ছিল ২০০৬ বিশ্বকাপে?

যদি কেউ বলে যে, টোগোর সাথে জিদানবিহীন ফ্রান্স ম্যাচটি না জিতলে তো পরের পর্বে খেলতেই পারতেন না জিদান, তাহলে কি ভুল বলা হবে? ভুল হবে না, কথাটি সত্য। তবে সেদিন ফ্রান্সের জয়টাকে কেউ অস্বাভাবিক হিসেবে ধরেনি। বরং ফ্রান্স হেরে গেলে সেটাকেই আপসেট ধরা হতো। কিন্তু এরপরেও সেই বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় জিদানই। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন?

টোগোর বিপক্ষে ম্যাচটি বাঁচিয়ে নেওয়ার পরও হেনরি কিংবা ভিয়েরা সেভাবে আলোচনায় আসেন না, যতটা আসেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো ইউরো ২০১৬-তে হাঙ্গেরির বিপক্ষে ম্যাচ বাঁচানোর পর। অথচ দুটোই কিন্তু গ্রুপ পর্বের ম্যাচ।

এখানে একটি কথা মাথায় রাখা উচিত, প্রতিটি বিশ্বকাপ, ইউরো, কোপা আমেরিকা কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের মতো টুর্নামেন্টে ফিক্সচারটা এমনভাবে থাকে যাতে বড় দলগুলো অন্তত ২য় পর্ব পর্যন্ত সহজেই উঠে যায়। মাঝে মাঝে দুয়েকটি গ্রুপ ডেথ গ্রুপ হয়ে যায়। আবার মাঝে মাঝে কোনো ছোট দলও চমক দেখিয়ে বড় দলকে গ্রুপ থেকে ছিটকে ফেলে। এই বিষয়গুলোকে আপাতত ব্যতিক্রম ধরে নিয়েই পরের বিষয়গুলোকে এগুনো যাক।

আসলে ইতিহাস বলে, বিশেষজ্ঞ বিচারকেরা মূল্য দেন অকল্পনীয় কোনো পারফর্মেন্সকে। টোগোর সাথে ম্যাচটি জিততে ফ্রান্সের কারো কোনো অতিমানবীয় পারফর্মেন্স করার প্রয়োজন ছিল না। সাকিব আল হাসান বাদে বাংলাদেশ যদি আফগানদের সাথে জিতে, সেটিকে সবার খুব উঁচু মাত্রার পারফর্মেন্স ধরা হবে না, কিন্তু হেরে গেলে সেটার চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হবে। বিশেষজ্ঞরা হয়তো ভেবেছিলেন যে, গ্রুপ পর্ব থেকে পরের পর্বে ওঠাটা ফ্রান্সের জন্য তেমন অসাধারণ কিছু নয়, কিন্তু ব্রাজিলকে হারানোটা অসাধারণ। সেই ম্যাচ ফ্রান্স জিততে না পারলে জিনেদিন জিদান আজ সেই অবস্থানে থাকতেন না যেখানে তিনি বর্তমানে আছেন, সেটা নিশ্চিতভাবে বলা যায়।

তাহলে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ভূমিকাটা কেন বড় করে দেখা হয়? কারণ হাঙ্গেরির বিপক্ষে তার দল বারবার পিছিয়ে পড়ছিল। পরিস্থিতির কারণেই যে দলের খুব সহজে পরের পর্বে যাওয়ার কথা, সেই দলটাকেই টেনে পরের পর্বে তোলার জন্য তাকে কিছু স্পেশাল পারফর্মেন্স করতে হয়েছে।

ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর ভুমিকাটা কেন বড় করে দেখা হয়? Source: Michael Steele/Getty Images

দলীয় খেলায় কোনো দল যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে তার জন্য কোনো খেলোয়াড়কে এককভাবে দায়ী করা ঠিক না। তবে দল খারাপ করার পরেও যদি কোনো খেলোয়াড় তার দলকে একটি পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছুতে সাহায্য করে তাহলে তাকে ‘স্পেশাল’ বলা যাবে। সেই স্পেশাল কাজটি করেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো।

প্রায় একই ধরনের পারফর্ম করেছেন মেসি, ইকুয়েডরের বিপক্ষে বাছাইপর্বে। এই কারণে ব্রাজিলের মতো প্রতিপক্ষের বিপরীতে হ্যাটট্রিক থাকার পরেও আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে তার সেরা পারফর্মেন্স হয়ে যায় স্রেফ বাছাই পর্বের একটি ম্যাচ। এবারের বিশ্বকাপের মূল পর্বে আর্জেন্টিনাকে তোলার জন্য মেসিকে তাই বাড়তি ক্রেডিট দিতেই হয়।

জার্মান, স্পেন কিংবা ইতালির মতো দলগুলো অনেকটা কর্পোরেট কালচারের মতো দল সাজায়। এরকম দলে এককভাবে কোনো খেলোয়াড় সেভাবে ভূমিকা রাখে না, দলগতভাবে খেলে থাকে। এ কারণে ‘জিদান না থাকলে ফ্রান্সের বিশ্বকাপ কোয়ার্টারেই শেষ হয়ে যেত’ কথাটি যতটা সহজে বলা যায়, ‘পিরলো না থাকলে বিশ্বকাপ জিততে পারতো না ইতালি’ কথাটি ততটা সহজে বলা যায় না। অন্তত সেই বিশ্বকাপের বিচারটি সেই সাক্ষ্যই দেয়। এই কারণেই ফ্রান্স বিশ্বকাপ হেরে যাওয়ার পরেও জিদানকে ব্যর্থ হিসেবে ধরা হয় না। কারণ কেউই ফ্রান্সকে কোয়ার্টার ফাইনালের পরে এগুবে বলে বিবেচনা করেনি।

বিশ্বকাপের মূল পর্বে আর্জেন্টিনাকে তোলার জন্য মেসিকে তাই বাড়তি ক্রেডিট দিতেই হয়; Source: youtube.com

আসলে ব্যক্তিগত পারফর্মেন্স যখন দলের কোনো কাজে না লাগে, তখন সেটাকে খুব বেশি মূল্যায়ন করা হয় না। এই পর্যন্ত বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড়কে অন্তত সেমি পর্যন্ত পৌঁছুতেই হয়েছে, এরপর বিবেচনা শুরু হয়েছে। আপনার পারফর্মেন্স যদি আপনার দলকে অন্তত সেমি ফাইনাল পর্যন্তই পৌঁছাতে না পারে, তাহলে খুব একটা লাভ হবে না।

‘খুব ভালো খেলেও দলের অন্যান্যদের ব্যর্থতায় বাদ পড়েছেন’– এরকম খেলোয়াড় ইতিহাসে অনেক পাওয়া যাবে। তবে দল খারাপ করার পর কিংবা মোটামুটি খেলার পরেও নিজের বিশেষত্ব দিয়ে দলকে একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছানোর কাজটা খুব কম খেলোয়াড়ই করতে পেরেছেন। আর ইতিহাস বলে, যে জিনিসটি কম পরিমাণে হয়, সেটির মূল্য সবসময়ই কিছুটা বেশি হয়। কোনো সন্দেহ নেই যে, ২০০৬ সালের জিদানের পারফর্মেন্সটা তেমনই দুষ্প্রাপ্য ছিল।

পুরস্কার পাবার মতো পারফর্মেন্স কাকে বলে, আশা করি সেটার কিছুটা পরিস্কার ব্যাখ্যা দিতে পেরেছি।

দ্বিতীয় পর্ব- ফুটবলে ব্যক্তিগত সেরা হবার ক্ষেত্রে দলীয় সফলতার ভূমিকা কতটুকু? (দ্বিতীয় পর্ব)

ফিচার ইমেজ- Pinterest

Related Articles