Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মেসি কি শুধুই ক্লাব লিজেন্ড?

লিজেন্ড বলতে আমরা কী বুঝি ? সহজ ভাষায় বলতে গেলে লিজেন্ড হচ্ছেন নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে সবচেয়ে বিখ্যাত এবং প্রসিদ্ধ কোনো মানুষ।

আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় টেনিসের সেরা খেলোয়াড় কে, তাহলে বেশিরভাগ মানুষের মনেই রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল, পিট সাম্প্রাস- এই নামগুলো আসবে।

লিজেন্ড হচ্ছেন এমন কিছু ব্যক্তি, যারা নির্দিষ্ট কোনো বিষয়ে আলোচনা করতে গেলে নিজেদের অজান্তেই আমাদের মনের কোনে ভেসে আসবেন। নাদাল কিংবা ফেদেরারের বিষয়টাও এমনই। টেনিস বললেই যেন তাদের অবয়ব ভেসে উঠে মনের কোনে। ফুটবলেও লিজেন্ড বললে পেলে, ম্যারাডোনা- এদের নামই আপনার মাথায় আসবে।

তাহলে ফুটবলে ক্লাব লিজেন্ড বলতে আমরা কী বুঝি? সহজ ভাষায় বলা যায়, ক্লাব লিজেন্ড হচ্ছেন এমন একজন ব্যক্তি, যিনি সফলতা পান ক্লাবে খেলে, জাতীয় দলে সেভাবে সফল হন না।

বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় মেসিকে অনেকেই ক্লাব লিজেন্ড বলে থাকেন। আসলেই কি মেসি ক্লাব লিজেন্ড? মেসি কি জাতীয় দলের হয়ে ভালো খেলেন না?

লিওনেল মেসি; source: The Goal

আর্জেন্টিনার হয়ে সবচেয়ে বেশি গোল (৬১টি), ৩৭টি অ্যাসিস্ট, পরপর দুটি মেজর টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার (২০১৪ এর বিশ্বকাপ আর ২০১৫ এর কোপা), কোপা আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি (১১টি) অ্যাসিস্টের রেকর্ড, দক্ষিণ আমেরিকার বাছাইপর্বে সবচেয়ে বেশি গোল করার রেকর্ড, বিশ্বকাপে টানা চারবার ম্যান অব দ্য ম্যাচের পুরস্কার- এর সব কিছুই কিন্তু তার আর্জেন্টিনার জার্সি গায়েই করা।

কিন্তু এরপরেও তার সম্পর্কে এমন অপবাদ কেন? তিনি আর্জেন্টিনার হয়ে কোনো মেজর আন্তর্জাতিক ট্রফি জিতেননি বলে? তার মানে, যারা জাতীয় দল ও ক্লাব দুটোতেই ভালো খেলেন কিন্তু অর্জনে আন্তর্জাতিক ট্রফি নেই, তাদের পরিচয় কি শুধুই ক্লাব লিজেন্ড?

এই বিষয়টি আলোচনা করার আগে সম্পর্কযুক্ত আরো কিছু বিষয় দেখা যাক।

ক্লাব লিজেন্ড কথাটা বললে বেশিরভাগ মানুষের মনে প্রথমেই যার নাম ভেসে আসবে তিনি হলেন ওয়েইন রুনি। অথচ রুনিকে সবাই প্রথম চেনে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ভালো খেলার কারণেই। মাত্র ১৯ বছর বয়সে ইউরো ২০০৪ এ সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপ ম্যাচে দুটি গোল করেন তিনি। পরবর্তী ম্যাচে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষেও তিনি দুটি গোল করেন।

ওয়েইন রুনি, শুরুটা দুর্দান্ত হলেও শেষ পর্যন্ত হতাশাই সঙ্গী; source: The Sun

কিন্তু কোয়ার্টার ফাইনালে ৯ মিনিটের মাথায় ফর্মে থাকা রুনি ইনজুরিতে পড়ে বিদায় নেন। সেই ম্যাচে ইংল্যান্ড হেরে যায় টাইব্রেকারে। জাতীয় দলে স্বপ্নের মতো শুরু হলেও পরবর্তীতে সেটা ধরে রাখতে পারেননি রুনি। তিনটি বিশ্বকাপ খেলে করেছেন মাত্র ১ গোল। রুনির মতো একজন খেলোয়াড়ের কাছ থেকে এমন পারফর্মেন্স অবশ্যই হতাশাজনক।

আসলে শুধু রুনি নয়, ইংল্যান্ডের সেই প্রজন্মের অনেক খেলোয়াড়কেই কেবল ক্লাব লিজেন্ড মনে করা হয়। জেরার্ড, ল্যাম্পার্ড, বেকহাম- এদের কেউ কি ক্লাবে যতখানি সাফল্যের সাথে খেলেছেন, তার সিকি ভাগও জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পেরেছেন?

বেকহাম, জেরাড আর ল্যাম্পার্ড জাতীয় দলের হয়ে এই প্রজন্মটা কিছুই জেতেনি; source: NewsLocke

বিষয়টি এটাই। তারা জাতীয় দলের হয়েও একেবারে খারাপ খেলেননি, কিন্তু নিজেদের পারফর্মেন্স দিয়ে ক্লাবকে যতটা সফল করতে পেরেছিলেন, জাতীয় দলকে সেভাবে পারেননি। এ কারণেই তাদেরকে শুধু ক্লাব লিজেন্ডই বলা হয়।

অনেক সময় আবার এমন হয়ে যায় যে, ক্লাবের অতি মানবীয় পারফর্মেন্স না দেখাতে পারার কারণে জাতীয় দলে ভালো পারফর্মেন্স করার পরেও ক্লাব লিজেন্ড কথাটা শুনতে হয়। ২০০২ বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলের রিভালদোর সম্পর্কে এই অপবাদটা ছিল। অথচ কোপা আমেরিকা ১৯৯৯ এর সর্বোচ্চ গোলদাতা আর সেরা খেলোয়াড় রিভালদোই ছিলেন। ৯৮ এর বিশ্বকাপেও রিভালদো অসাধারণ খেলেছিলেন। ৩টি গোল করার সাথে সাথে সেমিতে নেদারল্যান্ডের বিপক্ষে রোনালদোর করা একমাত্র গোলের অ্যাসিস্ট ছিল তার। কিন্তু এত ভালো খেলার পরেও অনেকের চোখে তিনি ক্লাব লিজেন্ডই ছিলেন শুধু, কারণ ব্রাজিলের হয়ে তার পারফর্মেন্সটা আসলে বার্সাসুলভ ছিল না। তবে ২০০২ বিশ্বকাপে ৫ গোল করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তার এই দুর্নাম ঘুচেছে।

থিয়েরি হেনরি; source: cnn.com

আরেকজন ক্লাব লিজেন্ড হিসেবে পরিচিত খেলোয়াড় হচ্ছেন থিয়েরি হেনরি। ফ্রান্সের তারকা খেলোয়াড়, আর্সেনালের হয়ে বহু স্মরণীয় জয়ের রূপকার। আর্সেনালের মূল খেলোয়াড় হিসেবে খেলেছেন এবং তার প্রতিদানও দিয়েছেন দুর্দান্তভাবে। জাতীয় দলের হয়ে বিশ্বকাপ, ইউরো, কনফডারেশন কাপও জিতেছেন। কিন্তু ফ্রান্স কখনোই হেনরির কাছ থেকে আর্সেনালসুলভ সাপোর্ট পায়নি। হয়তো জিদান থাকার কারণে মূল ভুমিকাটুকু পালন করার সুযোগ হয়নি। কিন্তু যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন ততটুকুতে এক ২০০৩ এর কনফেডারেশন কাপ বাদে নিজেকে চেনাতে পারেননি। ২০০৩ এর কনফেডারেশন কাপে হেনরি গোল্ডেন বল আর গোল্ডেন বুট দুটোই জেতার সাথে সাথে চ্যাম্পিয়ন হয় ফ্রান্স। এরপরেও হেনরির সম্পর্কে অভিযোগ যে, তিনি মূল সময়ে ব্যর্থ এবং অভিযোগটা খুব একটা মিথ্যা নয়। আসলে ২০০২ বিশ্বকাপে জিদানের অনুপস্থিতির সময় কিংবা জিদান অবসর নেওয়ার পর ফ্রান্সকে নিয়ে তেমন কিছুই করতে পারেননি হেনরি।

ব্রাজিলের রোনালদিনহো সম্পর্কেও কিন্তু এক সময় এই অভিযোগ ছিল। তবে তাকে ঠিক ক্লাব লিজেন্ড বলা হতো না, তবে ক্লাবের হয়ে যতটা সফল জাতীয় দলের হয়ে ততটা নয়, এই কারণে অনেকে তাকে দোষারোপ করেন। আজকের বার্সার পরিবর্তনের ফাউন্ডেশন হচ্ছেন রোনালদিনহো (যেমনটা ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার সর্বজয়ী দলের মূল কারিগর ধরা হয় মার্ক টেইলরকে)। আবার ব্রাজিলের ২০০৬ বিশ্বকাপের তারকাবহুল দলের কোয়ার্টার ফাইনালে বাদ পড়ার জন্যও দায়ী করা হয় রোনালদিনহোর ফ্লপ থাকাকে। দিনহো ছিলেন সেই বিশ্বকাপে ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় খেলোয়াড়।

রোনালদিনহো; source: fcbarcelona.com

লিজেন্ড হবার জন্য আন্তর্জাতিক ট্রফি জেতাটা সবসময় জরুরী নয়, ক্রুয়েফের কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি নেই। এ কারণে যদি তাকে কেউ ক্লাব লিজেন্ড বলে, তাহলে তার মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা উচিত। তবে আন্তর্জাতিক ট্রফি জয় একজন খেলোয়াড়ের মর্যাদাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। ক্রুয়েফ যদি ‘৭৪ এর বিশ্বকাপটা পেতেন, তাহলে ফুটবল ইতিহাসটাই অন্যভাবে লেখা হতো।

জাতীয় দলের হয়ে ভালো খেলাটা গুরুত্বপূর্ণ, কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি জয় বাড়তি একটা ফ্যাক্টর এবং অবশ্যই অনেক গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। কিন্তু লিজেন্ড হবার অন্তরায় নয়।

সেই মাপের ভালো খেলাটা কি মেসি খেলতে পেরেছেন? আসলে অলটাইম লিজেন্ড হবার জন্য জাতীয় দলের হয়ে যতটুকু ভালো খেলার প্রয়োজন, তা ইতোমধ্যে মেসি খেলে ফেলেছেন। তারপরেও বিষয়টা নিয়ে এত জল ঘোলা করা কেন?

এটিও সত্যি যে, মেসি বার্সার হয়ে ফাইনাল ম্যাচগুলোতে যেভাবে খেলেছেন, আর্জেন্টিনার হয়ে তিনটি ফাইনালে তাকে সেভাবে খুঁজে পাওয়া যায়নি। এমনকি ফাইনাল বাদে কিছু গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচেও তাকে ঠিক বার্সার মতো করে পাওয়া যায়নি।

সেই মাপের ভালো খেলাটা কি মেসি খেলতে পেরেছেন? source: si.com

গোল অ্যাসিস্টের কথা বিবেচনা করলে মেসির আন্তর্জাতিক পারফর্মেন্স অবশ্যই খারাপ নয়। এমনকি অনেক সফল খেলোয়াড়ের চেয়েও তার পরিসংখ্যান যথেষ্ট ভালো। গ্রেট খেলোয়াড়দের যে একটা গুণ আছে, তার অনুপস্থিতিতে দল তাকে মিস করবে, সেটা মেসির ক্ষেত্রে পুরোপুরিই সত্য। মেসি ছাড়া আর্জেন্টনা দলটা যেন পূর্ণাঙ্গ না। তবে মেসির বার্সার হয়ে গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে যেমন অতিমানবীয় পারফর্মেন্স আছে, আর্জেন্টিনার হয়ে অমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে তেমনটি নেই। অনেকেই হয়তো বলবেন যে, বার্সাতে তিনি সতীর্থদের কাছ থেকে যে সমর্থন পান আর্জেন্টিনাতে সেটা পান না। অথচ কিছু বিষয়; যেমন- সলো রান, ফ্রি কিক এসবের জন্য ব্যক্তিগত দক্ষতাই যথেষ্ট, দলের সাহায্যটা নগণ্য।

ইতিহাস যাদেরকে অল টাইম গ্রেটের উঁচু স্তরে রাখে, তাদের জাতীয় দল আর ক্লাব দলের পারফর্মেন্সের মাঝে একটা সাম্যাবস্থা আছে। পেলে, ম্যারাডোনা, ইউসেবিও, জিদান, প্লাতিনি, ক্রুয়েফ, পুসকাস, বেকেনবাওয়ার- যতগুলো নাম বলা হলো, তাদের যে কারোরই ক্লাব পারফর্মেন্সের চেয়ে জাতীয় দলের হয়ে পারফর্মেন্স খারাপ নয়, বরং কয়েকজনের ক্ষেত্রে জাতীয় দলের হয়েই তুলনামূলকভাবে ভালো বলা যায়। সেভাবে বিবেচনা করলে মেসির ক্লাবের পারফর্মেন্সের তুলনায় জাতীয় দলের পারফর্মেন্স খারাপ উপরে উল্লেখিত গ্রেটদের তুলনায়।

কিন্তু এটি তার লিজেন্ড হবার পথে অন্তরায় নয়, কেবল লিজেন্ডদের তালিকায় উপরে উঠার জন্য বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ। যদি আন্তর্জাতিক ট্রফি না জেতার কারণে কাউকে কেবল ক্লাব লিজেন্ড বলতে হয়; তাহলে মালদিনি, ব্যাজিও, পুসকাস, ক্রুয়েফের মতো খেলোয়াড়কেও শুধু ক্লাব লিজেন্ডই বলতে হবে।

জাভির কথা একটু চিন্তা করুন, ইউসিএল জিতেছেন ৪ বার। বিশ্বকাপ ১ বার, ইউরো ২ বার। স্পেন কিংবা বার্সার সফলতার জন্য মূল ক্রেডিট দেয়া হয় জাভিকেই। এরপরেও কি ফুটবলের ইতিহাসে তাকে কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি না জেতা ক্রুয়েফের চেয়ে কেউ এগিয়ে রাখবে? তাহলে কেন কোনো আন্তর্জাতিক ট্রফি না জিতেও ক্রুয়েফকে এগিয়ে রাখা হয়, সেটা একটু ভাবুন। বিশ্বকাপ আর ইউরো জয়ী পেদ্রো (সাথে তিনটা ইউসিএল জয়ী) কি তাহলে ক্রুয়েফের চেয়েও বড় লিজেন্ড?

ইয়োহান ক্রুয়েফ; source: nasljerseys.com

মেসির ক্যারিয়ারের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের মুখোমুখি হয়েছিলেন সম্প্রতি ১১ই অক্টোবর ইকুয়েডরের বিপক্ষে। এই ম্যাচটিতে মেসির পারফর্মেন্স আর্জেন্টাইন সমর্থকদের নতুন করে আশ্বাস জুগিয়েছে যে, তারা অচিরেই হয়তো বার্সেলোনার মেসিকে পেতে যাচ্ছে।

মেসির পারফর্মেন্স আর্জেন্টাইন সমর্থকদের নতুন করে আশ্বাস জোগাচ্ছে; source: diariopopular.com

সেরকম হলে কেবল ‘ক্লাব লিজেন্ড’ নামটা তার ঘুচবে। ফুটবল ইতিহাসে মেসির মতো খেলোয়াড়ের স্থান কী হবে তা সময়ই বলে দেবে। তবে আর্জেন্টিনার সমর্থকদের সাথে সাথে ফুটবলের সত্যিকারের সমর্থকরাও চান, ম্যারাডোনা, জিদান, পেলে, রোনালদো লিমাদের মতো মেসিও নিজের যোগ্যতায় একটি আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট জিতুক। তাতে তার মতো উঁচুদরের খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার একটি সফল পূর্ণতা পায়।

ফিচার ইমেজ- the18.com

Related Articles