Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মাইকেল বালাক: পাদপ্রদীপের আড়ালে থাকা একজন নায়ক

‘ট্রেবল’ কাকে বলে, সেটি নিশ্চয়ই কোনো ফুটবলপ্রেমীকে ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন নেই। ইউরোপিয়ান লিগগুলোতে একটি মৌসুমে প্রধান টুর্নামেন্ট হয় মূলত তিনটি- ঘরোয়া লিগ, ঘরোয়া কাপ আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ। কোনো দল যদি একই সিজনে তিনটি শিরোপাই জিততে পারে, তাহলে তাদেরকে ট্রেবল জয়ী বলা হয়। কাজটি নিঃসন্দেহে কঠিন। কঠিন বলেই ইউরোপের এতদিনের ইতিহাসে এটি ঘটেছে মাত্র ৮ বার, এর মাঝে একমাত্র ক্লাব হিসেবে বার্সেলোনা দু’বার এই রেকর্ড করায় ট্রেবল জয়ী ক্লাব হলো মোটে ৭টি।

ট্রেবল জয়ী দলের আনন্দের বিপরীতে দুঃখ লুকিয়ে থাকে ফাইনালে হেরে যাওয়া দলগুলোর। কেউই ব্যর্থদের সেভাবে মনে রাখে না। তার উপর কোনো দল যদি পরপর তিনটি মেজর টুর্নামেন্টের ফাইনালে হেরে যায়, তাহলে তাদের অনুভূতি কেমন হবে? ক্লাব হিসেবে এমনই এক অভিজ্ঞতা হয়েছে বেয়ার লেভারকুসেনের ২০০১-০২ মৌসুমে।

সেই মৌসুমে ঘরোয়া লিগে শেষ তিন ম্যাচের আগ পর্যন্ত ৫ পয়েন্ট এগিয়ে থেকেও তারা লিগ শেষ করে বুরুশিয়া ডর্টমুন্ডের চেয়ে ১ পয়েন্ট পেছনে থেকে। এরপর ঘরোয়া কাপে শালকে ০৪ এর কাছে তারা হেরে যায় ৪-২ গোলে, পরবর্তীতে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে ২-১ গোলে হারে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে।

সেই বেয়ার লেভারকুসেনের সদস্য ছিলেন মাইকেল বালাক। কী বলা যায় তাকে, দুর্ভাগা?

বেয়ার লেভারকুসেনের জার্সি গায়ে; Source: Bundesliga Fanatic

অথচ ঘরোয়া লিগের সেই মৌসুমে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন বালাক (১৭ টি)। সেই মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগেও ৩য় সর্বোচ্চ গোলদাতা (৬ টি) ছিলেন তিনি। পরিসংখ্যান বলে, চেষ্টার কমতি ছিল না তার মাঝে।

সেই মৌসুমের শেষ ভাগেই ছিল বিশ্বকাপ। এখানে মাইকেল বালাক জার্মান দলের হয়ে খেলেন ভাগ্যকে ফেরাতে। কিন্তু সেখানেও রানার্স-আপ। সারা জীবন নিজের কাজটা ঠিকভাবে করে গেলেও, স্পট লাইটটা কখনোই ঠিক নিজের উপরে আনতে পারেননি তিনি। অথচ বেশিরভাগ মানুষই হয়তো মাইকেল বালাকের অবদানটা সেভাবে জানেনই না। সেটা জানানোর জন্যেই আজকের এই লেখা।

২০০২ বিশ্বকাপের সময় জার্মানি একটা পালা বদলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছিল। দলের বেশিরভাগ খেলোয়াড়ই তরুণ হওয়ায়, দলের সাথে তাদের মানিয়ে নিতে একটু সময় লাগছিল। জার্মানির পক্ষে বাছাই পর্বে মাইকেল বালাক সবচেয়ে বেশি গোল করেও (৩টি) গ্রুপে রানার্স-আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় তাদের। জার্মানিকে বাছাই পর্ব পার হতে হয়েছিল প্লে অফ খেলে। সেই প্লে অফেও মাইকেল বালাকের ভূমিকা ছিল অসামান্য।

বায়ার্নের হয়ে কাপ জেতার পর; Source: Alexander Hassenstein/Bongarts/Getty Images

প্লে অফে জার্মানির মুখোমুখি হয় সেই সময় এসি মিলানের হয়ে দুর্দান্ত খেলতে থাকা শেভচেঙ্কোর ইউক্রেন। প্রথম লেগটা হয় ইউক্রেনের মাঠে। ১৮ মিনিটেই গোল করে ইউক্রেন এগিয়ে যায়। তবে ৩০ মিনিটে মূল্যবান একটা অ্যাওয়ে গোল করে জার্মানিকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন মাইকেল বালাক। প্রতিপক্ষের মাঠে গিয়ে ১-১ ফলাফলটা খুব খারাপ নয়। কিন্তু দলটা যখন জার্মানি, তখন তাদের কাছ থেকে ফুটবলপ্রেমীদের প্রত্যাশা একটু বেশিই থাকে।

সেই প্রত্যাশা জার্মানি মেটালো পরের লেগে। ৪-১ গোলে জেতা সেই ম্যাচে জার্মানদের পক্ষে ১ম আর শেষ গোলটা আসে মাইকেল বালাকের পা থেকেই। বলা যায়, অনেকটা এককভাবেই জার্মানিকে সেবার মূল পর্বে নিয়ে যান বালাক।

২০০২ বিশ্বকাপে বালাক; Source: Getty Images

২০০২ বিশ্বকাপে জার্মান দলের মূল খেলোয়াড় ছিলেন অলিভার কান। তবে গোলকিপার দিয়ে তো আর বেশি দূর যাওয়া যায় না। যেকোনো টুর্নামেন্টে ভালো করতে চাইলে প্লেমেকারদের জ্বলে ওঠাটা জরুরি। জার্মান দলের প্লেমেকার ছিলেন মাইকেল বালাক। অবশ্য সেই বিশ্বকাপে জিদান, রিভালদো, লুইস ফিগো, টট্টি, ওর্তেগা, ভেরন, পল স্কোলস, বেকহামদের মতো প্লেমেকার থাকায় স্পট লাইটে বালাক ঠিক সেভাবে আসেননি।

গ্রুপ পর্বে সৌদি আরবের সাথে ৮-০ গোলে জিতে শুরুটা ভালোভাবেই করেছিল জার্মানি। ম্যাচে বালাক একটি গোলও পেয়েছিলেন। তা সৌদি আরবের সাথে জয়টাকে আর কতটুকু মূল্যায়ন করা হয়? পরের ম্যাচে আয়ারল্যান্ডের সাথে ১-১ গোলে ড্র করে কিছুটা চাপে পড়ে যায় জার্মানি। অবশ্য ক্যামেরুনের সাথে ২-০ গোলে জিতে দ্বিতীয় রাউন্ডে ভালোভাবেই উঠে তারা।

২০০২ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে গোল করার পর; Source: The Sun

দ্বিতীয় রাউন্ডে প্যারাগুয়ে তুলনামূলকভাবে সহজ প্রতিপক্ষই ছিল। ১-০ গোলে জিততে জার্মানিকে তেমন বেগ পেতেও হয়নি। কোয়ার্টার ফাইনালে তারা মুখোমুখি হয় যুক্তরাষ্ট্রের। সেই ম্যাচের একমাত্র গোলটি করেন বালাক। তবে টুর্নামেন্টে তাদেরকে সবচেয়ে বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হয় সেমিতে।

গাস হিডিঙ্কের ছোঁয়ায় সেই বিশ্বকাপে আশ্চর্যভাবে পরিবর্তন ঘটেছিল দক্ষিণ কোরিয়ার। পর্তুগাল, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দল গ্রুপে থাকা সত্ত্বেও গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হিসেবে দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠাটাই একটা বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচনা করা যায় তাদের। কিন্তু দ্বিতীয় রাউন্ডে ইতালি আর কোয়ার্টার ফাইনালে স্পেনের মতো দুটি দৈত্য বধ করার পরে সেমিতে জার্মানির বিরুদ্ধে কোরিয়াও কম ফেভারিট ছিল না। তার উপর দক্ষিণ কোরিয়া খেলছিল নিজেদের মাঠেই।

ম্যাচের ৭১ মিনিটে ডি বক্সের একটু বাইরে কোরিয়ার একটা শক্ত আক্রমণ বাঁচাতে গিয়ে বালাক পেছন থেকে ফাউল করেন। গোলটা বেঁচে যায়, কিন্তু বালাক হলুদ কার্ড খেয়ে মিস করেন ফাইনাল (দ্বিতীয় রাউন্ডে প্যারাগুয়ের বিরুদ্ধেও একটা হলুদ কার্ড ছিল বালাকের)। ৭৫ মিনিটে বালাকই ম্যাচজয়ী গোল করে আসন্ন ফাইনালে না থাকার আক্ষেপটা আরো বাড়িয়ে তুলেন।

২০০২ বিশ্বকাপে ব্রাজিল ছিল প্রায় নিখুঁত একটা দল। পূর্ণ শক্তির জার্মানির পক্ষেও সেই ব্রাজিলকে আটকানো কঠিন হতো, তার উপর খর্ব শক্তির জার্মানি বালাককে হারিয়ে আরো দুর্বল হয়ে যায়। পুরো টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ ৪টি অ্যাসিস্ট আর ৩টি গোল (যার মাঝে কোয়ার্টার আর সেমির ম্যাচের একমাত্র গোল) করে সেরা খেলোয়াড়ের দৌড়ে বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে ছিলেন বালাক। কিন্তু বিশ্বকাপের সেরা খেলোয়াড় নির্বাচনে শুধু খেলোয়াড়ি দক্ষতাই বিবেচনায় আনা হয়না, সাথে সাথে হলুদ কার্ড কিংবা লাল কার্ডের জন্য কিছু পয়েন্ট কাটাও যায়। সেজন্য বিশ্বকাপ শেষে সেরা খেলোয়াড়ের তিন জনের তালিকাতেও বালাকের জায়গা হয়নি। তবে সেই বিশ্বকাপের অল স্টার দলে সুযোগ পান তিনি।

চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালে জিদানের বিপক্ষে; Source: gettyimages

২০০২ বিশ্বকাপের অসাধারণ পারফর্মেন্সের পর রিয়াল মাদ্রিদ তার প্রতি আগ্রহ দেখায়। কিন্তু তিনি যোগ দেন বায়ার্ন মিউনিখে। এখানে থেকে তিনি তিনটি লিগ আর তিনটি কাপ জিতেন। ২০০৬ বিশ্বকাপে ঘরের মাঠে তিনি  জার্মান দলের অধিনায়ক হিসেবে খেলতে নামেন। কিন্তু সেমিতে ১১৯ আর ১২০ মিনিটের ২ গোলে ইতালির কাছে হেরে বিদায় নেয় তার দল। পরবর্তীতে ৩য় স্থান নির্ধারণী ম্যাচে পর্তুগালকে হারিয়ে ৩য় হয় জার্মানি। সেই বিশ্বকাপের অল স্টার দলেও সুযোগ পান মাইকেল বালাক।

২০০৬ মৌসুমের শেষে গুজব উঠে যে, রিয়াল মাদ্রিদ, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড, ইন্টারমিলান আর এসি মিলানের মতো দলগুলো বালাককে নিতে চায়। তবে বালাক শেষ পর্যন্ত চেলসিতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। চেলসিতে বালাক একটি লিগ শিরোপা আর তিনবার এফ.এ কাপ জেতেন।

চেলসির জার্সিতে; Source: 101 Great Goals

তবে মাইকেল বালাক ক্যারিয়ারের শেষ দুঃখটা পান ২০০৮ সালের ইউরো কাপে। এই টুর্নামেন্টেও জার্মানি স্পেনের কাছে পরাজিত হয়ে রানার্স-আপ হয়। মাইকেল বালাক আবারও অল স্টার দলে সুযোগ পান সেবারে।

মিডফিল্ডার হয়েও জার্মানির জার্সিতে ৯৮টি ম্যাচে ৪২টি গোল তার স্কোরিং অ্যাবিলিটির যথেষ্ট সাক্ষ্যই দেয়। এরপরও তার ক্যারিয়ারে ক্ষত হয়ে আছে অনেক মেজর টুর্নামেন্টের ফাইনালে উঠেও চ্যাম্পিয়ন হতে না পারাটা। বিশেষ করে বিশ্বকাপ, ইউরো আর চ্যাম্পিয়ন্স লিগ।

ইউরো ২০০৮ এর ফাইনালে হারের পর বিমর্ষ বালাক; Source: AFP PHOTO DDP / THOMAS LOHNES

ক্যারিয়ারে এরপর আর এই টুর্নামেন্ট গুলো জিততে না পারায় আক্ষেপ নিয়েই তাকে অবসর নিতে হয়। টুর্নামেন্টগুলো জিততে পারলে হয়তো স্পটলাইটটা তার উপর ঠিকভাবেই থাকতো। তবে এই পৃথিবীর মানুষ খুব কমই রানার্স-আপদের মনে রাখে। দুঃখজনক হলেও সত্য, সেই স্বল্প সংখ্যক মানুষগুলোর মাঝে মাইকেল বালাকের নামটি হয়তো নেই।

ফিচার ইমেজ- JUERGEN SCHWARZ/AFP/Getty Images

Related Articles