Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বিশ্বকাপ জেতাবে কে? মেসি-রোনালদো নাকি একটি ভালো মিডফিল্ড?

যদি আপনাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, আপনার প্রিয় ফুটবলার কে? ৯৯ ভাগ ক্ষেত্রেই উত্তরে আসবে কোনো না কোনো একজন আক্রমণভাগের খেলোয়াড়ের নাম। এটা কি কেবল ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ? না, এই দেখুন বর্ষসেরার যে পুরস্কারগুলো দেয়া হয়, তাতে মনোনয়ন থেকে বিজয়ী- সর্বত্রই আক্রমণভাগের খেলোয়াড়দের জয়জয়কার। আসলে সৌন্দর্যের খেলা ফুটবলের আসল চিত্তাকর্ষক অংশই হচ্ছে আক্রমণ। তবে আধুনিক ফুটবলে সাফল্যের প্রায় সবটাই মাঝমাঠ ভিত্তিক। একজন মেসি-রোনালদোর চেয়ে একজন পিরলো-ইনিয়েস্তারা কম গুরুত্ববহ নয়; উল্টো সাম্প্রতিক সাফল্যের বিচারে দ্বিতীয় দলের পাল্লাই ভারী।

সময়ের দুই সেরা মহারথী; Source: Bubble Argentina

২০০৬ সালের বিশ্বকাপে সবচেয়ে দারুণ আক্রমণভাগ নিয়ে গিয়েছিলো ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, পর্তুগাল, স্পেন এবং ফ্রান্স। কে ছিল না সেখানে? তুখোড় ফর্মের রোনালদিনহো, কাকা, দুই রোনালদো, রিকুয়েলমে, তেভেজ, ক্রেসপো, রাউল, অরি সহ অনেকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কে জিতলো? ইতালি, যাদের দলে বলার মতো কোন ড্রিবলার ছিল না!

২০১০ এ কাকা, রবিনহো, সেরা ফর্মের মেসি, রোনালদো, রোবেন, পার্সি ও রুনি। কিন্তু সেবার ৭ ম্যাচে মাত্র ৮ গোল করে জিতে নিল স্পেন! ২০১৪-তে মেসি, রোনালদো, নেইমার, রোবেন, বেনজেমা আর হ্যাজারডকে ছাপিয়ে কাপ জিতে নিল জার্মানি, যাদের ফুটবলটা ব্যক্তিকেন্দ্রিক না বা পাঁচজনকে কাটিয়ে গোল করার কেউ তাদের দলে নেই। কী? একটু অবাক লাগছে? এবার গত তিনবারে বিজয়ী তিনটি দলের মিডফিল্ড দেখুন। ২০০৬ ইতালির মাঝমাঠে ছিল পিরলো, গাত্তুসো, পেরোত্তা ও টট্টি। ২০১০ এ স্পেন মিডফিল্ড ছিল জাভি, ইনিয়েস্তা, জাবি আলোন্সো আর বুস্কেটসদের নিয়ে গড়া। ২০১৪ তে জার্মানির মিডফিল্ডে ছিল ক্রুস, খেদিরা, শোয়াইনস্টাইগার এবং ওজিলদের মতো প্লেয়াররা।

এবার আরো ভেতরে যাওয়া যাক। সাধারণত ফুটবলে মাঝমাঠকে মোটা দাগে দু’ভাগে ভাগ করা যায়: সেন্ট্রাল মিডফিল্ড আর অ্যাটাকিং মিডফিল্ড। খুব নির্দিষ্ট করে বললে এই সেন্ট্রাল মিডফিল্ডই খেলা নিয়ন্ত্রণ করে। সেন্ট্রাল মিডফিল্ডে দুই ধরনের প্লেয়ার থাকে: একজন খেলা বিল্ড করে (কন্ট্রোলার) আর একজন নিজের ডিফেন্সকে শিল্ড দেয় (ডেস্ট্রয়ার বা ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার)। দেখা যাচ্ছে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এই সেন্ট্রাল মিডফিল্ড জায়গাতে যারা প্রাধান্য বিস্তার করে খেলে, তারাই চ্যাম্পিয়ন হয়।

একনজরে হালকাভাবে ফুটবলের পজিশনগুলো; Source: Outside of the Boot

একটু গোড়া থেকে আসা যাক। ২০০২ সালের ব্রাজিল দলের সেন্ট্রাল মিডফিল্ড খুব আহামরি কিছু ছিল না। আসলে লাতিন দলগুলোর এসব থাকেও না। নিচ থেকে খেলা গঠন করার মতো কোনো কন্ট্রোলার ছিল না। কিন্তু দারুণ একজন ডেস্ট্রয়ার ছিল, জিলবার্তো সিলভা। তিনি খুব কম আক্রমণে যেতেন, কিন্তু যেটাকে বলে ‘ডার্ট-ওয়ার্ক’, সেটা তিনি দারুণভাবে করতেন। ফলে অ্যাটাকিং মিডে যারা ছিলো, তাদের উপর ডিফেন্সিভ কাজের চাপ কমে যাচ্ছিল। তার নাম হয়ে যায় ‘দ্য ইয়েলো ওয়াল’। তার ডিফেন্সিভ কাজে ফরোয়ার্ডরা স্বাধীনতা পেয়ে যাওয়ার ফল ছিল বিখ্যাত রোনালদো-রিভালদো-রোনালদিনহোদের আক্রমণের প্রদর্শনী।

২০০৬ সালের চ্যাম্পিয়ন ইতালির স্কোয়াডে জিলবার্তোর মতো কাজটা করেছিল মিলানের জেনারো গাত্তুসো। গাত্তুসোকে সেই আমলের সবচেয়ে নির্দয় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার বললে ভুল বলা হবে না। তাকে নিয়ে একটি কৌতুক আছে। সাংবাদিক জিজ্ঞাসা করছেন, “রিনো, আপনি কীভাবে প্রথম প্রেম নিবেদন করেন?” পাশ থেকে তার এক সতীর্থ জবাব দিয়ে দেয়, “কড়া একটা ফাউল করে!” কিন্তু তার সাথে ইতালির ছিল এমন একজন, যাকে বিশ্ব ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা মাঝমাঠ কন্ট্রোলার বলা যায়, তিনি আন্দ্রে পিরলো। প্রায় ৯২ ভাগ সফল পাস রেট ছিল তার। পুরো বিশ্বকাপজুড়ে বানিয়ে দিয়েছিলেন তিনটি গোল আর হয়েছিলেন সেমি-ফাইনাল আর ফাইনাল সহ সবচেয়ে বেশী ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ। আসলে পুরো ইতালিকে তিনিই খেলাতেন। তার কাছে বল গেলে ম্যাচের গতি সেট করে দিতেন, কার পায়ে বল বেশী ছিল বা ক্লান্ত এসব ভেবে অন্যজনকে বল দিতেন। ইতালির এই ব্রেইনকে ফাইনালে আটকাতে ফ্রান্স কোচ ডমেনেখ চেষ্টা করলেও বারবার পজিশন চেঞ্জ করে নিজেকে ফ্রি স্পেসে রেখেছিলেন তিনি।

ইতালির মাঝমাঠের দুই কান্ডারী, পিরলো ও গাত্তুসো (বাম থেকে); Source: PostRadar

২০১০ এর স্পেন মিডফিল্ডকে নিয়ে বলার অভিধা সংকটে পড়তে হয়। ২০০৮ সালে বার্সেলোনায় সদ্য টিকিটাকা বিপ্লব এনেছেন পেপ গার্দিওলা। টিকিটাকা হলো একটি খেলার স্টাইল, যাতে প্রচুর প্রচুর পাসিং খেলা হয়। আকারে খাটো জাভি, ইনিয়েস্তা, মেসি, যারা উচু লং বলে হাঁসফাঁস করতেন, তারা এই পাসিং গেমে আরো বেশী খাপ খেয়ে গেলেন। সেই বার্সেলোনা একাডেমির জাভি, ইনিয়েস্তা, বুস্কেটস, ফ্যাব্রেগাস আর রিয়ালের মিডফিল্ড মায়েস্ত্রো আলোন্সোদের মাঝমাঠের জবাব কারো ছিল না।

গড়ে ৫৯ ভাগ বল পজেশন ছিল স্পেনের। এর মানে হলো ৯০ মিনিটের মধ্যে প্রায় ৫৪ মিনিট বল ছিল স্পেনের পায়ে, যেটাকে বলে ‘ডিফেন্ডিং অন দ্য বল’, অর্থাৎ আপনার পায়ে যতক্ষণ বল ততক্ষণ আর যা-ই হোক, আপনি গোল খাচ্ছেন না। ব্যাপারটি যতটা সহজ ভাবা হয়, ততটা সহজ না। আপনার পায়ে যখন বল, প্রতিপক্ষ চায় প্রচুর চার্জ করে বল কেড়ে নিতে। তাই প্লেয়ারদের পুরো মাঠে কে কোথায় আছে বা পজিশন চেঞ্জ করে যাবে তা জানা থাকতে হয়। ব্যাপারটা এতই সহজ হলে সব দলই এটা গ্রহণ করতো। সাবেক বার্সেলোনা কোচ এনরিকে একবার এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, তিনি যুবদলের কোচ থাকতে তরুণ প্লেয়ারদের শুধু বুস্কেটসের ভিডিও দেখাতেন। অথচ বুস্কেটসের মনে হয় পাঁচ ম্যাচেও কোনো ড্রিবলিং থাকে না! তবে কেন? এনরিকে বলেছিলেন, মাঠে বুস্কেটস বল পায়ে পাওয়ার আগে একবার চারপাশটা কীভাবে স্ক্যান করে নেয় বা কীভাবে জায়গা বদলে বলটা পাবার জন্য ঠিক জায়গায় যায়, এসব গুণ তার অনবদ্য, যা ওদের মধ্যেও তিনি দিতে চেয়েছিলেন। যা-ই হোক, সেইবার ৩৫৫৭টি পাস খেলেছিলো স্পেন, যা সে অবধি ইতিহাসের সেরা। ৭ ম্যাচে মাত্র ৮টি গোল করে তারা হলো চ্যাম্পিয়ন। তাদের গোল দেয়া কষ্ট ছিল, কারণ তারা বলই হারাতো না।

স্পেনের অদম্য মিডফিল্ডের সেই তিনজন- জাভি, ইনিয়েস্তা ও আলোন্সো; Source: Give Me Sport

জার্মান ফুটবল বিপ্লবের পরে তার উঠতি খেলোয়াড়দের ধরণেও পরিবর্তন আসে। আগের যন্ত্রের মতো ফুটবলারদের বদলে উঠে আসতে থাকে এমন সব প্লেয়ার যারা পাসিং গেমে দক্ষ। জার্মানির এপ্রোচ ছিল ঠিক ২০১০ এর স্পেনের মতোই; বল পায়ে রাখা ও প্রচুর শর্ট পাস খেলা, যদিও তাদের আক্রমণের ধার স্পেনের চেয়ে বেশী ছিল। ক্রুস, শোয়ান্সটাইগারের মিডফিল্ড কন্ট্রোলের কাছাকাছিও ছিল না কোনো দল। সেবার টুর্নামেন্টের গড় ম্যাচ প্রতি পাসিং ১,০০৯ হলেও জার্মানির ছিল দেড় হাজারের বেশী! মানে ৫০০ পাসিং এর সমান মিনিট তাদের পায়েই বল ছিল, আর এ সময়টায় তাদের রক্ষণ ছিল নির্ভার আর প্রতিপক্ষেরা তটস্থ।

অথচ ঠিক একই সময়কালে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় ওদের সমান বা বেশী আক্রমণভাগের প্রতিভা আসলেও তারা কুলিয়ে উঠতে পারছে না। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনায় ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ভালো মানের উঠে আসলেও ক্রুস, পিরলোদের মতো কন্টোলিং মিডফিল্ডার উঠে আসেনি গত এক যুগেও। শিল্পের রোমাঞ্চ আছে, কিন্তু নেই আসল ব্রেইন যে পুরো দলকে খেলায়। ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে আর্জেন্টিনা হারার মতো খেলেনি সত্য, কিন্তু পিছিয়ে গেলে জার্মানি যে ফিরে আসতে পারতোনা তা কি নিশ্চিত? ২০০৬ এর রোনালদিনহো, কাকার ব্রাজিল আটকে যায় এক জিদান শো এর কাছে, আবার জিদানের ফ্রান্স হেরে যায় ইতালির কাছে কারণ তুলনামুলকভাবে ইতালির মিডফিল্ড ছিল উত্তম। তেভেজ, মেসি, হিগুয়েনদের মতো আক্রমনভাগ না নিয়েও আর্জেন্টিনাকে ৪-০ গোলে হারায় জার্মানি কারণ তাদের একটা পরিকল্পনা ছিল, আর ছিল মাঝমাঠের নিয়ন্ত্রণ। আবার সেই জার্মানির সাথে স্পেনের দেখা হলো সেমিতে। সেখানে স্পেনের মাঝমাঠ তাঁর শক্তি দেখালো আর জার্মানি বাদ!

একই ফ্রেমে ওজিল, ক্রুস, শোয়েনি ও শুরলে; Source: Prothom Alo

আসলে ফুটবলের রোমাঞ্চ তার আক্রমণ, কিন্তু সাফল্যভিত্তিক ফুটবলে ক্যালকুলেশন এখন বিশাল বড় ফ্যাক্টর। জাভি, ক্রুসরা প্রায়ই এক ম্যাচে একশর বেশী পাস এককভাবেই দেয়। এর মানে হলো, গড়ে সাড়ে দশ মিনিট সে একাই দলকে খেলায়, যে সময়টায় তার দল ফ্রন্টফুটে। এখন একজন দারুণ লাতিন ফরোয়ার্ড তার নৈপুণ্যে প্রতিপক্ষের দুজনকে কাটিয়ে ফেলল, কিন্তু তৃতীয়জনকে কাটাতে গিয়ে বল হারালো আর সুযোগসন্ধানী প্রতিপক্ষ কাউন্টার অ্যাটাকে দিয়ে দিল গোল, ক্ষতি কার? ঠিক এ কারণেই ইউরোপিয়ান ফুটবলে ড্রিবলিংয়ের প্রশংসা করা হলেও এটাকে আবশ্যিক গুণ ধরা হয় না। তারা খেলাটাকে ফোকাস করে সম্মিলিত চেষ্টায়। ফলাফল গত তিনবারই বিশ্বকাপজয়ী দল ইউরোপীয়ান।

মেসি, রোনালদো, নেইমাররা ফুটবলের আসল সৌন্দর্য হলেও বর্তমান ফুটবলে মাঝমাঠের গুরুত্ব এর চেয়েও বেশী বৈ কম না। বর্তমান প্রেক্ষাপটে একজন পিরলো, ক্রুস বা শোয়ান্সটাইগারকে কোনোভাবেই মেসি, রোনালদোর চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ বলা যায় না। লাতিন ফুটবলকে অবশ্যই এর সমধান খুঁজতে হবে ইউরোপীয়দের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য। পরিবর্তিত বাস্তবতায় একক নৈপুণ্যের দ্বারা সাফল্য পাওয়ার আশা যে বেশ দুষ্কর!

ফিচার ইমেজ- Goal.com

Related Articles