Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ই-বর্জ্য এবং ডিজিটাল দূষণে জর্জরিত জনপদের কাহিনী

ই-বর্জ্য বলতে কী বোঝায়?

একটু ভেবে দেখুন তো, আপনাদের বাসায় আশির দশকে কেনা সাদাকালো টেলিভিশনটি এখন কোথায় আছে? কিংবা আপনার জীবনে কেনা প্রথম মোবাইল ফোনটি এখন কোথায়? শুধু মোবাইল বা টেলিভিশন নয়, পুরনো কিংবা বিকল হয়ে গেলে বাসার সব ইলেক্ট্রনিক জিনিসই ফেলে দেওয়া হয়, অথবা পুরনো জিনিস কিনতে আসা ফেরিওয়ালাদের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়। পুরনো জিনিস মেরামত করে আরো বেশ কিছুদিন চালানো গেলেও একসময় আবর্জনা হিসাবে ফেলে দেওয়া ছাড়া আর কোনো গত্যন্তর থাকে না। এ ধরণের আবর্জনাকে বলা হয় ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য বা সংক্ষেপে ই-বর্জ্য।

অবাক করা ব্যাপার হলো, ২০১৬ সালের হিসাব অনুসারে শুধু ঐ বছর পৃথিবীতে আনুমানিক ৯.৩ কোটি টন ই-বর্জ্য উৎপাদিত হওয়ার কথা। তবে একদম সঠিক হিসাব পাওয়াটা বেশ দুষ্কর। তাই অনেকে মনে করেন আসল পরিমাণটা এর চেয়ে বেশিও হতে পারে। ই-বর্জ্য সঠিকভাবে রিসাইকেলিং না করে খোলা অবস্থায় পরিবেশে ফেলে রাখলে কল্পনাতীতভাবে পরিবেশকে দূষিত করে ফেলে। তাই সচেতন পাঠকদের মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে, মারাত্নক পরিবেশ দূষণকারী এসব ই-বর্জ্যের শেষ পরিণতি কি হয়? সেই প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজার চেষ্টা করা হয়েছে এই ফিচারটিতে। সেই সঙ্গে আমরা জানার চেষ্টা করবো পৃথিবীর বৃহত্তম ই-বর্জ্য ফেলার জায়গাগুলোর করুণ কাহিনী।

ই-বর্জ্য; ছবিসূত্র: bbc.com

কোথায় যাচ্ছে ই-বর্জ্য?

ইলেক্ট্রনিক সেক্টরে অভূতপূর্ব বিপ্লবের ফলে ১৯৯০ সালের দিকে উন্নত বিশ্বে অনেকটা হঠাৎ করেই ব্যক্তিগত কম্পিউটার ও মোবাইল ফোনের ব্যাপক ব্যবহার শুরু হয়েছিলো। যদিও উন্নয়নশীল বিশ্বে সেই বিপ্লবের জোয়ার পৌঁছুতে লেগেছিলো আরও দশ-পনের বছর। ফলে একবিংশ শতকের শুরু থেকেই হু হু করে বাড়লো মোবাইল ফোন ও পার্সোনাল কম্পিউটারের চাহিদা। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই আগের সংস্করণগুলোকে ছাপিয়ে যেতে লাগল নতুন নতুন সংস্করণ। তাই নষ্ট হওয়ার আগেই উপযোগিতা হারাতে আরম্ভ করলো পুরনো সংস্করণ। যদিও উন্নয়নশীল বিশ্বে হাত বদল হওয়া পুরনো জিনিস সেকেন্ড হ্যান্ড নামে দেদারসে বিক্রি হয়। কিন্তু উন্নত বিশ্বে এই ইলেক্ট্রনিক পণ্যগুলো অনেক ক্ষেত্রে ভাগাড়ে ফেলা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না। ফলে ইলেক্ট্রনিক বিপ্লবের সাথে সাথে আস্তে আস্তে যোগ হতে থাকলো ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য সমস্যা।

ই-বর্জ্যগুলো রিসাইকেল করা বেশ জটিল এবং ব্যয়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই খুব সস্তায় এই ঝামেলা এড়াতে এবং পরিবেশগত ঝুঁকি থেকে বাঁচতে উন্নত দেশগুলো একটি বিতর্কিত সমাধান বের করেছে বলে অনেক সমালোচক এবং পরিবেশবিদ দাবি করেন। ব্যাসেল কনভেনশনে সুস্পষ্ট উল্লেখ্য আছে, এক দেশের অপরিশোধিত এবং ক্ষতিকর ইলেক্ট্রনিক বর্জ্য অন্য দেশে ফেলা যাবে না। তাই আইনগত জটিলতা এড়াতে ধনী দেশগুলো পুরনো ইলেক্ট্রনিক ডিভাইসগুলোকে অনুদান তথা প্রযুক্তিগত ব্যবধান কমানোর সেতুবন্ধন হিসাবে চিহ্নিত করে আফ্রিকার গরিব দেশগুলোতে বিশেষ করে ঘানাতে পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। আর এই তথাকথিত অনুদান থেকে প্রাপ্ত ই-বর্জ্যকে ঘিরে ঘানার রাজধানীর অ্যাক্রার অদূরে আগবোগব্লোশি এলাকাতে গড়ে উঠেছে পৃথিবীর বৃহত্তম ই-বর্জ্যের ভাগাড়।

আগবোগব্লোশির ই-বর্জ্য ভাগাড়; ছবিসূত্র: theguardian.com

পরিবেশবাদীরা বলেন, প্রতি বছর ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে লক্ষ লক্ষ টন ই-বর্জ্য জাহাজযোগে ঘানাতে নিয়ে আসা হয়। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, প্রতি মাসে প্রায় ৬০০-১০০০ সেকেন্ড হ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক সরঞ্জাম ভর্তি কন্টেইনার অ্যাক্রা বন্দরে আসে। যার কিছু অংশ সরাসরি মেরামত করে ঘানার সেকেন্ড হ্যান্ড মার্কেটে বিক্রি করা হয়। আর বাকিগুলো সরাসরি চলে যায় আগবোগব্লোশি ড্যাম্পিং জোনে। শুধু বিদেশী বর্জ্যই নয়, ঘানার স্থানীয় ই-বর্জ্যও চলে আসে এখানে। ফেলে দেওয়া ইলেক্ট্রনিক জিনিস থেকে মূল্যবান অংশ পৃথক করা এবং অপ্রয়োজনীয় প্লাস্টিক পোড়ানোকে কেন্দ্র করে টিকে আছে এখানকার প্রায় ৪০ হাজার মানুষের জীবন ও জীবিকা। তবে উন্নত দেশগুলোর দাবি তাদের দেশ থেকে যা আসে তার অধিকাংশই আমদানি করে আনা এবং সেগুলো সেকেন্ড হ্যান্ড জিনিস হিসাবে ঘানার স্থানীয় বাজারে সরাসরি বিক্রি হয়। এগুলো থেকে আগবোগব্লোশিতে আসা ই-বর্জ্যের পরিমাণ খুবই সামান্য।

এদিকে সেকেন্ড হ্যান্ড পণ্য বাজারে সয়লাব হওয়ায় দরিদ্র জনগোষ্ঠীও প্রযুক্তি ব্যবহারের আওতায় আসছে। ফলে উন্নত দেশগুলোর দাবি, ঘানার মতো উন্নয়নশীল দেশে প্রযুক্তিগত অগ্রসরতা অর্জনের জন্য এই ব্যবস্থা নাকি বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করছে! তাই এক্ষেত্রে নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিস্তারিত গবেষণা ব্যাতীত দুই পক্ষের দাবির সত্যতা নিরূপণ করা একেবারেই দুঃসাধ্য।

ই-বর্জ্যের ভাগাড়ে শিশু; ছবিসূত্র: theguardian.com

শুরুর কথা

আগবোগব্লোশির শুরুর কথা জানতে চাইলে আমাদের ফিরে যেতে হবে খানিকটা পেছনে। পশ্চিম আফ্রিকার উন্নয়নশীল দেশ ঘানার অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা শুরু হয় ৬০ এর দশকে। ফলে ১৯৬০ থেকে ১৯৬৫ সালের মধ্যে এক ধাক্কায় ঘানার জাতীয় আয় ৫০% বেড়ে যায়। অর্থনৈতিক বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নগরায়নও জড়িত। ফলে দ্রুত নগরায়নের ফলে রাজধানী শহর অ্যাক্রায় ঝাঁকে ঝাঁকে পাড়ি জমাতে থাকে গ্রামের কর্মহীন মানুষের দল। তবে আগবোগব্লোশিতে কাজের সন্ধানে ছুটে আসা মানুষের ঢল নামে আশির দশকে গিনি ফাউল যুদ্ধের সময়। অবশ্য তখন আগবোগব্লোশির পরিচিতি ছিল ওল্ড ফাডামাডা বস্তি নামে। রাজধানী অ্যাক্রার উপকণ্ঠে কর্লে উপহ্রদের তীরে আগবোগব্লোশির অবস্থান। এখানে ইলেক্ট্রনিক বর্জ্যের প্রথম চালান পৌছায় ২০০০ সালের দিকে। এর আগে জায়গাটা ছিল অনেকটা স্যাঁতস্যাঁতে জলাভূমি।

মারাত্মকভাবে দূষিত কর্লে উপহ্রদ; ছবিসূত্র: atlasobscura.com

জীবিকা যখন মৃত্যুর কারণ

আগবোগব্লোশি ডাম্পিং জোনকে কেন্দ্র করে জীবনধারণ করছে প্রায় ৪০ হাজার মানুষ। উন্নত দেশগুলোর পাঠানো ই-বর্জ্য হোক আর আফ্রিকার স্থানীয় ই-বর্জ্যই হোক, পরিবেশের জন্য এই ডাম্পিং জোন যেন এক ভয়াবহ হুমকি! এখানে ইলেক্ট্রনিক অকেজো সার্কিট পোড়ানোর ফলে বাতাসে ব্যাপকহারে ছড়িয়ে পড়ছে সীসা, ক্যাডমিয়াম, আর্সেনিক। এছাড়া বস্তিগুলোতে সুপেয় পানি এবং স্যানিটেশনের অভাব প্রকট। এখানকার শ্রমিকদের অনেকেই বয়স বিশের কোঠা পেরুনোর আগেই ক্যান্সারসহ ফুসফুসের নানা প্রদাহে অকাল মৃত্যুবরণ করছে। যারা বেঁচে আছে তারাও প্রতিনিয়ত নানাবিধ স্বাস্থ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। তবে স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকা মানুষের প্রকৃত সংখ্যা ও ক্ষতিগ্রস্থদের সম্পূর্ণ হিসাব এখনও সঠিকভাবে নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি।

কিন্তু আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো এত কিছুর পরও শ্রমিকরা চায় না ই-বর্জ্য আগমন বন্ধ হোক। এর কারণ, এই বর্জ্যই তাদের জীবিকার উৎস। তাই বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান সৃষ্টি না করে এই ডাম্পিং জোন সহসা বন্ধ করাও সম্ভব নয়। অন্যদিকে এই এলাকায় অপরাধের হারও আশঙ্কাজনক। এখানে সক্রিয় রয়েছে বিভিন্ন সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্র। তাই অনেকে এই এলাকাকে তুলনা করেন বাইবেলে বর্ণিত অভিশপ্ত নগরী সদোম ও গোমরাহের সঙ্গে।

অনেকে এই এলাকাটাকে রূপকার্থে তুলনা করেন বাইবেলে বর্ণিত অভিশপ্ত সদোম ও গোমরাহ নগরের সঙ্গে; ছবিসূত্র: theguardian.com

২০১৫ সালের হিসাব অনুসারে শুধু ঐ বছরই সারা পৃথিবীতে ২০০ কোটি মোবাইল ফোন তৈরি করা হয়েছে এবং ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত সারা পৃথিবীতে মোট ১৫০০ কোটি মোবাইল ফোন বাজারজাত করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এর সঙ্গে তৈরিকৃত বিপুল পরিমাণ ল্যাপটপ, ক্যামেরা ও টেলিভিশনের হিসাব যোগ করা হলে সংখ্যাটা চোখ কপালে তোলার মতো বড় অঙ্কে চলে যেত এতে কোনো সন্দেহ নেই!

পুরনো কম্পিউটারের মেমোরি থেকে তথ্য উদ্ধারের সম্ভাবনা ও সম্ভাব্য ঝুঁকি

কম্পিউটার মেমোরির একটি চমৎপ্রদ দিক হচ্ছে, একদম ডিলিট করে দেওয়ার পরও বিশেষ কিছু সফটওয়্যার ব্যবহার করে অনেক সময় এ থেকে তথ্য উদঘাটন করা যায়। যেহেতু আমেরিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন উন্নত দেশের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের অনেক পুরনো কম্পিউটার এই আগবোগব্লোশিতে ফেলে দেয়া হয়েছে, এবং কোনোক্রমে সেগুলো সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের হাতে পড়লে প্রাপ্ত তথ্যের মাধ্যমে তারা ভয়ঙ্কর নাশকতা ঘটাতে পারে, এই আশংকায় প্রযুক্তি নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা খানিকটা নড়ে চড়ে বসেছেন। কম্পিউটারের মেমোরি কীভাবে কাজ করে এবং সেখান থেকে মুছে ফেলা তথ্য আবার ফিরে পাওয়া যায় সেটা জানতে আগ্রহী পাঠকরা দেখতে পারেন এই ভিডিওটি

রিসাইকেল করা সিপিইউ থেকে সংঘবদ্ধ অপরাধীরা বের করে ফেলতে পারে অনেক গোপন তথ্য; ছবিসূত্র: theguardian.com

শেষ কথা

প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা অর্জনের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা এখন সারা পৃথিবীর কাছে ভাবনার একটি বড় বিষয়। কারণ যতই উন্নত প্রযুক্তি আসুক না কেন, সেটা অর্জন করতে গিয়ে আমাদের বাসস্থান এই পৃথিবীর একবারে বসবাসের অযোগ্য হলে সেই ক্ষতি কোনোভাবেই পূরণ করা সম্ভব নয়। এজন্য সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে প্রযুক্তি নির্মাতা উন্নত দেশগুলোকে।

অন্যদিকে বৈশ্বিক দায়িত্ব অবহেলা করে ই-রিসাইকেলিং এর খরচ বাঁচিয়ে সাময়িকভাবে মুনাফালিপ্সুতা প্রকাশ করলে সেটা উন্নত বিশ্ব বা উন্নয়নশীল বিশ্ব কারো জন্যই ভালো ফল বয়ে আনবে না। উন্নত দেশগুলো থেকে আফ্রিকার ঘানার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে সেকেন্ড হ্যান্ড ইলেক্ট্রনিক সামগ্রী পাঠানোর ফলে একদিকে সাধারণ মানুষ যেমন খুব অল্প টাকায় প্রযুক্তির সংস্পর্শ পাচ্ছে, তেমনি সেটা আস্তে আস্তে পরিণত হচ্ছে পরিবেশ দূষণের বড় কারণে। শুধু আফ্রিকাতেই নয়, আমাদের দেশে এখনও জনগণের মধ্যে ই-বর্জ্য নিয়ে সচেতনতা গড়ে ওঠেনি। তাই স্মার্টফোন এবং অন্তর্জালের বিস্তারের পাশাপাশি ই-বর্জ্য সচেতনতা তৈরি করতে না পারলে জীবনকে সহজ করে তোলা প্রযুক্তিই হতে পারে আমাদের প্রাণনাশের প্রধান কারণ। তাই ই-বর্জ্য নিয়ে সকলের সচেতনতা একান্ত কাম্য।

Related Articles