Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ক্লারা আইমারভার: বিজ্ঞানের বিস্মৃত এক বীরাঙ্গনা

ক্লারা আইমারভার, নামটা অপরিচিত লাগছে নিশ্চয়? স্বাভাবিক, কারণ বিজ্ঞানের আদর্শ মনে প্রাণে ধারণ করা এই বীরাঙ্গনাকে আধুনিক বিজ্ঞানের ইতিহাস মনে রাখেনি। পৃথিবীর ইতিহাসে রসায়নে পিএইচডি করা প্রথম নারী তিনি। বিজ্ঞানের সাধনায় ব্রতী নারীদের অগ্রপথিক ক্লারা আইমারভার। এই রসায়নবিদ তার ক্ষুদ্র জীবনের অকাল পরিসমাপ্তি দ্বারা বিজ্ঞানের সম্মান অক্ষুণ্ণ রাখার প্রয়াস করে গেছেন। চলুন জানা যাক ক্লারার বিষাদময় জীবন ও করুণ মৃত্যু নিয়ে কিছু কথা।

ক্লারা আইমারভার : chemie-azubi.de

ক্লারার জন্ম ১৮৭০ সালের ২১ জুন, পূর্ব প্রুসিয়ার ব্রেসলাউ নামক স্থানে (জায়গাটি বর্তমানে পোল্যান্ডের অন্তর্গত)। বাবা ফিলিপ আইমারভার, মা অ্যানা; ক্লারার বাবাও ছিলেন একজন রসায়নবিদ। এ দম্পতির চার ছেলেমেয়ের মধ্যে ক্লারা ছিলেন সবার ছোট। ছোটকাল থেকেই ক্লারার বিজ্ঞানে বিশেষ আকর্ষণ ও তাবৎ দক্ষতা ছিল। কেমিস্ট বাবার কন্যা হওয়ার কারণেই হয়তো ঝোঁকটা বেশি ছিল রসায়নের প্রতি। কিন্তু এটা সেই সময়ের কথা যখন মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ ছিল নামমাত্র। বিয়ে-থা করে সংসার সামলানো আর একজন যোগ্য স্ত্রী ও মা হিসেবে নিজেকে গড়ে তোলার সামাজিক চাপ মেয়েদের উচ্চশিক্ষা অর্জনের পথ সংকীর্ণ করে রেখেছিল। ক্লারার আগ্রহ ছিল ন্যাচারাল সায়েন্সে। যেই যুগে প্রকৃতির ধারক ও বাহক নারীসমাজের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার অনুমতি ছিল না, সেই যুগে ক্লারা আইমারভার ছিলেন স্বয়ং এক মূর্তিমান বিপ্লব। ক্লারার অন্য বোনরা যখন সামাজিক রীতি মেনে বিবাহকেই জীবনের লক্ষ্য ধরে নিয়েছিল, তখন ক্লারার স্বপ্ন দেখতেন আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হবার।

স্কুল-কলেজের পাঠ শেষ করে ক্লারা ভর্তি হন ব্রেসলাউ ইউনিভার্সিটিতে। ১৮৯৬ সালের দিকে ব্রেসলাউ ইউনিভার্সিটিতে অতিথি হিসেবে নারীদের লেকচার শোনার অনুমতি ছিল। কিন্তু ক্লারার লক্ষ্য ছিল আরও বৃহৎ। ডক্টরাল প্রোগ্রামে যোগদানের জন্য ভর্তি পরীক্ষায় বসার অনুমতি চেয়ে বসেন ক্লারা। অনেক লড়াইয়ের পর তিনি অনুমতি পান এবং সাফল্যের সাথে ডক্টরেট করার জন্য মনোনীত হন। কিন্তু এই অর্জনের পরেও ক্লারার পথে বিশাল বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল পুরুষতন্ত্রের একাধিপত্য। ডক্টরেট করার জন্য তাকে কাজ করতে হয় একজন পুরুষের অধীনে, সহকারী হিসেবে। রিচার্ড অ্যাবেগ ছিলেন তার ডক্টরাল অ্যাডভাইজার। তার অধীনেই ‘ভারী ধাতব লবণের দ্রাব্যতা’ নিয়ে কাজ করে ১৯০০ সালে নিজের ডক্টরেট ডিগ্রীটি লাভ করেন ক্লারা আইমারভার। কোনো জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট করা তিনিই প্রথম নারী। কিন্তু শুধুমাত্র নারী হবার কারণেই তার গতিবিধি ছিল সীমিত। কিছু নারী সংস্থায় আর কিছু স্কুলে বক্তৃতা প্রদানের মধ্যেই এই প্রতিভাধর গবেষকের সামাজিক সুবিধা গন্ডীবদ্ধ হয়ে ছিল।

এরই মধ্যে ক্লারার পরিচয় হয় প্রখ্যাত রসায়নবিদ ফ্রিৎজ হেবারের সাথে। হেবার নিজেই ক্লারাকে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে বসেন। কিন্তু তখন পড়াশোনায় ব্যস্ত থাকায় ক্লারা এ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। নিজ লক্ষ্যে পৌঁছানোর পর ১৯০১ সালের আগস্টে তারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ফ্রিৎজ হেবারের সম্পর্কে কিছু ব্যাপার জেনে রাখা দরকার। বিজ্ঞান নিয়ে যাদের চর্চা আছে, তারা নাইট্রোজেন ও হাইড্রোজেন হতে অ্যামোনিয়া তৈরির হেবার-বস পদ্ধতিটি (Haber-Bosch Process) নিশ্চয় জানেন। সেই বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক জুটি হেবার ও বস-এর একজন, ফ্রিৎজ হেবার

ফ্রিৎজ হেবার : jewishnews.com.ua

হেবার জার্মানীর কালজরুয়ে (Karlsruhe) টেকনোলজিক্যাল ইউনিভার্সিটির প্রফেসর ছিলেন। বাতাসের নাইট্রোজেনকে নাইট্রোজেন যৌগে রুপান্তরিত করে উদ্ভিদের সার হিসেবে ব্যবহার উপযোগী করার প্রক্রিয়া আবিষ্কার করে তিনি নন্দিত হন। ১৯১৮ সালে রসায়নের নোবেলটিও তার ঝুলিতে যায়। তবে হেবার ছিলেন প্রচন্ড উচ্চাভিলাষী। জার্মানীর জাতীয় ও রাজনৈতিক আকাশে চিরাচরিত চিত্ররুপে ইহুদী বিদ্বেষ তখনও বিরাজমান ছিল। এমনকি মেধাবী ইহুদীদেরও সবসময় সন্দেহের চোখে দেখা হতো। সামাজিক পরিস্থিতির শিকার হয়ে হেবার ও ক্লারা দু’জনেই যথাক্রমে ১৮৯৩ ও ১৮৯৭ সালে ইহুদী হতে খ্রিষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন।

ক্লারা হয়ত ভেবেছিলেন যে রসায়নবিদকে বিয়ে করলে বিয়ের পরে তার গবেষণার কাজও তিনি নির্বিঘ্নে চালিয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু দেখা গেলো, ঘর সামলানো আর মাতৃত্বের চাপ এড়িয়ে কাজে মনোনিবেশ করা তার ঠিকমতো আর হয়ে ওঠে না। হেবারও ক্লারার কাজের প্রতি যথেষ্ট শ্রদ্ধাশীল ছিলেন না। অবশ্য বিয়ের পরে কিছুদিন হেবারের সাথে থার্মোডাইনামিক্সের উপর কাজ করেছেন ক্লারা। হেবারের উচ্চাভিলাষ তাকে কাজপাগলে পরিণত করেছিল। ক্লারা ও তাদের সন্তান হারম্যানকে দেবার মতো সময় তার ছিল না বললেই চলে। বরং কাজের সূত্রে এখানে সেখানে যাতায়াতের প্রক্ষিতে অন্যান্য অনেক নারীর সাথে হেবারের সখ্য গড়ে উঠেছিল।

জার্মান সেনাদলের সাথে হেবার সবসময় তোষণনীতি মেনে চলতেন। ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ যখন শুরু হয়, হেবার তখন কায়জার উইলহেম ইন্সটিটিউটের ফিজিক্যাল কেমিস্ট্রি বিভাগের পরিচালক। যুদ্ধের শুরু থেকেই হেবার ক্লোরিন গ্যাসকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের প্রক্রিয়ার উপর কাজ করছিলেন। তখন রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের উপর যথেষ্ট কড়াকড়ি ছিল। হেগ কনভেনশনে জার্মানী এ ব্যাপারে চুক্তিবদ্ধও ছিল। কিন্তু ১৯১৫ সালে ফ্রন্ট লাইনে জার্মান বাহিনীর পরাজয়ের পর হেবার রাসায়নিক অস্ত্র প্রয়োগের জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন। জার্মান কমান্ডাররা তখনও এর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এক জেনারেল বিষাক্ত গ্যাসের ব্যবহারকে ‘গরিমাহীন’ বলে উল্লেখ করেন। জীবনীকার মারগিট জ্যানজের মতে, হেবার সেই জেনারেলকে বলেন, “আপনি যদি এই যুদ্ধ জিততে চান, তাহলে দয়া করে বিশ্বাসের সাথে রাসায়নিক যুদ্ধ শুরু করুন।

আদর্শগত দিক দিয়ে দু’জন ছিলেন দুই মেরুর বাসিন্দা : twitter.com

ক্লারা সবসময়ই শান্তিবাদী ছিলেন। তিনি মনে করতেন বিজ্ঞানের ব্যবহার হওয়া উচিৎ শুধুই শান্তির জন্য। তাই স্বামীর বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের এই অপপ্রয়োগের বরাবর বিরোধিতা করেছেন তিনি। হেবারের রাসায়নিক অস্ত্রের পরিকল্পনাকে তিনি “বৈজ্ঞানিক আদর্শের বিকৃতি” বলে আখ্যায়িত করেন। ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য বিজ্ঞানের চূড়ান্ত অপব্যবহারের শুরুর দিনগুলোতে ক্লারার এই অবস্থান পারিবারিক ও বৈশ্বিক উভয় ক্ষেত্রেই ছিল এক প্রতিবাদী প্রতিধ্বনি। প্রকট পুরুষশাসিত সমাজে সে আওয়াজ এতোটাই ক্ষীণ ছিল যে পরিবারের কর্তা, স্বার্থপরায়ণ ও উচ্চাভিলাষী হেবারের কানে তার কোনো প্রভাবই হয়নি।

বিজয়ের নেশায় মত্ত জার্মান বাহিনীর এক অংশ তখন বেলজিয়ামের ইপ্রা-তে (Ypress) অবস্থানরত ছিল। সেখানে শত্রুপক্ষ ফ্রেঞ্চবাহিনীর জন্য প্রায় ৬,০০০ পিপেতে করে বিষাক্ত ক্লোরিন গ্যাস তৈরি রেখে জার্মান বাহিনী আদর্শ বায়ুপ্রবাহের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ২২ এপ্রিল ১৯১৫, সূর্যোদয়ের সাথে সাথেই জার্মান বাহিনী প্রায় ১৬৮ টনেরও বেশি ক্লোরিন বাতাসে ছেড়ে দেয়।

শত্রুপক্ষের উপর গ্যাস ছাড়ার সময় : mitbbs.com

দশ হাজার শত্রুসেনার অর্ধেকই মিনিটের মধ্যে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। এই গ্যাস হামলা থেকে বেঁচে যাওয়া কানাডিয়ান ল্যান্স সার্জেন্ট এলমার কটনের ভাষ্যমতে, এই মৃত্যু ছিল “শুকনো ডাঙায় ডুবে মরার মতো।” গ্যাসের প্রভাবে সাথে সাথে তীব্র মাথাব্যাথা আর ফুসফুসে ছুরির ফলার আঘাতের মতো ব্যাথা শুরু হয়ে গিয়েছিল। তার সাথে যোগ হয়েছিল ভয়ানক তৃষ্ণা, আর মুখ দিয়ে হলুদ ফেনা উঠে মুহূর্তের মধ্যে সৈন্যরা শয়ে শয়ে মারা পড়েছিল। এর দু’দিন পরে এক কানাডিয়ান সেনাবহরের উপর জার্মানরা আরেক দফা ক্লোরিনের মারণযজ্ঞ চালায়।

যুদ্ধক্ষেত্রে রাসায়নিক গ্যাসের শিকার সেনাদল : pinterest.com

এই সাফল্যের স্বীকৃতিরুপে হেবারকে ক্যাপ্টেন পদ প্রদান করা হয়। সেই বছরেরই ২ মে বার্লিনে নিজের বাড়িতে এক বিশাল ‘সাকসেস পার্টিতে’ যোগ দেন হেবার। অসহায় ক্লারা নিজের চোখের সামনে নিজেরই জীবনসঙ্গীর হাতে নিজের আজন্ম সাধনার ধন বিজ্ঞানের এমন দুর্গতি আর মেনে নিতে পারছিলেন না। তার উপর যে ছাদের তলায় তার বসবাস, সেখানেই এমন কুৎসিত মারণযজ্ঞের মহোল্লাস তার জন্য কতোটা কষ্টদায়ক ছিল, তা শুধু লিখে বুঝানো সম্ভব নয়। পার্টি শেষ হওয়ার কয়েক ঘন্টা পরে হেবারের আর্মি পিস্তলটি নিয়ে ক্লারা নিঃশব্দে বাগানে নেমে যান। তারপর ক্ষত-বিক্ষত হৃদয়টার দিকে পিস্তল তাক করে ট্রিগারটা টেনে দেন। আওয়াজ শুনে ছেলে হারম্যান দৌড়ে আসে। ছেলের কোলেই মা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বিজ্ঞান পথের দায়িত্বশীল এই সাধক বিজ্ঞানের সম্ভ্রম বাঁচাতে না পারার গ্লানি বুকে নিয়ে নিজ হাতেই নিজের জীবনের অবসান ঘটান। জীবদ্দশায় তার চোখ বেয়ে ক’ফোঁটা জল গড়িয়েছিল, তার খোঁজ স্বামী হেবার রাখেননি; মৃত্যুর পরে ক’ফোঁটা রক্ত ঝরলো, তার খবরও তিনি রাখলেন না। সদ্য আত্মহত্যা করা মায়ের দেহের পাশে ১৩ বছরের ছেলেকে রেখে পরদিন সকালেই হেবার ইস্টার্ণ ফ্রন্টে রওনা দিলেন। এবারের লক্ষ্য রাশিয়ান বাহিনীর উপর গ্যাস আক্রমণ! এভাবেই অবহেলায় আর গ্লানিতে শেষ হয়ে যায় এক সম্ভাবনাময় জ্যোতিষ্কের জীবনকাল।

একটা পিস্তলই হলো ক্লারার শেষ আশ্রয় (ছবি প্রতিকী) : ijr.com

বর্তমানে আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার যুদ্ধবিরোধী চিকিৎসকদের জার্মান সেকশন তাদের সবচেয়ে সম্মানসূচক পুরষ্কারটির নাম রেখেছে ক্লারা আইমারভার প্রাইজ। এছাড়া বিজ্ঞানচর্চা আর নৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কিত আরও বেশকিছু পুরষ্কার ক্লারার নামে প্রচলিত আছে। ক্লারাকে নিয়ে কিছু নাটক, শর্টফিল্ম এবং ফিকশনও রচিত হয়েছে। কিন্তু ‘ক্লারা আইমারভার’ নামটির তুলনামূলক খ্যাতিহীনতাই বলে দেয় যুদ্ধবাজ এই দুনিয়ায় শান্তিবাদীরা কতোটা প্রচ্ছন্ন। একজন ক্লারা আইমারভার প্রতিটি কল্যাণকামী বিজ্ঞানীর জন্য প্রেরণা, বিজ্ঞানের চর্চা ও সেবায় রত প্রতিটি নারীর জন্য প্রেরণা, কলুষিত পৃথিবীতে শান্তির ঝান্ডাবাহী প্রতিটি মানুষের জন্য প্রেরণা।

ফিচার ইমেজ- leimanblog.de

Related Articles