Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

বৃষ্টির ক্ষুদ্র ফোঁটায় বিশাল রংধনু তৈরির রহস্য

প্রায় সাড়ে তিনশ বছর আগে বিজ্ঞানী আইজ্যাক নিউটন দেখিয়েছিলেন, সাদা আলো আসলে সাতটি ভিন্ন ভিন্ন রঙের সমষ্টি। সাদা আলোকে যখন কোনো প্রিজমের মধ্য দিয়ে প্রেরণ করা হয়, তখন সেই আলোর ভেতরে থাকা সাতটি রং বিশ্লিষ্ট হয়ে যায়। ফলে ছোট পরিসরে তৈরি হয় রংধনু। সাদা আলো প্রিজমের ভেতর দিয়ে গেলে কেন অনেকগুলো ভাগে ভাগ হয়ে যাবে তার পেছনে চমৎকার একটি কারণ আছে। প্রত্যেক রঙের আলোর ফ্রিকোয়েন্সি ভিন্ন ভিন্ন। পানির ঢেউয়ের মতোই আলোও ঢেউ তুলে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। একটি পূর্ণাঙ্গ ঢেউকে বলা হয় কম্পন। আলোক রশ্মি প্রতি সেকেন্ডে যতগুলো কম্পন সম্পন্ন করে তাকে বলা হয় ফ্রিকোয়েন্সি। ফ্রিকোয়েন্সি বেশি হলে আলোর মাত্রা তীব্র হয়।

আলোকে প্রতিনিয়তই এক মাধ্যম থেকে আরেক মাধ্যমে গমন করতে হয়। বায়ু থেকে পানিতে, পানি থেকে বায়ুতে; বায়ু থেকে কাচে, কাচ থেকে বায়ুতে প্রভৃতি। আলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এক মাধ্যম থেকে আরেক মাধ্যমে গেলে তার গতিপথ কিছুটা বাঁকা হয়ে যায়। কম হোক আর বেশি হোক, বাঁকা হয়। আলোর আরেকটি ধর্ম হচ্ছে, ভিন্ন ভিন্ন ফ্রিকোয়েন্সির আলোক রশ্মি ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণে বাঁকা হয়। বায়ু থেকে কাচে গেলে বেগুনী আলো যত পরিমাণ বাঁকা হবে, লাল আলো তত পরিমাণ বাঁকা হবে না। এভাবে সাদা রং থেকে সাতটি আলাদা আলাদা রং বিশ্লিষ্ট হয়ে সাতটি আলাদা আলাদা দিকে ছড়িয়ে গিয়ে সাত রঙের রংধনু তৈরি করে।

প্রিজমে আলোর বিশ্লেষণ। ছবি: সায়েন্স এবিসি

কাচের প্রিজমের ভেতর দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন কোণে আলো বেঁকে গিয়ে রংধনুর সৃষ্টি করে, ব্যাপারটা সহজ। কিন্তু আকাশে কীভাবে রংধনু সৃষ্টি হয়? সেখানে কি অতি বিশাল কোনো প্রিজম স্থাপিত হয়ে আছে? না। আকাশে রংধনুর সৃষ্টির জন্য বিশাল প্রিজমের কোনো প্রয়োজন নেই, সামান্য ক্ষুদ্র বৃষ্টির কণার কারসাজিতেই এত বড় রংধনু তৈরি হওয়া সম্ভব। তার মানে বৃষ্টির ফোঁটাগুলো কি ক্ষুদ্র প্রিজমের মতো আচরণ করছে? এর উত্তর অনেকটা হ্যাঁ, আবার অনেকটা না। প্রিজমের কিছু বৈশিষ্ট্যের সাথে বৃষ্টির ফোঁটার মিল আছে, তবে তারা সম্পূর্ণই একরকম নয়।

খেয়াল করলে দেখা যাবে, রংধনু সবসময় সূর্যের বিপরীত দিকে উঠে। কেউ যদি রংধনুর দিকে তাকায়, তাহলে সূর্য সবসময় তার পেছন দিকে থাকবে। বৃষ্টির কণাগুলো ক্ষুদ্র বল বা গোলকের মতো আচরণ করে। আলো যখন কোনো স্বচ্ছ গোলকে আপতিত হয়, তখন সেটি ভিন্নরকম আচরণ করে, যা প্রিজমের বেলায় দেখা যায় না।

প্রিজম ও বৃষ্টির কণার মাঝে প্রধান পার্থক্যটি হচ্ছে, প্রিজমে আলো ১ম ও ২য় উভয় পৃষ্ঠ দিয়েই গমন করে চলে যায় কিন্তু বৃষ্টির কণার বেলায় এমনটা হয় না। বৃষ্টির কণার সামনের দিক থেকে আলো প্রবেশ করে ঠিকই কিন্তু পেছনের দিক বা দূরের পৃষ্ঠ দিয়ে আলো ভেদ করে চলে যেতে পারে না। আয়নার মতো প্রতিফলিত হয়ে চলে আসে। প্রতিফলনের স্বাভাবিক নিয়ম থেকে ব্যতিক্রম এই প্রতিফলনকে বলে ‘পূর্ণ অভ্যন্তরীণ প্রতিফলন’। আয়নার মতো আচরণ করে বলেই একে দেখতে হলে সবসময় সূর্যকে পেছনের দিকে রেখে দেখতে হয়। সূর্যের আলো এক পাশ দিয়ে প্রবেশ করে আরেক পাশ থেকে ডিগবাজি খেয়ে পেছনের দিকে ফিরে আসে। প্রক্রিয়াটা কীভাবে সম্পন্ন হয় তা এখানে বলছি।

ছবি: ডেভ ম্যাককেইন

ধরা যাক, দূরে কোথাও বৃষ্টি হচ্ছে। সূর্যকে পেছনের দিকে রেখে কেউ একজন বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে আছে। পেছন দিক থেকে সূর্যের আলো বৃষ্টির কোনো একটি ফোঁটার মধ্যে আপতিত হলো। সেখানে অবশ্যই অনেক অনেক ফোঁটা আছে, তবে এখানে হিসাবের জন্য এদের মাঝ থেকে একটি ফোঁটাকেই বিবেচনা করি। ধরি, আমাদের বিশেষ এই ফোঁটার নাম A। সূর্যের সাদা আলো A ফোঁটার সামনের পৃষ্ঠ দিয়ে প্রবেশ করে।

ছবি: ডেভ ম্যাককেইন

বায়ু মাধ্যম থেকে পানি মাধ্যমে প্রবেশ করার কারণে, সূর্যের ভিন্ন ভিন্ন রঙের আলো নিউটনের প্রিজমের ঘটনার মতো ভিন্ন ভিন্ন কোণে কিছুটা বেঁকে যাবে। এখানেও আগের মতোই শর্ত প্রযোজ্য- নীল আলো লাল আলোর চেয়ে বেশি কোণে বেঁকে যাবে। ফলে সামনের পৃষ্ঠ থেকে একটা রঙিন আলোর ছটা তৈরি হয়ে অপর পৃষ্ঠ পর্যন্ত যাবে। অপর পৃষ্ঠে যখন আঘাত করবে তখন পদার্থবিজ্ঞানের কিছু নিয়মের কারণে, আলো মাধ্যমকে ভেদ করে বাইরে না গিয়ে সেখান থেকে প্রতিফলিত হয়ে পেছনের দিকে ফিরে আসবে। উল্টোভাবে পেছনের দিকে আবার যখন আঘাত করবে, তখন লাল, নীল সহ অন্যান্য রঙের আলো আবারো কিছুটা বেঁকে বের হবে।

বের হবার সময় আলো সাতটি রঙের সুন্দর একটি বর্ণালি নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে, যেদিকে একজন লোক সূর্যকে পেছনের দিকে রেখে দাঁড়িয়ে আছে। এই বর্ণালির কোনো একটি অংশ যদি লোকটির চোখে লাগে, তাহলে লোকটি ঐ অংশের রং দেখতে পাবে। যদি বর্ণালির নীল অংশ এসে চোখ বরাবর পড়ে, তাহলে নিখাদ নীল রং দেখবে, আর যদি লাল বা অন্য অংশ এসে চোখে লাগে, তাহলে নিখাদ লাল বা অন্য রং দেখবে। সেখানে যদি দুজন লোক থাকে এবং দুজনের মাঝে একজন উঁচুতে আর একজন নিচুতে অবস্থান করে, তাহলে এমনও হতে পারে যে একজন দেখছে লাল আলো আর আরেকজন দেখছে নীল আলো। অথচ আলোর উৎপত্তি হয়েছিল একই স্থান থেকে। কৌণিক অবস্থানের কারণে তারা ভিন্ন ভিন্ন রং দেখছে।

কিন্তু রংধনুকে আমরা এরকম দেখি না। উঁচুতে বা নিচুতে যেখানেই অবস্থান করি না কেন রংধনুর সাত রঙের বর্ণিল সজ্জাকেই দেখি। মূলত আমরা কেউই একটি ফোঁটা থেকে আসা আলোর সবগুলো রং দেখতে পাই না। ভিন্ন ভিন্ন ফোঁটা থেকে আসা ভিন্ন ভিন্ন রং মিলে আমাদের চোখে রংধনুর আমেজ তৈরি করে।

অনেকগুলো বৃষ্টির ফোঁটার অনেকগুলো রং একত্রে মিলে আমাদের চোখে রংধনুর আমেজ তৈরি করে। ছবি: শাটারস্টক

কিন্তু এই আমেজ কীভাবে তৈরি করে? আমরা এখানে একটি ফোঁটা (A) থেকে বের হয়ে আসা আলো নিয়ে আলোচনা করছিলাম। সেখানে এটি ছাড়াও আরো মিলিয়ন মিলিয়ন পরিমাণ বৃষ্টির ফোঁটা আছে এবং এদের সকলেই A এর মতো আচরণ করছে। এদের থেকেও একই রকম বর্ণালিতে আলো বের হয়ে আসছে। ধরা যাক, এদের মাঝে একটির নাম হচ্ছে B, যা A থেকে কিছুটা নীচে অবস্থান করে (আগে উল্লেখিত চিত্র দ্রষ্টব্য)।

A থেকে নির্গত লাল আলো যদি লোকের চোখে লাগে তাহলে B থেকে নির্গত লাল আলো তার চোখে লাগবে না। কারণ B এর অবস্থান A এর চেয়ে কিছুটা নিচে। A এর লাল আলো যেখানে দর্শকের চোখে লাগে সেখানে B এর লাল আলো হয়তোবা লাগতে পারে দর্শকের পেটে। তবে লাল আলো পেটের দিকে লাগলেও নীল আলো আবার ঠিকই লাগবে চোখের দিকে। তাহলে একই অবস্থানে থেকে চোখ লাল ও নীল রঙের আলো দেখছে। একইভাবে A ও B এর মধ্যবর্তী অন্যান্য ফোঁটা থেকে হলুদ, সবুজ ও অন্যান্য আলো এসে লাগছে। এভাবে বৃষ্টির অনেক অনেক ফোঁটা একত্র হয়ে সম্পূর্ণ একটি দৃষ্টিনন্দন বর্ণালী তৈরি করে।

অনেকগুলো ফোঁটার সমন্বয়ে একটি বর্ণালী গঠিত হয়। ছবি: ডেভিড বার্কার ডিজাইন

তবে উপর থেকে নিচে কতগুলো রঙের সজ্জা মানেই রংধনু নয়। আকাশের রংধনু বলতে ধনুকের মতো বিস্তৃত এলাকাব্যাপী বাঁকানো সজ্জাকেই বোঝানো হয়। এরকম সজ্জার জন্য ৮/১০ টি ফোঁটা তো পরের কথা, কোটি কোটি ফোঁটার প্রয়োজন। তাহলে আকাশের রংধনু কীভাবে হয়? ভুলে গেলে চলবে না যে, বৃষ্টির ফোঁটা আছে মিলিয়ন মিলিয়ন পরিমাণ। এরাই বিস্তৃত এলাকা জুড়ে রংধনু তৈরি করে। প্রশ্নের পিঠে আরেক প্রশ্ন চলে আসে, বৃষ্টির ফোঁটা তো নড়াচড়া করে বা নিচে পড়ে যায়, তাহলে এর ফলে রংধনুর বর্ণালিতে সমস্যা হয় না কেন? যে মুহূর্তে কোনো একটি ফোঁটা দূরে সরে যাচ্ছে সে মুহূর্তেই অন্য একটি ফোঁটা সামনে থেকে হোক আর পেছন থেকে হোক, তার অবস্থান দখল করে নিচ্ছে। সেজন্য বৃষ্টির ফোঁটা নড়াচড়া করলেও তার অবস্থানে এসে তার কাজটি করে দিচ্ছে অন্য একটি ফোঁটা।

রংধনুকে আমরা ধনুকের মতো বাঁকানো দেখতে পাই কারণ এটি বৃত্তাকারে তৈরি হয়। আর আমাদের চোখ আছে এর কেন্দ্র বরাবর। চোখের চারপাশে নির্দিষ্ট ব্যাসার্ধের এলাকা জুড়ে রংধনু তৈরি হয়। এই কারণেই বৃষ্টির ফোঁটাগুলো চলাচল করা সত্ত্বেও রংধনু একই অবস্থানে স্থির থাকে। আমরা সম্পূর্ণ রংধনু দেখতে পাই না কারণ এটি ভূমির আড়ালে পড়ে যায়। কোনোভাবে যদি উপরে উঠা যায় এবং তখন যদি রংধনু সৃষ্টি হয় তাহলে সম্পূর্ণ বৃত্তাকার রংধনুই দেখা সম্ভব। প্লেনে ভ্রমণের সময় এরকম বৃত্তাকার রঙধনু দেখা যাবে।

বিশেষ পন্থায় বৃত্তাকার রংধনু দেখা সম্ভব। ছবি: মাই ডিসকভারিস

এটা আসলেই অবাক করার মতো ব্যাপার যে, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বস্তু কিংবা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনা একত্রে মিলে অনেক বিশাল কিছু ঘটিয়ে ফেলতে পারে।

ফিচার্ড ছবি: Mekamak

Related Articles