Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রহস্যঘেরা বাগদাদ ব্যাটারি: বিতর্কে বিভক্ত বিজ্ঞানীগণ

১৯৩৮ সালের কথা। ঘটনাস্থল ইরাকের রাজধানী বাগদাদ। বাগদাদ মূল শহর থেকে অদূরে খুজুত রাবু নামক স্থানে তখন কাজ করছিলেন জার্মান পুরাতাত্ত্বিক উইলহেম কনিগ। বাগদাদে মাটি খুঁড়ে বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বের তার সাথে ঐতিহাসিক যোগসূত্রিতা বের করা তার দায়িত্ব। সেই উইলহেম কনিগ খনন করতে গিয়ে আবিষ্কার করেন এক বিস্ময়কর পাত্র। পাত্রের ভেতর লোহার তৈরি লম্বা একটি দন্ডও পাওয়া যায়। মানুষের মুষ্টির সমান সেই কাদামাটির পাত্র নিয়ে তখন তেমন আগ্রহ দেখাননি কনিগ।

তখন ১৯০০ সাল থেকে শুরু করে আরেকদল অনুসন্ধানকারী বাইবেলে উল্লেখিত বিভিন্ন পবিত্র নিদর্শন খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন মধ্যপ্রাচ্য জুড়ে। কনিগের আবিষ্কৃত পাত্র তাদের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। কিন্তু তারা অনেক গবেষণার পরেও কোনো নিদর্শনের সাথে মিল খুঁজে পাননি। তাদের মধ্যে অনেকেই পাত্রটি নিয়ে কাজ করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। সেটি ফিরিয়ে দেয়া হয় কনিগের কাছে। কনিগ পাত্রটি নিয়ে কিছু অনুসন্ধান করে জানতে পারলেন, পাত্রের ভেতরের দিকে বেশ কিছু অংশ ক্ষয় হয়ে গিয়েছে এবং এই ক্ষয়ের কারণ হতে পারে কোনো অ্যাসিডের মাধ্যমে।

এই ঘটনার প্রায় ১৩৮ বছর আগে ইতালীয় বিজ্ঞানী কাউন্ট ভোল্টা বিদ্যুৎ নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে ব্যাটারি আবিষ্কার করেছিলেন। সেখানে তিনি অ্যাসিড দ্রবণের মধ্যে তামার পাত ডুবিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। জগত জুড়ে আলোড়ন ফেলা এই আবিষ্কার কনিগের অজানা ছিল না। তিনি দুইয়ে আর দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেললেন। “তাহলে কী এই কাদামাটির পাত্র কোনো ব্যাটারি?” কনিগের মনে কিন্তু তখন কোনো দ্বিধা নেই। তিনি নিশ্চিত ছিলেন তার আবিষ্কৃত পাত্রটিই পৃথিবীর প্রথম ব্যাটারি। তিনি দ্রুত এই সংবাদ প্রচার করে দিলেন।

১৯৩৮ এর সেই বাগদাদ ব্যাটারি খ্যাত কাদামাটির পাত্রটি শুধু কনিগকেই না, বিস্মিত করেছিল পুরো পৃথিবীকে। সবাই ভীষণ কৌতূহলে এগিয়ে আসলেন এই ব্যাটারির গবেষণায়।

এভাবেই আবিষ্কৃত হয়েছিলে বিজ্ঞানের অন্যতম ধাঁধা, বাগদাদ ব্যাটারি। এর পক্ষে-বিপক্ষে হাজারো যুক্তি-তর্ক, ব্যাখ্যা, আলোচনার পরেও যার রহস্যের সঠিক সমাধান করতে পারেননি বিজ্ঞানীরা।

বাগদাদ ব্যাটারির বর্ণনা

১৯৪০ সালে কনিগ তার এই অনুসন্ধান নিয়ে বিস্তারিত লিখে একটি জার্নালে প্রকাশ করলেন। সেই বিস্ময়কর পাত্রটি আকারে প্রায় ৫ ইঞ্চি লম্বা। পাত্রের সাথে একটি লোহার দণ্ড এবং পিচের তৈরি ছিপি পাওয়া যায়। পাত্রের ভেতরে লোহার দণ্ডটি তামার নল দিয়ে আবৃত। ধারণা করা হয়, তামার নলের ভেতর অম্লীয় দ্রবণ ব্যবহার করে ব্যাটারিটি সচল করা হতো।

বাগদাদ ব্যাটারির বিভিন্ন অংশ; source: aquiziam.com

এই ব্যাটারি আবিষ্কারের সময় পুরো পৃথিবী দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মেতে উঠেছিল। ফলে বাগদাদ ব্যাটারির কথা বেশ কয়েক বছরের জন্য বিজ্ঞানীরা ভুলে যান।

গবেষণাগারে বাগদাদ ব্যাটারি  

আবিষ্কারের প্রায় ৬০ বছর পর বিজ্ঞানীরা বাগদাদ ব্যাটারি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। অন্যদিকে ইতিহাসবিদরাও এগিয়ে আসেন। কারণ এর সত্যতার প্রমাণ পেলে পার্থিয়ানদের সম্পর্কে অনেক অজানা ইতিহাস বের হয়ে আসবে।

পার্থিয়ানদের ইতিহাস বদলে দিতে পারে ব্যাটারিগুলোর সত্যতা; source: theepochtimes.com

কিন্তু গবেষণার শুরুতেই শুরু হয় বিতর্ক। উইলহেম কনিগ কি পাত্রটি খনন করে পেয়েছেন নাকি জাদুঘরের অন্যান্য সংগ্রহের মাঝে খুঁজে পেয়েছেন তা নিয়ে সন্দেহ দেখা দেয়। কনিগের ধারণা অনুযায়ী পাত্রটি প্রায় ২৫০ খ্রিস্টপূর্বের দিকে তৈরি করা হয়েছিল। তবে অধিকাংশ বিজ্ঞানী এই ধারণা নাকচ করে দেন। কারণ পাত্রের গড়ন সাসানিদ শাসনামলের পাত্রগুলোর সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ। সেই অনুযায়ী পাত্রটি ৬০০ খ্রিস্টাব্দের দিকে তৈরি করা হয়।

খুজুত রাবুর স্থানীয়দের ইরাকিরা ‘পার্থিয়ান’ নামে ডাকেন। কিন্তু পার্থিয়ানরা জ্ঞান-বিজ্ঞানের দিক থেকে উন্নত ছিল না। তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল যুদ্ধবিগ্রহ। তাই এই ঘটনা ইতিহাসবিদদের বিস্মিত করেছিল।

ওদিকে বিজ্ঞানীরা কিন্তু ঐতিহাসিক দ্বন্দ্বকে পেছনে ফেলে ঠিকই কাজ করে যাচ্ছিলেন। কারণ মাটির পাত্রটি আসলেই ছিল বিস্ময়কর। এ ব্যাপারে ধাতু বিশেষজ্ঞ ড. পল ক্যাডক বলেন,

They are a one-off. As far as we know, nobody else has found anything like these. They are odd things; they are one of life’s enigmas.”

বাগদাদ ব্যাটারি থেকে প্রায় ২ ভোল্টের বিদ্যুৎ উৎপন্ন হতো; source: smith.edu

যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞানী উইলার্ড গ্রে বাগদাদ ব্যাটারির একটি রেপ্লিকা নির্মাণ করেন। এরপর তিনি তাতে আঙুরের রসের দ্রবণ ব্যবহার করেন। এই পরীক্ষায় গ্রে সফলতা পেলেন। ব্যাটারি সচল হয়ে গেল। বিদ্যুতের বিভব ছিল প্রায় ২ ভোল্ট। এর ফলে অনেকেই বাগদাদ ব্যাটারির সত্যতা মেনে নেন।

কিন্তু ব্যাটারির সাথে কোনো তার খুঁজে পাওয়া যায়নি। ফলে কোন ধাতুর তার দ্বারা ব্যাটারিতে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হতো সেটা জানা সম্ভব হয়নি। প্রাচীন ইরাকে তামার নল, লোহার দণ্ড, কাদামাটির পাত্র নিত্য ব্যবহার্য সামগ্রীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। তাই অনেক বিজ্ঞানী তখনও একে ব্যাটারি হিসেবে মানতে নারাজ ছিলেন। স্বয়ং ড. ক্যাডক আফসোস করে বলেন,

It’s a pity we have not found any wires. It means our interpretation of them could be completely wrong.”

ব্যাটারির অংশগুলো প্রাচীন ইরাকে নিত্য ব্যবহার্য বস্তু ছিল; source: smith.edu

তবে তিনি ধারণা করেন এই ব্যাটারির কিছু অংশ সময়ের আবর্তনে হারিয়ে গেছে। কারণ কেউ স্রেফ মনের ভুলে ঠিক ব্যাটারির মতো করে উপাদানগুলো একসাথে রেখে দিয়েছেন, সেটা মেনে নেয়া হাস্যকর।

সম্ভাব্য ব্যবহার

বাগদাদ ব্যাটারির মাধ্যমে বিদ্যুৎ চলাচল করানো সম্ভব, এটা প্রমাণিত হওয়ার পর বিজ্ঞানীরা এর সম্ভাব্য ব্যবহার নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। সে সময়ে গ্রিকরা ব্যথানাশের জন্য বৈদ্যুতিক মাছ ব্যবহার করতো। সেই থেকে ধারণা করা হয়, সম্ভবত বাগদাদ ব্যাটারি ঔষধ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। কিন্তু সেটা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। কারণ বাগদাদ ব্যাটারি থেকে উৎপন্ন ২ ভোল্টের বিদ্যুত দেহে কোনো প্রভাব ফেলবে না। তাই এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়।

বাগদাদ ব্যাটারি নিয়ে গবেষণা চলছে; source: aquiziam.com

তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য প্রস্তাব ছিল ইলেক্ট্রোপ্লেটিং (Electroplating)। এর মাধ্যমে যেকোনো ধাতুর উপর সোনা, রূপাসহ বিভিন্ন ধাতুর প্রলেপ দেওয়া যায়। এর পেছনে সবচেয়ে বড় যুক্তি ছিল এটা বাণিজ্যিক। ধারণা অনুযায়ী, এর মাধ্যমে ধাতুর উপর প্রলেপ দিয়ে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে ছুটে যেতেন ইরাকের বণিকরা।

জার্মান বিজ্ঞানী আর্নে ইগাব্রেশট বাগদাদ ব্যাটারির রেপ্লিকার দ্বারা প্রথম ইলেক্ট্রোপ্লেটিং করতে সক্ষম হন। তিনি অনেকগুলো ব্যাটারি শ্রেণি সমবায়ে যুক্ত করে একটি ধাতুর উপর ০.০০১ মি.মি. প্রলেপ তৈরি করতে সক্ষম হন। তিনি ধারণা করেন, বাগদাদের প্রাচীন ধাতবসামগ্রী এই ব্যাটারির সাহায্যে প্রলেপ দেওয়া হতো।

মজার ব্যাপার হলো, অন্যান্য বিজ্ঞানীরা এই পদ্ধতি অনুসরণ করে ব্যর্থ হন। তাই তারা এই পরীক্ষার ফলাফল মেনে নেননি। রোমার-পেলিজিউস জাদুঘরের গবেষক ড. বেরিতা শেমিজ এই পরীক্ষাটি ভুয়া বলে দাবি করেন। কারণ এই পরীক্ষার কোনো লিখিত দলিল পাওয়া যায়নি।

বাগদাদ ব্যাটারি কি ব্যাটারি নয়?

বাগদাদ ব্যাটারির বিরুদ্ধে বিভিন্ন বিজ্ঞানী শক্ত যুক্তি প্রদান করেছেন। তারা প্রমাণ করার চেষ্টা করেছেন যে, বাগদাদ ব্যাটারি স্রেফ একটি আসবাব ব্যতীত আর কিছুই নয়। প্রথমেই আসা যাক বাগদাদ ব্যাটারি কেন ব্যাটারি হতে পারবে না, এই প্রশ্নে।

বিখ্যাত টিভি অনুষ্ঠান Arthur C. Clarke’s Mysterious World -এর একটি পর্বে বাগদাদ ব্যাটারির অযোগ্যতা নিয়ে বলা হয়, ব্যাটারি সচল হবার পর এর ভেতরে ঘন গ্যাস উৎপন্ন হয় যা ব্যাটারির কার্যক্ষমতা হ্রাস করে দেয়। এছাড়াও অনেকগুলো ব্যাটারি একসাথে জুড়ে দিয়ে বিদ্যুতের উৎপাদন বৃদ্ধি করা সম্ভব হলেও এর বিভব মান কখনই ২ ভোল্ট এর চেয়ে বেশি পাওয়া সম্ভব হয়নি। এ ধরনের  ব্যাটারি ব্যবহার করা লাভজনক নয়।

আর ইলেক্ট্রোপ্লেটিংয়ের তত্ত্ব সুনির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে অনেক আগেই বিজ্ঞানীদের নিকট গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে।

বাগদাদ ব্যাটারি কি তাহলে সত্য নয়? source: MJ2 artesanos

তখন মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, যদি বাগদাদ ব্যাটারি কোনো ব্যাটারি নয়, তাহলে সেটা আসলে কী?

এই প্রশ্নের জবাবও প্রস্তুত রেখেছেন বিজ্ঞানীরা। তাদের মতে মেসোপটেমিয়ার শহর সেলুসিয়ার বিভিন্ন স্ক্রল সংরক্ষণের জন্য এসব পাত্র ব্যবহার করা হতো। কিন্তু এই ধারণা বাতিল করে দেন অপরপক্ষের বিজ্ঞানীরা। কারণ সেলুসিয়ার পাত্রগুলো কাদামাটির তৈরি ছিল না।

তবে বাগদাদ ব্যাটারি যে ব্যাটারি হতে পারে না, সে ধারণা কেউই উড়িয়ে দিচ্ছেন না। এখনো বাগদাদ ব্যাটারি বিজ্ঞানীদের নিকট এক অমীমাংসিত রহস্য। Danile Smith এর বিখ্যাত সংকলন ‘100 Things They Don’t Want You to Know’তে বাগদাদ ব্যাটারি নিয়ে স্বতন্ত্র ফিচার প্রকাশিত হয়। এছাড়াও Discovery Channel-এর ‘MythBuster’ অনুষ্ঠানে বাগদাদ ব্যাটারিকে নিয়ে বিশেষ ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়।

জাদুঘরের সংরক্ষিত বাগদাদ ব্যাটারি; source: ufoholic.com

বাগদাদ ব্যাটারি নিয়ে বিতর্কে বিভক্ত বিজ্ঞানীরা। হয়তো এটি বিজ্ঞানী ভোল্টার ব্যাটারি আবিষ্কারের হাজার বছর আগে ব্যবহৃত ব্যাটারি। তাহলে “কোন কারণে প্রাচীন ব্যাটারির কথা হারিয়ে গেল সভ্যতার অন্তরালে?” এই প্রশ্নের উত্তর নিয়ে মাথা ঘামাবেন গবেষকরা।

বৈদ্যুতিক ব্যাটারির আবিষ্কারক ভোল্টা; source: thefamouspeople.com

আর বিস্ময়কর পাত্রটি যদি ব্যাটারি না হয়, সেক্ষেত্রে ব্যাপারটি আরো রহস্য সৃষ্টি করবে। তখন অনুসন্ধানপর্ব নতুন মোড় নিতে পারে।

এভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে এরকম হাজারো বিস্ময়কর ধাঁধা সমাধান হবার অপেক্ষায় আছে। ধারণা করা হয়, সব রহস্যের সমাধান করা হলে হয়তো পৃথিবীর ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে। যেমন বাগদাদ ব্যাটারির কথাই ধরুন না। এটি সত্য প্রমাণিত হলে প্রাচীনকালের জীবনযাপন সম্পর্কে আমাদের ধারণা সম্পূর্ণ বদলে ফেলতে হবে।

ফিচার ইমেজঃ vina.com

Related Articles