Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

প্যারাফিলিয়া: মানুষের যত বিকৃত যৌনাচার

কেবলই সন্ধ্যা নেমেছে, চারপাশটা এখনো পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি। মেয়েদের হোস্টেলের পাশে এক ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। প্রকৃতির ডাকে এসেছে হয়ত। কিন্তু মেয়েদের হোস্টেলের সামনে কেন? তা-ও আবার ভাবসাবে মনে হচ্ছে তার উদ্দেশ্য অন্য কিছু। বিভিন্নভাবে সে নিজের পুরুষাঙ্গ দেখানোর চেষ্টা করছে।

ভর দুপুরবেলা, রাস্তাঘাটে লোকজন খুব বেশি নেই। রিতা কলেজ শেষ করে বাড়ি ফিরছে। কিছু বোঝার আগেই পেছন থেকে এক লোক তার স্তনে খুব জোরে চাপ দিল। তারপর খুব দ্রুত রাস্তা পার হয়ে অপরপাশে হারিয়ে গেল। রিতা হতভম্ব হয়ে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। মাথা ঘুরিয়ে দেখল কেউ এটা দেখেছে কিনা! তারপর মাথা নিচু করে আবার বাসার পথ ধরল।

পূজা তার বড় মামাকে একেবারেই পছন্দ করে না। তার মা তাকে অনেক অনুরোধ করেও মামার বাসায় নিতে পারেন না। কারণ জিজ্ঞেস করলে সে কিছুই বলে না। চোখ-মুখ শক্ত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। সে কীভাবে বলবে? বড় মামার কথা মনে হলেই তার সেসময়ের কথা মনে পড়ে যায়, যখন তার বয়স ছিল কেবল ছয় কি সাত বছর। মামা আদর করার কথা বলে তাকে কোলে নিতো। তারপর কোথায় কোথায় যে হাত দিতো! ছোট বলে তখন সে বুঝতো না। এখন সে সব বুঝতে পারে। তার প্রচণ্ড ঘৃণা হয়। কিন্তু এ কথা সে কাকে বলবে? কীভাবে বলবে? ছিঃ!

উপরের ঘটনাগুলো খুবই কমন। শুধু আমাদের দেশে না, গোটা বিশ্বেই এই ধরণের ঘটনা প্রতিদিনই ঘটছে। এগুলো হল এক ধরণের বিকৃত যৌন আচরণের বহিঃপ্রকাশ। সেক্স বা যৌনতা- শব্দগুলো বরাবরই সুড়সুড়ি দেয়ার মতো। এতদিন ধরে যৌনতা বিষয়ক যে কোনো আলোচনা ছিল ট্যাবু। কিন্তু বর্তমানে মিডিয়া, ইন্টারনেটের কল্যাণে ‘সেক্স’ শব্দটি আর নিষিদ্ধ নয়। এখন যৌন আচরণ অনেকক্ষেত্রেই অস্বাভাবিক, কখনো কখনো বড্ড নোংরা। অস্বাভাবিক এবং বিকৃত এই যৌনাচারকে মেডিকেলের ভাষায় প্যারাফিলিয়া (Paraphilia) বলে। আজকের আলোচনায় এ ধরনের কিছু কমন বিকৃত যৌন আচরণ সম্পর্কে আমরা জানবো।

১) পেডোফিলিয়া (Pedophilia)

এ শব্দটির সাথে অনেকেই পরিচিত, বাংলায় যাকে শিশুকাম বলে। যখন বয়স্ক ব্যক্তিরা কোনো বাচ্চার প্রতি যৌনাকাঙ্ক্ষা অনুভব করে, তখন বুঝতে হবে তিনি পেডোফিলিক। চাইল্ড পর্নোগ্রাফি দেখা অধিকাংশ ব্যক্তির মধ্যে শিশুকামিতার বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। আমাদের ৩য় গল্পের পূজা পেডোফিলিয়ার শিকার হয়েছিল।

Source: digaosenra.com

২) এক্সিবিশনিজম (Exhibitionism)

লেখার শুরুতেই যে ঘটনাটা উল্লেখ করা হয়েছে, তাকে বলা হয় এক্সিবিশনিজম। অপরিচিত কাউকে বা জনসম্মুখে নিজের গোপনাঙ্গ দেখিয়ে যৌন তৃপ্তি পাওয়াকেই এক্সিবিশনিজম বলে। একটি সুইডিশ সার্ভে মতে, সুইডেনের ২.১% নারী ও ৪.১% পুরুষ মনে করে, অপরিচিত কারও কাছে নিজেদের গোপনাঙ্গের প্রকাশ তাদেরকে উত্তেজিত করে। মাঝেমাঝেই আমরা শুনি, অমুক মডেল ঘোষণা দিয়েছে তার প্রিয় কোনো দল খেলায় জিতলে তিনি উলঙ্গ হয়ে রাস্তায় নামবেন। কিংবা ক্রিকেট খেলার মাঠে হঠাৎ করেই এক তরুণী উলঙ্গ হয়ে দৌড়ানো শুরু করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এমন ব্যক্তিরা এক্সিবিশনিজমে আক্রান্ত থাকে।

৩) জুওফিলিয়া (Zoophilia)

এটি Bestiality বা বাংলায় পশুকামী ও পশ্বাচার নামে পরিচিত। আপনি কি ভাবছেন পশুর সাথে মানুষের যৌন সম্পর্ক স্থাপন কীভাবে সম্ভব? আপনার জ্ঞাতার্থে জানানো দরকার- জাপান, আর্জেন্টিনা, হাঙ্গেরি, ফিনল্যান্ড এবং রোমানিয়া সহ বেশ কিছু দেশেই পশুকামিতা বৈধ। এমনকি অনেকের কাছে ‘স্বপ্নের দেশ’ হিসেবে পরিচিত আমেরিকার অনেক স্থানেই পশুকামিতার বৈধতা রয়েছে। অনেক ব্যক্তিই পশু পালন করে এ উদ্দেশ্যে। বাংলাদেশে পশ্বাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি যাবৎজীবন কারাদণ্ড।

৪) নেক্রোফিলিয়া (Necrophilia)

নেক্রোফিলিয়া বলতে লাশের সাথে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করাকে বোঝায়। খুবই ভয়ঙ্কর ব্যাপার, তাই না? ড. রোজম্যান এবং র‍্যাসনিকের গবেষণা মতে, ৫৭% নেক্রোফিলিকই হয় মর্গ দেখা-শোনাকারী কিংবা হাসপাতাল সংশ্লিষ্ট কেউ।

বিখ্যাত ইতালিয়ান শিল্পী পিয়েত্র পাজেত্তার আঁকা ছবি; Source: theartstack.com

৫) ভয়েরিজম (Voyeurism)

কোনো মেয়ে পোশাক পাল্টাচ্ছে বা গোসল করছে, আর কোনো ছেলে সেটা লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে তার যৌন ক্ষুধা মেটাচ্ছে- এ ধরনের বিকৃত যৌনাচরণকে বলা হয় ভয়েরিজম, গোপনে কারও নগ্ন বা অর্ধনগ্ন শরীর বা কারো যৌন কর্ম দেখে সুখ অনুভব করা। এই ভয়েরিজমকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময়ে তৈরি হয়েছে নানান সিনেমা। সেখানে দেখানো হয় নায়ক বাইনোকুলার ব্যবহার করে নায়িকার বেডরুমে ফোকাস করছে। তারপর গোপনে নায়িকার নগ্ন হয়ে যাওয়াটাকে উপভোগ করছে। মাঝেমাঝেই ট্রায়াল রুম বা পার্লারে সিসিটিভি ক্যামেরা অথবা কোনো মেয়ের গোপন ভিডিও ফাঁস সংক্রান্ত যে খবরগুলো আমরা শুনি, তার অধিকাংশ কেসই ভয়েরিজমের ফসল। উন্নত দেশ কানাডাতে রয়েছে ভয়েরিজমের মতো বিকৃত যৌনাচারের বৈধতা।

৬) ফ্রটিউরিজম (Frotteurism)

এটি সাধারণত জনবহুল জায়গায় বেশি হয়। বাংলাদেশের মত জনবহুল দেশে এই বিকৃত যৌনাচারের শিকার হয়নি কিংবা কাউকে রাস্তাঘাটে কাউকে এর শিকার হতে দেখেনি এমন লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন। আমাদের ২য় গল্পের রিতা এই বিকৃত যৌনাচারের শিকার হয়েছিল। এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়ই ভিড়ের মধ্যে মেয়েদের শরীরে হাত দেয়, কনুই কিংবা হাত দিয়ে স্তনে চাপ দেয় অথবা নিজের যৌনাঙ্গ ভিড়ের মধ্যে আরেকজনের সাথে ঘষে। ছেলেদের ক্ষেত্রে ফ্রটিউরিজমের হার মেয়েদের তুলনায় বেশি।

জাপানে ‘চিকান’দের থেকে সতর্কতা! Source: pinterest.com

৭) ম্যাসোচিজম (Masochism)

এতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা সাধারণত যৌন ক্রিয়ার সময় নিজেকে নানাভাবে শারীরিক কষ্ট বা আঘাত দিয়ে আনন্দ পায়। সাধারণত সেক্স করার সময় এরা অন্যের মাধ্যমে নিজেকে প্রহার করে। দড়ি দিয়ে বেঁধে কিংবা ইলেকট্রিক শক দিয়ে বিভিন্ন উপায়ে নিজের কামনা মেটায়। এই ডিজঅর্ডারে আক্রান্তদের মধ্যে ২.২% হল পুরুষ এবং ১.৩% নারী। মাত্রাতিরিক্ত পর্নোগ্রাফি আসক্তিই এই ডিজঅর্ডারের প্রধান কারণ।

৮) স্যাডিজম (Sadism)

এটি এক প্রকারের ধর্ষণ। ম্যাসোচিজম এবং স্যাডিজম একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। ম্যাসোচিজম হলো নিজেকে কষ্ট দেয়া আর স্যাডিস্টরা যৌন ক্রিয়ায় অন্যকে তার অনিচ্ছায় জোরপূর্বক একইভাবে কষ্ট দেয়। ম্যাসোচিজম এবং স্যাডিজমে অনেক সময় মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে।

৯) এমেটোফিলিয়া (Emetophilia)

সেক্সের সময় বমি করে, অন্যের বমি দেখে এবং ক্ষেত্রবিশেষে সঙ্গী/সঙ্গীনীর বমি খেয়ে যৌন সুখ অনুভব করে এমেটোফিলিয়ায় আক্রান্তরা। ভাবতেই গা গুলিয়ে আসছে না?

১০) ফেটিশিজম (Fetishism)

প্রায়ই মেয়েদের বিভিন্ন পোশাক চুরি হওয়ার ঘটনা শোনা যায়। সেটা হতে পারে আন্ডারগার্মেন্টস অথবা সাধারণ কোনো পোশাক। এই চুরির অনেকগুলোই হয়ে থাকে ফেটিশিজমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের দ্বারা। এরা সাধারণত যৌনাঙ্গ ব্যতীত দেহের নির্দিষ্ট কোনো অঙ্গ (বিশেষ করে পা), বস্তুগত জিনিস, যেমন- ব্রা, আন্ডারওয়্যার, প্যান্ট অথবা সাধারণ জামাকাপড় এসব নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভোগে। ২০১৪ সালে সেক্সচুয়্যাল মেডিসিনে প্রকাশিত একটি জার্নালের গবেষণার তথ্যানুযায়ী, ২৬.৩% নারী এবং ২৭.৮% পুরুষের এ ধরণের ফেটিশ নিয়ে ফ্যান্টাসি রয়েছে।

১১) বাইসেক্সুয়ালিটি (Bisexuality) 

যারা নারী, পুরুষ নির্বিশেষে সবার প্রতিই আকর্ষণ অনুভব করে, অর্থাৎ লিঙ্গ নিরপেক্ষ যৌনতা, তাদেরকে বলা উভকামী বা বাইসেক্সুয়াল। গবেষণায় দেখা গেছে উভকামী, সমকামীরা বিপরীতকামীদের তুলনায় ১৭ গুণ বেশি মলদ্বারের ক্যান্সারের ঝুঁকিতে আছে। মনোবিজ্ঞানী সিগমুন্ড ফ্রয়েড মনে করতেন যে, প্রত্যেক মানুষই জন্ম থেকে উভকামী। যদিও পরবর্তীতে এই ধারণা ভুল প্রমাণিত হয়। ব্যাঙ্গালোরের ‘পিপলস ইউনিয়ন অব সিভিল লিবার্টি’র একটি সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, সমকামীরা উভকামীদের শুধু প্রত্যাখ্যানই করে না, ঘৃণাও করে। অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, মেগান ফক্স, মাইলি সাইরাস, লিন্ডসে লোহান, লেডি গাগা, ক্যামেরুন ডিয়াজ, ডেভিড বওয়ি, ম্যাট বোমার এবং ক্যারি গ্র্যান্ট সহ অজস্র পশ্চিমা সেলেব্রিটিই উভকামী

১২) ইনসেস্ট (Incest)

অজাচার বা ইংরেজিতে ইনসেস্ট হল নিজের আপন রক্ত সম্পর্ক বা পরিবারের সদস্যদের মধ্যে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করা। সেটা নিজের মায়ের সাথে হতে পারে, হতে পারে নিজের বোনের সাথে। ইনসেস্টকে বলা হয় ‘The Last Taboo’। অনেক বিকৃত যৌনাচারকেই বহু মানুষ স্বাভাবিক হিসেবে গ্রহণ করেছে। কিন্তু দিনশেষে বিকৃতিরও তো একটা সীমা আছে, তাই না? তাই অনেক মানুষের কাছেই এটা মানব ইতিহাসের লম্বা একটা সময় বিকৃতি হিসেবেই গণ্য হয়ে এসেছে। তবে বর্তমান বিশ্বে নৈতিকতার অধঃপতনে সে প্রাচীরও ভাঙতে শুরু করেছে। NDTV-এর একটি রিপোর্টে ভারতে অজাচারের একটি পরিসংখ্যান দেখানো হয়েছে। রিপোর্ট অনুসারে, ভারতে ৫৩% শিশু শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়। অজাচারের শিকার ৩২% শিশুর বয়স কেবল দুই থেকে দশের মধ্যে। কল্পনা করতে কষ্ট হয়, তাই না? পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৫৫ সালে আমেরিকাতে প্রতি মিলিয়নে কেবল একজন মানুষ অজাচারে লিপ্ত হতো। আর এখন? প্রতি তিনটি মেয়ের মধ্যে একটি মেয়ে তাদের বয়স ১৮ হবার আগে নিজ গৃহেই অজাচারের শিকার হয়।

মানুষ প্যারাফিলিয়াতে আক্রান্ত কেন হয়? অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, এসব আচরণের শেকড় একদম শৈশবে প্রোথিত। মাত্রাতিরিক্ত পর্ণ আসক্তি মূল কারণগুলোর মধ্যে একটি। যারা চূড়ান্ত পর্যায়ের পর্ণে আসক্ত, তারা একসময় স্বাভাবিক যৌনাচারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। ভিন্ন কিছু করার চেষ্টা করে। সেখান থেকেই বিকৃতির শুরু হয়। ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় প্যারাফিলিয়ার পেছনে আরেকটি বড় কারণ।

সকল মানুষের মধ্যেই কম-বেশী যৌন চাহিদা রয়েছে। মানবজাতি এই প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়েই আজকের অবস্থানে এসেছে। তাই একে ঘৃণা করার কিছু নেই। তবে সেই যৌনতা যদি আমাদের প্যারাফিলিয়ার দিকে নিয়ে যায়, তবে তা নিয়ে চিন্তা করার সময় সম্ভবত এখনই।

তথ্যসূত্র

১) Nolen-Hoeksema, Susan (2014). Abnormal Psychology (6th ed.). New York City, NY: McGraw-Hill Education. p. 384.

Related Articles