Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

আমাদের মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি কী?

বিজ্ঞানী হিসেবে যে কয়েকজন ব্যক্তি সারা বিশ্বে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করেছে তাদের মধ্যে অন্যতম একজন জামাল নজরুল ইসলাম। ক্যামব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে তার লেখা বই পাঠ্য হিসেবে পড়ানো হয়। বিশ্বের বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তার লেখা বই “The Ultimate Fate of the Universe”। কিন্তু আক্ষেপের ব্যাপার হলো বাংলাদেশী এই বিজ্ঞানীর বিশ্ববিখ্যাত এই বইটি স্বয়ং বাংলাতে অনূদিত হয়নি এখনো। মহাবিশ্বের অত্যন্ত চমকপ্রদ একটি বিষয় নিয়ে লেখা বাংলাদেশী বিজ্ঞানীর অত্যন্ত চমৎকার এই বইটি বাংলায় ফিরিয়ে আনা উচিৎ ছিল অনেক আগেই। এই দায়িত্ববোধ থেকেই বইটিকে অনুবাদের প্রয়াস নেয়া হয়েছে। এখানে ১ম অধ্যায়ের বাংলা রূপান্তর উপস্থাপন করা হলো। অনুবাদ করেছেন সিরাজাম মুনির শ্রাবণ

বাংলার গর্ব বিজ্ঞানী জামাল নজরুল ইসলাম (১৯৩৯ – ২০১৩)। ছবি: বিডিনিউজ২৪

অন্তিম পরিণতিতে এই মহাবিশ্বের ভাগ্যে কী ঘটবে?

বুদ্ধিমত্তা বিকাশের পর থেকেই এই প্রশ্নটি আন্দোলিত করেছে এক মানুষ থেকে আরেক মানুষের মন। এই প্রশ্ন থেকে মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে আরো কিছু প্রশ্ন। এই পৃথিবীর ভবিষ্যৎ কী? কিংবা এই মানবজাতির ভবিষ্যৎ কী? বর্তমানে প্রশ্নগুলো খুব সহজ মনে হলেও অনেক কাল পর্যন্ত এদের কোনো বিজ্ঞানসম্মত ও গ্রহণযোগ্য উত্তর ছিল না। এ ধরনের প্রশ্নের গ্রহণযোগ্য ও বিজ্ঞানসম্মত উত্তর প্রদানের জন্য জ্যোতির্বিদ্যা ও সৃষ্টিতত্ত্বে যে পরিমাণ উন্নতি অর্জন হওয়া দরকার তা অর্জিত হয়েছে মাত্র কয়েক দশক আগে।

মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি বা অন্তিম পরিণতি ঘটতে অবশ্যই অনেক অনেক সময় লাগবে। ব্যাপক সময়ের ব্যবধানে এই মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী হবে তা নির্ভর করে দুটি বিষয়ের উপর- (১) মহাবিশ্বের বর্তমান গঠন কেমন এবং (২) মহাবিশ্ব কীভাবে এই গঠনে এসেছে। এ দুটি প্রশ্নের উত্তর জানলে মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ কী সে সম্পর্কে জানা যাবে। মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভালোভাবে আলোচনা করতে গেলে আস্ত একটা বই রচনা করার প্রয়োজন হবে। এখানে পাঠকদেরকে সংক্ষেপে একটি সামগ্রিক ধারণা (Bird’s eye view) দেবার চেষ্টা করা হবে।

সামগ্রিকভাবে মহাবিশ্বকে বিবেচনা করলে বলা যায় মহাবিশ্বের মূল গাঠনিক উপাদান হচ্ছে গ্যালাক্সি। মহাবিশ্বের সীমাহীন শূন্যতার ‘সাগরে’ কোটি কোটি ‘দ্বীপ’সদৃশ নক্ষত্রের সমন্বয়ে এক একটি গ্যালাক্সি গঠিত। সাধারণ একটি গ্যালাক্সিতে প্রায় একশো বিলিয়ন (১০^১১)-এর মতো নক্ষত্র থাকে। আমাদের সূর্য এরকমই একটি নক্ষত্র।

সাধারণ একটি গ্যালাক্সিতেই প্রায় একশো বিলিয়ন নক্ষত্র থাকে। ছবি: পিন্টারেস্ট

পৃথিবী, সূর্য ও সৌরজগতের অন্যান্য গ্রহ নিয়ে আমরা যে গ্যালাক্সিতে বসবাস করি তাকে বলা হয় মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি বা আকাশ গঙ্গা ছায়াপথ। এটিকে শুধুমাত্র ‘গ্যালাক্সি’ বা ‘ছায়াপথ’ নামেও ডাকা হয়। পর্যবেক্ষণযোগ্য সকল গ্যালাক্সি এবং গ্যালাক্সির সাথে সম্পর্কিত অন্যান্য বস্তুর সমন্বয়ে এই মহাবিশ্ব গঠিত। জোরালো প্রমাণ আছে যে, গড়পড়তাভাবে মহাবিশ্বের সকল অংশেই এসব বস্তু ও গ্যালাক্সি সমানভাবে ছড়িয়ে আছে।

ফরনাক্স নক্ষত্রমণ্ডলীতে গ্যালাক্সির একটি সমৃদ্ধ ক্লাস্টার। কয়েকটি গ্যালাক্সি যদি পারস্পরিক মহাকর্ষীয় আকর্ষণে আবদ্ধ থাকে তাহলে ঐ গ্যালাক্সিগুলোকে একসাথে বলা হয় ‘ক্লাস্টার’। ফরনাক্স ক্লাস্টারের গ্যালাক্সিগুলোও পারস্পরিক মহাকর্ষীয় আকর্ষণে বাধা। ১০^২৭ বছর পর এরকম অতিবিশাল ক্লাস্টার সংকুচিত হয়ে একটি সাধারণ ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। অতিবিশাল এই ক্লাস্টারের আকার হবে এখানে থাকা সবচেয়ে ছোট গ্যালাক্সির চেয়েও ছোট। ছবি: এস্ট্রোনমি নাউ

পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে এটা প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত হয়েছে যে, গ্যালাক্সিগুলো একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। তাই বলা যায় মহাবিশ্ব স্থির অবস্থায় নেই, গতিশীল বা চলমান অবস্থায় আছে। গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এর মানে হলো মহাবিশ্ব প্রসারিত হচ্ছে। গ্যালাক্সিগুলো যেহেতু একটি নির্দিষ্ট হারে একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, তাই সেখান থেকে অনুমান করা হয় অনেক অনেক আগের কোনো এক সময়ে এসব গ্যালাক্সি নিশ্চয়ই একত্রিত অবস্থায় ছিল। ধারণা করা হয় সময়টা ১৩.৮ বিলিয়ন বছর আগে।

মনে করা হয় ঐ সময়ে কল্পনাতীত বিশাল এক বিস্ফোরণ সংঘটিত হয়। ঐ বিস্ফোরণে একত্রে পুঞ্জিভূত থাকা মহাবিশ্বের সকল পদার্থ প্রচণ্ড বেগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। পরবর্তীতে এসব পদার্থ আলাদা আলাদাভাবে ঘনীভূত হয়। গ্যালাক্সি হিসেবে বর্তমানে আমরা যাদেরকে দেখতে পাই তারা সকলেই আসলে সেসব ঘনীভূত পদার্থের ফল। আলাদা আলাদা অঞ্চলে ঘনীভূত হয়ে জন্ম নিয়েছে আলাদা আলাদা গ্যালাক্সি। যে বিস্ফোরণের ফলে গ্যালাক্সিগুলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে এবং পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে সেই বিস্ফোরণটিকে বলা হয় ‘বিগ ব্যাং’।

সৃষ্টির শুরুতে এই মহাবিশ্বের সকল পদার্থ একত্রে পুঞ্জীভূত ছিল। ছবি: সেন্টার ফর থিওরিটিক্যাল কসমোলজি – ইউনিভার্সিটি অব ক্যামব্রিজ/সম্পাদনা: লেখক

বিশ্ব সৃষ্টিতত্ত্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি প্রশ্নের মাঝে একটি হচ্ছে- মহাবিশ্বের এই প্রসারণ কি চিরকাল চলতেই থাকবে? নাকি ভবিষ্যতে কোনো এক সময় প্রসারণ বন্ধ হয়ে সংকোচন শুরু হবে? এর স্পষ্ট কোনো উত্তর এখনো জানা নেই। মহাবিশ্ব যদি চিরকাল প্রসারিত হতেই থাকে, তাহলে এ ধরনের মহাবিশ্বকে বলে ‘উন্মুক্ত মহাবিশ্ব’। যদি প্রসারণ বন্ধ হয়ে যায় এবং সংকোচন শুরু হয় তাহলে এ ধরনের মহাবিশ্বকে বলে ‘বদ্ধ মহাবিশ্ব’।

আমাদের এই মহাবিশ্ব কি বদ্ধ নাকি উন্মুক্ত? এই মহা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি জ্যোতির্বিজ্ঞানীদেরকে তাড়িরে বেড়ায় সবসময়। মহাবিশ্বের অন্তিম পরিণতি- মহাবিশ্বের চূড়ান্ত নিয়তি নির্ভর করে এ প্রশ্নের উত্তরের উপর। বেশ কিছু বিজ্ঞানভিত্তিক সাক্ষ্য-প্রমাণ বলে মহাবিশ্ব উন্মুক্ত। তবে এটি পুরোপুরি নিশ্চিত নয়।

ধরে নিলাম মহাবিশ্ব উন্মুক্ত। যদি উন্মুক্ত হয়, তাহলে এর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে? গ্যালাক্সিগুলো যেহেতু মহাবিশ্বের মূল উপাদান, তাই প্রশ্নটিকে আমরা গ্যালাক্সির সাপেক্ষেও করতে পারি। এভাবে মহাবিশ্ব যদি উন্মুক্ত হয়, তাহলে অতি দীর্ঘ সময় পরে গ্যালাক্সিগুলোর কী পরিণতি হবে? একটি সাধারণ (Typical) গ্যালাক্সির কথা বিবেচনা করি। এ ধরনের একটি গ্যালাক্সি মূলত অনেকগুলো নক্ষত্রের সমন্বয়ে গঠিত। প্রত্যেক নক্ষত্রই সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। সময় শেষ হলে আয়ু ফুরিয়ে গেলে সেসব নক্ষত্র মারাও যায়। এটাকে বলা যায় ‘নক্ষত্রের চূড়ান্ত পর্যায়’। এই পর্যায়ে পৌঁছার পর নক্ষত্রের মাঝে তেমন কোনো পরিবর্তন সাধিত হয় না, যা হয় তা খুবই সামান্য। এই সামান্যটুকু হতেও অতি বিশাল সময়ের প্রয়োজন হয়। কমপক্ষে দশ বিলিয়ন বছর লাগে।

তিন উপায়ে নক্ষত্রের মৃত্যু হতে পারে। শ্বেত বামন, নিউট্রন নক্ষত্র ও ব্ল্যাকহোল। এই তিন পর্যায়ে নক্ষত্রের উপাদানগুলো অত্যন্ত ঘনীভূত অবস্থায় থাকে। এদের মাঝে যে নক্ষত্রে উপাদানগুলো সবচেয়ে বেশি ঘনীভূত অবস্থায় থাকে সেগুলোকে বলা হয় ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ বিবর।

নক্ষত্রের তিন ধরনের মৃত্যুর পর্যায়। ছবি: গেমার ডট কম/সম্পাদনা: লেখক

যদি যথেষ্ট সময় দেয়া হয়, তাহলে একসময় না একসময় একটি গ্যালাক্সির সকল নক্ষত্রই মারা যাবে। সেসব নক্ষত্রের কোনো কোনোটি শ্বেত বামন হবে, কোনো কোনোটি নিউট্রন নক্ষত্র হবে আর কোনো কোনোটি হবে ব্ল্যাকহোল। কোনো নক্ষত্র যদি শ্বেত বামন, নিউট্রন ও ব্ল্যাকহোল এই তিন অবস্থার কোনোটিতে উপনীত হয়, তাহলে আমরা সেই নক্ষত্রকে বলতে পারি মৃত নক্ষত্র। কোনো গ্যালাক্সির সবগুলো নক্ষত্র মরে যেতে একশো বিলিয়ন থেকে এক হাজার বিলিয়ন বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে। মোটামুটিভাবে এক হাজার বিলিয়ন বছরের ভেতর একটি গ্যালাক্সি মৃত নক্ষত্র দিয়ে পরিপূর্ণ হয়ে যাবে। নক্ষত্রের উত্তাপের অনুপস্থিতিতে পুরো গ্যালাক্সিজুড়ে বিরাজ করবে শীতলতা আর শীতলতা। গ্রহ, উপগ্রহ ও অন্যান্য ক্ষুদ্র বস্তুর মাঝে তখনো পারস্পরিক আকর্ষণ বিদ্যমান থাকবে। উন্মুক্ত মহাবিশ্বে গ্যালাক্সিগুলো তখনো একে অপরের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে। ফলে গ্যালাক্সিগুলোর মাঝে পারস্পরিক দূরত্বও বেড়ে যাবে অনেক।

এই অবস্থায় পৌঁছানোর পর গ্যালাক্সিগুলোতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে আরো অতি-বিশাল সময় পার হয়ে যাবে। মৃত নক্ষত্রগুলো অন্যান্য নক্ষত্রের সাথে সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে গ্যালাক্সি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে। এই প্রক্রিয়ায় গ্যালাক্সির প্রায় ৯৯% মৃত নক্ষত্র নিক্ষিপ্ত হয়ে বের হয়ে যাবে। প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে বিলিয়ন বিলিয়ন (১০^১৮) বছর বা বিলিয়ন বিলিয়ন বিলিয়ন (১০^২৭) বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগতে পারে।

অবশিষ্ট ১% মৃত নক্ষত্র মিলে অতি-ঘন ও অতি-সংকুচিত একটি অবস্থা সৃষ্টি করবে। এরা পরস্পর একত্র হয়ে একটি অতি ভারী ব্ল্যাকহোল সৃষ্টি করবে, যার ভর হবে সূর্যের ভরের চেয়ে বিলিয়ন গুণ বেশি। এই ব্ল্যাকহোলকে আমরা বলতে পারি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল বা দানবীয় কৃষ্ণবিবর।

অবশিষ্ট নক্ষত্রগুলো একত্র হয়ে গ্যালাক্সির কেন্দ্রে একটি সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল তৈরি করবে। ছবি: বিয়ন্ড আর্থি স্কাইস

এখানে গ্যালাক্সির যে ক্রমপরিবর্তনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে সেটাকে বলা হয় ‘গ্যালাক্সির পরিবর্তন গতিবিদ্যা’ বা Dynamical evolution of galaxy।

নক্ষত্রের তিন ধরনের মৃত্যুর কথা উল্লেখ করেছি। আরো উল্লেখ করেছি মৃত পর্যায়ে চলে গেলে নক্ষত্রের মাঝে সামান্যতম কোনো পরিবর্তন ঘটতেও দশ বিলিয়ন বা তার চেয়েও বেশি সময় লাগে। আসলে সময়ের ব্যবধান যখন কয়েক বিলিয়ন বছর হয়, তখন চূড়ান্ত অবস্থার মাঝেও কম-বেশি পরিবর্তন সম্পন্ন হয়। ব্ল্যাকহোল সাধারণত সবকিছু নিজের মধ্যে টেনে নিয়ে ধীরে ধীরে ভারী হয়। কিন্তু বিলিয়ন বিলিয়ন বছর সময়ের ব্যবধানে বিবেচনা করলে দেখা যাবে মৃত ব্ল্যাকহোলও বিকিরণ করতে করতে ধীরে ধীরে ভর হারাতে থাকে। এই ধীর প্রক্রিয়ায় বিকিরণের মাধ্যমে আস্ত ব্ল্যাকহোলও নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে। হোক সেটা অসীমতুল্য সময়, কিন্তু তারপরেও এটি এটি নিঃশেষ হবে। সূর্যের ভরের সমান কোনো ব্ল্যাকহোল এই প্রক্রিয়ায় ১০^৬৫ বছরের ভেতর নিঃশেষ হয়ে যাবে। (সূর্যের সমান ভরের নক্ষত্র সাধারণত ব্ল্যাকহোল হয় না। হিসেবের সুবিধার জন্য একক হিসেবে মাঝে মাঝে সূর্যের ভর ব্যবহার করা হয়।)

এই সময়টা অত্যন্ত বেশি। আস্ত একটি গ্যালাক্সি অত্যন্ত ধীর গতিতে মরে ভূত হয়ে একটি মাত্র ব্ল্যাকহোলে পরিণত হতে অত্যন্ত বিশাল সময় লাগে। কিন্তু সূর্যের ভরের সমান ছোট একটি ব্ল্যাকহোল বিকিরণের মাধ্যমে নিঃশেষ হতে তার চেয়েও অনেক গুণ বেশি সময় লাগবে। ব্ল্যাকহোলের বিকিরণের মাত্রা একদমই কম। স্বল্প মাত্রার কারণেই নিঃশেষ হতে এত বেশি সময় লাগে।

গ্যালাক্সির কেন্দ্রে এক বা একাধিক ব্ল্যাকহোল থাকে। এ ধরনের কেন্দ্রীয় ব্ল্যাকহোল অতি-বৃহৎ ও অত্যন্ত ভারী হয়। কেউ হয়তো প্রশ্ন করতে পারে এ ধরনের কেন্দ্রীয় ব্ল্যাকহোলের বেলায় কী ঘটবে? এটি কি চিরকাল অস্তিত্ববান থাকবে, নাকি এটিও পরিবর্তনের চক্রে ক্ষয়ে গিয়ে তার রাজসুলভ জৌলুশ হারাবে? হ্যাঁ, এরও ক্ষয় হবে। এ ধরনের কেন্দ্রীয় সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোল ১০^৯০ বছরের ভেতর ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। এর চেয়েও বৃহৎ ও ভারী ব্ল্যাকহোল আছে। সেগুলোকে বলা হয় সুপার গ্যালাকটিক ব্ল্যাকহোল। কোনো ক্লাস্টারে থাকা কয়েকটি গ্যালাক্সি একত্রিত হয়ে এ ধরনের ব্ল্যাকহোল তৈরি করে।[1] এ ধরনের অতি বৃহৎ ও অতি ভারী ব্ল্যাকহোলও ১০^১০০ বছরে বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষয়ে নিঃশেষিত ও বাষ্পীভূত অবস্থায় পরিণত হয়ে যাবে।

বিকিরণের মাধ্যমে সুপারম্যাসিভ ব্ল্যাকহোলও নিঃশেষ হয়ে যায়। ছবি: মিডিয়াম

এই প্রক্রিয়াতে ১০^১০০ বছরের মাঝে গ্যালাক্সিগুলোর সকল ব্ল্যাকহোল বিকিরণের মাধ্যমে ক্ষয়ে ক্ষয়ে সম্পূর্ণরূপে উবে যাবে। এরপর মহাবিশ্বে থাকবে শুধু শান্তশিষ্ট নিউট্রন নক্ষত্র ও শ্বেতবামন নক্ষত্র। আর থাকবে মহাজাগতিক মাপকাঠিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কিছু বস্তু। এই বস্তুগুলো গ্যালাক্সির ঘটনাবহুল সংঘর্ষের মুহূর্তে সেখান থেকে ছিটকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এই বস্তুগুলো আর মৃত নক্ষত্রগুলো তখন চির অন্ধকারময় মহাবিশ্বে অনন্তকালব্যাপী একা একা দিন পার করবে।

এই অবশিষ্ট বস্তুগুলোর মধ্যেও সূক্ষ্ম কিছু পরিবর্তন ঘটবে। তবে তা খুব ধীরগতির। সময়ও লাগবে খুব বেশি। ১০^১০০ বছরে যেখানে পুরো মহাবিশ্ব স্তিমিত হয়ে যাবে, সেখানে এসব অবশিষ্ট বস্তুর মাঝে সামান্য পরিবর্তন আসতে তারচেয়েও বেশি সময়ত লাগবে। তাহলে অবশিষ্ট বস্তুগুলোর চূড়ান্ত পরিণতি কী হবে?

এখানে এসে আমরা আরেকটা সংকটে পড়ে যাই। এই প্রশ্নের উত্তর নিশ্চিতভাবে এখনো জানা নেই। কিছু আনুমানিক ধারণা আছে। একটি সম্ভাবনা হচ্ছে শ্বেতবামন ও নিউট্রন নক্ষত্রগুলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে কৃষ্ণবিবরে পতিত হবে এবং পরবর্তীতে বিকিরণের মাধ্যমে তারাও নিঃশেষ হয়ে যাবে। কোয়ান্টাম বলবিদ্যার কিছু নিয়ম-নীতি এমনটাই বলে। এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগবে (১০^১০)^৭৬ বছর। এই সংখ্যাটি কল্পনাতীত পরিমাণ বিশাল। ‘বিলিয়ন’ শব্দটিকে এক বিলিয়ন বার লিখলে সেটি যত বড় সংখ্যা হবে তা-ও (১০^১০)^৭৬ এর তুলনায় একদম নস্যি।

মহাবিশ্বের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করার সময় মানবজাতি, মানব সভ্যতা ও প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নিয়েও আলোচনা চলে আসে। উন্মুক্ত মহাবিশ্বে অতি বৃহৎ সময়ের প্রেক্ষাপটে মানুষের ভবিষ্যৎ কী? সুদূর ভবিষ্যতে প্রাণ ও সভ্যতা কীভাবে নিজেদেরকে টিকিয়ে রাখবে? টিকে থাকার জন্য জীবন্ত প্রাণেরা কোন প্রক্রিয়ার আশ্রয় নেবে তা বলা মোটামুটি অসম্ভব। তবে প্রাণ ও সভ্যতার টিকে থাকা নির্ভর করে শক্তির উৎসের উপর। যেমন পৃথিবীর ক্ষেত্রে শক্তির উৎস হচ্ছে সূর্য। পৃথিবীর সমস্ত প্রাণ ও সভ্যতা পুরোপুরি নির্ভর করে আছে সূর্যের উপর। সূর্য না থাকলে কোনো প্রাণও টিকে থাকতে পারতো না, কোনো সভ্যতারও জন্ম হতো না।

প্রাণ ও সভ্যতা টিকে থাকে নক্ষত্রের শক্তির আশীর্বাদে। ছবি: নাসা

আগামী ১০^১০০ বছর বা তার চেয়েও বেশি সময় পর্যন্ত যথেষ্ট পরিমাণ শক্তির উৎস বিদ্যমান থাকবে। তত্ত্ব অন্তত পক্ষে সে কথাই বলে। সভ্যতা যদি ঐ সময় পর্যন্ত টিকে থাকে, তাহলে এরপর থেকেই সভ্যতাকে শক্তি সমস্যার মুখোমুখি হতে হবে। সীমাবদ্ধ কিছু শক্তি নিয়ে অনিশ্চিত দিন পার করতে হবে। এই সময়ের পরে কী ঘটবে কিংবা এই সমস্যা কাটিয়ে উঠার উপায় কী তা এখনো অমীমাংসিত রহস্য। তবে এই ব্যাপারে কিছু অনুমান ও সম্ভাবনা আছে। পরবর্তীতে এসব সম্ভাবনা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

মহাবিশ্ব সম্বন্ধে উপরে যে ধারণা প্রদান করা হয়েছে সেগুলো উন্মুক্ত মহাবিশ্ব মডেলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। উন্মুক্ত না হয়ে এই মহাবিশ্ব যদি বদ্ধ হয় তাহলে কী হবে? মহাবিশ্ব যদি বদ্ধ হয়, তাহলে এর প্রসারণ একটি নির্দিষ্ট সীমায় গিয়ে থেমে যাবে। বর্তমানে গ্যালাক্সিগুলোর মধ্যে গড় যে দূরত্ব বিদ্যমান, তা ধীরে ধীরে দ্বিগুণ পর্যন্ত হবে। এই অবস্থায় এটি ৪০ বা ৫০ বিলিয়ন বছর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকবে। এরপরই প্রসারণের উল্টো প্রক্রিয়ায় সংকুচিত হওয়া শুরু করবে। একটি সিনেমাকে যদি ব্যাকওয়ার্ডের মাধ্যমে উল্টো করে টেনে শেষ থেকে শুরুতে আনা হয়, তাহলে যেরকম হবে, মহাবিশ্বের সংকোচনের ঘটনাও সেরকমই হবে। ৯০ থেকে ১১০ বিলিয়ন বছর পরে মহাবিশ্বের ঘনত্ব অত্যন্ত বেড়ে যাবে। পাশাপাশি প্রচণ্ড উত্তপ্তও হয়ে যাবে। এর পরপরই Big Crunch বা বৃহৎ সংকোচন সংঘটিত হবে। অগ্নিবৎ উত্তাপে মহাবিশ্বের সকল বস্তু একত্রে মিলে যাবে। তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো ফাঁকা থাকবে না, সব দিক থেকে পূর্ণ হয়ে যাবে। এ যেন অনেকটা গ্রহ নক্ষত্র গ্যালাক্সির ‘সংঘবদ্ধ সংকোচন’। এই পরিস্থিতিতে কোনো প্রকার প্রাণ টিকে থাকার সম্ভাবনা একদমই ক্ষীণ। বিগ ক্রাঞ্চের পরে কী ঘটবে কিংবা সেখানে ‘পরে’ বলতে আদৌ কোনোকিছুর অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা কেউ জানে না।

বিগ ক্রাঞ্চের সময় মহাবিশ্বের সকল বস্তু একত্র হয়ে যাবে। ছবি: হাউ স্টাফ ওয়ার্কস

উন্মুক্ত মহাবিশ্ব সম্পর্কে সংক্ষেপে অনেক কিছু উল্লেখ করা হয়েছে এখানে। সম্প্রতি বিজ্ঞানীদের করা গবেষণায় এমন কিছু বেরিয়ে এসেছে যা একটু গোলমেলে। একে সঠিক হিসেবে ধরে নিলে উন্মুক্ত মহাবিশ্ব সম্পর্কে এখানে যে ধারণা প্রদান করা হয়েছে তাতে কিছু পরিবর্তন আনতে হবে। পদার্থের অন্যতম গাঠনিক উপাদান প্রোটন। এরা পরমাণুর মধ্যে একত্রিত অবস্থায় থাকে। পদার্থবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন অতি দীর্ঘ সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রোটন স্থায়ী নয়, ভারসাম্যহীন। পদার্থবিজ্ঞানীদের এই অনুমান সত্য হলে এটা মেনে নিতে হবে যে একসময় না একসময় প্রোটনগুলো পরস্পর থেকে বিশ্লিষ্ট হয়ে যাবে। সকল প্রোটন যদি আলাদা হয়ে যায় তাহলে তা মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতিতে প্রভাব রাখবে।

প্রোটনগুলো একত্রে না থেকে আলাদা হবার মানে হচ্ছে অণু-পরমাণুর রূপ পাল্টে যাওয়া। তেজস্ক্রিয় ভারী মৌলে প্রোটনগুলো দুই দলে ভাগ হয়ে যায় বলেই এ ধরনের পরমাণু ভেঙে গিয়ে স্বতন্ত্র দুটি পরমাণু তৈরি কহয়। আর অণু-পরমাণু দিয়েই পুরো মহাবিশ্ব গঠিত। প্রোটন তথা অণু-পরমাণুতে পরিবর্তন সম্পন্ন হওয়া মানে মহাবিশ্বের পরিবর্তন হওয়া। অণু-পরমাণুর সম্মিলিত ক্ষুদ্র পরিবর্তন পুরো মহাবিশ্বের আচার-আচরণে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে আসবে।

পদার্থবিজ্ঞানীরা দেখিয়েছেন বৃহৎ সময়ের প্রেক্ষাপটে প্রোটন ভারসাম্যহীন আচরণ করে। ছবি: ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক

এখন প্রশ্ন হতে পারে মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি নিয়ে এত মাথা ঘামানোর প্রয়োজন কী? এই প্রশ্নের উত্তর অন্য একটি প্রশ্নের উত্তরের মতো। বিপদ ও মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে মানুষ কেন এভারেস্টে আরোহন করে? কারণ সেখানে চ্যালেঞ্জ আছে, সমস্যা আছে। যেখানে সমস্যা আছে, সেখানেই মানুষ সমাধান খুঁজে নিতে চেষ্টা করে। মানব মনের প্রকৃতিই হচ্ছে অবিরতভাবে অনুসন্ধান করে যাওয়া এবং জ্ঞানের নতুন সীমানা তৈরি করা। মহাবিশ্ব ও মানব সভ্যতার চূড়ান্ত পরিণতি- এটা বেশ আগ্রহোদ্দীপক সমস্যা। এই চূড়ান্ত পরিণতির সাথে পদার্থবিজ্ঞান, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ও জ্ঞানের অন্যান্য শাখার মৌলিক কিছু প্রশ্ন জড়িত। মহাবিশ্বের চূড়ান্ত পরিণতি কেমন হবে তার উপর ভিত্তি করে এসব মৌলিক বিষয়ের উত্তর নির্ধারিত হবে। মহাবিশ্বের শেষ পরিণতি সম্বন্ধে ধারণা পরিষ্কার হবার মাধ্যমে জ্ঞানের এসব শাখার প্রভূত উন্নতি হতে পারে।

[টীকা ১] বিগ ব্যাংয়ের ফলে গ্যালাক্সিগুলো একে অপর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, কিন্তু কিছু কিছু গ্যালাক্সি আছে যারা নিকটবর্তী কয়েকটি গ্যালাক্সির সাথে মহাকর্ষীয় আকর্ষণে বাধা থাকে। আকর্ষণে বাধা সবগুলো গ্যালাক্সিকে একত্রে বলা হয় স্তবক বা ক্লাস্টার। পারস্পরিক আকর্ষণে তারা সকলে একসময় একত্র হয়ে যাবে তখন সেখানে সুপারগ্যালাকটিক ব্ল্যাকহোল তৈরি হবে।

বি: দ্র: বইয়ের মূল টেক্সট এবং এখানে প্রকাশিত টেক্সটের মাঝে সামান্য পার্থক্য আছে। ওয়েবসাইটের জন্য অপ্রয়োজনীয় বলে দেয়া হয়নি এখানে। বইটি যখন সম্পূর্ণভাবে কাগজে ছাপা হয়ে প্রকাশিত হবে, তখন টেক্সট মূল বইয়ের মতোই থাকবে। বিজ্ঞানের বিষয়গুলো পাঠকের বোঝার সুবিধার জন্য এখানের কোনো কোনো অংশে অনুবাদক কর্তৃক ক্ষুদ্র ব্যাখ্যা সংযোজিত হয়েছে। এখানে ব্যবহৃত কোনো ছবিই মূল বইতে ছিল না, পাঠকের অনুধাবনের সুবিধার জন্য অনুবাদক কর্তৃক সংযোজিত হয়েছে। তবে কোনোভাবেই মূল লেখকের বক্তব্যের ভাব ক্ষুন্ন করা হয়নি। প্রকাশিত বইতে অনুবাদকের সংযোজিত ব্যাখ্যা আলাদা করে নির্দেশিত থাকবে।

ফিচার ছবি: Medium

Related Articles