Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পদার্থের ক্ষত সেরে উঠবে আপনা-আপনি!

টারমিনেটর ২ চলচ্চিত্রটি হয়তো অনেকেই দেখে থাকবেন। ১৯৯১ সালে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটিতে টি-১০০০ নামের একটি রোবটকে দেখানো হয়, যা ভবিষ্যতের পৃথিবী থেকে সময় পরিভ্রমণের মাধ্যমে তৎকালীন পৃথিবীতে এসে হাজির হয়। রোবটটি এমন এক পদার্থের তৈরি যে, এটিকে যতোই গুলি করা হোক না কেন, তাতে হয়তো এর শরীরের অংশবিশেষ ফুটো হয়ে যায় অথবা শরীরের আকার বিকৃত হয়, কিন্তু সেটি খুবই স্বল্প সময়ের জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রোবটটির ক্ষতস্থান সম্পূর্ণ সেরে ওঠে। চলচ্চিত্রটি বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর হলেও, স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিভিন্ন ক্ষত মেরামত করে পূর্বের অবস্থায় ফিরে আসতে সক্ষম পদার্থ এখন আর কাল্পনিক না। অন্য অনেক বিষয়ের মতো কল্পবিজ্ঞানের এই ধারণাটিকেও বিজ্ঞানীরা বাস্তবে রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন। তারা নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছেন স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরাময় ক্ষমতা সম্পন্ন পদার্থ তথা Self Healing Material।

বিশ্বের কোনো কিছুই অবিনশ্বর না। কিছু কিছু পদার্থ হয়তো বেশি মজবুত এবং টেকসই, কিন্তু একটি নির্দিষ্ট সময় পর সব পদার্থই ক্ষয়প্রাপ্ত হয় বা ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ে। বিভিন্ন কারণে কোনো পদার্থ তার কার্যকারিতা হারাতে পারে। যেমন- অধিকাংশ পদার্থই বয়সের সাথে সাথে অত্যন্ত ধীরে ধীরে তাদের কার্যকারিতা হারায়। দৃশ্যমান কীট-পতঙ্গ থেকে রক্ষা করা সম্ভব হলেও কাঠের তৈরি আসবাবপত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় পর বিভিন্ন অনুজীবের আক্রমণে পচন ধরতে শুরু করে। প্লাস্টিকের তৈরি পদার্থও আলো এবং তাপের প্রভাবে ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে যেতে শুরু করে। লোহাতে একটা সময় পর মরচে পড়তে শুরু করে। যেসব পদার্থ নিয়মিত সচল থাকে, তারা ঘর্ষণের ফলে ক্ষয়প্রাপ্ত হতে থাকে এবং একসময় পীড়নের শেষ সীমায় উপনীত হয়ে ভেঙে পড়ে।

সূক্ষ্ম ফাটল বনাম কাঠামোগত ফাটল; Source: dwyercompanies.com

তবে প্রকৌশলী এবং বিজ্ঞানীদের কাছে পদার্থের যে ত্রুটিটি সবচেয়ে আতঙ্কের, তা হলো পদার্থের গায়ে তৈরি হওয়া সূক্ষ্ম ফাটল। কোনো পদার্থর উপর যখন তার সহ্য ক্ষমতার অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করা হয়, তখন তার গায়ে ফাটল তৈরি হতে থাকে। লোহায় মরচে পড়া বা কাঠে ঘুণে ধরা খুব সহজেই চোখে দেখা যায়। কিন্তু এ ধরনের সূক্ষ্ম ফাটল অনেক সময়ই দৃষ্টির অগোচরে রয়ে যায়। এবং এই ধরনের ফাটল সময়ের সাথে সাথে আরো চওড়া হয়ে পদার্থটিকে ব্যবহার অনুপযোগী করে তুলতে পারে অথবা এসব ফাটলের কারণে ঐ পদার্থ দ্বারা তৈরি যন্ত্র বা স্থাপনার অংশবিশেষ হঠাৎ করে কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই ভেঙে পড়তে পারে। আর ঠিক এসব সূক্ষ্ম ফাটল রোধেই সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল।

সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়ালের ধারণাটি প্রথম আসে ফাটল ধরা পদার্থ মেরামত করার প্রক্রিয়া থেকে। সাধারণত কোনো পদার্থের, বিশেষ করে প্লাস্টিক জাতীয় কোনো পদার্থের অভ্যন্তরে যখন ফাটলজনিত ত্রুটি দেখা দেয়, তখন বাইরে থেকে ইনজেকশনের মাধ্যমে পদার্থটির অভ্যন্তরে ইপক্সি জাতীয় আঠালো পদার্থ প্রবেশ করানো হয়, যা ফাটল ধরা অংশের ফাঁকা স্থানটুকু পূরণ করে এবং পদার্থটিকে জোড়া লাগাতে সাহায্য করে। কিন্তু যদি এমন হয় যে, পদার্থের ভেতরেই এই আঠালো পদার্থের যোগান থাকে, তাহলে বাইরে থেকে প্রবেশ না করিয়ে ভেতর থেকেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদার্থটির ত্রুটি মেরামত করা সম্ভব হবে। এই ধারণার উপর ভিত্তি করে ২০০১ সালে সর্বপ্রথম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক স্কট হোয়াইট, ন্যান্সি সোটোস এবং তাদের সহকর্মীরা প্রথম স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরাময় ক্ষমতা সম্পন্ন পলিমারের ধারণা দেন।

ইনজেকশনের মাধ্যমে যেভাবে ইপক্সি প্রবেশ করিয়ে ফাটল মেরামত করা হয়; Source: cdnassets.hw.net

পদার্থকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরাময়ক্ষম হিসেবে তৈরি করার প্রযুক্তিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হচ্ছে এর অভ্যন্তরে আঠালো রাসায়নিক ঘন তরল পদার্থ সম্বলিত অতি ক্ষুদ্রাকৃতির মাইক্রোক্যাপসুল অন্তর্ভুক্ত করে দেওয়া, যা পদার্থটির ফাটল জোড়া দিতে সক্ষম। এর ফলে যখনই বাইরের আঘাত অথবা কোনো কারণে পদার্থটির ভেতরে কোনো জায়গায় সূক্ষ্ম ফাটল তৈরি হবে, তখনই সে স্থানের ক্যাপসুলগুলো ভেঙে ভেতর থেকে আঠালো রাসায়নিক তরল পদার্থ বের হয়ে সে ফাটলটুকু বন্ধ করে দিবে। এর কর্মপদ্ধতি অনেকটাই ইপক্সি জাতীয় আঠালো রাসায়নিক পদার্থের মতো, যেগুলো দুটি ভিন্ন টিউবে পাওয়া যায় এবং যখন পরস্পরের সাথে এদেরকে মিশ্রিত করা হয়, তখন এরা রাসায়নিকভাবে বিক্রিয়া করে অত্যন্ত শক্ত বন্ধন সৃষ্টি করে।

ক্যাপসুলগুলোকে বিভিন্নভাবে প্লাস্টিক (পলিমার) জাতীয় পদার্থের অভ্যন্তরে ব্যবহার করা যায়। সবচেয়ে সহজ পদ্ধতিটি হচ্ছে উপরে বর্ণিত পদ্ধতি, যেখানে ক্যাপসুলগুলো ভেঙে সেগুলো ফাটল ধরা স্থানগুলো পূরণ করে দেয় এবং পদার্থটিকে জোড়া লাগিয়ে দেয়।। এছাড়াও আরেকটি পদ্ধতি আছে, যেখানে মূল প্লাস্টিকের পদার্থটি হয় পলিমারের তৈরি, কিন্তু ক্যাপসুলগুলোর ভেতরে থাকে তরল মনোমার। যখন ক্যাপসুল ভেঙে তরলগুলো বের হয়ে প্লাস্টিকের সংস্পর্শে আসে, তখন মনোমারগুলো রাসায়নিকভাবে পলিমারের সাথে বিক্রিয়া করে আরো অধিক পরিমাণ মূল প্লাস্টিক পদার্থটি তৈরির মাধ্যমে ফাটল ধরা স্থানগুলো বন্ধ করে দেয়।

ক্যাপসুল পদ্ধতি যেভাবে কাজ করে; Source: researchgate.net

তবে এ ধরনের ক্যাপসুল অন্তর্ভুক্তির একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো, এ পদ্ধতিতে ক্যাপসুলগুলোকে হতে হয় অত্যন্ত ক্ষুদ্রাকৃতির। ফলে সেগুলো খুব বেশি মেরামতকারী তরল ধারণ করতে পারে না এবং বড় আকারের ত্রুটি মেরামত করতে পারে না। এছাড়াও এ পদ্ধতিতে কোনো স্থান মাত্র একবার মেরামত করা সম্ভব হয়। মেরামতকৃত স্থান যেহেতু স্বাভাবিকভাবেই মূল পদার্থের তুলনায় অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়, তাই সে স্থানটিতে আবারও ফাটল সৃষ্টির সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু যেহেতু প্রথমবারেই সেখানকার ক্যাপসুল ব্যবহৃত হয়ে গেছে, তাই দ্বিতীয়বার পদার্থটির ফাটল মেরামত করা সম্ভব হয় না।

ক্যাপসুলগুলো যত ছোটই হোক না কেন, তা মূল পদার্থটিকে কিছুটা দুর্বল করে ফেলে। ফলে পদার্থটিতে ফাটল ধরার সম্ভাবনা বৃদ্ধি পায়। অর্থাৎ এ পদ্ধতির সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো এর আপাতবৈপরিত্য। এটি ফাটল রোধ করার জন্য ক্যাপসুল অন্তর্ভুক্ত করছে, অথচ ক্যাপসুলের অন্তর্ভুক্তির ফলে ফাটল ধরার সম্ভাবনা বেড়ে যাচ্ছে। তাছাড়া প্রকৃতিতে জীবদেহ এভাবে কাজ করে না। আমাদের শরীরের অভ্যন্তরে এরকম কোনো ক্যাপসুল নেই, যা থেকে কোনো প্রতিষেধক বের হয়ে আমাদের শরীরের কোনো ক্ষয় পূরণ করবে।

মাইক্রোভাসকুলার পদ্ধতি যেভাবে কাজ করে; Source: researchgate.net

বিজ্ঞানীরাও স্বয়ংক্রিয়ভাবে পদার্থ মেরামতের বিকল্প প্রযুক্তি হিসেবে এই পদ্ধতিটি কাজে লাগিয়েছেন। এই পদ্ধতিতে পদার্থের অভ্যন্তরে অত্যন্ত সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম টিউব জালিকার মতো ছড়িয়ে  থাকে, যাদের মধ্য দিয়ে মেরামতকারী আঠালো তরল পদার্থ প্রবাহিত হয়। এই টিউবগুলোর ব্যাস হয় প্রায় ১০০ মাইক্রন, যা মানুষের চুলের চেয়েও সূক্ষ্ম। যখনই কোনো স্থানে ফাটল তৈরি হয়, তখন সে স্থানের টিউবটি ফেটে যাওয়ায় টিউবের অভ্যন্তরের চাপ হ্রাস পাওয়ায় এর অন্যান্য প্রান্ত থেকে মেরামতকারী তরল এসে ফাটলের স্থানগুলোতে জমা হতে থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত না ফাটলটি পূর্ণ হয়ে যায়।

মাইক্রোভাসকুলার পদ্ধতি নামে পরিচিত পদ্ধতিতে ক্যাপসুল পদ্ধতির চেয়ে অন্তত ১০ গুণ বড় ফাটল মেরামত করা সম্ভব হয়। এছাড়া এর মাধ্যমে একই স্থানে একাধিকবারও মেরামত করা সম্ভব হয়। তবে এ পদ্ধতির সীমাবদ্ধতা হচ্ছে, এতে তরলগুলোকে দীর্ঘপথ পাড়ি দিয়ে গন্তব্যস্থলে আসতে হয় বলে মেরামত করার গতি অত্যন্ত ধীর। যদি ফাটল তৈরি হওয়ার গতি মেরামতের গতির চেয়েও বেশি হয়, তখন এ পদ্ধতি আর কাজ করে না। তবে কংক্রিটের ভবন, ব্রিজ প্রভৃতি স্থাপনার ক্ষেত্রে ফাটল বা ক্র্যাক অত্যন্ত ধীর গতিতে সৃষ্টি হয় বলে সেসব ক্ষেত্রে এ পদ্ধতি খুবই কার্যকর।

থার্মোপ্লাস্টিকে বুলেটের ছিদ্র স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিরাময় হওয়ার পরীক্ষা; Source: hearstapps.com

এই দুটো পদ্ধতি ছাড়াও বিজ্ঞানীরা প্রতিনিয়ত গবেষণা করে যাচ্ছেন বিভিন্ন ধরনের পদার্থের স্বয়ংক্রিয় নিরাময়ের বিভিন্ন ধরনের পদ্ধতি আবিস্কারের জন্য। এর মধ্যে বিশেষত প্লাস্টিকের ক্ষেত্রে প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিশেষ করে থার্মোপ্লাস্টিক, অর্থাৎ যে ধরনের প্লাস্টিককে তাপ দিয়ে গলিয়ে আবার ঠাণ্ডা করে নতুন করে আকৃতি দেওয়া সম্ভব, সেসব পদার্থ সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়াল হিসেবে বেশ উপযুক্ত বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। বিজ্ঞানীরা এমনকি এমন পরীক্ষাও করেছেন, যেখানে এ ধরনের প্লাস্টিকের তৈরি পাতের উপর গুলি করার পরে পাতটি বুলেটের আঘাতে উৎপন্ন তাপ ব্যবহার করে নিজে নিজেই বুলেটের ছিদ্র বন্ধ করে ফেলতে সক্ষম হয়েছে

ভবিষ্যতে সেলফ হিলিং ম্যাটেরিয়ালের উৎপাদন এবং ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে পারে। বিভিন্ন স্থাপনা, ভবন, সেতু ছাড়াও এটি ব্যবহৃত হতে পারে গাড়িতে, যেন সামান্য আঘাত তা নিজেই সারিয়ে নিতে পারে। রঙের ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার দেখা যেতে পারে, যার ফলে কোনো পৃষ্ঠ থেকে ঘষা লেগে খানিকটা রং উঠে গেলেও দ্রুতই তা নতুন রং দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যাবে। এর ব্যবহার হতে পারে পানির পাইপলাইনে, যেন কোনো স্থানে সূক্ষ্ম ছিদ্র হলেও স্বয়ংক্রিয়ভাবেই সেই ছিদ্র বন্ধ হয়ে যায়।

ফিচার ইমেজ- autonomic.beckman.illinois.edu

Related Articles