Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ওয়াটার ব্রিজ: সেতুর বুকেই চলছে জাহাজ

সাধারণত ব্রিজ বা সেতু বলতে কোনো নদীর এপাড় হতে ওপাড়ে যাওয়ার কোনো কৃত্রিম পথকে বোঝায়। নদ-নদীর উপর দিয়ে আমরা যে সেতু দেখতে পাই, তা মূলত ভারী যানবাহন বা মানুষ চলাচল করার জন্য তৈরি হয়ে থাকে। তবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এমন কিছু সেতু আছে, যেগুলো তৈরি হয়েছে বিভিন্ন খাল বা নদীর মাঝে সংযোগ স্থাপনের নিমিত্তে। ফলে সেতুগুলোর মধ্যে বয়ে চলে কৃত্রিম খাল। আর সেই খালের উপর দিয়ে চলাচল করে নৌকা বা ছোটখাটো জাহাজ। এ ধরনের সেতুগুলোকে সাধারণত জলসেতু, ইংরেজিতে ‘ওয়াটার ব্রিজ’ বা ‘এক্যুইডাক্ট‘ বলা হয়।

মেগডিবার্গ ব্রিজ

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিদ্যমান সেতুগুলোর মধ্যে মেগডিবার্গ ব্রিজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অসম্ভব সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দন কাঠামো এই সেতুটির। এর মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে জার্মানির রিন নদী থেকে ছুটে আসা অবারিত জলের ধারা। আর এই কৃত্রিম খালের দু’পাশে আছে মানুষের হাঁটার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা। জার্মানির রাজধানী বার্লিন হতে ১০০ মাইল পশ্চিমে, মেগডিবার্গ শহরে অবস্থিত সেতুটি তৈরির মূল উদ্দেশ্য ছিল বার্লিনকে রিন নদীর সাথে সংযুক্ত করে একটি নদীপথ তৈরি করা।

মেগডিবার্গ ব্রিজ; Source: youtube.com

তবে মজার ব্যাপার হলো, এই সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয় ১৮৭০ সালে, যখন পৃথিবী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে খুব বেশি অগ্রসর হয়ে উঠেনি। কিন্তু জার্মান বিজ্ঞানীরা ছিলেন অনেক সাহসী এবং বিচক্ষণ। আর সেই কারণেই তারা এ ধরনের একটি সেতু নির্মাণের আধুনিক চিন্তার পরিচয় দিতে পেরেছিলেন। তবে পরিকল্পনা থাকা সত্ত্বেও পর্যাপ্ত অর্থ ও যন্ত্রপাতির অভাবে সেসময় সেতুর কাজ শুরু করা সম্ভব হয়নি।

জার্মানি কখনো এই ব্রিজের চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসেনি। বিংশ শতাব্দীর প্রথম থেকেই এই সেতু নিয়ে অনেক ধরনের জল্পনা-কল্পনা চলতে থাকে। সেতুর জন্য প্রয়োজনীয় স্থান নির্বাচন থেকে শুরু করে পানি প্রবাহের পরিমাপ, সবকিছুর একটি বিস্তারিত খসড়া তৈরী অবস্থাতেই ছিল জার্মান সরকারের কাছে। অবশেষে ১৯৩০ সালের দিকে পুনরায় এই সেতুর পরিকল্পনা করা হয় এবং এর নির্মাণ কাজে হাত দেওয়া হয়। কিন্তু সেতুর কাজ চলাকালীন শুরু হয়ে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই সময়টাতে জার্মানির চলমান সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড কার্যত বন্ধ হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে বার্লিন প্রাচীরের মাধ্যমে জার্মানি পূর্ব ও পশ্চিম এই দুই অংশে বিভক্ত হয়ে পড়াতে সেতুটির কাজ একেবারেই বন্ধ থাকে।

পূর্ব জার্মানি ও পশ্চিম জার্মানির মধ্যকার বার্লিন দেয়াল; Source: thoughtco.com

তারপর অনেক চড়াই-উৎরাই পার হয়ে ১৯৯০ সালের দিকে বার্লিন প্রাচীর ভাঙার মাধ্যমে দুই দেশ এক হয়ে যায়। এরপর জার্মানি তাদের ফেলে রাখা উন্নয়নমূলক কাজগুলো পুনরায় একে একে শুরু করতে থাকে। কাজগুলোর মধ্যে সবচাইতে উল্লেখযোগ্য ছিল জার্মানির পানিব্যবস্থার উন্নয়ন সাধন। আর সেই পথ ধরেই মেগডিবার্গ ব্রিজের পরিকল্পনা আবার নতুন করে হালে পানি পেল। ১৯৯৭ সালে পুনঃরায় এই সেতু তৈরির কাজে হাত দেওয়া হয়। ছয় বছর পর ২০০৩ সালে সেতুটির কাজ সমাপ্ত হয় এবং সকলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়।

কৃত্রিম খালটির দুপাশে সাধারণ মানুষের যাতায়াত; Source: youtube.com

সেতুটি তৈরির পিছনে জোরালো অর্থনৈতিক কারণও ছিল। সেতুটি মূলত এলবি এবং মিটেলল্যান্ড নামক দুটি নদীকে মিলিত করেছে। এটি রিনল্যান্ড এবং বার্লিনের মধ্যে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করার এক অন্যতম মাধ্যম।

এলবি এবং মিটলল্যান্ড হ্রদের সাথে রিন নদীর যোগসূত্র স্থাপন; source: youtube.com

মেগডিবার্গ ব্রিজ লম্বায় ৯১৮ মিটার এবং উচ্চতায় ৬৯০ মিটার। এই সেতুর মধ্যে যে কৃত্রিম খাল রয়েছে তা ৩৪ মিটার লম্বা এবং ৪.২৫ মিটার গভীর। সেতুটি তৈরি করতে প্রায় ২৪ হাজার মেট্রিক টন স্টিল আর ৬৮ হাজার ঘন মিটার কংক্রিট প্রয়োজন হয়েছিল। সেতুটি মূলত বাণিজ্যিক জাহাজ, স্টিমার, লঞ্চ ইত্যাদি জলযান চলাচল করার জন্যই তৈরি করা হয়েছিল। এটি নির্মাণ করতে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ইউরো খরচ হয়। তবে বর্তমানে সেতুটি বাণিজ্যিক গুরুত্বের পাশাপাশি পর্যটন শিল্পেও অবদান রাখছে। প্রতিদিন দেশি-বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক এই সেতু দেখতে ভিড় জমায় বার্লিনে।

পন্টকাইসাইলতে এক্যুইডাক্ট

যুক্তরাজ্যে শিল্প বিপ্লবের সময় ডেনবিগশায়রের কয়লা খনির সাথে যুক্তরাজ্যের মূল নৌপথের একটি যোগসূত্র স্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। ফলে ১৭৯৫ সাল থেকে ১৮০৫ সালের মধ্যে পানি চলাচলের জন্য একটি সেতু নির্মাণ করা হয়। এটি  যুক্তরাজ্যের এলেসমেয়ার হ্রদের সাথে ডি নদীর একটি যোগসূত্র স্থাপন করে। দু’শ বছর আগে নির্মিত এই সেতু সত্যিকার অর্থেই তখনকার প্রকৌশলীদের অসাধারণ কৃতিত্বের সাক্ষর বহন করে।

পন্টকাইসালতে এক্যুইডাক্ট; Source: pontcysyllte-aqueduct.co.uk

সেতুটি লম্বায় ৩০৭ মিটার, চওড়ায় ৩.৪ মিটার এবং গভীরতায় ১.৬০ মিটার। উনিশ শতকের প্রথমার্ধে যুক্তরাজ্যের অর্থনৈতিক উন্নয়নে এই সেতুটি ব্যাপক সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এর উপর দিয়ে বিভিন্ন খনি হতে কয়লা, চুনাপাথর সহ আরও বিভিন্ন প্রয়োজনীয় মালামাল ছোট জাহাজে করে খুব সহজে পরিবহন করা যেত। বিশেষ করে ওয়েলসের কিছু পাহাড় ও সেখানকার কৃষির জন্য ব্যবহৃত খালগুলি এই কৃত্রিম খাল থেকে বেশ উপকৃত হয়।

জলসেতুর উপর দিয়ে চলমান নৌকা; Source: qualitycottages.co.uk

বর্তমানে এই সেতু দিয়ে কয়লা বা চুনাপাথর, এসব কিছুই আর পরিবহন করা হয় না। শুধুমাত্র পর্যটকদের কথা বিবেচনা করে এখনো পর্যন্ত সচল রাখা হয়েছে এটি। দিন দিন পর্যটকদের মাঝে এই সেতু নিয়ে কৌতুহল বেড়েই চলেছে। ১৯৫৪ সালের পর থেকে যুক্তরাজ্য সরকার সেতুটির দেখাশোনা করার জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করার কারণে আজও বয়ে চলেছে এই কৃত্রিম খাল।

বার্টন সুইং এক্যুইডাক্ট

যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার শহরের উপর দিয়ে বয়ে চলেছে আরওয়েল নদীটি। এই নদীর উপর ১৮৯৪ সালের দিকে তৈরি করা হয় একটি পরিবর্তনশীল জলসেতু। পরিবর্তনশীল বলা হয় কারণ, সেতুটি মূলত একটি গোল চাকতির উপর অবস্থিত, যার সাহায্য এটিকে বিভিন্ন দিকে ঘোরানো যায়।

১৮৯৪ সালে নির্মিত বার্টন সুইং এক্যুইডাক্টের ছবি; Source: pinterest.com

বার্টন সুইং এক্যুইডাক্ট সেতুটির ওজন প্রায় ১,৪৫০ টন, লম্বায় এটি ১০০ মিটার দীর্ঘ। এই সেতুতে প্রায় ৮০০ টন পানি সংরক্ষণ করা থাকে এবং যখন বড় কোনো জাহাজ এর নিচে দিয়ে যায় তখন সেতুটি পানি সহ নব্বই ডিগ্রীতে ঘুরে গিয়ে জাহাজটির জন্য জায়গা করে দেয়।

বার্টন সুইং এক্যুইডাক্ট; Source: nbnorthernpride.blogspot.com

বিশ্বে এটি একমাত্র জলসেতু, যেটি প্রয়োজন অনুযায়ী ঘোরানো যায়। এই সেতুটিকেও উনবিংশ শতাব্দীর প্রকৌশলীদের এক অনন্য কাজ বলে মানা হয়। সেতুটি ১৮৯৪ সাল থেকে শুরু করে এখনো পর্যন্ত বেশ ভালোভাবেই কার্যক্ষম রয়েছে।

ব্রাইরে এক্যুইডেক্ট

১৮৯৬ সালে ফ্রান্সে নির্মিত হয় এই জলসেতুটি। ২০০৩ সাল পর্যন্ত জার্মানির মেগডিবার্গ ব্রিজ নির্মাণের আগে এটিই ছিল সবচাইতে দীর্ঘতম জলসেতু। সেতুটি লম্বায় ৬৬২.৭ মিটার, প্রস্থে ৬ মিটার এবং গভীরতায় ২.২ মিটার। প্রায় ১৩,০০০ টন পানি পরিবহন করতে সক্ষম এই সেতুটি। ফ্রান্সের বিখ্যাত প্রকৌশলী গুস্তাভো আইফেলের অনন্য কীর্তি এই সেতু।

ব্রাইর এক্যুইডাক্ট; Source: bargewanderlust.wordpress.com

আভন এক্যুইডেক্ট

স্কটল্যান্ডের লিনিথগাও শহরের ইউনিয়ন হ্রদ এবং আভন নদীর সংযোগ স্থাপনকারী একটি সেতু হলো আভন এক্যুইডেক্ট। সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৭৬১ সালে। ২৫০ মিটার দৈর্ঘ্যের এই সেতুটি নদীর পৃষ্ঠদেশ হতে প্রায় ২৬ মিটার উপরে অবস্থিত। এই কৃত্রিম খালটির দু’পাশে মানুষের হাঁটা-চলার ব্যবস্থা রয়েছে।

আভন এক্যুইডাক্ট; Source: news.anglowelsh.co.uk

লৌহ শিল্পের বিকাশের সাথে সাথে ব্যাপক উন্নতি সাধন হয়েছে নির্মাণ শিল্পেরও। বিভিন্ন খ্যাতনামা প্রযুক্তিবিদ এসব উন্নয়নের সাথে জড়িত। উপরে আলোচিত সেতুগুলোর বাইরেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরও কিছু জলসেতু রয়েছে। তবে তাদের মধ্যে বেলজিয়ামের পোন্ট ডু সার্ট এক্যুইডাক্ট, নেদারল্যান্ডের ক্রেবারসগাত, যুক্তরাজ্যের এডসটন এক্যুইডাক্ট ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

ফিচার ইমেজ- oyethanks.com

Related Articles