Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ঐতিহাসিক গোলকুন্ডা দুর্গ: অতৃপ্ত আত্মাদের প্রতিধ্বনি

আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে কত অজানা ইতিহাস। ইতিহাসের এসব খেরো খাতা খুললেই দেখা যাবে, তাতে রয়েছে বহু আত্মত্যাগ, হিংসা ও ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী। শুধু বইয়েই যে সেগুলোর অস্তিত্ব পাওয়া যায়, তা কিন্তু নয়। বরং ইতিহাসের এ অজানা অধ্যায়গুলো জানতে পারা যায় ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থানগুলো থেকে। সেসব জায়গার প্রতিটি দেয়াল, প্রতি ইট এখনো বহন করে চলেছে রক্তে ভেজা নানা ইতিহাস। প্রাচীন রাজবাড়ি কিংবা কোনো দুর্গ বা প্রাসাদ যেন একেকটি মূর্তমান ইতিহাসের সাক্ষী।

মানুষ বরাবরই রহস্যপ্রিয়। প্রকৃতিতে রহস্যে মোড়া যেকোনো কিছুই রহস্যপ্রিয় মানুষকে চিরকাল তাড়া করে বেড়ায়। আর তাই রহস্যের খোঁজে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় ঘুরে বেড়ায়। অনুসন্ধান করতে বেরিয়ে পড়ে সেসব নানা ঐতিহাসিক স্থানের পানে যেখানে জড়িয়ে রয়েছে অত্যাচার-বর্বরতা-হত্যা-শোষণ আর অভিশাপের অজানা সব কাহিনী।

গোলকুন্ডা দুর্গ পৃথিবীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা এমনই একটি ঐতিহাসিক স্থান। দুর্গটির পরতে পরতে ছড়িয়ে রয়েছে নানা অজানা কাহিনী। তার মধ্যে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক কাহিনী। সেই সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কল্পনা মিশ্রিত গা ছমছমে কিছু গল্প। স্থানটিতে গেলে অন্তত সেরকম একটা শিউরে ওঠা অনুভূতি আপনি পেলেও পেতে পারেন। তার আগে চলুন জেনে নেয়া যাক দুর্গটি প্রতিষ্ঠার কাহিনী।

ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের গোলকুন্ডা দুর্গ। ছবিসূত্রঃ flicr.com

গোলকুন্ডা দুর্গ ভারতের অন্ধ্র প্রদেশে অবস্থিত। হায়দ্রাবাদের পশ্চিম প্রান্তে ১১ কি.মি. দূরে অবস্থিত গোলকুন্ডা দুর্গ ভারতের সবথেকে সুন্দর কেল্লাগুলোর মধ্যে অন্যতম। দুর্গের ৯ কি.মি. দূরে অবস্থিত হুসেন সাগর লেক। দুর্গটি নির্মাণে হিন্দু এবং মুসলিম দুই শাসকের ভূমিকা থাকায় দুর্গের স্থাপত্যশৈলীতে তার প্রভাব দেখা যায় প্রবলভাবে।

গোলকুন্ডা একসময় পরিচিত ছিল মানকাল নামে। ভারতের বিখ্যাত কাকাতিয়া রাজবংশের তত্ত্বাবধানে নির্মিত হয়েছিল এই দুর্গ। মুলত কাকাতিয়া সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের নিরাপত্তার অংশ হিসেবে কান্দাপল্লী দুর্গের সাথে নির্মিত হয় গোলকুন্ডা দুর্গটি। দুর্গটি একটি গ্রানাইট পাহাড়ের উপর নির্মিত। উচ্চতায় এটি ১২০ মিটার (৪৮০ ফুট), যার চারপাশে বাইরের শক্তির আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য তৈরি করা হয়েছিলো পরিখা। পরবর্তী সময়ে রানী রুদ্রমা দেবী এবং তার উত্তরাধিকারী প্রতাপারুদ্রের তত্ত্বাবধানে দুর্গটি পুনঃনির্মাণ করা হয় ও এর ভিত আরো শক্ত করে গড়ে তোলা হয়।

গোলকুন্ডা দুর্গের ভিতরের দৃশ্য। ছবিসূত্রঃ wanderful.com

এরপর মুসুনরি নায়েক তুঘলকী সেনাবাহিনীদের পরাজিত করে দুর্গের দখল নেন। ১৩৬৪ খ্রিস্টাব্দে মুসুনরি নায়েকের একটি চুক্তির অংশ হিসেবে দুর্গটি বাহমানী সুলতানকে হস্তান্তর করা হয়। বাহমানী সুলতানের অধীনে দুর্গ এবং এর পার্শ্ববর্তী অঞ্চল ধীরে ধীরে সমৃদ্ধশালী হয়ে উঠেছিল। ঠিক এ সময় তেলঙ্গানার গভর্নর হিসেবে পাঠানো হয় সুলতান কুলি কুতুব-উল-মুলককে (১৪৮৭-১৫৪৩)। ১৫০১ সালের দিকে তিনি গর্ভনর হিসেবে দায়িত্ব নেন।

বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষার জন্য স্থাপিত কামান। ছবিসূত্রঃ hauntedindia.blogspot.com

বাহমানী সুলতানের সামাজ্য ধীরে ধীরে দুর্বল হতে থাকলে সুলতান কুলি কুতুব শাহ ১৫৩৮ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে তেলঙ্গানার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। গোলকুন্ডা দুর্গকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠিত হয় কুতুব শাহী রাজবংশের সাম্রাজ্য। ৬২ বছরে কুতুব শাহী রাজবংশের প্রথম তিন সুলতান দুর্গটি সম্প্রসারিত করেন। বর্তমানে দুর্গটির যে গঠনশৈলী তা এই তিন সুলতানের অবদান।

গোলকুন্ডা দুর্গের নকশা। ছবিসূত্রঃ pinterest.com

অন্ধ্র প্রদেশের এ অঞ্চলে রয়েছে একাধিক কয়লাখনি। বহু হীরের সন্ধান দিয়েছে এই অঞ্চল। শুধু তা-ই নয়, বিখ্যাত কোহিনুর হীরের সন্ধানও মিলেছিল এই অঞ্চলে। যেখানে হীরে আছে, সেখানে লোভের ছায়া পড়বে না, তা কি কখনো হতে পারে? খনির নিচ থেকে আশ্চর্য অমূল্য রত্ন হীরের সন্ধান যেমন পাওয়া যায়, ঠিক তেমনি এ দুর্গকে ঘিরেও জড়িয়ে রয়েছে নানা অভিশপ্ত কাহিনী। শোনা যায়, এ গোলকুন্ডা দুর্গে রচিত হয়েছিল এক ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী। এমন কিছু ঘটেছিল এখানে যার জন্য এখনো ভৌতিক আবেশ রয়ে গিয়েছে এ দুর্গে!

দুর্গের বাইরের দেয়াল। ছবিসূত্রঃ The Siasat Daily

দুর্গটি কেন ধীরে ধীরে অভিশপ্ত হয়ে উঠলো তা জানার জন্য আমাদের ফিরে তাকাতে হবে কুতুব শাহী রাজবংশের দিকে। কুতুব শাহী রাজ পরিবারের বিভিন্ন সুলতানের প্রেমের কাহিনী সর্বজন বিদিত। মোহাম্মদ কুলু কুতুব শাহ প্রেমে পড়েছিলেন ভাগমতি নামের এক নারীর সৌন্দর্যের, ঠিক তেমনি এ বংশেরই আরেক সুলতান আবদুল্লাহ কুতুব শাহ প্রেমে পড়েন তারামতি নামের এক রমণীর। বংশের পঞ্চম সুলতান ভাগমতির সম্মানে শহরের নামকরণ করেন ভাগিনীগর (যা বর্তমানে হায়দ্রাবাদ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত)। আর বংশের সপ্তম সুলতান আবদুল্লা কুতুব শাহ তারামতির নামানুসারে তারামতি বারদারী সঙ্গীত অডিটোরিয়াম তৈরি করেন।

দুর্গের বাইরের দৃশ্য। ছবিসূত্রঃ cepolina.com

মূলত সুলতান আবদুল্লা কুতুব শাহকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এই কাহিনী। স্থানীয় এক গল্প থেকে জানা যায়, দুর্গের পাশের এক সরাইখানায় বিদেশী অতিথিদের জন্য তারামতি আর তার বোন প্রেমামতি নৃত্য ও গান পরিবেশন করতেন। সুলতান তারামতির গান ও নৃত্যে এতটাই মুগ্ধ হয়ে যান যে তাদের দুই বোনকে ঐ স্থান থেকে নিয়ে এসে রাখেন সুলতানের অতিথিশালায়। এরপর থেকেই এ দুই বোন সুলতানের খাস মজলিশে নৃত্য ও গান পরিবেশন করতেন।

দুর্গের উপরের দিকের ছাদ। ছবিসূত্রঃ hauntedindia

পরে এ দু’জনের নামে তারামতি সঙ্গীত মন্দির এবং প্রেমামতি নৃত্য মন্দির নামে দু’টি পৃথক বাসস্থান গড়ে তোলেন সুলতান। কিন্তু তারামতির প্রতি সুলতানের দুর্বলতা ছিল সবচেয়ে বেশি। তারামতির রূপ, গান আর নৃত্যে এতটাই মুগ্ধ হয়ে পড়েন সুলতান যে তারামতির প্রতি গভীর ভালবাসা জন্মায় তার। এ দুর্গ নাকি সেই নিবিড় প্রেমের এক নীরব সাক্ষী।

ফোর্টের পিছনের দিকের দৃশ্য। ছবিসূত্রঃ India City Trip

কিন্তু তাদের সেই ভালবাসা কোনোদিন চুড়ান্ত পরিণতি পায়নি। কেন তাদের প্রেম চুড়ান্ত পরিণতি পায়নি তা জানা না গেলেও অবাক করা একটি বিষয় হচ্ছে এ দু’বোনের কবর হয়েছিল রাজবংশের নিজস্ব কবরস্থানে, অন্যান্য সুলতানদের বিবিদের সাথে। তাদের দুজনের ভালবাসা দুর্গের প্রতিটি খিলানের জানা। পরিণতি না পাওয়া এ প্রেমের জন্যই নাকি তাদের মুক্তি মেলেনি। আর সেজন্য নাকি আজও নর্তকী তারামতির অতৃপ্ত আত্মা দুর্গে ঘুরে বেড়ায়!

দুর্গে প্রবেশের রাস্তা। ছবিসূত্রঃ hauntedindia.blogspot.com

গোলকুন্ডা দুর্গটি পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ এবং সিনেমার শুটিংয়ের জন্য অত্যন্ত জনপ্রিয় এক স্পট। দুর্গের ভেতরের অন্ধকার প্যাসেজ, ফাঁকা বিস্তৃত স্থান, বড় বড় জানালা আর অন্ধকার ভূতুড়ে পরিবেশে পর্যটকরা ভয়ের এক শীতল আবহ অনুভব করেন। অনেকেই মনে করেন দুর্গটি অভিশপ্ত। কথিত আছে দুর্গের রাজকীয় দরবার হলে তারামতি সুলতানের সামনে প্রায়ই তার সুমধুর গান এবং অপূর্ব নৃত্যশৈলী প্রদর্শন করতেন। স্থানীয় অনেকেই রাত্রিবেলা দুর্গ থেকে নুপুরের আওয়াজ আর অদ্ভুত এক গোঙানির ধ্বনি শুনতে পান। তাদের বিশ্বাস দুর্গটিতে তারামতির অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়। আবার অনেকে সুলতান আবদুল্লা কুতুব শাহের আত্মা ঘুরে বেড়ায় বলে মন্তব্য করেছেন। শোনা যায় অনেক পর্যটকই এখানে এসে নানা ভীতিকর অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছেন।

দুর্গ দেখার জন্য পর্যটকদের ভিড়। ছবিসূত্রঃ tripoto.com

সন্ধ্যার পর এ দুর্গে বহু মানুষই অনেক ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন। সূর্য ডুবলেই নাকি অদ্ভুত সব আওয়াজ ভেসে আসে এ দুর্গ থেকে। শুধু তা-ই নয়, বহু ভৌতিক অবয়বের দেখাও নাকি মেলে সেখানে! এমনকি দুর্গের ধ্বংসস্তূপ থেকেও নাকি অনেকেই অদ্ভুত সব আওয়াজ শুনেছেন।

গোলকুন্ডা দুর্গের রাতের দৃশ্য। ছবিসূত্রঃ Flickr.com

তাদের বেশির ভাগই বিশ্বাস করেন দুর্গটিতে কোনো অতৃপ্ত আত্মা ঘুরে বেড়ায়। শোনা যায়, এ দুর্গে শুটিং করতে এসেও বহু অদ্ভুত পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন শুটিংয়ের কর্মীরা, যে ঘটনার কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি তারা। বর্তমানে সন্ধ্যা ছ’টার পর এ অঞ্চলে জনসাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ।

Related Articles