Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

এক দিনের ভ্রমণে ঘুরে আসুন ঝর্ণার দেশে

জীবন আমাদের ছকে বাঁধা। কমবেশি সকলেই ব্যস্ত; কেউ কাজে, কেউ বা অলসতায়! কর্মব্যস্ত দিনিলিপিতে অবসর যা-ও বা আসে, পুরোপুরি স্বাদ নেয়ার আগেই সে মিলিয়ে যায়। দিনের পর দিন সব কয়টা ছুটি ঘরে বসে কিংবা কাছেপিঠেই ঘুরেফিরে কাটিয়ে দেবেন, পরিবারের সাথে সময় কাটাবেন অথবা বন্ধুদের আড্ডায় আনন্দে বাঁচার রসদ খুঁজে নেবেন; তাতে কি মন সায় দেয়? কখনো তো ইচ্ছে জাগবেই এই বিশাল পৃথিবীটা খানিকটা হলেও দেখে নিতে। শহরের বুকে চিরচেনা এপাশ-ওপাশ দেখতে পাওয়া মাঠে হেঁটে কি আর বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানোর সাধ মেটে! নগরে লেকের নামে ছোট্ট একটু জলাশয় কি পানির বিশালতার স্বাদ দিতে পারে কখনো? উত্তরগুলো ‘না’ হবে সবসময়।

ঘোরতর প্রকৃতিপ্রেমীও জীবিকা নির্বাহের অথবা সংসার জীবনের কঠিন যাঁতাকলে পড়ে ভ্রমণ নামের সাধের কথা প্রায় ভুলেই যায়। তাদের জীবনে ছুটি মানেই পরিবার, আত্মীয় বা বন্ধুদের দেখাসাক্ষাৎ; ঘুরে বেড়ানো মানে দাওয়াত আর কাছাকাছি দূরত্বে দিনের বেলা ঘুরেফিরে রাতে ঘরে ফিরে আসা। এসবের মাঝে কারো কারো বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস আসে, অতল জলে ভাসতে মন আনচান করে, পাহাড়ের বুনো ঘ্রাণ যেন ক্যালেন্ডারের পাতায় বন্দী ছবির ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে ডাকে। মনের দাবী মেনে কেউ কেউ ছক কাটতেও বসে, একটু যদি ঘুরে আসা যায় দূরে কোথাও! ঠিক তখন ব্যস্ত জীবনের রোজনামচা সামনে এসে সব ভেস্তে দেয়। বাস্তবতা মুখ ভেঙচি কাটে, ঘুরতে যাবার বদলে কিছু জরুরি কাজ সেরে রাখার দায়িত্ববোধ মাথায় চাপিয়ে দেয়। সেই দীর্ঘশ্বাস বুকে চেপে চুপসে যায় ঘুরতে যাবার স্বপ্ন বোনা মানুষটা। হয়তো দিনগুলো এভাবেই পেরিয়ে যাবে অন্যদের ভ্রমণ গল্প শুনে, ফেসবুকের পাতায় প্রিয়জনদের ঘুরে বেড়ানোর ছবি দেখতে দেখতেই।

আদতে কি তাই? সময় হবে না, প্রচুর খরচ, ভ্রমণের এত ঝামেলা পোহানো যাবে না, একদিনের ছুটিতে বাড়ির কাছে বনভোজনই সই; এসব ভেবে যারা দূরের দেশে পা বাড়াচ্ছেন না, তারা কি জানেন কত বড় ভুল করে চলেছেন? একদিনের ফাঁকা সময়টাই আপনি দিব্যি কাজে লাগাতে পারেন দারুণ একটা ভ্রমণে যেতে। ঘুরে বেড়াতে না বিশাল আয়োজন লাগে, না অঢেল সময়, আর না রাজ্যের খরচ। লাগে কেবল সঠিক পরিকল্পনা। তা দিয়েই এক দিনের মাঝে সাগর, পাহাড়, ঝর্ণা-ঝিরি যেকোনো জায়গা মন ভরে দেখে আসা যায়।

পানি আর পাহাড়ের নেশা অন্যদের ভ্রমণের গল্প শুনে শুনে, বই পড়ে আর ছবি দেখেই হয়েছিলো। সেই বস্তু আসলেই নেশা নাকি মোহ, যাচাই করে নিতে তাই ভ্রমণের সাথে সখ্যতা হয়েছে বেশ কিছুদিন হলো। ঝর্ণাবিলাসে নিজেকে হারিয়ে জানা গেছে, এ নেশা অনেক গভীর, মোহ নয় মোটেও। ঝিরিপথে হেঁটে চলাতেই মেলে অদ্ভুত প্রশান্তির খোঁজ। পাহাড়ের নির্জনতা এক আদিম সংগীত গেয়ে চলে, তার সুর নিরেট নেশার জাল বুনে দিয়েছে মনের গভীরে। নদীর বুকে দিনভর ভেসে বেড়িয়ে পানির গভীরতায় মুগ্ধতা বেড়েছে আরো শতগুণ। বন্ধুদের দল নিয়ে ঘুরে বেড়ানো হয় বলে এটাও জানা আছে, সময় বড় তিতা সত্য। একজনের ছুটি হয় তো অন্যজনের রাজ্যের কাজ! আর তাই ব্যাটে-বলে মিলে যখন সবার একটা দিনের ছুটি জুটে যায়, ব্যাকপ্যাক গুছিয়ে দে ছুট। কাজেই আপনি যদি সময়ের অভাবে ঘুরতে না যাওয়া কপালপোড়া দলের সদস্য হয়ে থাকেন, তবে জেনে নিন, আপনাকে একদিনের ছুটিতে দূরপাল্লার ভ্রমনের স্বাদ নেয়ায় উসকানি দিতেই এই লেখা!

ঝর্ণা-ঝিরির দেশে যা! ছবিস্বত্ত্ব: রেজওয়ান মাহমুদ

ব্যাকপ্যাকিং ট্যুর ব্যাপক জনপ্রিয় এই সময়ে। ব্যাকপ্যাকে এক সেট কাপড়, তোয়ালে, শুকনো খাবার আর পানির বোতল, খুব প্রয়োজনের অন্যান্য সামগ্রী আর জরুরি ওষুধের পুঁটুলি গুছিয়ে নিয়েই আজকাল বেরিয়ে পড়া যায় ভ্রমণে। অনেক আগে এমন সময় ছিলো যখন বেড়ানো মানেই ছিলো ভারী সুটকেস, কাপড়ের বস্তা, বিশাল আয়োজন। দিন কিন্তু পাল্টে গেছে! তো আপনি কেন পুরনো ধারণা নিয়ে বসে থাকবেন? বিশাল বহরের চিন্তা ছাড়ুন। দুই-একজন সাথী জুটিয়ে, ব্যাকপ্যাকখানা গুছিয়ে নিয়ে ঝটপট পথে নামুন এবার। শুরু হোক আপনার হুটহাট ভ্রমণের এক অন্য জীবন।

প্রথমেই জেনে রাখুন এক দিনে দূরে ভ্রমণ করার মূল শর্ত- যাত্রা তুলে রাখতে হবে রাতের জন্য। মানে যাবেন রাতে, ফিরবেন রাতে, ঘুরে বেড়াবেন মাঝের দিনটুকু। সহজ হিসেব কিন্তু। এবার এই একটা দিনে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কোথায় কোথায় ঘোরা যেতে পারে কিংবা কোথায় কোথায় আপনি অবশ্যই যেতে চাচ্ছেন, কোন খাতে কত খরচ হতে পারে, সব খুঁটিনাটি বিষয় ছক করে নিন ভালোভাবে। মাথায় রাখুন, একটি সঠিক পরিকল্পনা শত বিপত্তি পেরিয়েও আপনার ভ্রমণকে সফল করতে পারে।

পানির দেশে বেড়ানোর গল্পই হোক আজকে। ঝর্ণার রাজ্যে ডুব দিয়ে একটা ছুটির গোটা দিন কাটিয়ে দেয়া যায় কিনা ভেবে দেখুন লেখাটা পড়তে পড়তে। নতুন যারা ঝর্ণাবিলাসে যাবেন বলে ভাবছেন, তাদের জন্য আদর্শ একটি জায়গা হতে পারে মিরসরাই। এখানে আছে ছোট-বড় অনেক ঝর্ণা, সাথে আছে একরাশ মুগ্ধতা। এই মুগ্ধতার হাতছানিতেই প্রথম ভ্রমণে ছুটে গিয়েছি খৈয়াছড়া আর নাপিত্তাছড়ার বাড়ি। ঝিরির শীতল জলে পা ডুবিয়ে অনেকটা পথ পাড়ি দেয়া, পাহাড় ডিঙিয়ে নিজেকে আরেকটু উঁচুতে তুলে নেয়ার আনন্দ, শরীর আর মনের ক্লান্তি ধুয়ে দেয়া ঝর্ণাস্নান- কী নেই এই ভ্রমণে!

একদিনে ঘুরে আসা সম্ভব এমন তো আরো অনেক জায়গা রয়েছে, তবু কেন মিরসরাই? প্রথম উত্তর হলো, ঝর্ণার প্রতি অফুরান ভালোবাসা। সাঁতার না জানা মানুষদের জন্য পানিতে দাপাদাপি করার পক্ষে ঝর্ণা অপেক্ষাকৃত সুরক্ষিত জায়গা, সেটাও একটা কারণ বটে। আরো একটা উত্তর হলো মিরসরাইয়ের যাতায়াত ব্যবস্থা ভালো। আমাদের ট্যুরের প্রথম কথা মানতে গেলে অর্থাৎ এক দিনের ভ্রমণ চাইলে ভালো যাতায়াত ব্যবস্থা থাকাটা বেশ জরুরি, কেননা আপনাকে এক রাতে যাত্রা করে আলো ফোটার শুরুতেই ভ্রমণের স্থানে পৌঁছুতে হবে, পরের রাতটা ফের যাত্রাপথে কাটিয়ে সকাল সকাল ঘরে ফিরতে হবে। পরের দিনও অবসর থাকলে তো সমস্যা নেই, কিন্তু যদি ফিরে এসেই আপনাকে কাজে কিংবা ক্লাসে ছুটতে হয়, তবে ঘরে ফেরা চাই সাত সকালেই।

রাতের হাইওয়েতে যারা কখনো যাত্রা করেনি, দুর্ভাগা বলা চলে তাদের। অন্ধকারের সাথে মৃদু আলোর মিতালী করে হাইওয়ে ঠিক জেগে থাকে রাতের বেলাতেও। জানালার লাগোয়া আসনে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে আকাশে ভাগ্যক্রমে তারার দেখাও পেয়ে যান যদি, বিশ্বাস করুন, ঐ সময়টাকেও স্মৃতিতে বন্দী করে রাখতে চাইবেন আপনি। যাত্রাটা উপভোগ করতে করতেই খানিক ঘুমিয়ে নিন, শরীরে ক্লান্তি থাকলে ঝর্ণার ট্রেইলেই নাহয় ঝিমুতে বসে যেতে পারেন!

বাস থেকে আপনি নামবেন মিরসরাই বাস স্ট্যান্ডে। কাছেই বাজার আছে যেখানে কোনো হোটেলে সকালের নাস্তা সেরে নিতে পারবেন। বাসের টিকেট কাউন্টার খুললে ফিরতি টিকেট কেটে রাখবেন এ বেলাতেই। রাতে ফিরে টিকেট পাবেন, সেই আশায় বসে থাকা অনুচিত। আলো না ফুটতেই যদি গন্তব্যে পৌঁছে যান, তবে আশেপাশের কোনো চা-দোকানে অপেক্ষা করুন। খৈয়াছড়া ঘুরতে আজকাল গাইড লাগে না, তবে নাপিত্তাছড়ার অলিগলিতে পথ না চিনে ঘুরতে যাবেন না যেন। আর তা চাইলে একবারেই সারাদিনের জন্য গাইড ঠিক করে নিন, কিংবা খৈয়াছড়া ঘুরে নাপিত্তাছড়ায় যাবার পথে স্থানীয়দের গ্রাম থেকে ডেকে নিতে পারেন কাউকে। অনেক ছোট বাচ্চাও আপনাকে কিছু টাকার বিনিময়ে হাসিমুখে ঘুরিয়ে আনবে সম্পূর্ণ ট্রেইল। কিন্তু নিরাপত্তা নিয়ে বেশি চিন্তিত হলে অভিজ্ঞ কাউকেই বেছে নিন গাইড হিসেবে, তাতে অনেকটা নিশ্চিন্ত থাকবেন আপনি।

বাজার থেকেই লেগুনা পেয়ে যাবেন, খৈয়াছড়ার দিকে আরেক ধাপের যাত্রা শুরু হবে তখন। লেগুনা থেকে নেমে গ্রামের ভেতরের পথে পাবেন সিএনজির দেখা। তাতে চড়ে আরো কতখানি পথ পার করে গ্রামের বেশ ভেতরে এলে তবেই শুরু হবে হাঁটার পালা। মেঠোপথে হাঁটতে হাঁটতে আর স্থানীয়দের বাড়িঘর দেখে ক্লান্ত হবার চেয়ে বরং উৎফুল্ল হয়ে উঠতে হয়। ঐ মানুষগুলোর মাটির ঘর, উঠোনে সুখ-দুঃখের টুকরো গল্প, বাচ্চাদের উৎসুক নজর আর লাজুক হাসি আপনাকে ছুঁয়ে যাবে ঠিক। এ পথ ধরে হেঁটে কিছু সময় পরেই কানে আসবে ঝর্ণার গর্জন। দেখা পাবেন ঝিরিপথের। মিলিয়ে নেবেন, প্রথমবারের মতো যখন সেই ধ্বনি কানে আসবে, ঘোর লেগে যাবে!

এ ঝিরির পরেই খৈয়াছড়া দেখা দেবে; ছবিস্বত্ত্ব: রেজওয়ান মাহমুদ

আর অল্প দূরেই ঝর্ণা আছে জেনেও তখন অস্থির লাগবে তাকে দেখার জন্য। শেষ সময়টুক কাটতে যেন আরো অনেক সময় নেবে! আর তারপর ছোট্ট ঝিরিপথের দেখা পেয়ে পানি ছোঁয়ার তৃষ্ণা যখন প্রবল, চোখের সামনে মাথা তুলে দাঁড়াবে অপরূপ খৈয়াছড়া। প্রথম দর্শনেই নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন তার কাছে। মুগ্ধতার প্রথম ধাক্কা কাটলে জলদি পানিতে নামা চাই, পরের গন্তব্য নাপিত্তাছড়া, নাহলে ভাগে সময় কম পাবে। খৈয়াছড়ায় যত সকালে পৌঁছুতে পারবেন, তত মঙ্গল। সহজে যাওয়া যায় বলে খৈয়াছড়ায় প্রচুর মানুষ বেলা গড়ানোর সাথে সাথে ভিড় জমায়। ঝর্ণায় মনের আঁশ মিটিয়ে গা ভাসানোর সুযোগ নিতে হলে সেই ভিড় এড়ানো চাই। আর  প্রকৃতির নির্জনতার মজাই যদি না নেয়া যায়, মন কি পুরো তৃপ্ত হবে?

খৈয়াছড়ার প্রথম ধাপ, যা প্রথম দর্শনেই মায়ায় ফেলে দেবে; ছবিস্বত্ত্ব: তাহমিনা আক্তার

খৈয়াছড়া সাতটি ধাপের বিশাল এক ঝর্ণা। ধাপ পেরিয়ে উঠতে পারেন যতগুলো সম্ভব। মাটির গা বেয়ে দড়ি ধরে বেয়ে উঠতে আর নামতে গেলে এই ভ্রমণে রোমাঞ্চের মজাও কম মিলবে না। খাটুনিতে শরীর পরিশ্রান্ত হবে বটে, কিন্তু ঝর্ণা আর কুমের একেক রকম রূপ চোখ আর মনে শান্তি আনবে অনেক বেশি। খৈয়াছড়ার পাট চুকিয়ে মন একটু খারাপ করেই হয়তো ফেরার পথ ধরবেন। এ রূপ একবার দেখে কি সাধ মেটে?

মাটির গা বেয়ে দড়ি আর গাছের শেকড় ধরেই উঠতে-নামতে হবে খৈয়াছড়ার উপরের ধাপগুলো দেখতে; ছবিস্বত্ত্ব: তাহমিনা আক্তার

যাবার বেলা গ্রামের পথে খাবারের দোকান দেখবেন, নিজেদের দুপুরের খাবারের ফরমায়েশ দিয়ে যাবেন সেখানে। ঝর্ণাস্নান সেরে ফেরার পথে গিয়ে বসলেই খাবার হাজির হয়ে যাবে। ঘরের খাবারের স্বাদে ভাত-তরকারিতে পেট ঠান্ডা হবে এই বেলা। বাঁশের বেড়ার চারপাশ খোলা ছাউনির নিচে বসে অবশ্য তখন যা-ই খাবেন, সব কিছুতেই স্বাদ পেতে থাকবেন।

এমন পরিবেশে হবে দুপুরের আহার; ছবিস্বত্ত্ব: রেজওয়ান মাহমুদ

খাবার সেরে খুশি মন আর ভরা পেট নিয়ে আবার শুরু হবে পথচলা। সেই হাঁটা পথ আবার, আর তা পেরিয়ে সিএনজির জন্য দাঁড়াবেন, তারপর বড় রাস্তায় এসে ফের লেগুনার অপেক্ষা। লেগুনা এবার আপনাকে নিয়ে যাবে নয়দুয়ারী। গন্তব্যে নেমেই দেখা মিলবে গ্রামের রাস্তার। কোনো বাহন নেই সেই পথে। ট্রেইল মূলত এই ঝর্ণাতেই পাবেন। গ্রাম পেরিয়েই শুরু হবে বিশাল নাপিত্তাছড়া ট্রেইল। বুনো গন্ধে ভরপুর একটা অতো বড় পথ, হাঁটতে গিয়েই ঘোরে পড়ে যেতে হয়। ঝিরিপথের সৌন্দর্য কতটা গভীর হতে পারে, কতটা নেশায় জড়ালে মানুষ বারবার ছুটে আসে এমন পথ ধরে হাঁটতে, নাপিত্তাছড়া সেবার আমাদের তাই দেখিয়েছিলো। তুলনামূলক বেশ নির্জন এই ট্রেইলে পথ চলতে পাহাড় আর বনের নিস্তব্ধ আবেশে হারাতে পারেন নিজেকে। পায়ের নিচে শীতল জলের ধারা ক্লান্তিকে শরীরে চেপে বসতে দেয় না।

নাপিত্তাছড়াতেই দেখা মিলবে এই ঘোর লাগানো বুনোপথের; ছবিস্বত্ত্ব: রেজওয়ান মাহমুদ

কুপিকাটা কুম, টিপরা কুম, নাপিত্তাছড়া আর বাঘবিয়ানী- মোট চারটি ছোট-বড় ঝর্ণা এ ট্রেইলের প্রধান সদস্য। চারটিই দেখার সৌভাগ্য হয়েছিলো আমাদের। সুনসান বিশাল ট্রেইলে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে ক্ষণেক্ষণে নিজের মাঝেই হারিয়ে যেতে হয়, প্রতিটি মুহূর্ত ভালোলাগার একেকটা অনুভূতি দিয়ে যায় মনে-প্রাণে, সেই গল্প আসলে শব্দে বর্ণনা করার সাধ্য হয় না পুরো!

টিপরা কুমের ছোট্ট আঙিনা চোখ জুড়াবে; ছবিস্বত্ত্ব: তাহমিনা আক্তার

টিপরা কুম আর কুপিকাটা কুম আকারে ছোট ঝর্ণা। তাই বলে তাদের বাড়িতে গিয়ে বসতে মানা, তা কিন্তু নয়! একটু বসে জিরিয়ে নেবেন, আরো অনেকটা পথ তখনো বাকি। তাছাড়া অনেকটা পথ উঠতে হয় পাহাড় ডিঙিয়ে, তাতে কিন্তু কম ঝক্কি নেই।

কুপিকাটা কুমের বাড়িতে এই পাথুরে আসনে বসে একটু জিরোনো যাক এবার; ছবিস্বত্ত্ব: তাহমিনা আক্তার

আর তারপরে আপনি যাবেন বড় দুই ঝর্ণা, বাঘবিয়ানী আর নাপিত্তাছড়ার বাড়ি। আমরা আগে বাঘবিয়ানী গিয়েছিলাম। বরফ শীতল ছিলো সেদিন বাঘবিয়ানীর কুমের পানি। তাতে গা ডুবিয়ে দীর্ঘ হাঁটাপথের ক্লান্তি যা-ও বা জমে, দূর হয়ে যায় সমস্তটা। যেন আকাশ থেকে মাথা গলিয়ে নেমেছে এই সুন্দরী ঝর্ণা, প্রথম দেখায় তাকে এরকমই লাগতে পারে। হা করে অবাক চোখে তাকিয়ে দেখার মত রূপ বটে তার!

বাঘবিয়ানী চোখ দু’খানা আকাশে উঠিয়ে দেয়ার মতলব এঁটে বসে আছে; ছবিস্বত্ত্ব: তাহমিনা আক্তার

বাঘবিয়ানীতে ডুব দিয়ে উঠতে মন না চাইলেও এবার যে উঠতে হবে একটু জলদি। বেলা গড়িয়ে তখন অনেক বেজে যেতে পারে, আর সন্ধ্যা নামলে ঐ গহীন বুনো পথে দিশা হারাতে পারেন আপনি। শেষ ঝর্ণা নাপিত্তাছড়া, যার নামে ট্রেইলের নাম, সে কিন্তু তখনো আপনার অপেক্ষায় আছে। তিনটা ধারা বেয়ে পানি গড়িয়ে এসে ছোট একটা কুমে জমা হয় নাপিত্তাছড়া ঝর্ণায়। শেষ বেলায় তার বাড়িতে বসে আরেকবার শরীর আর মন ভিজিয়ে নিয়েই শেষ করুন আপনার ঝর্ণাবিলাস।

নাপিত্তাছড়া অপেক্ষায় থাকবে, হয়তো এমন রোদমাখা হাসি নিয়ে; ছবিস্বত্ত্ব: রেজওয়ান মাহমুদ

বেলা থাকতেই ফিরে আসুন গ্রামের পথে। তখন হয়তো সন্ধ্যা নামছে, মাটির রাস্তা ধরে হাঁটতে গিয়ে আপনি পেছন ফিরে তাকাবেন এক-আধবার। দূরে ঐ পাহাড়ের সারি বুকে হাহাকার তুলবে তখন। বিদায় নিচ্ছেন আপনি, বুনো গন্ধের শেষ হতে চলেছে একটু একটু করে। মন খারাপ না করে বরং তখনই সামনের ভ্রমণের জন্য জায়গা ভাবতে থাকুন। কেন বলছি এমনটা? আরে ভাই, এই একটা ঘোরলাগা ভ্রমণের পরে অতো সহজে কি আর আপনার মন শহুরে জীবনে টিকবে! খুব জলদিই আবার বের হবেন আপনি, অন্য কোনো ঝর্ণার দেশে, পাহাড়ের নেশায় নিজেকে বুঁদ করতে তর সইবে না আপনার। মিলিয়ে নেবেন কথাটা!

ফিচার ইমেজ- তাহমিনা আক্তার

Related Articles