Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ঘুরে আসুন অপরূপ নাফাখুম

নদীমাতৃক বাংলাদেশের সমতল রূপে সবাই মজলেও অনেকেই ঝর্ণার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পাশের দেশগুলোতে ছুটে যেতে চান। কিন্তু বাংলার অপার রূপ কোনো দিক থেকেই তার গুণমুগ্ধদের আকাঙ্ক্ষাকে অপূর্ণ রাখেনি। তাই পাহাড় আর ঝর্ণার অপরূপ মেলবন্ধন দেখতে চাইলে চলে যেতে হবে দূরে কোথাও না, পার্বত্য চট্টগ্রামেই!

সম্পূর্ণ পার্বত্য এলাকার বহু ঝর্ণার মাঝেও বিশেষ জায়গা দখল করে আছে কিছু জলপ্রপাত (ঝর্ণা নয়)। অনেকের কাছেই কথাটি নতুন শোনালেও বাংলাদেশে মনোমুগ্ধকর জলপ্রপাতের উপস্থিতি আরও বেশ কিছুদিন আগেই ভ্রমণপিপাসুদের নজরে আসে। আর এসব জলপ্রপাতে যাওয়াটা কিছুটা দুর্গম হওয়ায় তা যেন অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমীদের কাছে স্বর্গ। বাংলার এমনই এক নিজস্ব জলপ্রপাত নাফাখুম নিয়ে ছিল আমাদের ঘোরাঘুরির পরিকল্পনা।

নাফাখুম বান্দরবান জেলার থানচি উপজেলার রেমাক্রি বাজার থেকে প্রায় তিন ঘণ্টার হাঁটা পথ। ঢাকা থেকে বাসে বান্দরবান, সেখান থেকে চান্দের গাড়িতে (জীপে) করে যেতে হবে পাহাড়ি উঁচু-নিচু, সর্পিল রাস্তা পেরিয়ে থানচি। পথে পড়বে শৈল প্রপাত, চিম্বুক, নীলগিরি– যেখানে থামতেও পারেন চাইলে। কিন্তু এসব পেরিয়ে কখনো হাতের ডানে, কখনো বামে খাড়া ঢালে ভাসমান মেঘের চাদর দেখতে দেখতে হারিয়ে যাবেন এই পাহাড়ের দুনিয়ায়।

থানচি যাওয়ার পথে পড়ে এমন অনেক ব্রিজ আর আঁকাবাঁকা রাস্তা © রাসেল আহমেদ জয়

কখনো ঠিক সামনেই মেঘের পানে যেতে যেতে পথ বাঁয়ে মুড়ে যাবে, আবার কখনো পথের ঠিক উপরেই মেঘের দল ছুঁয়ে দেবে আপনাকে। এভাবে প্রায় ৩/৪ ঘণ্টা চলার পরে থানচি নামক ছোট একটি উপজেলায় চলে আসবেন। এরপরে মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক পাওয়াটা মুশকিল হয়ে যাবে। বিজিবি, পুলিশের কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে ঘাট থেকে সরু ইঞ্জিনচালিত নৌকা নিয়ে পাথুরে সাঙ্গু নদী বেয়ে ৩ ঘণ্টা লাগবে রেমাক্রি বাজার যেতে।

সাঙ্গু নদীর চেহারা শীতে যতটা পাথুরে, বর্ষায় ততটাই ভয়ঙ্কর। এই নদী ভ্রমণে মনের ভেতর যে একটা তীব্র অ্যাডভেঞ্চারের তৃষ্ণা জেগে উঠবে, তা বলাই বাহুল্য। এমন নাম না জানা সব মাথা উঁচু পাহাড় আর তার গা বেয়ে পড়া পানির সরু ধারার মাঝে পাথুরে নদীর তীব্র স্রোতের প্রতিকূলে যেতে গিয়ে, হারিয়ে যাবেন যেন অন্য পৃথিবীতে।

পাথুরে বাঁকের সাঙ্গু নদী © রাসেল আহমেদ জয়

তিন্দু পেরোতেই পথে পড়বে বড় পাথর, রাজা পাথর, রানী পাথর নামে স্থানীয়দের কাছে পূজনীয় কিছু বিশেষ আকৃতির পাথর। প্রকৃতির খেয়ালে হাজার বছরের ক্ষয়প্রাপ্ত অদ্ভুত সুন্দর এই বিশালাকৃতির পাথরগুলো। কিন্তু না, এখনো নাফাখুমে আপনি এসে পৌঁছাননি। সাঙ্গুর ভয়ঙ্কর রূপে হারিয়ে যেতে যেতে চলে আসবেন রেমাক্রি বাজার, সেখান থেকে সরাসরি এবার পাহাড়ের পায়ে হাঁটা পথে রওনা দিতে হবে নাফাখুমের পথে। এখানে চড়াই-উৎরাই নেই বললেই চলে। শীতকালে বেড়াতে এলে খুবই সহজ ট্রেকিং করা যাবে। রেমাক্রি খালের পানি কমে যাওয়ায় খুবই সহজে পাড় ধরে হেঁটে গেলেই নাফাখুম পাওয়া যাবে। কিন্তু পানি থাকাকালে বেশ কৌশলীভাবে কঠিন পথে ৩ বার খাল পেরিয়ে, তাতে কখনো কোমর পানি, কখনো গলা পানি, পৌঁছাতে হবে গন্তব্যে। আর ঘোর বর্ষায় এই ট্রেকিং রীতিমতো বিপজ্জনক। ৩ ঘণ্টার পায়ে হাঁটা শেষে যখন প্রবল পানির একটানা গর্জন পাবেন, বহুরূপী নাফাখুম এক ঘোরলাগা অনুভুতি নিয়ে হাজির হবে আপনার সামনে।

নদীর বুকে জলের আস্ফালন © রাসেল আহমেদ জয়

এখনো দেশের আর সব দুর্গম এলাকার মতো এখানে এক অদ্ভুত নীরবতার বাস। প্রকৃতি এখানে গভীর, ঘন, রহস্যময়! শুধু একটানা পাহাড়ি খালের পাথরে আছড়ে পড়া স্রোতের তীব্র শব্দ সত্যিই এক অন্য জগতের দ্যোতনা সৃষ্টি করে। ফিরে আসি নাফাখুমের কথায়। ‘খুম’ একটি মারমা শব্দ, যার মানে হলো ঝর্ণা বা ঝিরি। আগে ঝর্ণার ঠিক নিচে যেখানে পানি আছড়ে পড়ে, সেখানে ‘নাফ’ নামক এক ধরনের মাছ প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত। মাছগুলোর মজার বৈশিষ্ট্য হলো, সেগুলো স্রোতের বিপরীতে ঝর্ণার নিচ থেকে লাফিয়ে উপরে উঠার চেষ্টা করত। তবে এখন আর তেমন দেখা যায় না।

পানির এই উজান বেয়ে চলে বিশেষ রকম সরু ইঞ্জিনের নৌকা © রাসেল আহমেদ জয়

এই প্রপাতের চারপাশে হাজার বছর (পড়ুন লক্ষ-কোটি) ক্ষয়ের ফলে অগণিত ধাপের সৃষ্টি হয়েছে। ভরা বর্ষায় পানি প্রায় মূল প্রপাতের সমান্তরালে দু’কূল ছাপিয়ে প্রবাহিত হয়। এই কারণে নাফাখুমকে অনেক সময় ‘বাংলার নায়াগ্রা’ বলা হয়। নাফাখুমের দু’পাশে এবং পেছনে বিস্তৃত পাথুরে ঢালে নানা আকৃতির গর্ত বা কিছু ক্ষেত্রে সরু সুড়ঙ্গের দেখা পাওয়া যায়। এগুলো বেশ আগ্রহোদ্দীপক হলেও এমন কোনো গর্তে পা দেওয়া বা নেমে পড়ার চেষ্টা করাটা বেশ বোকামি এবং সেটা বিপজ্জনক হতে পারে।

হাজার বছরের ক্ষয়ে যাওয়া পাথর © রাসেল আহমেদ জয়

এই গর্ত নিয়েও একটা প্রচলিত গল্প আছে। এখানে স্থানীয় লোকেরা নাফ মাছ ধরে নাকে বড়শি আটকে গর্তে রেখে দিত। একবার এক জেলে বিশালাকৃতি এক মাছ গর্তে রাখতেই মাছের টানে সে নিজেই নাকি গর্তে পড়ে চিরকালের জন্যে হারিয়ে যায়। গল্পটি যেমনই লাগুক না কেন, কিছু গর্ত সত্যিই মূল ঝর্ণায় গিয়ে শেষ হয়েছে বলেই মনে হয়। নাফাখুমের পেছন দিকে গেলে এর উৎস খালের ধারা, দু’পাশে উঁচু পাহাড়, ঘন জঙ্গলের রূপ কিছুটা সময় আপনাকে আচ্ছন্ন করে রাখবে। প্রপাতের পেছন দিয়ে অপর পাশে যাওয়া সম্ভব। তবে বর্ষাকালে তো নয়ই, পানি কম থাকার সময়ও বিশেষ প্রস্তুতি ও হারনেস এর ব্যবহার করা উচিত কারণ, পাথুরে খালের গভীরতা অনেক জায়গাতেই বোঝা কঠিন এবং এখানে চোরা গর্তও থাকে প্রচুর। ঝর্ণার পানিতে লাফ দিয়ে শরীর জুড়িয়ে নিতে পারেন। কিন্তু সাঁতার জানা না থাকলে, পানি বেশি থাকা অবস্থায় এমন কিছু না করাই উত্তম। আর ভুলেও ঠিক ঝর্ণার উপর থেকে লাফ দিতে যাবেন না, দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা শতভাগ।

ভোরের আলোয় স্বর্গীয় নাফাখুম © লেখক

এবার ফিরে আসার পালা। এমন মনোমুগ্ধকর জায়গা ছেড়ে আসতে গেলে পেছন দিকে মন টানবেই। তবে আসার সময় পথ বদলে রেমাক্রি ঝিরি হয়ে আসতে পারেন (অনেকে এই পথেই যায়)। সুন্দর এই ঝিরিতে বসে শীতল হয়ে সরাসরি নৌকায় করে রওনা হতে হবে থানচির উদ্দেশ্যে। তবে এক্ষেত্রে আগেই নৌকার সাথে কথা বলে রাখতে হবে।

নাফাখুমের স্রোতধারা, এখান দিয়েই যাওয়া যাবে ওপার! © রাসেল আহমেদ জয়

থানচি আসা যাওয়ার পথে আরেকটি অসাধারণ স্পট তিন্দু বাজার। ছবির মতো পরিপাটি এই পাড়ায় থেকে যেতে পারেন এক রাত, যদি হাতে সময় থাকে। এখানে আসার আগেই যা ঠিক করে নিতে হবে তা হলো, কয় দিন কোথায় থাকবেন। সময়কে ঠিকভাবে ভাগ করে সেই অনুযায়ী চলা খুবই জরুরি, যদি নির্দিষ্ট দিনে ফেরত আসতে চান। কারণ, বিকেল ৪টার পরে এই এলাকায় কোনো যানবাহন পাবেন না। বিজিবি ও পুলিশকেও আগে ভাগেই জানিয়ে যাওয়া ভালো, কত দিনের পরিকল্পনা আপনার। গাইড, নৌকা, থাকার জায়গা ইত্যাদি আগেই ঠিক করে নিবেন।

যাওয়ার আগে যাবতীয় পরিকল্পনা করে নেবেন © রাসেল আহমেদ জয়

থাকার জায়গা বলতে থানচিতে আছে ‘থানচি কুটির’ ও আরও কিছু  গেস্ট হাউস। তিন্দু বাজার, রেমাক্রি বাজারে স্থানীয় ব্যবস্থায় থাকতে হবে। যেহেতু ট্রেকিং করতে হবে, অবশ্যই ট্রেকিং উপযোগী স্যান্ডেল, পোশাক, গামছা, ফার্স্ট এইড কিট ইত্যাদি সাথে রাখতে হবে। নিতে হবে স্যালাইন আর প্রচুর শুকনো খাবার, খেজুর ইত্যাদি। বর্ষাকাল ছাড়া জোঁকের ভয় নেই বললেই চলে, তবু সাবধানতার মার নেই, সাথে ছুরি আর লবণ ও রাখতে পারেন।

ফিরে আসার সময় মনে করে নিজেদের ময়লা সাথেই প্যাকেটে করে ফেরত নিয়ে আসবেন, প্রকৃতির রূপ আপনার পরে কেউ এসে ঠিক যেন আপনার মতো করেই দেখতে পায়। ফিরে আসার সময় একটু নস্টালজিয়া তো কাজ করবেই। মনে হতে পারে, নাফাখুমের পেছনের খাল বেয়ে হেঁটে যাওয়ার কথা। বলে রাখা ভালো, নাফাখুমের উৎস খাল ধরে পেছনে যেতে থাকলে পাওয়া যাবে আরও গহীনে লুকানো আমিয়াখুম জলপ্রপাতে যাওয়ার পথ, তবে সেই গল্প তোলা থাক আরেকদিনের জন্য।

ফিচার ইমেজ © রাসেল আহমেদ জয়

Related Articles