Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হ্যারি পটার ভক্তদের হাতেই কি বিলুপ্ত হবে পেঁচারা?

হ্যারি পটারের সেই তুষার সাদা পেঁচা হেডউইগের কথা মনে আছে? সারা বিশ্বজুড়ে তুমুল জনপ্রিয় এই উপন্যাস লেখার আগে হয়তো পেঁচা দিয়ে চিঠি চালাচালি করার চিন্তা কারো মাথায়ও আসেনি। বাস্তবে অসম্ভব হলেও, হ্যারি পটার উপন্যাস সিরিজ আর সিনেমার কল্যাণে ভক্তদের অনেকেই শুরু করে দিয়েছেন পেঁচা পোষার মতো কঠিন কাজটি। হ্যারি পটারের জাদুর দুনিয়ার মতো বাস্তবে পেঁচা দিয়ে চিঠি পাঠানো বেশ কষ্টের কাজ।

হ্যারি পটারের হাতে তার পেঁচা হেডউইগ; Source: Harry Potter Wiki

শুধু হ্যারি পটার সিনেমায় পেঁচা দিয়ে চিঠি পাঠাবার দৃশ্যকে বাস্তব করে তুলতে পেঁচাকে ট্রেনিং দিতে হয়েছে তিন মাস ধরে। তবে ইমেইল কিংবা মেসেঞ্জারের যুগে চিঠি আদান প্রদানে কেউ এই ঝামেলা পোহাতে না চাইলেও, থেমে নেই পেঁচা পোষার কাজটি। ইন্দোনেশিয়া আর ভারতের হ্যারি পটারের তরুণ ভক্তদের বিশাল অংশ নিজেদের পোষা পেঁচা পাবার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। তরুণ ভক্তগোষ্ঠির এই চাহিদা পূরণ করতে ইন্দোনেশিয়া আর ভারতের পাখির বাজারে হঠাৎ করেই বন্য পেঁচার আনাগোনা বেড়ে গেছে। বেশিরভাগ পেঁচারই বংশবৃদ্ধির গতি অনেক কম। আর তার সাথে অনিয়ন্ত্রিতভাবে এই পেঁচা শিকার কি এই পাখিকে অরণ্য থেকে বিলুপ্ত করবে কিনা এই নিয়েও শংকা প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদরা।

ভারত, ইন্দোনেশিয়া সহ বিভিন্ন দেশে হ্যারি পটার ভক্তদের পেঁচার প্রতি ভালোবাসাকে কেন্দ্র করে পাখি ব্যবসায়ীরা পেঁচা শিকার এবং বাণিজ্যিকভাবে তা বিক্রি শুরু করার ফলে ইতোমধ্যে অনেক প্রজাতির পেঁচা প্রকৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়ার আশংকাও করছেন পরিবেশবিদরা। ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের দেওয়া এক তথ্য অনুসারে ইন্দোনেশিয়াতে শুধু ২০১৬ সালেই ১৩ হাজারের বেশি পেঁচা বিক্রি হয়েছে। ১০ ডলার থেকে ৩০ ডলার মূল্যের এসব পেঁচার প্রথম এবং প্রধান ক্রেতা উঠতি বয়সের তরুণ হ্যারি পটার ভক্তরা। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য পেঁচার ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। হ্যারি পটারের পেঁচা পোষার বাতিক পেয়ে বসা তরুণদের হাতেই কি তাহলে বিলুপ্তির কফিনে শেষ পেরেক পড়বে ইন্দোনেশিয়া আর ভারতের পেঁচাদের?

হ্যারি পটার আসার আগে পোষা প্রাণী হিসেবে পেঁচার কদর ঠিক কতটুকু ছিলো?

ফসলের জমিতে ইঁদুর নিধন করতে বেশ প্রাচীনকাল থেকেই কৃষকরা পোষ মানাতেন পেঁচার দলকে। তবে প্রয়োজন ছাড়াও যে শখের বশে পেঁচা পুষে আনন্দ পান অনেকেই। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট থিওডোর রুজভেল্ট ছিলেন এদেরই একজন। পোষা প্রাণী হিসেবে পেঁচা তার বেশ পছন্দের ছিলো। কাকতালীয় হলেও সত্য যে, থিওডোর রুজভেল্টের পেঁচাটিও দেখতে তুষার সাদা বর্ণের, ঠিক হ্যারি পটারের হেডউইগের মতো দেখতে।

থিওডোর রুজভেল্টের পেঁচাটিকে মাউন্ট করে সংরক্ষণ করা হয়েছে; Source: American Museum of Natural History

১৯১১ সালে মাউন্ট করা পেঁচাটি রুজভেল্ট আমেরিকার মিউজিয়াম অফ ন্যাচারাল হিস্ট্রিতে প্রদর্শনীর জন্য দিয়ে দেন। এখনো সেই মাউন্ট করা পেঁচাটি মিউজিয়ামের থিওডোর রুজভেল্ট মেমোরিয়াল হলে সংরক্ষিত আছে।

বিখ্যাত চিত্রকর পাবলো পিকাসোও পেঁচাপ্রেমিক ছিলেন। কুড়িয়ে পাওয়া অসুস্থ এক পেঁচাকে যত্ন-আত্তি করে ভালোবেসে ফেলেন এই শিকারী পাখিকে।

পাবলো পিকাসোর হাতে তার পেঁচা; ; Souce: Getty Images

পেঁচা পালন এবং কিছু কথা

কিন্তু হ্যারি পটার আসার আগে পৃথিবীজুড়ে পোষা প্রাণী হিসেবে পেঁচার চাহিদা মোটেই বেশি ছিলো না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বেশ কিছু দেশে সরকারি অনুমোদন ব্যতীত পেঁচা পালন এবং বিক্রি করা নিষিদ্ধ। পেঁচা মূলত একটি নিশাচর শিকারী প্রাণী হওয়ায় গৃহপালিত পাখি হিসেবে পালনের ফলে এর দ্বারা শিশু এবং জনসাধারণের ক্ষতির আশংকা থেকেই যায়। তাই যুক্তরাষ্ট্রে কেউ স্থায়ীভাবে পেঁচার মালিক হতে পারেন না। রাতের বেলায় শিকারে নিয়োজিত থাকায় দিনের আলোয় পেঁচা দেখতে পাওয়া খুবই দুর্লভ ব্যাপার। তবে শান্তিপ্রিয় এবং মানুষের থেকে দূরত্ব বজায় রাখা এই প্রাণীটিকে তার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত করলে ফলাফল হিসেবে বড় নখ আর শক্ত ডানার আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত হওয়া খুব স্বাভাবিক। তাই পেঁচাকে পোষা প্রাণী হিসেবে ঘরে স্থান দেওয়ার আগে ভালো করে ভেবে নেয়াই শ্রেয়।

তবে হ্যারি পটারের তুষার সাদা পেঁচা হেডউইগের প্রেমে যারা পড়েছেন সেই ভক্তদের এতো সাত-পাঁচ চিন্তা করার সময় কোথায়? ইন্দোনেশিয়ার বালি আর জাভা দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে পোষা পেঁচার বাজার। ভক্তদের চাহিদা মেয়াতে বাক্সবন্দী বন্য পেঁচাদের ঠাঁই হচ্ছে এই বাজারে।

ইন্দোনেশিয়ার বাজারে পাওয়া যাচ্ছে দুর্লভ প্রজাতির বন্য পেঁচা; Souce: pinterest.com

পরিবেশে থাকা দুর্লভ এই শিকারী পাখিকে নিয়ে যারা গবেষণা করছেন তাদের মতে, ২০০১ সালে আগে যখন ইন্দোনেশিয়াতে হ্যারি পটার জনপ্রিয় হওয়ার আগে বছরে গড়ে ১০০ পেঁচা বিক্রি হতো, যার বেশিরভাগ গবেষণা কিংবা মিউজিয়ামের জন্য। ফসলের জমিতে ইঁদুর নিধন করতে ইন্দোনেশিয়া এবং ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন জায়গায় কৃষকেরা পেঁচা ব্যবহার করতেন। তবে ইঁদুর দমনের বিষ বাণিজ্যিকভাবে বাজারে আসতে শুরু করার সাথে সাথে মানুষের সাথে বেশ দূরত্ব তৈরি হয়ে যায় এই প্রাণীর। পাশাপাশি নিশাচর প্রাণী হওয়ায় দিনের বেলায় দেখা না যাবার কারণে সময়ের সাথে পেঁচার সংখ্যা পরিবর্তনের তেমন কোনো পরিসংখ্যানও নেই অনেক দেশের কাছে। তবে মানুষের মনোযোগের আড়ালে থেকে পেঁচাদের এই নির্বিঘ্ন দিনাতিপাত করার দৃশ্যপট বদলে দিয়েছে হ্যারি পটার।

জাভা দ্বীপের পেঁচার বাজারে খাঁচায় বন্দী পেঁচার কাতর দৃষ্টি; Souce: reachtheworld.org

পৃথিবীজুড়ে বেস্ট সেলার এই উপন্যাসের বদৌলতে উঠতি তরুণদের অনেকেই এখন পেঁচাকে পোষা প্রাণী হিসেবে পেতে আগ্রহী। আর ইন্দোনেশিয়া আর ভারতে এই সংখ্যা অনেক বেশি। পাশাপাশি মাংসাশী প্রাণী পেঁচার জন্য বিশেষভাবে নির্মিত খাদ্যদ্রব্য আর খাঁচার চাহিদাও বাড়ছে এই দেশগুলোতে।

বন্যেরা বনে সুন্দর

আর শুধু ২০১৬ সালের এক পরিসংখ্যান বলছে, ইন্দোনেশিয়াতে পোষা প্রাণী হিসেবে ১৩ হাজারের বেশি পেঁচা বেক্রি হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত এই পেঁচা শিকারের ফলে একদিকে যেমন বিপন্ন হচ্ছে পরিবেশের ভারসাম্য অন্যদিকে প্রকৃতি থেকে পেঁচার বেশকিছু প্রজাতির বিলুপ্তির আশংকাও করছেন অনেকে।

বিশেষজ্ঞের কাছে ট্রেনিং দিয়ে পোষ মানানো পেঁচা; Souce: telegraph.co.uk

পরিবেশবিদসহ সংবাদমাধ্যমগুলোও উঠতি বয়সের হ্যারি পটার ফ্যানদেরকে দায়ী করছেন। অনেকেই আবার এই ঘটনার জন্য দায়ী করে বসেছেন হ্যারি পটার সিরিজের লেখিকা জে কে রাউলিংকে। তবে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে রাউলিং হ্যারি পটার ভক্তদের এই নির্বিচারে পেঁচাকে পোষা প্রাণীতে পরিণত করতে অনুৎসাহিতই করেছেন

“If it is true that anybody has been influenced by my books to think that an owl would be happiest shut in a small cage and kept in a house, I would like to take this opportunity to say as forcefully as I can: please don’t”

পেঁচা কি আসলেই ভালো পোষা প্রাণী?

পেঁচার আচরণ নিয়ে গবেষক বিজ্ঞানীরাও বলছেন, পেঁচা পোষা প্রাণী হিসেবে কখনোই ভালো নয়। পেঁচার আচরণ বিশ্লেষণ করে করে দেখা গেছে এরা বরং লোকালয় এবং মানুষ থেকে দূরে থাকতেই বেশ পছন্দ করে। পাশাপাশি পেঁচাকে পোষ মানানো দুঃসাধ্য হয়ে ওঠার পেছনের আরো কিছু কারণ হলো-

  • পেঁচা পালন করতে বিশাল পরিমাণ জায়গা দরকার। সাধারণত অন্যান্য গৃহপালিত পাখির জন্য নির্মিত ছোট খাচায় পেঁচার মতো শিকারী পাখিরা অস্বস্তি বোধ করে। বেশিদিন ধরে ছোট খাঁচায় আটকে রাখলে এবং স্বাভাবিক শিকার করার সুযোগ না করে দিলে পেঁচা হিংস্র হয়ে উঠে। ফলে পোষ মানাতে চেষ্টা করা ব্যক্তির উপরেই ধারালো নখ আর দাতের সদ্ব্যবহার করে বসতে পারে এই শিকারী পাখি।
  • পেঁচা শিকারী প্রাণী হওয়ায় এটি মূলত মাংসাশী। তাই একে ফলমূল বা শাকসবজি খেতে দিয়ে লাভ নেই। প্রকৃতিতে পেঁচা সাধারণত ইঁদুর, কাঠবিড়ালি, খরগোশের মতো ছোট প্রাণীর মাংস খেয়ে বেঁচে থাকে। তাই পেঁচাকে বন্দী করে পোষ মানাতে হলে খাদ্যের পেছনে ব্যয় করতে হবে অঢেল অর্থ।
  • পেঁচাকে ট্রেনিং দেওয়া বেশ কঠিন কাজ। হ্যারি পটার সিনেমায় পেঁচা দিয়ে চিঠি পাঠাবার দৃশ্যকে বাস্তব করে তুলতে পেঁচাদেরকে বিশেষজ্ঞরা ট্রেইনিং দিয়েছেন প্রায় তিন মাসের বেশি সময় ধরে এবং প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল।
  • শিকারি পাখিরা যেহেতু বেশিরভাগ সময়ই স্বাধীনভাবে নিজেদের শিকার ধরতে সক্ষম, তাই মানুষের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে এরা তেমন গুরুত্ব দেয় না। ফলে বিশেষজ্ঞের কাছে ট্রেনিং দিয়ে পোষ মানানো পেঁচাটি যে আকাশে ছাড়ার পরে পোষকের কাছে আবার ফিরে আসবে এমন নিশ্চয়তা নেই।

তাই যথাযথ বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ছাড়া পেঁচা পালন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের অনেক দেশে আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ভারত, ইন্দোনেশিয়াসহ অনেক দেশেই এই ধরণের আইন না থাকায় অবৈধভাবে বন্য পেঁচা ধরে তা বিক্রি করা হচ্ছে সাধারণ মানুষের কাছে, যাদের একটি বড় অংশ হ্যারি পটারের অনুকরণ করেই ভয়ংকর সুন্দর এই প্রাণীকে বাড়িতে এনে খাঁচায় বন্দী করছেন।

ফিচার ইমেজ- petattack.com

Related Articles