Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মালিই কি হচ্ছে পরবর্তী সিরিয়া ?

আমাদের মনে একটা বদ্ধমূল ধারণা আছে যে, আল-কায়েদা, আইএস এবং অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন সংশ্লিষ্ট যে যুদ্ধ তা কেবল মধ্যপ্রাচ্যকেন্দ্রিক একটি সমস্যা। সে কারণে চলমান ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ’ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল থাকতে আমাদের দৃষ্টি ইরাক এবং সিরিয়ায় ঘোরাফেরা করে, কখনো কখনো বড়জোর তা আফগানিস্তান কি পাকিস্তানে এসে ঠেকে। এর বাইরে আফ্রিকার বিস্তৃত অঞ্চলঃ লিবিয়া, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া এবং মালিতে আল-কায়েদা, আইএসসহ আরো নানা নামের জঙ্গি সংগঠনগুলোর কার্যক্রম, এদের প্রসার এবং প্রতিরোধ সম্পর্কে আমরা অনেকটা অন্ধকারে থাকি বলা চলে। বাংলাদেশের প্রচলিত সংবাদমাধ্যমগুলোও খুব সহজে আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোর খবরগুলোকে পাশ কাটিয়ে যায়। অথচ এই সংকটের প্রকৃতি এবং সামগ্রিক চিত্রটা বোঝার জন্য আফ্রিকার এই দেশগুলোকে বাদ দেয়ার কোনো উপায়ই নেই।

পশ্চিম আফ্রিকার ভূমি বেষ্টির দেশ মালি, Operation World

আর সে কারণেই চলে আসে মালির কথা। বিচ্ছিন্নতাবাদ, সহিংসতা, জাতিগত কোন্দল, সামরিক অভ্যুত্থানসহ নানা রকম অস্থিতিশীলতায় আক্রান্ত দেশটি ২০১২ সাল থেকে জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। একটি দুইটি নয়, এ পর্যন্ত মালির বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত ৫টি শক্তিশালী সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠনের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে, যার মধ্যে আল-কায়েদাও রয়েছে।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনের ঘানি টানা দেশ মালি। ২০১২ সালের জঙ্গি সংগঠনগুলোর জোর তৎপরতা শুরু হওয়ার পর ঐ বছরের ডিসেম্বরেই ‘অপারেশন সারভাল’ নাম দিয়ে মালিতে সামরিক অভিযান চালায় দেশটির সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্স। সাবেক ঔপনিবেশিক শাসক ফ্রান্সের এই সেনা অভিযানের মধ্য দিয়ে ২০১২ সালে বিশ্বের নজরে এসে যায় দেশটি। জঙ্গি দমনের যত সদিচ্ছাই থাক, তাঁর সাথে মালির খনিজ প্রাচুর্যে হাত দেয়ার বাসনাও মিশে আছে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা। সম্প্রতি ফ্রান্সের নতুন প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর দায়িত্ব গ্রহণের পর মালির ভবিষ্যৎ নিয়ে আবার জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়েছে। সাবেক ফরাসি প্রেসিডেন্ট ফ্রাসোয়া ওঁলাদ যে যুদ্ধের শুরু করেছেন, ক্ষমতায় এসেই সেই যুদ্ধের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন ম্যাখোঁ

মালির বর্তমানে প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিমের সঙ্গে ম্যাখোঁ, BBC

সমস্যার শুরু কোথায়?

হস্তক্ষেপের ব্যাপারটা একেবারে হঠাৎ থেকে শুরু হয়নি । ২০১২ সালের শুরুতে মালির উত্তরাঞ্চলে অনেকগুলো বিচ্ছিন্নতাবাদী দল একত্র হয়ে এমএনএলএ জোট গঠন করে। এরপরই স্বাধীনতার দাবিতে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়। এই যুদ্ধের নেপথ্যে আছে দেশটির যাযাবর তুয়ারেগ জাতি, যাদের জনসংখ্যা প্রায় ১.৫ মিলিয়ন। এরা মালি, নাইজার, আলজেরিয়া ও লিবিয়াতে ছড়িয়ে আছে। শতাব্দীর পর শতাব্দী এরা সাহারা এলাকায় বিভিন্ন বাণিজ্যপথ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে জীবিকা নির্বাহ করতো। কিন্তু মালি ফ্রান্সের উপনিবেশ হওয়ার পর ফ্রান্সের সঙ্গে এদের তীব্র সংঘাত সৃষ্টি হয়। সে সময় অত্যাধুনিক ফ্রেঞ্চ অস্ত্রের কাছে তাদের সামান্য দেশীয় অস্ত্রে তারা পরাজিত হয় ও পরে গণহত্যার শিকার হয় এবং পরবর্তীতে চুক্তির মাধ্যমে আত্মরক্ষা করে। ১৯৬০ সালে মালি স্বাধীন হওয়ার পর তুয়ারেগরা ফের স্বাধীনতার দাবিতে অস্ত্র তুলে নেয়।

ঐতিহ্যবাহী আকাশী রঙা পোশাকে তুয়ারেগরা, Sandiego Reader

যাই হোক, তুয়ারেগ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য করার জন্য প্রাথমিকভাবে এগিয়ে আসে ‘আনসার দিনে’ নামের এক শক্তিশালী কট্টর ইসলামপন্থী জঙ্গি দল। যৌথ প্রচেষ্টায় মালির উত্তরাঞ্চল থেকে শুরু কেন্দ্রীয় সরকারের সেনাদের সরিয়েও দিতে সক্ষম হয় এই জোট। কিন্তু তারপরেই লাগে দ্বন্দ্ব। মুক্ত এলাকায় শাসনব্যবস্থা নিয়ে আনসার দিনে এবং এমএনএলএ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। একসময় তা তীব্র সহিংস রূপ নেয়। নিজ ভূমি থেকেই তুয়ারেগদের তাড়িয়ে দিতে শুরু করে আনসার দিনের যোদ্ধারা। তাদের সাথে যোগ দেয় আশেপাশের অন্যান্য জঙ্গি দল।

মালির রাজধানী বামাকো, BBC

প্রশ্ন উঠতে পারে, এই যখন অবস্থা, তখন মালির কেন্দ্রীয় সরকার কি করছিলো? দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার হলো, ঐ বছরের মার্চে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আমাদৌ তৌমানি তৌরেকে উচ্ছেদকারী সেনা ক্যুর ফলে তীব্র রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখে পড়ে দেশটি। সামরিক অভ্যুত্থানের পর আরো অনেকগুলো প্রদেশে বিদ্রোহ শুরু হয়। তৈরি হয় এক অদৃষ্টপূর্ব অরাজক পরিস্থিতির। সামরিক হস্তক্ষেপের পর দায়িত্ব নেয়া অন্তঃবর্তীকালীন সরকার ফ্রান্সের সাহায্য চেয়ে বসে। কালবিলম্ব না করে মালিতে সেনা পাঠিয়ে দেয় ফ্রান্স।

সহজ সমাধান কেন নেই?

কার্টুনিস্টের চোখে ফরাসি হস্তক্ষেপ

তাহলে দেখা যাচ্ছে, তুয়ারেগদের স্বায়ত্বশাসন এবং কেন্দ্রীয় সরকারে শক্তিশালী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারলে মালির দুঃখ ঘুচে যায়। তবে তা হচ্ছে না কেন?

স্বায়ত্ত্বশাসনের প্রসঙ্গে আসা যাক। বিশিষ্ট লেখক, সাংবাদিক ও মানবতাকর্মী স্টেফান সিমানোয়িজের মতে, মালির বর্তমান সমস্যা, তুয়ারেগ বিদ্রোহ ও ফ্রান্সের হস্তক্ষেপকে ইউরোনিয়ামের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করা যেতে পারে। তিনি লিখেছেন, “এর একটি প্রধান কারণ হতে পারে মালি ও নাইজারের সরকার তুয়ারেগকে ওই এলাকার স্বায়ত্বশাসন দিতে রাজি নয়। তাদের বসবাসের ওই এলাকায় প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদ ও পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ইউরোনিয়াম মজুদ আছে, সেই সঙ্গে আছে তেলের খনিও।” তিনি উল্লেখ করেন, “অ্যারেভা নামের ফ্রান্সের মাইনিং কোম্পানি, নাইজারের ইউরোনিয়ামের অধিকার হারিয়েছে। তারাই ব্যাখ্যা করতে পারবে, কেন ফ্রান্স মালিকে হারাতে চায় না।” এই ব্যাপারটা ফ্রান্সের স্বার্থের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার অ্যাসোসিয়েশনের তথ্য অনুযায়ী, ফ্রান্সের বিদ্যুতের শতকরা ৭৫ ভাগই উৎপাদিত হয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে, ইউরেনিয়ামকে জ্বালানী হিসেবে ব্যবহার করে। বর্তমানে বিশ্বে বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় রপ্তানীকারকও ফ্রান্স, যা তারা ইউরেনিয়াম ব্যবহার করেই করে থাকে। বস্তুত আর এই রপ্তানিতে বাৎসরিক রাজস্ব আসে প্রায় ৩ বিলিয়ন ইউরো। অন্যান্য দেশেও তারা সিমানোয়িজের উল্লেখ করা অ্যারেভা কোম্পানির মাধ্যমে পারমাণবিক প্রকল্প তৈরি করে দেয়ার কাজ নেয়। সব মিলিয়ে বলা যায়, ইউরেনিয়ামের উপর ভয়ানক রকমের নির্ভরশীল ফরাসি অর্থনীতি। তাই বলা যায়, মালির ইউরেনিয়াম-সমৃদ্ধ উত্তরাঞ্চলের অস্থিতিশীলতা ফ্রান্সের স্বার্থের জন্য ভীষণভাবে হুমকিস্বরূপ। তুয়ারেগদের সাথে ফ্রান্সের মনোমালিন্য তো অনেক পুরনো, এই সম্পদপূর্ণ এলাকাগুলো ইসলামপন্থীদের হাতে গেলেও শেষমেশ ফ্রান্সের আঁতেই ঘা লাগবে।

দ্য গ্রেট মস্ক অব জেনে, মালি। Source: Tourist-Destination.Com

অন্যদিকে দীর্ঘদিন ধরে বিদেশী অর্থায়নে নানা রকমের প্রশিক্ষণ দেয়া হলেও, মালিতে এমন কোনো সেনাবাহিনী দাঁড়ায়নি, যা সামরিক দিক থেকে শক্তিশালী এবং গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ২০১২ সালের অভ্যুত্থান হয় সেনাপ্রধান ক্যাপ্টেন সানোগোর নেতৃত্বে। একটু পেছনে তাকালে দেখা যাবে, ক্যাপ্টেন সানোগো আফ্রো-মার্কিন কমান্ডের (আফ্রিকম) বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত এক সদস্য । ৩৯ বছর বয়েসী সানোগো ১৯৮৯ সাল থেকে ২০০০ পর্যন্ত মোট ছয়বার ট্রেনিং মিশনে গিয়েছেন। এতবার প্রশিক্ষণে যাওয়ার ব্যাপারটি রীতিমত বিষ্ময়কর। ইচ্ছাকৃত হোক, আর অনিচ্ছাকৃতভাবেই হোক, মালিতে সামরিক ক্যুয়ের সঙ্গে জড়িত সেনা সদস্যদের বেশিরভাগের ক্যারিয়ারেই মার্কিন ট্রেনিংয়ের ব্যাপারটি আছে। তাছাড়া গত এক দশকে মালিতে সামরিক খাতে মার্কিন সাহায্য ১ বিলিয়নেরও বেশি। তাই ডিসেম্বরে ফ্রান্স যখন আমেরিকাকে বাদ দিয়েই মালিতে সামরিক হস্তক্ষেপ করে, আমেরিকা ও ফ্রান্সের মধ্যে মনোমালিন্যের একটা আবহ সৃষ্টি হয়। প্রশিক্ষণের ব্যাপার বাদ দিলেও মালির সেনাবাহিনী একেবারেই সুসংগঠিত নয়। সেনাপ্রধানের ভাষায়, এখন যুদ্ধ লাগলে, আমার বাহিনীর অর্ধেক সদস্যকেও যুদ্ধক্ষেত্রে নেয়া যাবে না, কারণ তারা সে জন্য প্রস্তুত নয়। অন্যদিকে জঙ্গি দলগুলোর প্রতিটি যোদ্ধাই যে কোনো মুহুর্তে যুদ্ধে নামতে প্রস্তুত।

গত পাঁচ বছরে ফরাসি সহায়তায় আনসার দিনেসহ অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনের হাতে চলে যাওয়া অনেক এলাকা পুনরুদ্ধার সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বিদেশী সহায়তায় সাময়িক উপশম হলেও বিচ্ছিন্নতাবাদ, জাতিগত কোন্দল এবং অস্থির গণতন্ত্রের সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। তাই যে কোনো সময়েই সিরিয়ার মতো ফের অরাজকতায় পর্যবসিত হতে পারে মালি।

Related Articles