Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নেভি সীল ট্রেনিং: দুর্ধর্ষ সৈনিক তৈরির অন্তরালের গল্প

নেভি সীল নামের সাথে কি রকম একটা পানি-পানি গন্ধ লেগে থাকলেও নেভি সীলের মতো নিখুঁত সর্বচর বাহিনী মনে হয় না ইতিহাস ঘেঁটে আর পাওয়া যাবে। যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনীর জল-স্থল-অন্তরীক্ষের এই অসাধারণ বাহিনীটিকে যে কেন বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর এবং চৌকস সেনাদল বলা হয় তা এর আগেও বহুবার প্রমাণ করে দিয়েছে নেভি সীলরা। অবশ্য “The Only Easy Day Was Yesterday” মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী এই ফ্রগম্যানদেরকে যেসব ট্রেনিং-এ সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে নেভি সীলের গৌরবময় সোনালী পদকটি অর্জন করতে হয়, তা কল্পনা করলেও সাধারণ মানুষের রক্ত পানি হয়ে যেতে পারে! আর আজকের বিষয়বস্তুও কোনো ইতিহাস নয়, কোনো দুঃসাহসিক মিশনের গল্পও নয়। আজকের গল্পটি হলো শুধুই নেভি সীল ট্রেনিং, যে তালিমের মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে বিশ্বের সেরা বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার মূল উপাদান।

কাউকে কখনোই নেভি সীলে ঢুকতে কখনো বাধ্য করা হয় না, এদের পুরোটাই স্বেচ্ছাসেবকদের বাহিনী। যদিও বেশিরভাগ নাবিকদেরই স্বপ্ন থাকে Sea, Air এবং Land এর এই স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীতে নিজের জায়গা পাকাপোক্ত করে নেওয়া। যুক্তরাষ্ট্র নৌবাহিনীর ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী সকল নাবিকদের জন্য নেভি সীলের দরজা খোলা, তবে তার আগে আট সপ্তাহ কর্তৃপক্ষের নিবিড় পর্যবেক্ষণে থাকতে হয়। কোনো নাবিকের অতীত জীবনে যদি মাদক কিংবা অপরাধের কালো আঁচড় কোনোভাবে লেগেই যায়, সীল হওয়ার স্বপ্ন অধরাই থেকে যেতে সামান্য অসুবিধা হবে না। দক্ষ ইংরেজি ভাষাজ্ঞান আর নিখুঁত দর্শনশক্তি নেভি সীল হতে পারার আরো দুটো বড় যোগ্যতা।

ইউএস নেভি সীলস-এর সোনালী প্রতীক

স্ক্রিনিং টেস্ট

নেভি সীল ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণ করার জন্যই নাবিকদেরকে বেশ কিছু পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয়, যাকে বলা হয় ফিজিক্যাল স্ক্রিনিং টেস্ট বা এককথায় PST। এই টেস্ট মূলত করা হয় নাবিকরা নেভি সীল ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণ করার মতো শারীরিক সামর্থ্য আছে কিনা তা দেখার জন্য।

এগুলোর মধ্যে আছে ৫০০ গজ ব্রেস্ট স্ট্রোক কিংবা সাইড স্ট্রোক সাঁতার, পুশ আপ, সিট আপ, পুল আপ এবং দৌড়ানো। নাম শুনে সহজ হতে পারে, কিন্তু বেঁধে দেওয়া সময় যে কাউকেই ট্রেনিং থেকে বিদায় করে দিতে পারে। নিচের টেবিল থেকে PST এর সামগ্রিক ধারণা সহজেই পাওয়া সম্ভব।

 

নেভি সীলের ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণ করার এই শুরুর ধাপেই ৪২% বিদায় নেয়, বাকি ৫৮% এর পরবর্তী গন্তব্য কানাডার সীমান্তবর্তী গ্রেট লেকস।

ন্যাভাল স্পেশাল ওয়ারফেয়ার প্রিপারেটরি স্কুল (৮ সপ্তাহ)

“উইন্ডি সিটি” শিকাগোর উত্তরে গেলেই চোখে পড়বে ৭ বর্গ কি.মি. এলাকার বিশাল জায়গা জুড়ে ১,১২৯টি অট্টালিকার সমন্বয়ে তৈরি ইউনাইটেড স্টেটস নেভির ন্যাভাল স্টেশন। প্রতি বছর আমেরিকান নৌবাহিনীর নামের পাশে যুক্ত হওয়া চল্লিশ হাজার নাবিকের সবাইকেই এখান থেকে ছিলছাপ্পড় মেরে নিতে হয়, আর নেভি সীলরাও এর ব্যতিক্রম নয়।

ন্যাভাল স্টেশন, গ্রেট লেকস, ইলিনয়

মূল ট্রেনিং শুরু হওয়ার আগের এই আট সপ্তাহে আবারও তাদের ধারাবাহিক স্ক্রিনিং টেস্টের মুখোমুখি হতে হয়। এটি হলো ট্রেনিং-এ অংশগ্রহণ করার জন্য সর্বশেষ স্ক্রিনিং টেস্ট। এই টেস্টে একজন নাবিককে বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে একটানা দৌড়াতে হয় চার মাইল (৩১ মিনিট), সাঁতার কাটতে হয় এক কিলোমিটার (২৪ মিনিট), পুশ আপ আর সিট আপের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় যথাক্রমে ৭০ এবং ৬০-এ। প্রায় ৯০% ব্যক্তিই এ ধাপে সফলভাবে শেষ করে, বাকি ১০%-এর জায়গা হয় নৌবাহিনীর অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জায়গায়, তবে সেটা অবশ্যই নেভি সীলের চেয়ে বেশি নয়।

বেসিক আন্ডারওয়াটার ডেমোলিশন/সীল (BUD/S) ট্রেনিং (২৪ সপ্তাহ)

বাড/স ট্রেনিং-এর এই ২৪ সপ্তাহকে ভাগ করা হয় চারটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগে। সেগুলো হলো-

  • ইনডকট্রিনেশন (৩ সপ্তাহ)

ইনডকট্রিনেশনকে যদি শুদ্ধ বাংলায় প্রকাশ করা হয় তাহলে তার মানে দাঁড়ায় মতদীক্ষাদান। বলা যায়, ট্রেনিং শুরু হওয়ার নেভি সীল নিয়ে তাদের মনোভাব বোঝার চেষ্টা করা হয়। নেভি সীলের কাজকর্ম, দায়িত্ব-কর্তব্য, নিয়ম-কানুন সম্পর্কে পরিপূর্ণ ধারণা দেওয়া হয়, একজন নেভি সীলের জীবন কি রকম তা সম্পর্কে লেকচার দেওয়া হয় এবং তারা সত্যিই এ কাজের জন্য তৈরি কিনা তা জিজ্ঞাসা করা হয়; কারণ তাদের সামনে অপেক্ষা করছে ভয়াবহ এক ট্রেনিং এবং দারুণ এক অর্জন।

  • প্রথম পর্যায়ঃ ফিজিক্যাল কন্ডিশন (৭ সপ্তাহ)

বলা যায়, এই ধাপটিই পুরো ট্রেনিং-এর সবচেয়ে কঠিন ধাপ। মাত্র ৩৩% নাবিক এই পরীক্ষা দাঁতে দাঁত চেপে রেখে শেষ করতে পারে, বাকিদের নেভি সীল হওয়ার স্বপ্ন অকালেই ঝরে পড়ে। তো কি এমন ট্রেনিং দেওয়া হয় এই ধাপে সেটাই জানা যাক।

প্রথম দুই সপ্তাহ-এর ট্রেনিংকে বলা হয় তৃতীয় সপ্তাহ-এর প্রস্তুতি; যে সপ্তাহকে বলা হয় “হেল উইক” অর্থাৎ নারকীয় সপ্তাহ। হেল উইকের এই চরম সপ্তাহ প্রতিটি নাবিকের শারীরিক সক্ষমতার চরম পরীক্ষা নেয়। এই সাতদিন মাত্র ৪ ঘন্টা ঘুমানোর সুযোগ পায় নাবিকরা, বাকি ২০ ঘন্টায় মুখোমুখি হতে হয় ভয়াবহ সব অভিজ্ঞতার। এই সপ্তাহে ঘন্টার পর ঘন্টা সমুদ্র সৈকতে শুয়ে থাকতে স্রোতের ধাক্কা অগ্রাহ্য করে, কাঁদায় মাখামাখি হয়ে পড়ে থাকতে হয়, টেলিফোন লাইনের বিশাল সব খুঁটি নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। এমনকি প্রতিদিন পাড়ি দিতে হয় ২০০ মাইল উঁচুনিচু পথ! পরবর্তী চার সপ্তাহেও চলতে থাকেই একইরকম ট্রেনিং।

ট্রেনিং শুরু করার আগে ইন্সট্রাকটরের নির্দেশ শুনে নিচ্ছে নাবিকরা

ঢেউয়ের আঘাতে পর্যুদস্ত নাবিকরা

হেল উইক ট্রেনিং শুরু হওয়ার পরেই নাবিকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে নেভি সীলে ট্রেনিং এ যোগ দেওয়া ভুল কোনো সিদ্ধান্ত ছিল কিনা এবং দুই-তৃতীয়াংশ নাবিকই এই সপ্তাহে হাল ছেড়ে দেয়! ট্রেনিং থেকে বিদায় নেওয়ার ব্যাপারটাও বেশ অদ্ভুত। নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর পুঁতে রাখা জাহাজের ঘন্টার সামনে নিজের হেলমেট রেখে তিনবার ঘন্টা বাজালেই সে সীল ট্রেনিং থেকে অব্যাহতি নিতে পারবে। এই নারকীয় সপ্তাহের শেষ হওয়ার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই সফলভাবে শেষ করা নাবিকদের মেডিকেল পরীক্ষা করা হয় দুইবার, তারা কি প্রস্তুত পরবর্তী পর্যায়ের জন্য?

বিশালাকার ভারী বস্তু নিয়ে ট্রেনিং-এ ব্যস্ত সীলরা

আত্মগোপন করার ট্রেনিং-এ কাঁদায় মাখামাখি নাবিকরা

  • দ্বিতীয় পর্যায়ঃ কমব্যাট ডাইভিং (৭ সপ্তাহ)

সীলদেরকে অন্যান্য সকল স্পেশাল ফোর্স থেকে যে জিনিসটি আলাদা করে দেয় তা হলো এই আন্ডারওয়াটার কমব্যাট ডাইভিং। বলা যায় সীল নামের তাৎপর্যটাই এই কোর্সের উপর নির্ভর করে, কারণ সীলের মতো পানির নিচে স্বচ্ছন্দে চলাফেরা, নড়াচড়া এবং দ্বন্দ্বযুদ্ধের সবকিছুই সাত সপ্তাহ ধরে চলা এই কোর্সে শেখানো হয়।

নাবিকদেরকে পিছমোড়া করে হাত-পা বেঁধে পানির নিচে ছেড়ে দেওয়া হয় এবং ঐ অবস্থাতেই সাঁতার কাটতে হয়! এছাড়াও অত্যাধুনিক প্রযুক্তির স্কুবা ডাইভিং গিয়ার ব্যবহারের নিয়মকানুনসহ ক্লোজড সার্কিট-ওপেন সার্কিট স্কুবা সাঁতারও কোর্সটির মূল বিষয়। মূলত, একজন নেভি সীলকে পানির নিচে চলাফেরাকে অভ্যস্ত করে নেওয়াই কমব্যাট ডাইভিং কোর্সের উদ্দেশ্য। এ কারণে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মিশনে শত্রুর চোখের আড়ালে থেকেই পানির নিচ দিয়ে অবাধ চলাফেরা করতে পারে নেভি সীলরা।

হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পানির নিচে সাঁতরানো নাবিকরা

  • তৃতীয় পর্যায়ঃ ল্যান্ড ওয়্যারফেয়ার (৭ সপ্তাহ)

বাড/স ট্রেনিং-এর শেষ পর্যায়ের এই সাত সপ্তাহে নেভি সীলরা ট্রেনিং নেয় মৌলিক কিছু অস্ত্রচালনা, প্যাট্রলিং-র‍্যাপেলিং, ল্যান্ড নেভিগেশনের মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিসের, যেগুলোর ফলে গভীর পানির মতো শক্ত মাটির উপরেও নাবিকরা দক্ষ হয়ে উঠতে পারে। যেকোনো ধরণের অস্ত্রচালনা, গ্রেনেড/বিস্ফোরক ব্যবহারের মূল ধারণাটি এই কোর্স থেকেই পায় তারা।

মৌলিক অস্ত্রচালনা বিষয়ক ট্রেনিং

বিস্ফোরক সংক্রান্ত ট্রেনিং

প্যারাশুট জাম্প স্কুল (৩ সপ্তাহ)

বাদামী-সবুজ স্থল আর নীল জলে নিজেদের ট্রেনিং শেষ করার পর নেভি সীলদের পরবর্তী কাজ বিশাল আকাশেও নিজেদের দক্ষতাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। ক্যালিফোর্নিয়ার স্যান ডিয়েগোতে ৩ সপ্তাহ ধরে চলা এই কোর্সের শুরুটা হয় স্ট্যাটিক লাইন প্যারাশুট জাম্পের মাধ্যমে, যেখানে নিরাপদ দূরত্বে আসার সাথে সাথেই এয়ারক্র্যাফটে লাগানো দড়ির ধাক্কায় প্যারাশুট স্বয়ংক্রিয়ভাবে খুলে যাবে। ৩ সপ্তাহ পর যখন নেভি সীলরা শেষ ধাপের দিকে পা বাড়ায় তখন তাদের ঝুলিতে যোগ হয় রাতের অন্ধকারে ১০ হাজার ফিট উপর থেকে কোনো রকম নিরাপত্তা ছাড়াই ঝাঁপ দেওয়ার মতো অভিজ্ঞতা!

কুকুরসহ বিমান থেকে লাফ দিচ্ছেন ট্রেনিংরত এক সীল

সীল কোয়ালিফিকেশন ট্রেনিং (২৬ সপ্তাহ)

নেভি সীলের সোনালী নোঙরের পদকটা হাতে পাওয়ার জন্য নাবিকদেরকে অপেক্ষা করতে হয় আরও ২৬ সপ্তাহ। এ সময় যুদ্ধক্ষেত্রে কিভাবে একজন সীল চলাফেরা করবে সে সম্পর্কেই ট্রেনিং দেওয়া হয়। খালি হাতে শত্রুকে পরাস্ত করা, আহত সহযোদ্ধাকে সাহায্য করার মেডিকেল ট্রেনিং, শত্রুদের কাছে বন্দী থাকা অবস্থায় পালানো, মরুভূমি-বরফাঞ্চলে বেঁচে থাকার কৌশল, শত্রুদলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলাসহ বিভিন্ন জীবন বাঁচানো ট্রেনিং-এর মাধ্যমে শেষ হয় নেভি সীলের সকল সদস্যের মূল ট্রেনিং।

সীল ট্রুপ ট্রেনিং (স্পেশাল)

নেভি সীল ট্রেনিংকে বলা যায় ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ অবস্থা। দীর্ঘ ৬১ সপ্তাহ বিভিন উত্থাল-পাথাল অবস্থায় যাওয়ার পরও সীলদেরকে ট্রেনিং করতে হয় নিজেদের যোগ দেওয়া ডিপার্টমেন্টের ধরণের উপর। যেমনঃ কেউ স্নাইপার ডিভিশনে যোগ দিলে তাকে অবশ্যই স্নাইপিং-এর উপর আলাদা অতিরিক্ত ট্রেনিং করতে হবে। এছাড়াও নিজেদের প্লাটুন-রেজিমেন্ট-এর মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার জন্য আলাদাভাবে গ্রুপ-লেভেল ট্রেনিং এবং ইউনিট লেভেল ট্রেনিং করতে হয় যা প্রায় ৬ মাস ধরে চলে!

এভাবেই প্রায় দুই বছর ট্রেনিং-এর মাধ্যমে তৈরি হয় নেভি সীলের একেকজন দুর্ধর্ষ সৈনিক যাদের জীবনে “No Easy Day”-এর কোনো স্থান নেই।

 

Related Articles