Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

রহস্যময় হত্যাকাণ্ডের রাজসাক্ষী যখন তোতাপাখি

প্রভুভক্ত প্রাণী হিসেবে কুকুর, আদুরে প্রাণী হিসেবে বিড়াল আর কথা বলিয়ে প্রাণী হিসেবে তোতাপাখির কদরই আলাদা। তবে নেহাত শখ পূরণ, আহ্লাদ দেখানো বা ঘরের শোভা বর্ধনের চেয়েও ঢের গুরুত্বপূর্ণ কাজ যে এসব প্রাণী করতে পারে তা প্রমাণ করে দেখিয়েছে মিশিগানের একটি তোতাপাখি, বাড তার নাম। তার মালিকের রহস্যময় মৃত্যুর কূলকিনারা খুঁজতে গিয়ে পুলিশেরও যখন হিমশিম খাওয়ার দশা, তখনই সাক্ষী হিসেবে বাডের আবির্ভাব খুলে দেয় মিশিগানে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ডের জটিল প্যাঁচ।

ডেট্রোয়েট নিউজের বরাতে জানা যায়, ২০১৫ সালের মে মাসের ২৫ তারিখে রহস্যময় এক গুলির আঘাতে মারা যায় মার্টিন ডুরাম। পর পর পাঁচ রাউন্ড গুলি করা হয় তাকে। কে তাকে গুলি করে আর কেনই বা গুলি করে এই প্রশ্নের কোনো উত্তর খুঁজে পাচ্ছিল না পুলিশ। সাদাসিধে এই ভালো মানুষটার উপর কার এত ক্ষোভ থাকতে পারে তা ভাবতে ভাবতে হয়রান হয়ে যায় আত্মীয়-স্বজনরা।

বছর দুয়েক পার হয়ে যাওয়ার পরেও যখন এই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত কাউকে চিহ্নিত করা কিংবা আটক করা সম্ভব হয়নি, তখন এই হত্যাকাণ্ডটিকে জাতীয় সংবাদে পরিণত করতে তৎপর হয়ে ওঠেন মার্টিনের আত্মীয়রা। তাদের মধ্যে একজন বলেন, যে অস্ত্র দিয়ে মার্টিনকে খুন করা হয়েছে তিনি জানেন সেটা কোথায় লুকানো আছে। এই কথা শুনে অন্যান্য আত্মীয়রা বলে ওঠেন, যদি ঐ আত্মীয় নিজেই হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত না থাকবে, তাহলে তিনি এতটা নিশ্চিত হয়ে অস্ত্রের সন্ধান দিচ্ছেন কীভাবে? আত্মীয়রা সবাই ভাগ হয়ে যায় দু’পক্ষে। আর এই দু’পক্ষের মধ্যে সমানে চলে কাদা ছোড়াছুড়ি। শেষমেশ পুলিশ ভাবতে থাকে এটি হয়তো নিছকই জীবনের উপর বিতৃষ্ণ হয়ে করা একটি আত্মহত্যা, যাকে কেন্দ্র করে চলছে অহেতুক হট্টগোল।

স্বামীর হত্যাকারী গ্লেনা; Source: ytimg.com

পুলিশের এই ধারণার সাথে গলা মেলায় মার্টিনের স্ত্রী গ্লেনা ডুরাম। ২০১৫ সালে স্বামীকে গুলি করে মারার অপরাধে সর্বপ্রথম তাকেই দোষী সাব্যস্ত করে পুলিশ। কিন্তু হাতে উপযুক্ত কোনো প্রমাণ না থাকায় বাধ্য হয়ে তাকে ছেড়ে দেয় তারা। তবে সাবেক স্বামীর মৃত্যুর দু’বছর পর এই রহস্য সমাধান করতে এগিয়ে আসেন মার্টিনের প্রাক্তন স্ত্রী ক্রিশ্চিনা কেলার। তিনি জানান মার্টিনের পোষা তোতাপাখিটি মৃত্যুর আগ মুহূর্তে মার্টিনের বলে যাওয়া কথাগুলো বারবার বলছে। চমকপ্রদ এই তথ্যটি মামলার অগ্রগতির পথে প্রথম পদক্ষেপ ছিল।

শাট আপ, মার্টিনের মৃত্যুর সপ্তাহখানিক পরে ধারণকৃত একটি ভিডিওতে গম্ভীর আর রাগী সুরে কথাগুলো বলতে শোনা যায় আফ্রিকান ধূসর এই তোতাপাখিটিকে। তার এই কথাগুলো সব সময় শেষ হতো তীব্র একটি চিৎকারের সাথে “ডোন্ট শুট ” বাক্যটির মাধ্যমে। মার্টিনের মৃত্যুর পরে ২০১৫ সালের মে মাসে থেকেই বাডকে নিজের সাথে রাখছেন কেলার। তিনি জানান, “আমি অন্তর থেকে বিশ্বাস করি ওগুলো মার্টির শেষ কথা। বাডের কথা বলার ধরণ থেকে আমি দুটো গলার স্বরকে আলাদা করতে পেরেছি। একটি স্বর খুব চিৎকার করে কথা বলে আর ‘ডোন্ট শুট’ বলে থেমে যায়।

আদালতের বিচারকার্যে তোতাপাখিটিকে ব্যবহার করা হয়নি, তার সাক্ষ্য নেয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। তবে প্রাথমিকভাবে প্রসিকিউটর জানান প্রয়োজন হলে তোতাপাখিটিকে আদালতে হাজির করা হবে। পরবর্তীতে মার্টিনের বর্তমান স্ত্রী গ্লেনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে তার মুখ থেকে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী পায় পুলিশ। পুলিশ কিংবা আদালতের পক্ষ থেকে খোলসা করে কিছু বলা না হলেও ধারণা করা হচ্ছে সাংসারিক জীবনে নানাবিধ সমস্যা কিংবা পরকীয়ার জের ধরে এ হত্যাকাণ্ড ঘটে। প্রথম কারণটি সত্যি হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি কেননা মার্টিনের মৃত্যুর পরে যখন গ্লেনাকে উদ্ধার করা হয়, তখন তার মাথায়ও আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। খুব সম্ভবত মার্টিনকে খুন করে গ্লেনা নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করে। দুর্ভাগ্যবশত সে বেঁচে গেলেও পরবর্তীতে এই ব্যাপারটি সম্পর্কে নিজেকে পুরোপুরি সুবিধাজনক অবস্থানে রেখে গোটা ব্যাপারটা অস্বীকার করে গ্লেনা। মাথায় আঘাতের চিহ্ন কোথা থেকে আসলো এই ব্যাপারেও সন্তোষজনক কোনো উত্তর দিতে পারেনি সে। উপযুক্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহের পর এ বছরের ২৯ জুলাই আদালত তার সুচিন্তিত মতামত অনুযায়ী গ্লেনাকে দোষী সাব্যস্ত করে ২৮ আগস্ট তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সিদ্ধান্ত নেয়।

মার্টিন ও গ্লেনা দম্পতি; Source: thesun.co.uk

মার্টিনের ডুরামের মা, লিলিয়ান, গোটা ব্যাপারটি নিয়ে বেশ দ্বিধায় ভুগতে থাকেন। স্থানীয় গণমাধ্যমকে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি জানান, “ডুরামের স্ত্রী গ্লেনাকে আদালত কক্ষে এতোটা নির্লিপ্ত দেখতে খুবই খারাপ লাগছিল। আমার ছেলের মৃত্যুতে তার হাত আছে এই ব্যাপারে যাবতীয় তথ্যপ্রমাণ থাকার পরেও তার মধ্যে কোনো অনুশোচনাবোধ নেই।” দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে বলেন তিনি, “এটা সুখের কিছু না, এটা মোটেও সুখের কোনো অনুভূতি না। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য দুই বছর অপেক্ষা করাটা তীব্র কষ্টের।

বাডের বর্তমান মালিক, মার্টিন ডুরামের প্রাক্তন স্ত্রী ক্রিশ্চিনা কেলার বলেন, তিনি শুরুতেই বুঝতে পেরেছিলেন কোথাও কোনো অস্বাভাবিকতা আছে। যে রাতে মার্টিন নিহত হয় সে রাত থেকেই বাড দ্বৈত কণ্ঠের একটি আলাপচারিতা বারংবার পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে। আর সবশেষে বলা ঐ ‘ডোন্ট শুট’ কথাটিই প্রমাণ করে এটি মার্টিনের মৃত্যুর সাথেই সংশ্লিষ্ট। পর পর পাঁচ বার গুলির শব্দ শুনে প্রচণ্ড ভয় পাওয়া তোতাপাখিটি এর বাইরে আর কিছুই বলছে না।

মার্টিন ডুরামের বাবা-মা জানান, এমনটাও হতে পারে যে মার্টিন আর গ্লেনা কোনো কিছু নিয়ে তর্ক করছিল, আর তাদের শেষ কথাটি শুনেই এভাবে পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছে বাড। স্থানীয় গনমাধ্যমকে ডুরামের বাবা বলেন, “ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি বাড ঐ রাতে মার্টিনের সাথেই ছিল, হত্যাকাণ্ডটি তার চোখের সামনেই ঘটে। মার্টিনের বলা শেষ কথাগুলো সে মনে রেখেছে আর তা-ই সে বলছে।” শুরুর দিকে লিলিয়ান অর্থাৎ মার্টিনের মা অবশ্য বলেন, “পাখিটা যা ইচ্ছা তা-ই মনে রাখে আর বলতে থাকে। ওর মুখ খুবই খারাপ আর ওর কথা বিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই।” পরবর্তীতে অবশ্য গ্লেনার মুখ থেকে সত্যিটা জানতে পেরে বাডের কথাকেই বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন লিলিয়ান।

টেলিভিশনের পর্দায় বাড; Source: tribwxmi.com

আমাদের আজকের প্রতিবেদনের মূল নায়ক বাড। এবার তাহলে তাকে নিয়ে কিছু কথা বলা যাক। মজার ব্যাপার হলো বাড শুধু কয়েকটি লাইন বলে মানুষকে ভেঙিয়ে তার পাখিসুলভ স্বভাব প্রকাশ করেনি। বরং সে একই সাথে দু’জন ভিন্ন মানুষের গলার স্বর নকল করে পুরো ঘটনাটির একটা ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করেছে। লাইভ সাইন্সকে দেয়া সাক্ষাৎকারে পাখি বিষয়ক গবেষকরা জানান, এমনটিও হতে পারে যে পাখিটি টেলিভিশন দেখে কিংবা অন্য কোথাও থেকে শুনে লাইনগুলো বলেছে। কিন্তু আফ্রিকান ধূসর তোতাপাখি সাধারণত পরোক্ষ কোনো উক্তি একবারের বেশি ব্যবহার করে না। যেহেতু সে এই কথাগুলো বারবার বলে যাচ্ছে, কাজেই ধরে নিতে হবে বাড এই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী। তার গলার আওয়াজের এই পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা চালান কয়েকজন বিশেষজ্ঞ। সিরিংক্স নামের যে অঙ্গ দিয়ে পাখিরা শব্দ তৈরি করে, তা পাখিদের ফুসফুসের উপরে শ্বাসযন্ত্রকে ঘিরে অবস্থিত। তোতাপাখির ক্ষেত্রে এই সিরিংক্সকে কেন্দ্র করে কয়েকটি জটিল পেশী আবর্তিত হয় বলে জানান হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক পেপারবার্গ। তার নিজের আফ্রিকান ধূসর তোতাপাখি অ্যালেক্স ১০০টিরও বেশি শব্দ বলতে পারত। জটিল এই পেশীগুলো এই প্রজাতির তোতাপাখিকে সাধারণ কথা বলিয়ে পাখির তুলনায় কথা বলা ও স্বর নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে আরও বেশি দক্ষতা প্রদান করেছে বলে জানান তিনি। বুদ্ধিমত্তার দিক থেকেও কিছুটা এগিয়ে থাকা এই পাখিগুলো যদি কোনো বিবাহিত দম্পতির সাথে থাকে, তাহলে সে তাদের ভালোবাসা ও ঝগড়া দুটি পৃথক সময়ের ভাষাই মস্তিষ্কে ধারণ করে নিতে পারে। ঠিক এমনটাই ঘটেছিল বাডের সাথে, মার্টিনের মৃত্যুর সময়কার কথাগুলো খুব দ্রুত বন্দী করে নিয়েছিল তার মস্তিষ্ক আর অনবরত সে বলে চলছিল একই বুলি

এই ঘটনার পর থেকে আফ্রিকান ধূসর জাতের তোতাপাখি নিয়ে বিস্তর গবেষণা চলছে। কেউ হাতড়ে বেড়াচ্ছেন এই পাখিদের অতীত রেকর্ড, কেউ খুঁজে বেড়াচ্ছেন তাদের অ্যানাটমি। এই প্রজাতির তোতাপাখি মানুষের বুলি নকল করতে খুব ওস্তাদ। ছোট একটি বাচ্চার মতো বোধশক্তি সম্পন্ন এই তোতাপাখি মানুষের খুব কাছাকাছি থাকে বিধায় তারা সহজেই মানুষকে অনুকরণ করতে পারে। মূলত আফ্রিকায় বসবাসকারী এই প্রজাতির তোতাপাখিগুলোর ওজন হয় ৪০০ গ্রামের কাছাকাছি। ১৯৯৩ সালে সংঘটিত একটি খুনের বিচারেও সাক্ষী হিসেবে বিবেচিত হয় একটি আফ্রিকান ধূসর তোতা। বিবাদী গ্যারি জোসেফ রাস্পকে নিরপরাধী সাব্যস্ত করতে এটি বারবার বলতে থাকে “রিচার্ড, না, না, না।” শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাস্পকে দোষী সাব্যস্ত করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে আদালত। আর তখন থেকেই তোতাপাখির সাক্ষ্য গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নেয় আদালত।

ফিচার ইমেজ- globalo.com

Related Articles