Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ভালোবাসার উপাখ্যান: শরণার্থী আটকে গেলেন সীমান্তরক্ষীর প্রেমে

প্রেম শ্বাশ্বত। দেশ-কাল-স্থান-সীমান্তের বেড়াজালে তাকে আটকে রাখা যায় না। কখন, কার জীবনে এই ভালোবাসার অনাবিল সৌন্দর্য এসে ধরা দেবে, তা কেউ কি কখনো বলতে পারে? ইতিহাসে আমরা পড়েছি বহু ব্যর্থ প্রেমের কাহিনী। কিন্তু আজ এমন এক ভালোবাসার গল্প সম্পর্কে জানবো, যার পরিসমাপ্তি ঘটেছে অভূতপূর্ব আনন্দময় পরিণতির মধ্য দিয়ে। এই ভালোবাসার উপাখ্যান তৈরি হয়েছে এক ইরাকি শরণার্থী মেয়ে আর এক মেসিডোনিয়ান সীমান্তরক্ষীর মাঝে। কীভাবে এই প্রেম সেই প্রেমিক যুগলের জীবনে ঝড় তুলেছিল, চলুন তা জানা যাক।

২০১৬ সালের শুরুর দিকের কথা। আইএস ও তার সহযোগীরা ইরাক জুড়ে চালাচ্ছে একের পর এক হামলা। চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে প্রচণ্ড সহিংসতা। অনেক অধিবাসীই আসন্ন বিপদের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালাতে লাগলো। তারা আশ্রয় নিতে লাগলো সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে। এমনই এক পরিস্থিতিতে ইরাক থেকে পালিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেয় নুরা আরকাভাজি ও তার পরিবার।

নুরা আরকাভাজি ; Source: BBC.com

বিশ বছর বয়সী নুরা ইরাকের পূর্বাঞ্চলের দিয়ালা প্রদেশে মা, বাবা ও ভাই-বোন নিয়ে সুখেই বাস করছিল। সে ছয়টি ভাষায় পারদর্শী ছিল। তাই সহজেই তার ব্যক্তিত্ব অন্যদের মুগ্ধ করতে পারতো। তার বাবা ছিলেন একজন প্রকৌশলী। আইএস জঙ্গীরা একদিন তাদের এলাকায় হামলা চালালো। এলাকার অনেক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের সাথে নুরার বাবাকে ধরে নিয়ে যায় জঙ্গীরা। তার মুক্তির জন্য নুরার পরিবারের কাছ থেকে তারা মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। বাবাকে মুক্ত করে আনার পর ঐ অঞ্চলটি আর তাদের কাছ নিরাপদ মনে হয়নি।

আইএস জঙ্গীদের ইরাক দখল; Source: truthernews.wordpress.com

নুরাসহ পরিবারের সবাই সিদ্ধান্ত নেয়, জীবন বাঁচাতে নিরাপদ আশ্রয়স্থল জার্মানি পাড়ি জমাবে তারা। যেহেতু তাদের পরিবারের অন্যান্য অনেক সদস্যই সেখানে বসবাস করে, তাই জার্মানি যাওয়ার জন্য মনঃস্থির করে নুরা পরিবার। স্বপ্ন ছিল শুধু পুরো পরিবারের সবাইকে নিয়ে নিরাপদে বেঁচে থাকার। তাই অন্যান্য অনেক পরিবারের মতোই নুরার পরিবার তাদের স্থায়ী আবাসস্থল থেকে পথে নামতে বাধ্য হয় এবং পশ্চিমে তুরস্কের দিকে যাত্রা শুরু করে। প্রাণের মায়ায় নুরা, তার দুটো ছোট ভাই-বোন নিয়ে মা-বাবা সহ দীর্ঘ দুর্বিসহ সেই যাত্রা মেনে নেয়। পরিবারটি প্রথমে তুরস্কে এসে পৌঁছায়। পরে সেখান থেকে নৌকায় গ্রিসের লেসবস দ্বীপ হয়ে শেষ পর্যন্ত মেসিডোনিয়াতে এসে পৌঁছায়। এভাবে তখন বহু শরণার্থী একই পথ অনুসরণ করে ইউরোপে প্রবেশ করার জন্য চেষ্টা করে।

মেসিডোনিয়ার সীমান্তে পৌঁছে তারা দেখতে পায় শরণার্থীদের বিশাল মিছিল। এদের মধ্যেই ঠাঁই হয় নুরা ও তার পরিবারের। শরণার্থীদের জন্য তখন ইউরোপে প্রবেশ বেশ কষ্টকর হয়ে উঠেছিল। তাদের জন্য বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রবেশের সব পথ। মেসিডোনিয়ার সীমান্তে এসে শরণার্থীরা অপেক্ষা করতে লাগলো। তখন সরকারের উর্ধ্বতন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে শরণার্থীদের মেসিডোনিয়ার মধ্য দিয়ে সার্বিয়ায় যেতে দেয়া হবে কিনা, এই সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলোচনা চলছিল।

মেসিডোনিয়ার সীমান্তে শরণার্থীদের ভিড়; Source: delfi.lt

ঐ সময় সীমান্তে ববি ডোডেভস্কি নামে ৩৫ বছর বয়সী এক মেসিডোনিয়ান যুবক ১৫ বছর ধরে পুলিশ বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন। সীমান্তে শরণার্থীদের চাপ বেড়ে যাওয়ায় এক বছর আগে এ সীমান্তে তার পোস্টিং হয়েছে। ইংরেজী ভাষায় দক্ষ হওয়ায় শরণার্থীদের সাথে ইংরেজীতে কথা বলার সুবিধার জন্য তাকে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসেবে নিয়োজিত করা হয়েছিল। তিনি দু’বার বিয়ে করেছিলেন। ঠিক প্রেম করে বিয়ে, তা বলা যাবে না। তাই কোনো বিয়েই তার বেশি দিন টিকলো না। ভদ্রলোকের ঘরে তখন তিন সন্তান। এসব পরিচয় ছাড়াও তিনি ছিলেন একজন পেশাদার নৃত্যশিল্পী।

ববি ডোডেভস্কি; Source: oglobo.globo.com

তার ড্যান্স গ্রুপ নিয়ে বছরের বিভিন্ন সময় তাকে রাশিয়া, স্পেনসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভ্রমণ করতে হয়। তাই বিভিন্ন দেশের মানুষের সাথে যোগাযোগ স্থাপনের জন্য তাকে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে হয়। আর এভাবেই তিনি ইংরেজি ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেন। সীমান্তে কর্মরত অবস্থায় তিনি শরণার্থীদের বিবর্ণ দুর্দশা দেখে ব্যথিত হতেন। চেষ্টা করতেন তাদের নানাভাবে সহযোগিতা করতে।

সেদিন ছিল অন্যান্য দিনের চেয়ে একটু আলাদা। বেশ বৃষ্টি পড়ছিল। ববির সেদিন ডিউটিও ছিল না। তাই ভাবছিলেন, বেশ জমিয়ে দিনটি সন্তানদের সাথে কাটাবেন। কিন্তু বিধি বাম! অফিস থেকে জরুরী তলব। তাকে ঐদিন ডিউটি করতে হবে। কী আর করা! হয়তো সেটাই নিয়তিতে গাঁথা ছিল! আর এভাবেই সেদিন তৈরি হতে থাকল এক ভালোবাসার গল্পের পটভূমি।

সেই বৃষ্টিস্নাত দিনে অনেকটা বাধ্য হয়েই কাজে যোগ দিলেন ববি। আর সেদিনই মেসিডোনিয়ার সীমান্তে এসে উপস্থিত হয় নুরা আরকাভাজি ও তার পরিবার। সেদিন নুরার বেশ জ্বর। সাইবেরিয়ান সীমান্তে প্রবেশ করতে পারবে কিনা এই তথ্য জানার জন্য অসুস্থ নুরা অত্যন্ত মরিয়া হয়েই কর্তব্যরত সীমান্তরক্ষীদের সাথে কথা বলতে যায়। কিন্তু তার ইংরেজি ভাষা সীমান্তরক্ষীরা খুব একটা বুঝতে পারছিল না। তাই নুরাকে নিয়ে যাওয়া হয় এমন একজন অফিসারের কাছে যিনি ইংরেজি ভাষায় নুরার প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবেন। তিনি আর কেউ নন, এই গল্পের নায়ক ববি ডোডেভস্কি।

প্রথম দেখাতেই ববির হৃদয়ে এক আশ্চর্য অনুভূতি তৈরি হয়েছিল যা তিনি ব্যক্ত করেছিলেন পরবর্তী এক সাক্ষাৎকারে। ববি ডোডেভস্কি তার প্রথম সাক্ষাতের কথা জানিয়েছিলেন এভাবে, “সেদিন নুরাকে দেখে মনে হয়েছিল তার সাথেই জড়িয়ে রয়েছে আমার নিয়তি। নুরার চোখে এমন কিছু ছিল যা আমাকে আবিষ্ট করে দিয়েছিল।” ববির কাজে মনোযোগের অবস্থা দেখে তার এক সহকর্মী মজা করে বলেছিলেন, “তুমি তো কাজে মন বসাতেই পারছো না। মনে হচ্ছে তুমি প্রেমে পড়েছ, আর তোমার সমস্ত মনোযোগ কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে।” সৃষ্টিকর্তাই যেন তাদের জন্য এই দিনটি বরাদ্দ করে রেখেছিলেন। সত্যি বলতে কী, সেই প্রথম দেখাতেই ববি নুরার প্রেমে পড়ে যান। সে দেখাই ছিল শেষ পর্যন্ত দুজনের একসঙ্গে পথ চলার শুরু।

সেদিন মরিয়া ও অসহায় নুরাকে আশ্বাসবাণী দেয়া ছাড়া আর কোনো কথা হয়নি ববির। মেসিডোনিয়ার এক ট্রানজিট ক্যাম্পে নুরা সহ বিভিন্ন শরণার্থীরা আশ্রয় নিয়েছিল, সেসময় নুরার সাথে বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হয় ববির। ছয় ভাষায় দক্ষ হওয়ায় নুরা স্থানীয় রেড ক্রসের স্বেচ্ছাসেবীদের নানাভাবে সাহায্য করছিলেন। তখন কাজের ফাঁকে ফাঁকে ববির সাথে প্রেমের সম্পর্ক ধীরে ধীরে গভীরতর হতে শুরু করলো নুরার। শরণার্থী শিশুদের সঙ্গে ববির খেলায় মেতে উঠা, তার কথাবার্তা, চাল-চলন সবকিছুই নুরাকে মুগ্ধ করতো।  একদিন ববি নুরাকে তার মায়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার জন্য শহরের বাজারে কাছে অবস্থিত তার বাসায় নিয়ে গেলেন।

প্রথম দেখার পর নানা কাজের ফাঁকে পরষ্পরের সান্নিধ্যে আসা; Source: YouTube

এপ্রিলের এক সন্ধ্যায় এক রেস্টুরেন্টে ডিনার খেতে খেতে ববি নুরাকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন অনেকটা নাটকীয় ধাঁচে, ঠিক এভাবে- “তুমি কি আমাকে বিয়ে করবে?” নুরা প্রথমে মনে করেছিলেন, ববি হয়তো রসিকতা করছে। কিন্তু ববি দশবারই এক প্রস্তাব নুরাকে জানাচ্ছিলেন, যা মোটেই রসিকতার পর্যায়ে ছিল না। দশমবারের সময় রাজি হয়ে যায় নুরা।

বিয়ের দিনের ফটোগ্রাফীতে নুরা আরকাভাজি ও ববি ডোডেভস্কি; Source: cnn.com

মার্চে পরিচয়, এপ্রিলে এসে প্রেম, আর জুলাইয়ে শুভ পরিণয়। সবার ভালোবাসা নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় তাদের বিবাহ অনুষ্ঠান। ১৩ জুলাই ২০১৬, নুরার জন্মদিনকে বেছে নেওয়া হয় বিয়ের অনুষ্ঠানের জন্য। উৎসবে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন ১২০ জন সুহৃদ ও নুরার রেডক্রসের বন্ধুরা। গানবাজনা ও নৃত্যের সাথে পালিত হয় তাদের বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান।

আর এভাবে শুভ পরিণতি ঘটলো এক মায়াময় ভালোবাসার। প্রেম আর ভালোবাসার মায়াজালে নুরার স্বপ্ন জার্মানিতে নয়, মেসিডোনিয়াতেই আটকে দিল তাকে। নুরার পরিবারের অন্য সদস্যরা শেষ পর্যন্ত জার্মানিতে প্রবেশ করতে পেরেছিলেন এবং এখন সেখানেই স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। কিন্তু নুরা রয়ে গেল মেসিডোনিয়াতেই।

নিজেদের অ্যাপার্টমেন্টে ডোডেভস্কির আগের তিন সন্তান সহ পাঁচ জনের সুখের সংসার।  শিগগিরই তাদের সঙ্গে যোগ দিতে আসছে পরিবারের সর্বকনিষ্ঠ ষষ্ঠ সদস্য। সবার ভালোবাসা ও সহযোগিতায় এই সুখী দম্পতির জীবন আরো আনন্দময় হয়ে উঠুক, এটাই সকলের কাছে তাদের প্রার্থনা।

ফিচার ইমেজ- The Independent

Related Articles