মানব সমাজে কৃষিকাজের সবচেয়ে পুরনো নমুনা পাওয়া যায় আজ থেকে ২৩ হাজার বছর আগে মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক স্থানে- মানব সভ্যতার ইতিহাসে এই কাহিনী নিশ্চয়ই শুনেছেন? আজ এতদিন পরে যদি আপনি শোনেন, এই পৃথিবীর বুকে আরেকটি প্রাণী মানুষের বহু বছর আগে থেকেই পাঁচ কোটি বছর ধরে কৃষিকাজ করে ফসল উৎপাদন করে আসছে- তাহলে আপনার অনুভূতি ঠিক কেমন হবে? অবিশ্বাস চোখ বড় বড় করে তারপর নিশ্চয়ই হাসিতে ফেটে পড়বেন। তারপর বলবেন, ''ধুর! তাই হয় নাকি?''
কিন্তু এটিই সত্যি। পৃথিবীর ইতিহাসে পরভোজী প্রাণীদের মধ্যে সর্বপ্রথম কৃষিকাজ করার গৌরবের ভাগীদার এক প্রজাতির পিঁপড়ে। আর পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী নয়, যারা নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করে। এই নিবন্ধটি শেষ করার পর আপনি নিজেও অন্তত গোটা আষ্টেক কৃষিকাজ জানা প্রাণী সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হবেন!
পাতা কাটুরে পিঁপড়া:
চাষবাসের কথা হিসেব করলে সর্বপ্রথম যে প্রাণীটি মাথায় আসে তার নাম পাতা কাটুরে পিঁপড়া। প্রাণীজগতে একাজে এদের সমকক্ষ কেউ নেই। কোন কোন ক্ষেত্রে তো এরা মানুষকেও পেছনে দিয়েছে। তারা মূলত ছত্রাক চাষি। আর যে সে ছত্রাক নয়- তারা এমন কিছু ছত্রাক চাষ করে যারা পৃথিবীর পরিবেশ থেকে বহুকাল আগে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এই পিঁপড়াদের ক্ষেত(!) এ শুধু টিকে আছে তাদের অস্তিত্ব!
ধারণা করা হয় এই বিশেষ জাতের ছত্রাক তারা চাষ করা শুরু করেছিলো ত্রিশ মিলিয়ন বছর আগে। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ যেমন অভিযোজন ঘটিয়ে ফসলগুলোকে আজকের কাঙ্ক্ষিত রূপে নিয়ে এসেছে (উদাহরণস্বরূপ, মধ্যযুগে আজকের বিচি ছাড়া কলার কোনো অস্তিত্ব ছিল না), ঠিক তেমনিভাবে পিঁপড়াগুলো তাদের ফসলের অভিযোজন ঘটিয়ে এসেছে!
আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলে পাওয়া যায় এইসব দক্ষ চাষাদের। তাদের ভূগর্ভস্থ কৃষিভিত্তিক সমাজগুলো ফাঙ্গাস চাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে।
চাষাবাদের জন্য তাদের সুপরিকল্পিত এবং সুরক্ষিত ক্ষেত আছে। এই ক্ষেতগুলো এমন রুক্ষ, গরম পরিবেশ দ্বারা পৃথক করা থাকে যে, পিঁপড়াদের প্রত্যক্ষ পরিচর্যা ছাড়া এখানে কোন ছত্রাক বেঁচে থাকতে পারে না। ফলে তারা ভেজালমুক্ত কাঙ্ক্ষিত ফসল পেয়ে যায়।
এই ক্ষুদ্রকায় কৃষকেরা চারপাশে উপযুক্ত খাবার যোগ্য উদ্ভিদের খোঁজ করে- তাদের নিজেদের জন্য নয়। বরং ঐসব ছত্রাকের জন্য। তারপর সেগুলো নিয়ে তাদের আস্তানায় ফিরে আসে। এরপরে অন্য দল সেই মহার্ঘ্য উদ্ভিদ কণাগুলোকে চিবিয়ে ছত্রাকের উপযোগী পেস্টে পরিণত করে। এর ফলে তারা দ্রুত বিশাল পরিমাণে নিজেদের প্রয়োজনীয় ছত্রাক উৎপাদন করতে সম্ভব হয়।
পিঁপড়াগুলো তাদের ফসলের উপরে এতটা নির্ভরশীল যে, যখন কোন নতুন রাণী নতুন আবাস গড়ে তুলত চায়, তখন সে আগের সমাজ থেকে কিছু ছত্রাক ধার করে নেয়। তারপর সেগুলো দিয়ে চাষ শুরু করে।
বোয়ার বার্ড:
অস্ট্রেলিয়া এবং নিউগিনি তে বোয়ার বার্ড নামে এক জাতের পাখি পাওয়া যায়, যারা ঠ্যালায় পড়ে চাষবাস করে। এরা একমাত্র প্রাণী যারা খাওয়ার উদ্দেশ্য ব্যতিরেকেই গাছপালা লাগায়- তাও বাড়ি সাজানোর উদ্দেশ্যে। পুরুষ পাখিগুলো বেশ বড়সড় বাসা তৈরি করে। তারপর হরেক রকম বস্তু দিয়ে বাসাগুলোকে সাজায়। লক্ষ্য একটাই- কোন রমণীর মন পাওয়া। স্ত্রী বোয়ার বার্ড বেগুনী বেরি আর বুনো টমেটো খুব পছন্দ করে- ঠিক যেমন মেয়েরা গোলাপ ফুল পেলে আহ্লাদে আটখানা হয়ে যায়।
তাই বোয়ার বার্ড বুনো টমেটোর ফল দিয়ে বাসা সাজায়। পরে যখ সেগুলো শুকিয়ে যায়, তখন বাসার আশেপাশে ছড়িয়ে দেয়। সেগুলো থেকে গাছ হয়, তাতে উজ্জ্বল বেগুনী রঙের ফুল ধরে। সেখান থেকে গাড় সবুজ ফল হয়। বোয়ার বার্ডের বাড়িও যেন ঝলমল করে ওঠে। বোয়ার বার্ড এক বাসায় টানা দশ বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। সুতরাং ঘরবাড়ি সাজানোর উপায় যে ফলপ্রসূ, তা না বললেও চলে! বাড়ি তো সাজানো হল- এরপর কি? তারপরের টুকু তো মেয়েদের অংশ! সেই চমৎকার বাড়ি দেখে হয়তো কাঙ্ক্ষিত রমণী পটেই যায়। তারপরে তারা সুখশান্তিতে সংসার করে।
উইপোকা:
উইপোকা তার জটিল কারুকার্যময় এবং শক্তপোক্ত বাসা বানানোর জন্য বেশ বিখ্যাত। অতি ক্ষুদ্র এই প্রাণীগুলো এত বড় বাসা তৈরি করে যে তা মাথা ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। শুধু আকারের জন্যই নয়, কৌশলের দিক থেকে বাসাগুলো নিখুঁত।
প্রকাণ্ড এই বাসাগুলোর ভেতরে এমন কিছু প্রকোষ্ঠ তৈরি করে সেখানকার আলোবাতাস, তাপমাত্রা আর আর্দ্রতা ছত্রাক জন্মানোর জন্য একেবারে উপযুক্ত। ঠিক যেন একটি গ্রিনহাউজ। এই পরিবেশ ছত্রাকগুলো জন্মানোর জন্য এতটাই উপযুক্ত যে, ছত্রাকগুলো জীবনধারণের জন্য পুরোপুরি এই উইপোকাদের উপর নির্ভরশীল।
ছত্রাক থেকে স্পোর সংগ্রহ করে বিশেষভাবে বানানো চেম্বারগুলোতে সেগুলো রোপণ করে উইপোকারা। উপযুক্ত আবহাওয়া পেয়ে দ্রুত স্পোর থেকে ছত্রাক অঙ্কুরিত হয়। কিন্তু সেগুলো বেড়ে উঠতে তো পুষ্টি উপাদান লাগবে। সেগুলো আসবে কোথা থেকে?- এর উপায়ও বের করেছে উইপোকারা। তাদের মলকে সার হিসেবে ব্যবহার করে ছত্রাক চাষে! আর যেহেতু উইপোকার খাবারের বড় অংশই কাঠ- তাদের মলের পুরোটা জুড়েই থাকে অপাচ্য সেলুলোজ; যা পরজীবী ছত্রাকের জন্য সোনায় সোহাগা।
আচ্ছা, উইপোকার মূল খাবার যদি কাঠই হয়, তাহলে ছত্রাক চাষ করে তাদের লাভটি কি? উইপোকার প্রধান খাবার কাঠ হওয়ার ফলে তাদের দেহে নাইট্রোজেন সহ আরো কিছু পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি থাকে। তারা ছত্রাকের শিকড় (যা প্রকৃত অর্থে মাইসেলিয়াম) খেয়ে সেই প্রয়োজন মিটিয়ে নেয়।
ছত্রাকগুলি তাদের জীবনধারণের জন্য উইপোকার উপর এতটা নির্ভরশীল যে তাদেরকে কৃত্রিমভাবে চাষ (এই ছত্রাকগুলো খেতে আবার খুব সুস্বাদু) করা সম্ভব হয়নি! এদের নামও দেওয়া হয়েছে উইপোকার সাথে এদের মায়া মহব্বতকে মাথায় রেখে- Termitomyces।
মার্শ শামুক:
উত্তর আমেরিকার পূর্ব উপকূলে একধরণের শামুক পাওয়া যায় যার নাম মার্শ শামুক। বৈজ্ঞানিক নাম Littoraria irrorata। আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা শামুকগুলো লবণাক্ত জলাভূমিতে বসবাস করে। এক প্রকার ছত্রাকের প্রতি এদের ভারী লোভ! কিন্তু ছত্রাকগুলো তো আর চাইলেই পাওয়া যায় না। তাই বলে মার্শ শামুকেরাও থেমে যাওয়ার পাত্র নয়। তারাও বের করেছে অদ্ভুত এক পদ্ধতি।
এরা কর্ড গ্রাস নামের একপ্রকারের ঘাসের কাণ্ডে তাদের ধারালো দাঁতের সাহায্যে গভীর ক্ষত তৈরি করে। তারপর সেখানে মলত্যাগ করে। এর ফলে সেখানে এই ছত্রাকেরা জন্ম নেয়। এরপর সেগুলোকে ভক্ষণ করে শামুকগুলো।
ড্যামশেল ফিশ:
সমুদ্রের ছোট মাছদের মুল খাবার নানা রকম শৈবাল। কিন্তু বেচারা ড্যামশেল ফিশ এর কপাল খুবই মন্দ! সে চাইলেই ইচ্ছামত শৈবাল খেতে পারে না। কারণ এদের দেহে সব রকম শৈবাল পরিপাকের জন্য যথেষ্ট এনজাইম নেই। তাই অল্প কিছু জাতের শৈবাল থেকেই এদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করতে হয়। এদের মধ্যে একটি হল পলিসিফোনিয়া শৈবাল।
ওদিকে অন্যান্য মাছেদের তো আর সে ঝামেলা নেই। তাই তারা গড়ে যা পায় তাই সাবাড় করে ফেলে। এতে ড্যামশেল ফিশ ভারী অসুবিধায় পড়ে। কিন্তু বেঁচে থাকতে হলে খেতে হবে। তাই এরা বের করেছে এক অভিনব উপায়! নিজেদের খাবারের যোগান ঠিক রাখতে শেষমেশ ঝুড়ি কোদাল নিয়ে কোমর বেধে নেমে পড়েছে এরা!
এরা নির্দিষ্ট একটি জায়গা বেছে নিয়ে নিজের আস্তানা গেড়ে বসে। তারপর সেখানে পলিসিফোনিয়া চাষ করে। কেউ কেউ শুধুমাত্র লাল পলিসিফোনিয়ারই চাষ করে শুধু! আর কিছু মাছ আছে, যারা রুচি বদলের জন্য মিশ্র বাগান পদ্ধতি বেছে নিয়েছে। কিন্তু সে যাইহোক, এদের বাগানের ভেতরে অন্যান্য শৈবাল যদি কদাচিৎ জন্ম নেয়, তাহলে সেগুলো তুলে সটান বাইরে ফেলে দিয়ে আসে। অবশ্য এদের গল্প এখানেই শেষ নয়।
চাষ করার পাশাপাশি অন্যান্য প্রাণী এসে যেন তার সাধের বাগানখানির বারোটা বাজিয়ে না দেয় তাই এটিকে বুক দিয়ে আগলে রাখে সে। তার তল্লাটে যদি কোন সি-আর্চিন কিংবা অন্যান্য শত্রু আসে, তাদের ভাগিয়ে দেওয়ার ব্যাপারেও সে সিদ্ধহস্ত!
মিশর, কেনিয়া, মৌরিতানিয়া, মালদ্বীপ, থাইল্যান্ড, বোর্নিও সহ পৃথিবীর আরো অনেক জায়গায় দেখা গেছে এই কৃষক মাছেদের! সে হিসাবে বলতে গেলে এরা আন্তর্জাতিক কৃষক সম্প্রদায়!
তো, আপনার কি মনে হয়? সেরা কৃষকের পুরষ্কার কার হাতে ওঠা উচিত?
This article is about some animals who grow food by themselves.
Feature Image: Jaymi Heimbuch