Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যামান্ডা নক্স: খুনের আসামী থেকে বেস্টসেলার বইয়ের লেখিকা

২০০৭ সালের ২ নভেম্বর।

ইতালির পেরুজিয়া অঞ্চলের পুলিশের কাছে একটি ফোনকল এলো। খবর এলো সাংঘাতিক এক হত্যাকাণ্ডের। ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেলো, মেরিডিথ কার্চার নামের একজন ব্রিটিশ তরুণী নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন। এই তরুণী ইংল্যান্ড থেকে উচ্চশিক্ষার জন্য ইতালিতে এসেছিলেন। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তাকে নির্দয়তার রক্তাক্ত শিকার হতে হলো। 

খুনের শিকার মেরিডিথ কার্চার: Image Source: mirror.co.uk

যাদের দিকে সন্দেহের তীর লক্ষ্য করে ছিলো, তাদের একজন ছিলো হতভাগ্য  মেরিডিথের আমেরিকান রুমমেট। তার নাম অ্যামান্ডা নক্স। সেই কারণে গণমাধ্যমের নজরও ছিলো এই প্রবাসী আমেরিকানের দিকে।

মেরিডিথ কার্চার যুক্তরাজ্যের দক্ষিণ লন্ডনে বেড়ে ওঠা এক প্রাণবন্ত তরুণী ছিলেন। জাতিতে ইংরেজ হলেও ইতালিয়ান ভাষা, সংস্কৃতি, সঙ্গীত ও ইতিহাসে তার ভীষণ আগ্রহ ছিলো। তাই উচ্চশিক্ষার জন্য ইতালির পাহাড়ি শহর পেরুজিয়াকে বেছে নিয়েছিলেন। তার ইচ্ছে ছিলো ইউরোপের রাজনীতি বিষয়ে পড়াশোনা করার। নতুন ও অপরিচিত স্থানে তিনজনের সাথে এক কটেজে থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন। এর মধ্যে দুজন তরুণ ইতালিয়ান আইনজীবী, আরেকজন আমেরিকান তরুণী অ্যামান্ডা নক্স।

অভিযুক্ত অ্যামান্ডা নক্স: Image Source: biography.com 

অ্যামান্ডা নক্স মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের অধিবাসী ছিলেন। সুদূর পেরুজিয়া এলাকায় ছুটে এসেছিলেন ইতালিয়ান সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা করবেন বলে। এজন্য আমেরিকায় থাকার সময়ই বিভিন্ন রকম খণ্ডকালীন চাকরি করে যাত্রার খরচ জোগাড় করেছিলেন। সিনেমার চরিত্রের মধ্যে হ্যারি পটার তার বিশেষ পছন্দের তালিকায় ছিলো। মেরিডিথ কার্চারের সাথে তার স্বভাবে পার্থক্য থাকলেও সম্পর্ক ভালো ছিলো। অবসরে দুজনে একত্রে বেড়াতেও যেতেন। ক্ল্যাসিকাল মিউজিকের এক অনুষ্ঠানে দুজনে একত্রে যাওয়ার পর ইতালিয়ান তথ্যপ্রযুক্তির ছাত্র রাফায়েলে সুলেচিতোর সাথে তাদের পরিচয় হয়। রাফায়েলে ছিলেন অ্যামান্ডার প্রিয় চরিত্র হ্যারি পটারের মতো দেখতে। পরিচয়ের পর দুজনের প্রেম হতেও বেশি দেরি হয়নি।

অ্যামান্ডা নক্স ও রাফায়েলে সুলেচিতো; Image Source: bbc.com

২০০৭ সালের ৩১ অক্টোবর। সেদিন ছিলো হ্যালোউইন ডে।

ইউরোপের অন্যান্য শহরের মতো পেরুজিয়াতেও তরুণরা উৎসবের আনন্দে মেতে উঠেছিলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন বন্ধুদের সাথে মেরিডিথও আমোদে মেতে উঠলেন। হ্যালোউইনের সাজের ঐতিহ্য ও নিয়ম অনুযায়ী তিনি সেজেছিলেন ভ্যাম্পায়ার। ছবিতে তাকে বেশ প্রাণবন্ত আর সুন্দর লাগছিলো। উৎসবমুখর সেই পরিবেশে আনন্দের মাঝে তেমন কোনো বিষাদের সুর জোরালোভাবে শোনা যায়নি।

কিন্তু বিষাদ অপেক্ষা করে ছিলো।

২ নভেম্বর। সকাল ৯টার দিকে স্থানীয় একজন মহিলা তার বাড়ির সামনের বাগানে দুটো মোবাইল ফোন পেলেন। তিনি মোবাইল দুটি স্থানীয় পোস্টাল পুলিশের কার্যালয়ে নিয়ে গেলেন। তার মধ্যে একটি মোবাইল কাছাকাছি এক কটেজের ঠিকানায় রেজিস্টার করা ছিলো। পুলিশ ঘটনাস্থলে এসে অ্যামান্ডা নক্স ও রাফায়েলে সুলেচিতোকে দেখতে পায়।

এদিকে অ্যামান্ডার বক্তব্য অনুযায়ী, আগের দিন রাতটা রাফায়েলের সাথে কাটিয়ে ২ তারিখ সকালে তিনি কটেজে ফিরছিলেন। ঘরে এসে তিনি কিছু অশুভ কিছু আভাস পান। বাথরুমের বেসিনে শুকনো রক্তের দাগ দেখেছিলেন। তিনি অ্যাপার্টমেন্টের ইতালিয়ান রুমমেট ফিলোমেনা রোমানেলিকে ফোন করে তার আশঙ্কার কথা জানালেন। তারা ইতালির এলিট পুলিশ ফোর্স কারাবিনিয়েরিকে ফোন করে জানালেন। তার আগেই পোস্টাল পুলিশ কটেজের কাছাকাছি উপস্থিত হয়।

যে ঘরে মেরিডিথ কার্চার খুন হন; Image Source: heavy.com

মৃতদেহ আবিষ্কারের তিন দিন পর সন্দেহের বশে পুলিশ রাফায়েলে ও অ্যামান্ডাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। প্রথমদিকে পুলিশের জেরার মুখে অ্যামান্ডা খুনের ব্যাপারে কিছু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেন। পরে অবশ্য তিনি দাবি করেন, ইতালির পুলিশ তাকে ভয় দেখিয়ে স্বীকারোক্তি দিতে বাধ্য করেছিলো। এমনকি তাকে কোনো আইনজীবীর সাথেও কথা বলতে দেওয়া হয়নি। তিনি পুলিশের বিরুদ্ধে শারীরিক আঘাত দেবার অভিযোগও এনেছিলেন। তার ভাষ্য অনুযায়ী, সেদিন রাতে মেরিডিথ কার্চারের ঘটনা সম্পর্কে মুখ খোলার জন্য তাকে যাবজ্জীবন জেলের হুমকী দেওয়া হয়েছিলো।

২০০৮ সালের জুলাই মাসে রাফায়েলে ও অ্যামান্ডা নক্সের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে খুনের মামলা করা হয়। দীর্ঘ বিচারপ্রক্রিয়া শেষে তাকে ২০০৮ সালে দোষী সাব্যস্ত করে ২০ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়।

এদিকে মেরিডিথ কার্চারের লাশ তদন্ত করে ফরেনসিক ল্যাব রুডি গুড্ডে (Rudy Guede) নামের এক দাগী অপরাধীর ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ডিএনএ পায়। অ্যামান্ডা নক্সের বিরুদ্ধে অভিযোগ করার সময় তাকেও গ্রেফতার করা হয়। সে পরোক্ষভাবে খুনের অভিযোগ স্বীকার করে নেয়। তার কথা অনুযায়ী, মেরিডিথ যে রাতে খুন হয়, অ্যামান্ডা সে রাতে কটেজে ছিলো না। পরে সে তার বক্তব্যের এই অংশ বদলে দিয়ে অ্যামান্ডাকে একরকম ফাঁসানোর চেষ্টা করে।

প্রকৃত খুনী রুডি গুড্ডে; Image Source: news.sky.com

হতভাগ্য মেরিডিথের মৃতদেশের আশেপাশে রুডি’র ডিএনএ পাওয়া গিয়েছিলো। পুলিশ অনেক তন্ন তন্ন করে খুঁজেও সেখানে অ্যামান্ডা বা রাফায়েলের ডিএনএ’র কোনো চিহ্ন পায়নি। কিন্তু পরে চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটনা ঘটে। মেরিডিথের পরনের জামার এক কোণে রাফায়েলের ডিএনএ পাওয়া যায়। বিবাদী পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, খুন হওয়ার প্রথম তদন্তের ৪৬ দিন পর খুঁজে পাওয়া এমন আলামত গভীর সন্দেহের জন্ম দেয়। পরে আবার মেরিডিথের রান্নাঘরে ব্যবহৃত একটি ছুরি রাফায়েলের অ্যাপার্টমেন্টে পাওয়া গিয়েছিলো। ডিটেকটিভরা যাকে হত্যার অস্ত্র হিসেবে দাবি করছিলো। ছুরিটির হাতলে মেরিডিথ ও অ্যামান্ডা দুজনেরই ডিএনএ’র আলামত পাওয়া গিয়েছে বলে দাবি করা হয়। কিন্তু আপিল চলার সময় ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা এই আলামতকে দুর্বল বলে দাবি করেছিলেন।

ঘটনার দিন শুরু থেকে অ্যামান্ডা নক্স নিজেকে নির্দোষ দাবি করে আসছিলেন। ২০১০ সালের নভেম্বর মাসে রাফায়েলে ও তার বিচার শুরু হয়। এসময় ফরেনসিক বিশেষজ্ঞরা সব রকম আলামত থেকে অ্যামান্ডা ও রাফায়েলের জড়িত না থাকার পক্ষে সাক্ষ্য দেন। আদালত নিযুক্ত বিশেষজ্ঞরা তদন্তের প্রথমদিকে পুলিশের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত লক্ষ্যের দিকে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন।

২০১১ সালের ৩ অক্টোবর ইতালির আদালত অ্যামান্ডা নক্স ও রাফায়েলে সুলেচিতোকে নির্দোষ হিসেবে মেরিডিথ কার্চার হত্যা মামলা থেকে খালাস দেয়। এরপর অ্যামান্ডা ইতালি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে পাড়ি জমান। সেখানে তাকে ব্যাপকভাবে গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে হয়।

কিন্তু পরে কিছু বিতর্কিত ঘটনা পরিস্থিতিকে আবার ঘোলাটে করে তোলে। ২০১৩ সালের মার্চ মাসে ইতালির সর্বোচ্চ আদালত একই মামলার কারণে অ্যামান্ডা নক্সকে আবার তলব করে। ২০১১ সালে তাকে ও রাফায়েলেকে খালাস দেওয়ার রায় অগ্রাহ্য করা হয়। অ্যামান্ডা পুনরায় ইতালির আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে অস্বীকার করেন। ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ইতালির আদালত তার অনুপস্থিতিতেই রাফায়েলের সাথে তাকেও খুনের দায়ে ২৮ বছর ৬ মাসের কারাদণ্ড প্রদান করে।

আসলে নাটকীয়তা তখনও বেশ খানিকটা বাকি ছিলো। ২০১৫ সালে এই খুনের মামলার শুরু থেকে শেষ পর্যালোচনা করা হয়। শেষে ২৭ মার্চ আদালতের উচ্চ বিভাগ ৫২ পৃষ্ঠার এক রায় প্রদান করে। এই রায়ে পুরো  তদন্ত প্রক্রিয়ার একটি বড় অংশকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মন্তব্য করা হয়। পুলিশের কাজের প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করা হয়। এতে অ্যামান্ডা নক্স ও রাফায়েলে সুলেচিতোকে আবারও নির্দোষ বলে রায় দেওয়া হলো। অন্যদিকে রুডি গুড্ডেকে খুনী সাব্যস্ত করে তার শাস্তি বহাল রাখা হয়। নির্দোষ হবার পরও হয়রানির শিকার হওয়ায় পুরো তদন্তকারী টিমকে একরকম তিরষ্কার করা হয়। একে এক অর্থে হয়তো আদালতের প্রায়শ্চিত্ব বলা যায়।

অ্যামান্ডা নক্সের বেস্টসেলার বইয়ের প্রচ্ছদ; Image Source: nytimes.com

২০১৩ সালের ৩০ এপ্রিল অ্যামান্ডা নক্সের লেখা বই Waiting to Be Heard: A Memoir প্রকাশিত হয়। মেরিডিথ কার্চারের নির্মম হত্যাকাণ্ড, তদন্তে অ্যামান্ডার জড়িয়ে পড়া, পুলিশের জেরা, মামলার জটিলতা ও লেখিকার ভয়ের মনস্তত্ত্ব এতে সার্থকভাবে ফুটে উঠেছে। একজন মানুষের জীবনে যেন পারিপার্শ্বিক ঘটনার প্রভাবে আকস্মিকভাবেই একরকম নরক নেমে আসে। সেখানে অমানুষিক ভয়ের মুখোমুখী হতে হয় সত্য, তবে সাহস না হারিয়ে ধৈর্য ও মানসিক শক্তিতে তার মোকাবেলা করতে হয়। তবে নিজের সত্যিকারের অবস্থান নিজের কাছে পরিষ্কার থাকলে শত প্রতিকূলতা আসলেও তা অতিক্রম করা অসম্ভব কিছু নয়।

Waiting to Be Heard বইটিতে অভিজ্ঞতা ও মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতির সমন্বয়ে বর্ণনা করা হয়েছে স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড়িয়ে একা অসহায়ভাবে যুদ্ধ করার এক অবিশ্বাস্য গল্প। উল্লেখ্য, অসম যুদ্ধের আখ্যান নিয়ে লেখা এই বইটি নন ফিকশন হিসেবে ২০১৩ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমস বেস্ট সেলার তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলো।  

বিশ্বের চমৎকার, জানা-অজানা সব বিষয় নিয়ে আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/

Related Articles