Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

হিমালয় থেকে হিমু

‘হিমু’ নামটি পড়ার সাথে সাথেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে হলুদ পাঞ্জাবি পড়ে নগ্ন পায়ে হেঁটে চলা এক ভবঘুরে যুবকের ছবি, যে কিনা দিন-রাত অনবরত হেঁটে চলেছে তো চলছেই। এর পরপরই স্বভাবত হিমুর স্রষ্টার নামটাও ঠোঁটের ডগায় চলে আসে। মনে পড়ে সেই রহস্যময় পুরুষের কথা যিনি কলমের ছোঁয়ায় বদলে দিয়েছেন হাজারো যুবকের জীবন। যার অনুপ্রেরণায় মানুষ জীবনের অসঙ্গতিকে তুচ্ছ করতে শিখেছে, পেয়েছে সমাজের মাঝে অন্তর্নিহিত সত্যকে উপলব্ধি করার ক্ষমতা, আত্মস্থ করতে পেরেছে কীভাবে সমাজকে কাঁচকলা দেখিয়েও নিজের মতো করে বাঁচতে পারা যায়। তিনি আমাদের প্রয়াত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ।

হুমায়ূন সাহিত্যে যে ক’টি চরিত্র সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা লাভ করেছে, তার মধ্যে হিমু অন্যতম। অনেকে মনে করেন এ সকল চরিত্রের মধ্যে ‘হিমু’র জনপ্রিয়তাই সবচাইতে বেশি। কেননা হিমু এমনই একটি চরিত্র যাকে সামাজিক অনুশাসনের মধ্যে বেঁধে রাখা যায় না, আবার তার প্রবল মানবিকতাকেও অস্বীকার করা যায় না। হিমু একইসাথে আনন্দাচ্ছন্ন, আবার বিষাদজড়িত। সে অনেকটাই হাস্যচ্ছলে আপনাকে একটি পরিপূর্ণ শহুরে জীবনব্যবস্থা থেকে ঘুরিয়ে আনবে। যেখানে থাকবে প্রচণ্ড রকমের নির্দয়তা, আবার ঠিক তার বিপরীতে থাকবে অমায়িক মায়া-মমতা।

রাতের আঁধারে ল্যাম্পপোস্টের নিচে একজন হিমু; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ সৃষ্টি মিউজিক

ময়ূরাক্ষীর তীর

নব্বইয়ের দশকের গোড়াতে ‘ময়ূরাক্ষী’ উপন্যাসের মাধ্যমে হিমুর আবির্ভাব ঘটে। সেখানে প্রবল দুর্দশা এবং অস্বচ্ছলতার ভেতর থেকে এক টুকরো সুখ খুঁজে নিতে হিমুকে কল্পনার ময়ূরাক্ষীর তীরে চলে যেতে দেখা যায়। ইচ্ছে হলেই যেকোনো সময়ে সে নদীতীরে ভ্রমণ করতে পারে। চাইলে যে কাউকে সাথেও নিয়ে যেতে পারে। মাঝে মাঝে সেখানে তার মাকেও দেখতে পায় হিমু।

উপন্যাসটিতে দেখা যায় হিমুর বাবা প্রায় বিকারগ্রস্থ একজন মানুষ, যিনি তার ছেলেকে মহাপুরুষ বানাবার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। মহাপুরুষ বানানোর কাজে বিঘ্ন ঘটতে পারার আশঙ্কায় হিমুর মাকে হত্যাও হয়তো তিনিই করেন। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ারদের স্কুলের মতো তিনি একটি মহাপুরুষ বানানোর স্কুল খোলেন যার একমাত্র ছাত্র ছিল তার সন্তান হিমু। স্কুলের পোশাক ছিল পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি, যা হিমু আজও পরে বেড়ায় এ শহরের অলিতে গলিতে। ঘটনাক্রমে জীবনের একটা সময় এমনও এসেছিল যখন হিমুকে তার পিশাচসম মামাদের সাথে বসবাস করতে হয়। সেখানেও তার মহাপুরুষ হয়ে উঠবার জীবনের এক নতুন অধ্যায়ের সাথে পরিচিত হয় সে। এভাবেই হয় হিমু সিরিজের সূচনা।

হিমুর অভ্যুদয় ঘটা উপন্যাস ‘ময়ূরাক্ষী’; ছবিসূত্রঃ বাংলাপিডিএফক্লাব

হিমালয় থেকে হিমু

হিমুর পিতামহ হিমুর নাম রেখেছিলেন চৌধুরী ইমতিয়াজ টুটুল। তবে পিতামহের দেয়া এ নামটির বদলে জীবনের অন্যান্য সবকিছুর মতোই হিমু গ্রহণ করে তার বাবার দেয়া নাম হিমালয়। তার বাবার ধারণা ছিল হিমালয় নামটি পর্বতের মতোই মহত্ত্ব প্রকাশ করে। কারণ হিমালয়কে ছোঁয়া কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। হিমালয় থেকে সংক্ষেপে তার নাম হয়ে গেল হিমু। অনেক সময় সেটা আবার হয়ে যায় শুধু ‘হি’।

বাবার হাতে নানান অত্যাচারের শিকার হলেও বাবার আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করে হিমু। এ যেন অদ্ভুত এক বাধ্যতা! বাবার দেয়া নির্দেশ অনুযায়ী সবসময় খালি পায়ে হেঁটে বেড়ায় এবং পকেটবিহীন হলুদ পাঞ্জাবি তার নিয়মিত পোশাক হয়ে যায়। হিমুর বাবা তার পুত্রের জন্য বেশ কিছু মহান বাণীও লিখে রেখে গেছেন যা এখনো হিমুর চলার পথের দিশারী হিসেবে কাজ করে। এ সকল বাণী হিমুর মহাপুরুষ হবার জন্য আবশ্যক হিসেবে বিবেচিত হয়। যেমন ‘আজ হিমুর বিয়ে’ উপন্যাসে হিমুর বাবা বলেন –

“আবেগ হচ্ছে বিষ্ঠা। এই বিষ্ঠা শরীরে রাখতে নেই। শরীর থেকে বের করে দিতে হয়। মহান স্রষ্টা আবেগশূন্য। এত বড় সৃষ্টি আবেগ দিয়ে করা সম্ভব না। সৃষ্টি হয়েছে লজিকে। সৃষ্টিতে আবেগের স্থান নেই। অন্যের আগে বুঝতে হলে নিজেকে আবেগশূন্য হতে হবে।”।

মহাপুরুষ হিমু

হিমুর বাবার মহাপুরুষ বানানোর প্রয়াস হিমুকে কতটুকু মহাপুরুষ করতে পেরেছিল তা জানা যায় না। তবে হিমুকে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমী একটি চরিত্রে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিল ঠিকই। হিমুর চরিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় হিমু ২৫-৩০ বছর বয়সী অনাড়ম্বর একজন যুবক। তবে অনাড়ম্বর হলেও তার মধ্যে বেশ কিছু উদ্ভট আচরণ ছিল যা সাধারণ থেকে তাকে করেছে আলাদা। কারো কাছে সেটা বিরক্তিকর, আর কারো কাছে একদমই ‘মহাপুরুষ’!

হিমু নিজেকে একজন অবিরাম হন্টক হিসেবে দাবি করে এবং তার একমাত্র কাজ রাত-বিরাতে ঘুরে বেড়ানো। প্রায়শই হিমু পার্কে এবং রাস্তায় রাত কাটায়। এ কারণে তাকে কয়েকবার সন্দেহভাজন হিসেবে কারাবাসও করতে হয়। আর এই সুযোগে বিভিন্ন থানার অফিসারদের সাথে বেশ মজার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। আবার অন্য দিকে হিমুর সাথে কিছু খুনি-সন্ত্রাসীরও ভাল সখ্য দেখা যায়।

হিমুর আধুনিক চিত্রণ; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ শাহিনুর রাশিদ তুহিন

হিমু মিসির আলির মতো অতি যুক্তিবাদী না। হিমু মনে করে ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর’। অনেক সময় নিজের বিশ্বাস থেকে ভবিষ্যদ্বাণী করে হিমু এবং প্রায় প্রতিবারই তা মিলে যায়। এতে করে অনেকে তাকে মহাপুরুষ ভাবতে শুরু করে। যদিও এসব ক্ষমতায় হিমুর নিজেরই বিশ্বাস নেই, তবে এ থেকে মেলা সুযোগ সে ঠিকই আদায় করে নেয়। এবং প্রায় প্রতিটি উপন্যাসেই তাকে মহাপুরুষ ভাবা বেশ কিছু শিষ্যের দেখা পাওয়া যায়।

হিমু চরিত্রের সবচে’ আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে যেকোনো পরিস্থিতিতেই সে স্বাভাবিক থাকতে পারে এবং খুব সহজেই মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলতে পারে। সুন্দর করে হাস্যরসাত্মক ভঙ্গিমায় কথা বলে যাওয়াও তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। তবে এসব হাস্যরসের মাঝে শহুরে ভণ্ডামির নানান দিক ফুটে ওঠার পাশাপাশি মানবজীবনের অন্তর্লীন বিষাদগ্রস্ততার চিত্রও খুব সহজেই ধরা দেয়। এ কারণে অনেক সময় হিমুকে অকর্মা যুবকও মনে হতে পারে। কিন্তু সে কখনো অন্যের অনিষ্ট করে না এবং দিনশেষে প্রতিটি উপন্যাসেই হিমুকে নিঃস্বার্থ এবং পরোপকারী হিসেবে দেখা যায়।

হিমু এবং অন্যান্য

হিমু সিরিজের উপন্যাস পড়েছেন, কিন্তু মাজেদা খালাকে চেনেন না, এমন কি হতে পারে? অবশ্যই না। হিমুর আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে কেউই তাকে খুব ভালো চোখে দেখতো না একমাত্র মাজেদা খালা ছাড়া। তাই মাজেদা খালা হিমু সিরিজের বেশ গুরুত্বপূর্ণ এক চরিত্র। এছাড়া হিমুর ফুপাতো ভাই বাদলকেও বিভিন্ন উপন্যাসে দেখতে পাওয়া যায় যে কিনা হিমুর একান্ত ভক্তদের মধ্যে অন্যতম।

হিমুকে হিমু হিসেবে গড়ে তোলার পেছনে হিমুর বাবার পর সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে হিমুর বান্ধবী রুপা। রুপা হিমুকে পছন্দ করে, হয়তোবা ভালবাসে। হিমুও যে রুপাকে পছন্দ করে না তা নয়। মাঝে মাঝে হিমু রুপাকে কোনো এক দোকান থেকে ফ্রীতে ফোন করে নীল শাড়ি পরে তাদের বারান্দায় দাঁড়াতে বলে। রুপাও হিমুর জন্য অপেক্ষা করে। হিমু আসে না। রুপা তারপরও অবাক হয় না। বরং সে হিমুকে তার মেসে চিঠি পাঠায়, একটুখানি অনুযোগ থাকে তাতে, আর কিছু না! রুপা হিমুর উদ্ভট আচরণের সাথেও বেশ ভালভাবেই পরিচিত। তবুও হিমুকে তার ভাল লাগে এই অদ্ভুত আচরণের জন্যই। তাই রুপাকেও কম উদ্ভট বলা যায় না! হিমুরও মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে এই মহাপুরুষগিরি ছেড়ে-ছুড়ে অন্য জীবন শুরু করতে। একেবারে সাধারণ আর ছাপোষা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আর সেটা করা হয়ে ওঠে না। কারণ হিমুদের আবেগ গায়ে মাখতে নেই, হিমুদের ভালোবাসতে নেই। হিমুরা কাউকে ভালবাসে না।

হিমু এবং রুপার একটি চিত্রণ; ছবি কৃতজ্ঞতাঃ উন্মাদ অয়ন

হিমু সিরিজের মোট প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা ২১টি। প্রতিটি উপন্যাসই পেয়েছে অসম্ভব রকমের পাঠকপ্রিয়তা। শুধুমাত্র বাংলাদেশ নয়, সীমান্তের ওপারেও রয়েছে হিমুর তুমুল জনপ্রিয়তা। সব ক’টি উপন্যাস একত্র করে প্রকাশিত হয়েছে হিমু সমগ্র। এছাড়া ‘হিমু মামা’ নামে হুমায়ূন আহমেদের একটি উপন্যাস রয়েছে সেখানে এক তরুণ যুবকের হিমু হবার প্রয়াস দেখা যায়। ‘হিমুর বাবার কথামালা’ নামে বিভিন্ন উপন্যাসে দেয়া হিমুর বাবার উপদেশের একটি সংকলনও প্রকাশিত হয়েছে।

হিমু সিরিজের বেশ কয়েকটি উপন্যাসের ওপর কয়েকটি নাটকও নির্মাণ করা হয়েছে। তবে অনেকের মতে সেগুলো উপন্যাসের মতো প্রাণবন্ত হয়নি। উপন্যাস অবলম্বনের বাইরে হুমায়ূন আহমেদের কয়েকটি নাটকে হিমুর গৌণ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। এর মধ্যে ‘আজ রবিবার’ অন্যতম জনপ্রিয় একটি নাটক।

হিমু চরিত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে অনেকেই হিমু হবার চেষ্টা করেছে। আর এটাই হিমু চরিত্রের সবচেয়ে বড় গুণ। কেননা হিমু শুধু বইয়ের পাতাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, মিশে গেছে সাধারণ মানুষের সাথে। অনেকেই বলা নেই কওয়া নেই, হিমু হতে চায়! কিন্তু হঠাৎ করেই হিমুস্রষ্টা আমাদের থেকে বিদায় নেয়ায় সমাপ্ত হয়েছে হিমু সিরিজ। খালি পায়ে জুতো পরা হয়নি আর কোনো হিমুর। হলো না ভবঘুরে জীবনের ইতি। হলুদ পাঞ্জাবিতে যুক্ত হলো না পকেটও। তবুও হিমুস্রষ্টা হুমায়ুন আহমেদ আরও বহুদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের মাঝে তারই রচে যাওয়া অজানা অদেখা সহস্র হিমুর মধ্যে।

হিমুরা হাঁটবে, আর তাদের জন্য দেখা-অদেখা রুপারা অফুরান অপেক্ষায় ডুববে, লিখবে কত না চিঠি!

হুমায়ূন আহমেদ এবং তারই সৃষ্ট চরিত্র হিমু; ছবিসূত্রঃ সোনেলা ব্লগ

Related Articles