Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত জনপ্রিয় কিছু গান

কথা, সুর আর বাদ্যযন্ত্রের সমন্বয়ে শিল্পীর কন্ঠে যখন শ্রুতিমধুর শব্দসুর তৈরি হয়, তখন তা আমাদের কাছে একটি পরিপূর্ণ গান হিসেবে পরিচিতি পায়। এই গান সৃষ্টির ব্যাপারে কথা আগে না সুর আগে- এই নিয়ে অনেক দ্বন্দ্ব রয়েছে। তবে চিরাচরিত নিয়মে লেখক লেখার পর সেই লেখায় সুরের সৃষ্টি করা হয়। তবে এর ব্যতিক্রমও হয় অনেকবার। অনেক সুরকারের মনে আগে সুর আসে, তারপর সেই সুরে কথা বসানো হয়। তা সে সুর আগে হোক আর কথা আগে হোক, শ্রুতিমধুর হলেই গানটি সকলের কাছে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

কবিতা থেকে গানের ভাবনাটা নতুন কিছু নয়। অনেক কাল আগে থেকেই কবিতা থেকে গান তৈরির চেষ্টা চলে আসছে। কবিতার নিজস্ব সুর, তাল রয়েছে। সেই বিচারেই একজন সুরকার কবিতাটির সুর করেন। তবে কবিতা থেকে সুর করার কাজটি মোটেও সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। আজ এমন কিছু গান নিয়ে আলোচনা করা হবে, যে গানগুলো বানানো হয়েছে কবিতায় সুর বসিয়ে অথবা কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে কথা পরিবর্তনের পর সুরারোপ করে।

বেণীমাধব

প্রথম আলোচনা করব কলকাতার জনপ্রিয় শিল্পী লোপামুদ্রা মিত্রের গাওয়া বেণীমাধব গানটির কথা। বেণীমাধব গানটি মূলত কবি জয় গোস্বামীর কবিতা ‘মালতীবালা বালিকা বিদ্যালয়’ এর উপর সুরারোপিত। কবিতাটিতে সুর দিয়েছিলেন সমীর চট্টোপাধ্যায়।

গানটি মুক্তি পাওয়ার পরেই বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৯৯ সালের দিকে ‘অন্য হাওয়ার অন্য গান’ নামে অ্যালবামে প্রথম গানটি প্রকাশিত হয়। পরে অবশ্য ব্যাপক জনপ্রিয়তার কারণে ‘কবিতা থেকে গান’ নামে আরেক অ্যালবামে নতুন করে গাওয়া হয় গানটি। বাংলা গানের জগতে কবিতা থেকে গান তৈরির একটি নতুন পথদ্রষ্টা বলা চলে লোপামুদ্রা মিত্রকে। সেই সময় একাধারে অনেকগুলো জনপ্রিয় কবিতা থেকে গান করেছিলেন তিনি।

তবে এসবের পেছনে মূখ্য ভূমিকা পালন করেছেন গীতিকার ও সুরকার সমীর চট্টোপাধ্যায়ের। তার হাত ধরেই মূলত আধুনিক কবিতায় সুর করার শুরু। সমীর-লোপামুদ্রা জুটি অনেকগুলো কবিতা থেকে গান তৈরি করেছিলেন। যেমন- সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘সাঁকোটা দুলছে’, জীবনানন্দ দাশের ‘আবার আসিব ফিরে’, শঙ্খ ঘোষের ‘যমুনাবতী’, ‘মনে হয় অনেক দিনেই’, জয় গোস্বামীর ‘আমরা তো অল্পে খুশি’সহ আরো অনেক গান।

লোপামুদ্রা মিত্র; Image Source: youtube.com

তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা

দ্বিতীয় যে গানটির উল্লেখ করা হবে সেটি হলো কবির সুমনের গাওয়া ‘তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা’। একে সরাসরি কবিতা থেকে গান বলা যায় না। এটি কবি শহীদ কাদরীর ‘তোমাকে অভিবাদন, প্রিয়তমা’ কবিতা থেকে অনেকটাই অনুপ্রাণিত বলা চলে।

শহীদ কাদরি; Image Source: thefinancialexpress.com.bd

কবির সুমনের শব্দচয়ন শহীদ কাদরীর মূল কবিতা থেকে অনেকটাই আলাদা, কিন্তু ভাবাবেগ অনেকটাই অভিন্ন। ১৯৯৪ সালে ‘গানওয়ালা’ অ্যালবামে ‘অভিবাদন’ নামে গানটি প্রকাশ পায়। কবিতাটির প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল

ভয় নেই
আমি এমন ব্যবস্থা করবো যাতে সেনাবাহিনী
গোলাপের গুচ্ছ কাঁধে নিয়ে
মার্চপাস্ট করে চলে যাবে
এবং স্যালুট করবে
কেবল তোমাকে প্রিয়তমা।

ভালো আছি ভালো থেকো

এবার আরেকটি জনপ্রিয় গানের কথা উল্লেখ করা হবে যেটি মূলত ছিল রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহর লেখা ও সুর করা ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো’ গানটি। অনেকের মতে, এটি মূলত কবিতা থেকেই সুর করা হয়। গানটি পরবর্তীকালে সালমান শাহ ও শাবনূর অভিনীত ‘তোমাকে চাই’ চলচ্চিত্রে ব্যবহার করা হয়। গানটিতে আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল নতুন করে সঙ্গীতায়োজন করেন। এছাড়াও বিভিন্ন শিল্পী বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে গানটি উপস্থাপন করেছেন। বাংলা গানের ইতিহাসে এটি কালজয়ী গান হিসেবে জনপ্রিয় হয়ে আছে।

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহ; Image Source: banglainsider.com

তারায় তারায়

জেমসের অসম্ভব জনপ্রিয় গানগুলোর মধ্যে একটি ‘আমি তারায় তারায় রটিয়ে দেব, তুমি আমার’। গানটি মূলত বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান নাগরিক কবি শামসুর রাহমানের ‘উত্তর’ কবিতার ছায়া অবলম্বনে রচিত।

কবি শামসুর রাহমান; Image Source: youtube.com

১৯৯৫ সালের দিকে কবির অনুমতি নিয়ে ব্যান্ড ফিলিংসের ‘নগরবাউল’ অ্যালবামে প্রকাশিত হয় গানটি। এই গান প্রচার হওয়ার পর থেকে আজ পর্যন্ত সমানভাবে জনপ্রিয় হয়ে আসছে। উত্তর কবিতার প্রথম কিছু লাইন ছিল এমন-

তুমি হে সুন্দরীতমা নীলিমার দিকে তাকিয়ে বলতেই পারো
‘এই আকাশ আমার’
কিন্তু নীল আকাশ কোনো উত্তর দেবে না।
সন্ধ্যেবেলা ক্যামেলিয়া হাতে নিয়ে বলতেই পারো,
‘ফুল তুই আমার’
তবু ফুল থাকবে নীরব নিজের সৌরভে আচ্ছন্ন হয়ে।

রানার ও অবাক পৃথিবী

বাংলা কবিতায় খুব অল্প সময় বেঁচে থেকেও বেশ সুদৃঢ় স্থান করে গেছেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য্য। সুকান্তের অসংখ্য জনপ্রিয় কবিতার মধ্যে রানার ও অবাক পৃথিবী বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বাংলা গানের শক্তিমান সুরকার সলিল চৌধুরীর অসাধারণ ও সুনিপুণ সুরের মূর্ছনায় কবিতা দুটি হয়ে উঠলো সকলের পছন্দের গান। দুটি গানই গেয়েছেন জনপ্রিয় শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সলিল-হেমন্তের অসাধারণ যুগলবন্দী গান দু’টিকে সম্পূর্ণ অন্যমাত্রায় পৌঁছে দিয়েছে।

সুকান্ত ভট্টাযার্য্য; Image Source: thedailynewnation.com

পালকির গান

কবিতায় ছন্দের কারুকাজ এবং উপযুক্ত শব্দ চয়নের জন্য ছন্দের জাদুকর বলা হয় কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তকে। তার কবিতার মধ্যে কিছুটা ছড়ার ছায়া লক্ষ্য করা যায়। সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘পালকির গান’ কবিতাটি পুরো গ্রামবাংলার অপার সৌন্দর্য এবং তখনকার দিনের পালকি বাহকদের নিয়ে বিভিন্ন উপমায় মোড়ানো এক সুদীর্ঘ কবিতা। এই ধরনের কবিতায় অসাধারণ প্রতিভার ছোঁয়া দিয়ে সলিল চৌধুরী আরো একবার অবাক করে দিয়েছেন বিশ্বকে। আর এই কাজে অসাধারণ কন্ঠের প্রয়োজন ছিল যা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দরাজ ও আবেগি কন্ঠে খুব ভালভাবে ফুটে উঠেছে।

সলিল চট্টোপাধ্যায়; Image Source: news18.com

কারার ঐ লৌহ কপাট, কান্ডারি হুশিয়ার এবং নতুনের গান

বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ভাঙার গান’ কাব্যগ্রন্থের প্রকাশিত একটি কবিতা ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ এবং ‘কান্ডারি হুঁশিয়ার!’ অসম্ভব জনপ্রিয় দুটি কবিতা। পরবর্তীকালে কাজী নজরুল ইসলাম দু’টি কবিতাতেই নিজেই সুরারোপ করেন। উভয় গানই পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙে স্বাধীনতা সংগ্রামে যেকোনো বাধা ভাঙার আহ্বানে তৈরি। আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও এই গানদ্বয়ের বিশেষ অবদান রয়েছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ব্যান্ড আর্টসেল নতুন করে নতুন আয়োজনে গান দু’টিকে অ্যালবামবন্দী করে। বাংলাদেশের রণসঙ্গীত ‘চল চল চল’০ ১৯২৯ সালে লেখা ‘সন্ধ্যা’ কাব্যগ্রন্থের অন্তর্গত একটি কবিতা, যার নাম ‘নতুনের গান’।

কাজী নজরুল ইসলাম; Image source: dhakatribune.com

এমনি করে সবাই যাবে

বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যান্ড ফিডব্যাকের অ্যালবাম ‘১৪০০ বঙ্গাব্দের’ একটি সুপরিচিত গান ‘এমনি করে সবাই যাবে’ বা ‘পালকি-২’। গানটির শুরুতে প্রথমেই আবৃত্তি করা হয় ভাস্বর বন্দোপাধ্যায়ের কন্ঠে রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহের কবিতা ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়’ কবিতাটি। কবিতাটির শেষ লাইন ‘এমনি করে সবাই যাবে’কে মূল ভিত্তি ধরে পুরো গানটি রচনা করা হয়।    

এখনো আলো আসে

রুদ্র মুহম্মদ শহীদুল্লাহের কবিতা ‘খুটিনাটি খুনশুটি-১৭’ এর প্রথম কিছু লাইন হলো

নিখিল দিয়েছিলো নরক-নগ্নতা,
আমার চোখে ছিল অমলিন দৃষ্টি।
হৃদয় ছুঁয়েছিলো মেঘের মগ্নতা,
তবুও ঝরলো না প্রার্থিত বৃষ্টি।

মেহেদী হাসান নীল বর্তমান সময়ের একজন উদীয়মান সঙ্গীতশিল্পী। তার প্রচেষ্টায় ‘খুটিনাটি খুনশুটি-১৭’ কবিতাটি এখন অসম্ভব জনপ্রিয় একটি গান। অসম্ভব সুন্দর সুর এবং গায়কীর কারণে খুব অল্প সময়ের মাঝেই গানটি সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। 

কে আর বাজাতে পারে

বর্তমান সময়ের উদীয়মান শিল্পী আহমেদ হাসান সানি ‘সানির মুক্তাঞ্চল’ নামের ব্যানারে কিছু গান ইউটিউবে প্রকাশ করেন। গানগুলোর মধ্যে ‘কে আর বাজাতে পারে’ গানটি তার এক অন্যতম প্রয়াস। গানটি মূলত লেখক, ঔপন্যাসিক এবং কবি আহমেদ ছফার কবিতা ‘কে আর বাজাতের পারে’র উপর সুরারোপিত। কবিতাটির কিছু লাইন

যে শহরে বোবার মত ঝুলছে নীরবতা
বুকের নদীর ঢেউে জাগে মাছের মত কথা
কারা যেন সামনে দাড়ায় সোহাগ ভুলায় তারা
ছায়ার মত চমকে মিলায় ছায়ার শরীরেরা
কে আর বাজাতে পারে পাখী তোমার মত
কে আর লুকাতে পারে পাখী তোমার ক্ষত

আহমেদ হাসান সানি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘আনন্দ ভৈরবী’ নামক একটি কবিতা নিয়েও কাজ করেছেন। 

আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলনে যখন বহু ছাত্র, সাধারণ জনগণ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে; তখন পুলিশ মিছিলের উপর গুলিবর্ষণ করে। গুলিতে নিহত হয় রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ অনেকেই। আবদুল গাফফার চৌধুরী তখন আহত ছাত্রদের দেখতে ঢাকা মেডিকেলে গিয়ে দেখেন গুলিতে নিহত লাশ। সেই লাশের মিছিল দেখে তার মনে হতে লাগল এই তো তার ভাইয়েরই রক্ত মাখা লাশ! তখন দু’টি চরণ আনমনেই ধরা দিলো তার কাছে- ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি; আমি কি ভুলিতে পারি?’ এরপর কয়েকদিনের চেষ্টায় পুরো কবিতাটি লেখা শেষ হয়। ভাষা আন্দোলনের প্রথম লিফলেটে কবিতাটি ‘একুশের গান’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়। 

আবদুল গাফফার চৌধুরি; Image Source: kalerkantho.com

যুবলীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক আবদুল লতিফ কবিতাটিতে প্রথম সুরারোপ করে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গাইতে থাকেন। পরবর্তীতে স্বনামধন্য সুরকার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা আলতাফ মাহমুদ কবিতাটিতে সুর দেন। এই সুরটিই প্রভাতফেরীর গান হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক সুর হিসেবে স্বীকৃত হয়।  

কবিতা নিয়ে বিভিন্ন শিল্পী, সুরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে কাজ করেছেন। এখনো অনেক শিল্পী কবিতা থেকে গান তৈরি করার দিকে বিশেষভাবে আগ্রহী। আমাদের এই অল্প পরিসরে সবগুলো নিয়ে আলোচনা করা প্রায় অসম্ভব। কিছু উল্লেখযোগ্য জনপ্রিয় কবিতা থেকে গান নিয়ে আমাদের এই আয়োজন। কবিতা থেকে আরো জনপ্রিয় শ্রুতিমধুর সব গান তৈরি হোক- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

This article is a Bengali article. This story is about a few songs which are composed of poems. 

 All the sources are hyperlinked into the article.

 Featured Image: dainikazadi.net

Related Articles