Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website. The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যাডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোটো: পার্ল হারবার আক্রমণের মূল পরিকল্পনাকারী || শেষ পর্ব

(পর্ব ৩ এর পর থেকে) 

মিডওয়ের যুদ্ধ

ইয়ামামোটো মিডওয়ে দ্বীপপুঞ্জে বড়সড় আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এই দ্বীপপুঞ্জকে বলা হতো ‘পার্ল হারবারের প্রহরী’। আমেরিকান নৌবাহিনীর জন্য এই অঞ্চল ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একে রক্ষার জন্য আমেরিকানরা অবশ্যই সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে। ইয়ামামোটো আশা করেছিলেন এই অঞ্চল রক্ষায় আসা আমেরিকানদের এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো জাপানের নৌবাহিনী ধ্বংস করে দেবে। জাপানের প্রায় পুরো নৌবহরই ছিল তার পরিকল্পনার অংশ।

জাপানের নৌবাহিনীর সাংকেতিক বার্তা বা নেভাল কোড ডি সফলভাবে পাঠোদ্ধার করায় আমেরিকার নৌবাহিনীর প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের কমান্ডার অ্যাডমিরাল চেস্টার নিমিটজ এই আক্রমণ সম্পর্কে আগেই জানতে পারেন। তিনি তার বাহিনীকে পাঠান জাপানিদের অ্যামবুশ আক্রমণ করতে। জাপানের হাই কমান্ড ইয়ামামোটোর পরিকল্পনাকে কিছুটা পরিবর্তন করে। তারা এর সাথে আরো দুটি মিশন যোগ করে। একটি ছিল পশ্চিমাদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার জন্য উত্তর প্রশান্তীয় অঞ্চলে আক্রমণ করা। অন্যটি ছিল নিউ গায়নার পোর্ট মোর্সবি অঞ্চল দখল করা, যা অস্ট্রেলিয়া দখলে ভূমিকা রাখবে। ইয়ামামোটোর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তখন তুলনামূলক কম সামরিক শক্তি অবশিষ্ট থাকে।

আমেরিকান নৌবাহিনীর অ্যাডমিরাল চেস্টার নিমিটজ; Image Source: US Naval History & Heritage Command

মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করার অংশ হিসাবে জাপানিরা অ্যালিউশিয়ান দ্বীপপুঞ্জে হানা দেয়। কিন্তু আমেরিকা তাদের ফন্দি আগেই জেনে যাওয়ায় সেদিকে আর সেনা পাঠায়নি। ফলে জাপানিরা সেখানে অযথাই তাদের সময় ও সামরিক বাহিনী অপচয় করতে থাকে। ইয়ামামোটো দশটা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের তিনটা বরাদ্দ রাখেন নিউ গায়ানা দখলের জন্য। এর আগে ১৯৪২ এর মে মাসে কোরাল সাগরের যুদ্ধে একটা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ডুবে যায় এবং দুটো ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হয়, যেগুলো মিডওয়ের যুদ্ধে ছিল না। ইয়ামামোটোর আক্রমণ বাহিনীকে কয়েকশ মাইল দূরত্বে চারটি ইউনিটে ভাগ করার সিদ্ধান্তও ভুল ছিল। তার পরিকল্পনা ছিল ইউনিটগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সাহায্যের সুযোগ রাখা। কিন্তু সে সময়ের প্রযুক্তি দিয়ে তা করা কঠিন ছিল। এদের মধ্যে সমন্বয় রাখাটাও কঠিন হয়ে পড়েছিল।

তিনি কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করেন। আমেরিকানদের শক্তিমত্তা সম্পর্কেও তার মূল্যায়ন ভুল ছিল। জাপানের নৌবাহিনী কোরাল সাগরের যুদ্ধে মাত্র একটি আমেরিকান এয়ারক্রাফট ধ্বংস করতে পারে। ইয়ামামোটোর বিশ্বাস ছিল তারা দুটি ক্যারিয়ার ধ্বংস করতে পারবেন। ইয়ামামোটো বাকি দুইটি এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারের অবস্থান নির্ণয় করতেও ভুল করেছিলেন। তিনি সেটা নির্ণয় করতে পারতেন যদি গোয়েন্দা কার্যক্রমকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পারতেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন আমেরিকান যুদ্ধজাহাজগুলো পার্ল হারবারে ছিল, যা আসলে ভুল ছিল।

মিডওয়ের যুদ্ধে জাপানি টর্পেডোর আক্রমণের শিকার ইউএসএস ইয়র্কটাউন; Image Source: National Archives and Records Administration

১৯৪২ সালের ৪ জুন মিডওয়ের যুদ্ধ (ব্যাটল অব মিডওয়ে) শুরু হয়। এটা ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ নৌবাহিনীর যুদ্ধগুলোর একটি। জাপানিদের চারটা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ডুবে যায়, যা তাদের ওপর মারাত্মক আঘাত হয়ে আসে। জাপান তাদের মোমেন্টাম হারিয়ে ফেলে। তাদের আক্রমণাত্বক মনোভাবটা চলে যায় আমেরিকার দিকে। মিডওয়ের যুদ্ধে পরাজয় সাম্রাজ্যবাদী জাপানের সম্প্রসারণ থামিয়ে দেয়।

জাপানের শিল্প খাত আমেরিকার উৎপাদন হারের সাথে তাল মেলাতে পারেনি। ফলে দ্রুতই যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজের সংখ্যার দিক দিয়ে জাপান আমেরিকার তুলনায় পিছিয়ে পড়ে। জাপানের জন্য এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার হারানোর চেয়েও বড় ক্ষতি ছিল পাইলটদের হারানো। খুব অল্প সময়ে হারানো পাইলটদের জায়গায় নতুন পাইলট প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের তৈরি করতে পারেনি জাপান।

অ্যাডমিরাল ইয়ামামোটোর সর্বশেষ ছবি; Image Source: World War II Database

মিডওয়ের যুদ্ধে জাপানিদের এতটাই ক্ষতি হয়েছিলে যে, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারীদের এটা নিয়ে কথা বলাই নিষিদ্ধ করা হয়। ১৯৫০ এর দশকের শুরুর দিকে গিয়ে জাপানের জনগণ জানতে পারে, তাদের সাম্রাজ্যের কত বড় পরাজয় হয়েছিল। মিডওয়ের পরাজয়ের পরও ইয়ামামোটোকে কমান্ডার হিসাবে বহাল রাখা হয় শুধুমাত্র বাহিনীর মনোবল ধরে রাখার জন্য। তাছাড়া ইয়ামামোটোকে পদচ্যুত করলে পরাজয়ের ব্যাপারটা ফাঁস হয়ে যেত। তবে এই পরাজয়ে ইয়ামামোটোর ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়। তিনি আর কোনো ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা পাননি।

ইয়ামামোটো তখন আমেরিকানদের মোকাবেলা করার জন্য রক্ষণাত্মক কৌশল গ্রহণ করেন। জাপানের তখন আমেরিকাকে মোকাবেলা করার উপযুক্ত উপায় ছিল রাতের বেলা আক্রমণ করা অথবা স্থলভূমি থেকে যুদ্ধবিমান নিয়ে আক্রমণ করা। মিডওয়ের রণক্ষেত্রে আমেরিকানদের জয় খুব গুরুত্বপূর্ণ হলেও তাতে যুদ্ধ শেষ হয়ে যায়নি। জাপানের নৌবহর বাজেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তখনো শখানেক যুদ্ধজাহাজ তাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। জাপান যুদ্ধের শেষ দিনগুলো পর্যন্ত হিংস্রভাবে যুদ্ধ করে যায়।

জাপান এরপর কয়েকটা কৌশলগত বিজয় পেলেও আমেরিকাকে যুদ্ধে পরাজিত করতে পারেনি। ইয়ামামোটো তখন যুদ্ধকে প্রলম্বিত করার কৌশল নেন। তার উদ্দেশ্য ছিল প্রতিপক্ষের ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি করে তাদের অর্থনীতির ওপর চাপ প্রয়োগ করা, যেন তারা অলাভজনক মনে করে যুদ্ধ সমাপ্ত করে (এট্রিশন স্ট্র্যাটেজি)। তার এই কৌশল আমেরিকান নৌবাহিনীর ক্ষতি করে, কিন্তু জাপানিদেরও অনেক মূল্য দিতে হয়। এতে জাপানের নৌবাহিনীর ক্ষমতা আরো হ্রাস পায়। এরপর জাপানিদের শুধু রক্ষণাত্মকভাবেই যুদ্ধ করে যেতে হয়েছে।

ইয়ামামোটোর মৃত্যু

১৯৪৩ সালের শুরুতে ইয়ামামোটো তার এক বন্ধুকে বলেছিলেন, তিনি হয়তো যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত আর জীবিত থাকবেন না। ১৯৪৩ এর ফেব্রুয়ারিতে গুয়াডাল ক্যানালের যুদ্ধে পরাজয়ের পর তিনি দক্ষিণ প্রশান্তীয় অঞ্চলের ঘাঁটিতে গিয়ে তার সৈন্যদের মনোবল চাঙ্গা করতে চাইলেন। ১৪ এপ্রিল আমেরিকার গোয়েন্দারা ইয়ামামোটোর এই সফর সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্য উদ্ধার করে। ১৮ এপ্রিল সকালে ইয়ামামোটো রাবাউল থেকে সলোমন দ্বীপপুঞ্জের বেলিলি বিমানঘাঁটিতে যাওয়ার কথা ছিল।

১৭ এপ্রিল অ্যাডমিরাল নিমিটজ ইয়ামামোটোর বিমান আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। এই মিশনের জন্য নিযুক্ত করা হয় পি-৩৮ (P-38) লাইটনিং স্কোয়াড্রন। এই যুদ্ধবিমানগুলোর পরিসর ছিল পর্যাপ্ত এবং তথ্য আদান-প্রদানের ক্ষমতাও ছিল ভালো। তিন ইউনিটের ১৮ জন পাইলটকে খুব সাবধানে বাছাই করা হয়। তাদের বলা হয় টার্গেট একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। কিন্তু ‘ইয়ামামোটো’ নামটি কখনো উল্লেখ করা হয়নি।

১৮ এপ্রিল সকালে অ্যামবুশ আক্রমণের হুমকি জেনেও দুটি পরিবহন বিমান ও একটি জিরো যুদ্ধবিমান রাবাউল থেকে উত্তরণ করে। কিছুক্ষণ পর গুয়াডাল ক্যানাল থেকে পি-৩৮ যুদ্ধবিমানগুলোও উত্তরণ করে। সকাল ৯ টা ৩৪ মিনিটে দুই বাহিনীর মধ্যে বিমানযুদ্ধ শুরু হয়। ইয়ামামোটোর বিমান আঘাতপ্রাপ্ত হয় এবং পাপুয়া নিউগিনির বুগেনভিল দ্বীপের জঙ্গলে বিধ্বস্ত হয়।

অ্যাডমিরাল ইয়ামামোটোকে বহন করা বিধ্বস্ত জিফোর বোম্বার; Image Source: World War II Database 

পরের দিন জাপানের উদ্ধারকারী দল বিধ্বস্ত অঞ্চল খুঁজে পায় এবং ইয়ামামোটোর মৃতদেহও উদ্ধার করে। মৃত অ্যাডমিরাল বিধ্বস্ত বিমানের বাইরে বসা অবস্থায় ছিলেন। তার হাত সাথে থাকা সামুরাই তরবারির হাতলে শক্ত করে ধরা অবস্থায় ছিল। 

মাসখানেক পর তার মৃত্যুসংবাদ জাপানি জনগণের কাছে উন্মোচন করা হয়। মিডওয়ের যুদ্ধ ও গুয়াডালক্যানালের যুদ্ধে পরাজয়ের পরও তাদের কাছে জাপানিদের বীরত্বের কথা প্রচার করা হতো। ইয়ামামোটোর মৃত্যু তাদেরকে মানসিকভাবে মারাত্মক আঘাত করে। জাপান সরকার মেনে নিতে বাধ্য হয়, আমেরিকানরা পার্ল হারবার আক্রমণের ধাক্কা কাটিয়ে উঠেছে এবং এখন প্রতিআক্রমণে অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে উঠেছে।

ইয়ামামোটোকে বিধ্বস্ত হওয়া স্থানেই সমাহিত করা হয়। তার ছাই-ভস্ম ‘মুসাশি’ ব্যাটলশিপের মাধ্যমে টোকিওতে পাঠানো হয়। ৫ জুন রাষ্ট্রীয়ভাবে তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। তাকে সম্মানসূচক মার্শাল অ্যাডমিরাল পদমর্যাদা দেওয়া হয়। এছাড়া অর্ডার অব দ্য ক্রিসেন্থিমাম ও নাৎসি জার্মানির পক্ষ থেকে নাইট’স ক্রস সম্মাননা দেওয়া হয়। তার ছাইয়ের কিছু অংশ নাগাওকার চুকোজি মন্দিরে পূর্বপুরুষদের পাশে সমাহিত করা হয়।

১৯৪৩ সালের ৫ জুন রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ইয়ামামোটোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে; Image Source: World War II Database

ইয়ামামোটো যে ৪০ বছর জাপানের নৌবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করেছেন, এই দশকগুলো ছিল জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ঘটনাবহুল সময়। তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকলেও সামরিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ কেউ ছিলেন না। তবে এটা তার অবদানগুলোকে ছোট করে দেয় না। ইসোরোকু ইয়ামামোটো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও আধুনিক যুদ্ধক্ষেত্রের শ্রেষ্ঠ নেতাদের একজন ছিলেন। বিশেষ করে যুদ্ধ পূর্ববর্তী সময়টাতে তার বিভিন্ন কার্যক্রম ও চিন্তাধারা নির্দেশ করে তিনি সে সময়ের তুলনায় দূরদর্শিতার দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে ছিলেন।

ইয়ামামোটো উপলব্ধি করেছিলেন ব্যাটলশিপের দিন ফুরিয়ে গেছে। নৌবাহিনীতে সবচেয়ে কার্যকর অস্ত্র হবে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার। ১৯২০ এর দশকে এটা নিয়েই কাজ শুরু করেন। তাকে নৌ বিমানচালনার অগ্রদূতদের একজন বিবেচনা করা হয়। বর্তমান সময়ে সকল পরাশক্তি এয়ারক্রাফট ব্যবহার করছে অথবা সামরিক বাহিনীতে রাখার চেষ্টা করছে। আমেরিকা তার জাতীয় নিরাপত্তার জন্য একে গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র বিবেচনা করে।

ইয়ামামোটো আমেরিকার সাথে তার দেশের যুদ্ধ দেখতে চাননি। তবে তিনি ছিলেন সামুরাই পরিবারের সন্তান। যখন যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়, তার সাম্রাজ্য রক্ষা করার ব্যাপারে তিনি ছিলেন বদ্ধপরিকর। প্রথম দিকে তার সুফলও পায় জাপান। কিন্তু আমেরিকা যখন সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামল, তখনই জাপান ও ইয়ামামোটোর ভাগ্য লেখা হয়ে যায়।  

Related Articles