Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

অ্যাডমিরাল ইসোরোকু ইয়ামামোটো: পার্ল হারবার আক্রমণের মূল পরিকল্পনাকারী || পর্ব ৩

(পর্ব ২ এর পর থেকে) 

পার্ল হারবার আক্রমণ ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ

১৯৩৭ সালে সাইনো-জাপানি যুদ্ধ শুরু হলে এর উত্তাপ লাগে পশ্চিমেও। চীন ও ইন্দোচীন অঞ্চলে জাপানের দখলদারির প্রতিবাদে ১৯৪১ সালের জুলাইয়ে আমেরিকা, ব্রিটেন ও নেদারল্যান্ড জাপানের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। মিত্রপক্ষের এই নিষেধাজ্ঞার মধ্যে ছিল জাপানে তেল ও ধাতব পদার্থের রপ্তানি নিষিদ্ধকরণ, জাপানি নৌযানগুলোর জন্য পানামা খাল বন্ধ করে দেওয়া ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত করা। কিন্তু এই নিষেধাজ্ঞাকে জাপানি সামরিক নেতারা দেখেন পশ্চিমাদের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদে সমৃদ্ধ ইউরোপীয় কলোনিগুলো দখল করার সুযোগ হিসাবে।

জাপানি নেতারা উপলব্ধি করেন তাদের সাম্রাজ্য বিস্তারে মূল বাধা আমেরিকার সাথে যুদ্ধ অনিবার্য। আসন্ন যুদ্ধে জাপানের কৌশলগত দিক দিয়ে এগিয়ে থাকার প্রথম পদক্ষেপ ছিল যেকোনো মূল্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তেলসমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো দখল করা। জাপানের নৌশক্তির ভার দুই বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়- নৌবাহিনীর জেনারেল স্টাফ ও সম্মিলিত সামরিক বহর। তারা দ্রুত তেল সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো দখলে নেওয়ার ব্যাপারে একমত ছিলেন, কিন্তু সম্ভাব্য সেরা উপায় নিয়ে তাদের মধ্যে মতবিরোধ ছিল।

সম্মিলিত সামরিক বহরের সহকর্মীদের সাথে ইয়ামামোটো; Image Source: Wikimedia Commons

জেনারেল স্টাফের প্রধান অ্যাডমিরাল নাগানো ওসামি চাচ্ছিলেন নৌবাহিনীর বেশিরভাগ অংশ সরাসরি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আক্রমণে ব্যবহার করতে। এর পক্ষে যুক্তি ছিল আমেরিকা যুদ্ধে অংশ নেওয়ার আগেই জাপান এই অঞ্চল দখল করে ফেলতে পারবে। এরপর যদি আমেরিকা আসেও, তাদেরকে সুশিমার যুদ্ধে রাশিয়ার মতো উড়িয়ে দেওয়া যাবে। ইয়ামামোটোর কাছে এই কৌশল খুবই রক্ষণাত্মক মনে হয়। তিনি আমেরিকার নৌশক্তি নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি আশঙ্কা করছিলেন, জাপানিরা পুনরায় সংঘবদ্ধ হওয়ার আগেই আমেরিকানরা পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আক্রমণ করে বসতে পারে। এই বিপর্যয় এড়ানোর জন্য তিনি চাচ্ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া আক্রমণের পাশাপাশি আমেরিকান নৌঘাঁটিতেও আক্রমণ করতে। আমেরিকানদের উপর আকস্মিক আক্রমণ করলে তাদের নৌ বহরকে ক্ষতিগ্রস্ত করা যাবে এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অঞ্চল দখল করা সহজ হবে।

শক্তিশালী আমেরিকার বিপক্ষে একমাত্র আশা ছিল নৌঘাঁটিতে অতর্কিত আক্রমণ করে তাদের চমকে দেওয়া। ইয়ামামোটো ১৯৪০ সালের শুরু থেকেই এই আক্রমণের পরিকল্পনা করতে থাকেন। যদিও তিনি জাপানের সম্ভাবনা নিয়ে খুব একটা আশাবাদী ছিলেন না। এ প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন,

যদি আপনি বলেন আমাদের জন্য লড়ে যাওয়া আবশ্যক, তাহলে বলব আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের সাথে যুদ্ধের শুরুর ৬ মাস বা এক বছর হয়তো অনেকগুলো অবাধ বিজয় এনে দিতে পারব। কিন্তু যুদ্ধ দুই বছর বা তিন বছর লম্বা হয়ে গেলে আমাদের চূড়ান্ত বিজয় নিয়ে আমি সন্দিহান।

প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আমেরকার নৌবহরের বেশিরভাগ যুদ্ধজাহাজই ছিল পার্ল হারবারে। ইয়ামামোটো পার্ল হারবার আক্রমণে প্রভাবিত হয়েছিলেন ১৯৪০ সালের ১১ নভেম্বর তারান্তোতে ব্রিটিশ ব্রিটিশ নৌবাহিনীর যুদ্ধবিমান কর্তৃক টর্পেডো বোম্বারের আক্রমণে ইতালির নৌবহর ধ্বংস হতে দেখে। তারান্তোর যুদ্ধে ব্রিটিশ নৌবাহিনীর ২০টি যুদ্ধবিমান থেকে আক্রমণ করা হলে বেশ কয়েকটি ইতালিয়ান ব্যাটলশিপ ডুবে যায়। এতে প্রমাণিত হয় বিমান থেকে টর্পেডো নিক্ষেপ করা হলে অগভীর পানিতেও জাহাজ ডুবানো সম্ভব। ১৯৪১ সালের গ্রীষ্মে জাপান প্রস্তুত করে মার্ক ৯৫ টর্পেডো, যা অগভীর জলপথের জাহাজ ডুবাতে সক্ষম ছিল। পার্ল হারবার আক্রমণের জন্য এ রকম অস্ত্রই প্রয়োজন ছিল।

বিশেষজ্ঞরা অনেকে মনে করেন ১৯২৫ সালে ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক হেক্টর সি বাইওয়াটারের লেখা ‘দ্য গ্রেট প্যাসিফিক ওয়ার’ বই থেকে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এই উপন্যাসে পার্ল হারবারে আমেরিকার নৌবাহিনীর উপর জাপানিদের অতর্কিত আক্রমণের কথা বলা হয়েছিল। 

‘নাগাতো’ যুদ্ধজাহাজে ইয়ামামোটো (মাঝে); Image Source: World War II Database

নৌবাহিনীর উপরের মহলের ব্যক্তিরা আমেরিকার নৌবাহিনীর ক্ষমতাকে গুরুত্ব সহকারেই দেখছিলেন। কিন্তু তারা ইয়ামামোটোর প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। যদি আমেরিকাকে চমকে না দেওয়া যায়, তাহলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলে জাপানের আধিপত্য বিস্তারের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। ইয়ামামোটো আমেরিকার সাথে যুদ্ধে যেতে না চাইলেও তার পরিকল্পনায় অটল থাকেন। যখনই আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হলো, ইয়ামামোটো তার সেরাটা দিয়ে দেন যুদ্ধের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের জন্য।

তিনি এই যুদ্ধ প্রসঙ্গে ১৯৪০ সালে একবার বলেন,

আমেরিকার সাথে যুদ্ধ করতে যাওয়া মানে পুরো বিশ্বের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করতে যাওয়া। কিন্তু যেহেতু এখন যুদ্ধ হতেই যাচ্ছে, আমি আমার সেরাটা দিয়ে দেব। কোনো সন্দেহ নেই আমি ‘নাগাতো’র বোর্ডে মরে পরড়ে থাকব।

এর এক বছর পর এক স্কুল বন্ধুর সাথে দেখা হলে বলেন,

আমেরিকানদের শুধু আরামপ্রিয় আর দুর্বল জাতি হিসেবে বিবেচনা করা ভুল হবে। আমি তোমাকে বলতে পারি তারা সাহসী, রোমাঞ্চপ্রিয় ও লড়াকু। তারা বিজ্ঞানমনস্ক ও উন্নত। একটা বিষয় মনে রাখা দরকার, তাদের ইন্ডাস্ট্রি অনেক উন্নত। তাদের প্রচুর তেল আছে, যা আমাদের নেই। জাপান আমেরিকাকে পরাজিত করতে পারবে না। তাই আমাদের উচিত হবে না তাদের সাথে যুদ্ধে যাওয়া।  

যখন তার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হচ্ছিল না, তিনি হুমকি দেন সম্মিলিত বহরের প্রধান থেকে পদত্যাগ করবেন। তার আল্টিমেটাম কাজে দেয়। ১৯৪১ সালের ৩ নভেম্বর তার পরিকল্পনা গৃহীত হয়।

২২ নভেম্বর জাপানি টাস্ক ফোর্স কুরিল দ্বীপপুঞ্জের কাছে টানকান উপসাগরে অবস্থান করে। ২৬ তারিখে তারা যাত্রা শুরু করে একটা অপেক্ষা করার স্থানে। সেখানে থেমে পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। ১ ডিসেম্বর তারা আক্রমণের নির্দেশ পায়। টাস্ক ফোর্স পার্ল হারবারের উদ্দেশ্যে গোপন পথে যাত্রা শুরু করে। ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর ভোর হওয়ার আগে ছয়টা এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার এসে পার্ল হারবারের ২০০ মাইল উত্তরে অবস্থান করে।

সকাল ছয়টায় বিমান আক্রমণের প্রথম দলটা উড়ে যায়। ৭ টা ৪৯ মিনিটে সাংকেতিক বার্তা চলে আসে- তোরা! তোরা! তোরা! (Tora! Tora! Tora!), যা নির্দেশ করছিল আক্রমণ শুরু করার জন্য। এটা ছিল দারুণ কৌশলগত সাফল্য। এতে দুইটি ব্যাটলশিপ ডুবিয়ে দেওয়া হয়, পাঁচটি মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এবং অনেকগুলো ছোট ছোট যুদ্ধজাহাজ আক্রমণের শিকার হয়ে ডুবে যায়। শখানেক যুদ্ধবিমান ধ্বংস হয় এবং ২৪০২ জন আমেরিকান সৈন্য ও নাবিক নিহত হয়। আমেরিকার কোনো এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়নি। কারণ সে মুহূর্তে সেগুলো পার্ল হারবারে ছিল না। জাপানের ২৯টি যুদ্ধবিমান ও কয়েকটি সাবমেরিন ধ্বংস হয়।

পার্ল হারবার আক্রমণে বিধ্বস্ত আমেরিকার যুদ্ধজাহাজ; Image Source: Universal History Archive/Getty Images

জাপানের আকস্মিক আক্রমণ আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবাহিনীকে অক্ষম করে দেয়। আমেরিকার জলপথের আধিপত্যও দুর্বল হয়ে যায়। জাপান মধ্য ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল দখল করে নেয়। তবে জাপানের এ বিজয় ছিল ক্ষণস্থায়ী। এই আক্রমণে আমেরিকার প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহর পুরোপুরি ধ্বংস হয়নি। বরং আমেরিকার তখন জাপানের সাথে যুদ্ধ করার জন্য পুরোদমে প্রস্তুতি নিতে থাকে। ইয়ামামোটোর পূর্বানুমান তখন পুরোপুরি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ইউরোপীয় যুদ্ধে আমেরিকার অংশগ্রহণ নিয়ে তাদের জনগণের মিশ্র প্রতিক্রিয়া ছিল। কিন্তু জাপানের এই আক্রমণের ফলে তারা একাট্টা হয়ে যায় সমুচিত প্রতিশোধের জন্য।

পার্ল হারবার আক্রমণের পর জাপানের টাস্ক ফোর্স পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চল থেকে ভারত মহাসাগর পর্যন্ত দক্ষিণ দিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এই আক্রমণ গুয়াম, হংকং, সায়াম, ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া, বার্মা দখল করতে ভূমিকা রাখে। জাপান এইচএমস প্রিন্স অব ওয়েলস ও এইচএমএস রিপালস নামের দুটি ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজও ধ্বংস করে। এতে তারা সিঙ্গাপুর দখল করতে সক্ষম হয়। পাঁচ মাসের মধ্যে জাপান দক্ষিণাঞ্চলের প্রাকৃতিক সম্পদ সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলো দখল করে ফেলে, যা আমেরিকা ও ব্রিটেন উভয়ের জন্যই বড় ধাক্কা হয়ে আসে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানের নৌবাহিনী; Image Source: Getty Images

জাপানের সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ইতোমধ্যে আরো আক্রমণাত্মক হওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে চাচ্ছিলেন, যার মধ্যে ভারত ও অস্ট্রেলিয়া দখলের পরিকল্পনাও ছিল। ইয়ামামোটো তখন মনে করিয়ে দেন এসব পরিকল্পনার মূল বাধা আমেরিকার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো।

আমেরিকার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে জাপানি আগ্রাসন প্রতিহত করার মিশনে ছিল। আমেরিকা জাপানের বিপক্ষে প্রথম বড় সাফল্য পায় ১৯৪২ সালের ১৮ এপ্রিল লেফটেন্যান্ট কর্নেল জেমস ডুলিটলের নেতৃত্বে ইউএসএস হর্নেট ক্যারিয়ার থেকে ১৬টি বি-২৫ বোম্বার উড্ডয়ন করে টোকিওর সামরিক ও শিল্পাঞ্চলগুলোতে এবং আরো কয়েকটা জাপানি শহরে আক্রমণ করে। এই আক্রমণে জাপানের ক্ষয়ক্ষতি খুব বেশি না হলেও এতে এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ার ও ব্যাটলশিপ নিয়ে বিতর্কের অবসান ঘটে। তখন জাপানের সামরিক বাহিনীর সবাই একমত হন আমেরিকার এয়ারক্রাফট ক্যারিয়ারগুলো ধ্বংস করার ব্যাপারে। ইয়ামামোটো তখন এটা নিয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন।

(এরপর দেখুন ৪র্থ ও শেষ পর্বে)

Related Articles